somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

জয়াবর্ধনে, তোমার জন্য ভালবাসা।।

১৭ ই আগস্ট, ২০১৪ দুপুর ২:২৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

১৯৯৯ সালের শুরুর দিকের কথা, ক্রিকেট খেলাটার পোকা বললে তখন আমাকে ভুল বলা হবে না। কি ওয়ান ডে, কি টেস্ট, সব খেলা লাইভ দেখা চাই। টিভি আব্বু আম্মুর রুমে, কিন্তু দিনের বেলায় আমার দখলে। মাস খানেক পর এস,এস,সি পরীক্ষা, কিন্তু কিসের পড়াশুনা! ক্রিকেট আগে, তারপর খাওয়া, পড়া, ঘুম, বাকি সব। আব্বু, আম্মু দুইজনই বিরক্ত, আব্বু তো বেশ হতাশ, আমার ভবিষ্যত চিন্তা করলেই তিনি খালি অন্ধকার দেখতে পান... কিন্তু এস,এস,সি পরীক্ষার্থী ছেলেকে তো আর প্রতিদিন মাইর দেয়া যায় না, তাই ধমক ধামক ছাড়া কিছু করার নাই। এইসব ধমক গায়ে মাখে কে!

সেই সময় প্রথমবারের মত শুরু হল এশিয়ান টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপ। বাংলাদেশ তখনো টেস্ট স্ট্যাটাস পায়নাই, বিশ্বকাপের জন্য কোয়ালিফাই করেছে। টিম হল তিনটা, পাকিস্তান, ভারত আর শ্রীলংকা। টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপ অনেক সময়সাপেক্ষ ব্যাপার, তাই সময় বাঁচাবার জন্য পাকিস্তানের ইন্ডিয়া ট্যুরের ৩য় টেস্ট ম্যাচটাকে (কলকাতায়) টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের অন্তর্ভুক্ত করে ফেলা হল। সেই টেস্টে পাকিস্তান জয়ী হয়, শোয়েব আক্তার শচীন টেন্ডুলকারকে প্রথম ইনিংসে এক অসাধারণ ইনসুইঙ্গারে বোল্ড করে, যেটা পরবর্তীতে ক্রিকেট ইতিহাসের দ্বিতীয় সেরা বল (শেন ওয়ার্ণের পরে) হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয়।

আমার স্ট্যাটাসের বিষয়বস্তু সেই টেস্ট নয়, তার পরের টেস্ট। ওয়ানডে বিশ্বকাপ ১৯৯৬ জেতার পরেও শ্রীলংকা তখনো টেস্টে নিচুসারির দল। কলম্বোতে ইন্ডিয়া- শ্রীলংকা ম্যাচ, ইন্ডিয়া প্রথম ইনিংসে বিশাল স্কোর করে ফেললো। শ্রীলংকা প্রথম ইনিংসে ব্যাট করতে নামলো, এবং শুরুতেই দলের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য ব্যাটসম্যান আতাপাত্তু বেকুবের মত আউট হয়ে গেল। এর পর আস্তে আস্তে হেঁটে মাঠে নামলো এক নতুন ব্যাটসম্যান। একেবারে নতুন না, এর আগেও বেশ কিছু টেস্ট খেলেছে সে, সেঞ্চুরিও করেছে, কিন্তু যে কোন কারণেই হোক, খেলাগুলো আমার দেখা হয়নি। পেপার পড়ে নামটা জেনেছি, অদ্ভুত ধরণের, 'মাহেলা জয়াবর্ধণে'। এটা যে কোন ছেলের নাম হতে পারে জানা ছিল না। আমার নানুর বাড়ির পাশে এক বাড়িতে মাহেলা নামের একটা মেয়ে থাকতো, তার কিছুটা মাথা খারাপ ধরণের ছিল, ছোটবেলায় সেই কারণেই হয়তো মাথায় ঢুকে গিয়েছিল যে 'মাহেলা' নামধারী মানুষেরা পাগল হয়। এটা যে একজন পুরুষ মানুষের এবং একজন সুস্থ মানুষের নাম হতে পারে, তা সেই খেলোয়ারকে দেখে জেনেছিলাম।

যেটা বলছিলাম, ডি সিলভা, রানাতুঙ্গার তখন শেষ সময়, ফর্ম তত ভাল না, জয়াসুরিয়া টিমে ,নাই, আতাপাত্তু আউট হয়ে যাওয়াতে মন খারাপ হয়ে গেল। (আমি আবার অলওয়েজ এন্টি ইন্ডিয়া, শুধু অস্ট্রেলিয়ার সাথে খেলা হলে আমি ইন্ডিয়ার পক্ষে থাকি)। টিভি বন্ধ করে পড়তে বসবো কি না চিন্তা করছি, তখনি বাচ্চা ছেলেটা অসাধারণ এক কাভার ড্রাইভ মেরে বসলো। কি সেই টাইমিং! কি সেই ফুটওয়ার্ক! বলে যেন ব্যাটের আলতো ছোঁয়া লাগলো, তাতেই বলটা মাটি কামড়ে তীব্র গতিতে চলে গেল সীমানার বাইরে। এরপর আমি মন্ত্রমুগ্ধের মত একটা জাদুকরি ইনিংস দেখলাম। কখনো কাভার ড্রাইভ, কখনো স্ট্রইট ড্রাইভ, কখনো লেগ গ্লান্স, কখনো সুইপ, প্রতিতা শট যেন বিশ্বসেরা শিল্পির তুলির নিপুণ আঁচরে আঁকা একেকটা মাস্টারপিস... দেখে হারিয়ে যেতে হয়...

এরপরের কাহিনীতে অনেক উত্থান পতন রয়েছে, এক দিনের ক্রিকেটে দুই তিনটা বছর তার খুব বাজে কেটেছে, টেস্টেও মাঝে অনেকদিন বড় স্কোর ছিলনা। পরিসংখ্যান বলবে, তার সময়ে তার চেয়ে ভাল ক্রিকেটার আরো আছেন, তার রানের গড় এমন আহামরি কিছু না, টেস্টে তা ৫০, কিন্তু এক দিনের ক্রিকেটে ৩৩ মাত্র। কিন্তু ক্রিকেট খেলাটাকে যে পরিসংখ্যান দিয়ে বিচার করে, সে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় বোকা। মাহেলা জয়াবর্ধনে তাই নিশ্চিতভাবেই সর্বকালের অন্যতম সেরা ক্রিকেটার, শ্রীলংকার সেরা দুজনের একজন, অন্যজন তার বন্ধু সাঙ্গাকারা। পরিসংখ্যান যদিও বলবে সাঙ্গাকারা বেশ এগিয়ে, রান, গড়, সব দিক দিয়েই, কিন্তু জয়াবর্ধনের খেলা দেখায় চোখের যে সুখ, তার সাথে কি অন্যকিছুর তুলনা চলে!! শুধু গাদা গাদা রান যদি বুকে ভালবাসার জন্ম দিত, তাহলে রোবট হেইডেন আর বেয়াদপ কোহলিকে মানুষ গালি দিতনা। ক্রিকেট খেলাটা শুধু রান করা আর উইকেট পাওয়া থেকে অনেক উঁচুস্তরের ব্যাপার, এখানে এটিচ্যুড, ডমিনেন্স, কার্টেসি, আর্ট, এই শব্দগুলোর কদর অনেক বেশি, আর এই সব কিছুর বিবেচনায় জয়াবর্ধণে নিশ্চিতভাবেই বিশ্বসেরাদের একজন।

জয়াবর্ধণের বিদায়ী টেস্ট চলছে, কলম্বোয়, নিজ দেশের মাটিতে, এর পর আর তাকে সাদা পোশাকে দেখা যাবেনা, দেখা যাবেনা ব্যাট নামের তুলিটা হাতে নিয়ে মাঠের চারপাশে নিপুণ আঁচড় দিতে... আমার সবচেয়ে প্রিয় খেলোয়ারগুলোর আরেকজন চলে যাচ্ছে খেলা ছেড়ে... এই টি টুয়েন্টির উলঙ্গ নাচানাচি, আর বল ব্যাটের মারামারির যুগে শিল্পিগুলো এভাবেই হারিয়ে যাচ্ছে, হারিয়ে যাচ্ছে শিল্পটাও... রাতের ঘুম কেড়ে নেয়া, অশ্রুঝরানো ক্রিকেট হয়ে যাচ্ছে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান... আর আমার মত কিছু বোকা মানুষ, যারা গায়ের জোরে মারা ১২০ মিটারের ছক্কার বদলে মাটি কাঁমড়ে ছুঁটে যাওয়া একটি কাভার ড্রাইভ দেখার অপেক্ষায় বুভুক্ষের মত টিভি সেটের সামনে এখনো কখনো সখনো বসে থাকে, তাদের হাহাকার বাড়ছে ক্রমাগত, দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে দীর্ঘঃশ্বাস...

জয়াবর্ধণে, তোমার জন্য ভালোবাসা।।
৪টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

খুলনায় বসবাসরত কোন ব্লগার আছেন?

লিখেছেন ইফতেখার ভূইয়া, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৪:৩২

খুলনা প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় তথা কুয়েট-এ অধ্যয়নরত কিংবা ঐ এলাকায় বসবাসরত কোন ব্লগার কি সামুতে আছেন? একটি দরিদ্র পরিবারকে সহযোগীতার জন্য মূলত কিছু তথ্য প্রয়োজন।

পরিবারটির কর্তা ব্যক্তি পেশায় একজন ভ্যান চালক... ...বাকিটুকু পড়ুন

একমাত্র আল্লাহর ইবাদত হবে আল্লাহ, রাসূল (সা.) ও আমিরের ইতায়াতে ওলামা তরিকায়

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৬:১০



সূরাঃ ১ ফাতিহা, ৪ নং আয়াতের অনুবাদ-
৪। আমরা আপনার ইবাদত করি এবং আপনার কাছে সাহায্য চাই।

সূরাঃ ৪ নিসার ৫৯ নং আয়াতের অনুবাদ-
৫৯। হে মুমিনগণ! যদি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। মুক্তিযোদ্ধা

লিখেছেন শাহ আজিজ, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:২১



মুক্তিযুদ্ধের সঠিক তালিকা প্রণয়ন ও ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা প্রসঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেছেন, ‘দেশের প্রতিটি উপজেলা পর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধা যাচাই বাছাই কমিটি রয়েছে। তারা স্থানীয়ভাবে যাচাই... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতীয় রাজাকাররা বাংলাদেশর উৎসব গুলোকে সনাতানাইজেশনের চেষ্টা করছে কেন?

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:৪৯



সম্প্রতি প্রতিবছর ঈদ, ১লা বৈশাখ, স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস, শহীদ দিবস এলে জঙ্গি রাজাকাররা হাউকাউ করে কেন? শিরোনামে মোহাম্মদ গোফরানের একটি লেখা চোখে পড়েছে, যে পোস্টে তিনি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঘুষের ধর্ম নাই

লিখেছেন প্রামানিক, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:৫৫


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

মুসলমানে শুকর খায় না
হিন্দু খায় না গাই
সবাই মিলেই সুদ, ঘুষ খায়
সেথায় বিভেদ নাই।

হিন্দু বলে জয় শ্র্রীরাম
মুসলিম আল্লাহ রসুল
হারাম খেয়েই ধর্ম করে
অন্যের ধরে ভুল।

পানি বললে জাত থাকে না
ঘুষ... ...বাকিটুকু পড়ুন

×