প্রিয় অভিজিত রায়
কবে দেশে এলেন জানতেই পারলাম না। কি হতে কি হয়ে গেল।
কি দরকার ছিলো আপনার এত কিছুর? কার জন্য করলেন এতকিছু?
বুয়েটের অতি সম্মানজনক শিক্ষকতা ছেড়ে আরো বড় পরিসরে প্রবাসে। শান্তিতেইতো ছিলেন আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের জর্জিয়ার বিলাসবহুল নগরী আটলান্টায় সম্মানজনক ইঞ্জিনিয়ারিং চাকুরি, সবার অতি আকাংখিত আমেরিকার সিটিজেনশিপ। আরামে আয়েসে কাটিয়ে দিতে পারতেন বাকি জীবন .. উচ্চ বেতন, ব্যাঙ্ক ব্যালেন্স, দামী লেক্সাস গাড়ী, ক্রেডিট কার্ড, , স্টাইলিশ ফাস্ট লাইফ... সপ্তাহে মাত্র ৪০ ঘন্টা কাজ। উইকেন্ডে বার, বীচ; মাসে মাসে লাসভেগাস, মিয়ামি কিম্বা হনুলুলু প্রমোদে। নিউ ইয়র্ক, ওয়াশিংটন, লস এঞ্জেলস। বিদেশ ট্যুরেও .. একজন মার্কিন নাগরিকের জন্য গোটা বিশ্বইতো উন্মুক্ত।
কিন্তু না; ফাস্ট লাইফ, ডাইনামিক ক্যারিয়ার, শাইনিং ফিউচার... বাদ দিয়ে আপনি দায়িত্ব নিয়েছিলেন সেই নিজ জন্মভুমির।– মুক্তচিন্তা বিজ্ঞানচর্চায় অনিচ্ছুক, অন্ধকারপ্রিয় একটি জাতির জন্য।
মৌলবাদি তান্ডবে মুক্ত চিন্তায় অনুন্নত পৃথিবীর একটি ঘনবসতি অঞ্চলের মানুষকে আধুনিক করার; আলো হাতে আধারের যাত্রীদের পথ দেখানোর, পেশাজীবনের শতব্যস্ততার মাঝেও তন্নতন্ন করে খুঁজে খুঁজে সমৃদ্ধ করেছেন 'মুক্তমনা' নামক আধুনিক ভাণ্ডার; একাই মশাল হাতে এসেছিলেন ঝলমলে ঝলমলে মুক্ত চিন্তার আলো নিয়ে।
আপনি আমাদের মত স্বার্থপর হন নি। আমরা কোটি প্রবাসী বিদেশে আসি ব্যক্তিগত ভাগ্যান্বেষণে; কিন্তু আপনি এসেছিলেন আমাদের জন্য আলো সংগ্রহে, এখানকার জ্ঞানের ঢেউকে আপনার স্বদেশে পৌঁছে দিতে; অন্ধকার ভাইরাসের বিপরীতে মুক্তচিন্তার মণিমুক্তা খুজে আনতে।
দামি অফিসের জটিল কাজের মধ্যেও আপনি ডুবে থাকতেন আপনার ভাবনার কাজে; অফিসের কাজ সেরে বাসায় চলে যেতেন দ্রুত; শতপাতা প্রিন্ট করে অনুবাদ করতেন; দীর্ঘ উইকেন্ডে পরিবারকে সময় না দিয়ে সবছেড়েছুঁড়ে বইয়ের পর বইয়ের পাতা উল্টাতেন; পিডিএফ খুজে পড়তে পড়তে আপনার চোখ ঝাপসা হয়ে যেত। একাই আপনি একসমুদ্র কাজ নিয়ে ডুবে থাকতেন। নিজের জন্য না, তের হাজার মাইল দূরে প্রিয় জন্মভুমি বাংলাদেশ নামক একটি ভূখণ্ডের মানুষদের জন্য।
আপনি মৌলিক কাজকে গুরুত্ব দিতেন। বাংলাভাষায় বিজ্ঞানভিত্তিক সম্পূর্ণ নতুন কিছু বিষয়কে পরিচিত করার স্বপ্ন দেখতেন। বাংলাভাষায় ক্ষুদ্র পাঠকশ্রেনির জন্য বৃহৎচিন্তাকে অনুবাদ করতেন, মহাবিশ্বের উদ্ভব, প্ররিক্রমা; চিন্তা- বিশ্বাস- অবিশ্বাস এসবের বিবর্তন, এসবের বিপুল জ্ঞ্যান ভান্ডার, কোন কটুক্তির আশ্রয় না নিয়ে মানুষের বিশ্বাসের সাথে বিজ্ঞানের সম্পর্ক; ধর্ম-বিশ্বাস এসবের বৈজ্ঞানিক, অত্যাধুনিক বিজ্ঞানভিত্তিক সহজ ব্যাখ্যা ... এসব বড় বিষয়ে সবেমাত্র কাজ শুরু করেছেন সহজ করে সহজ বাংলায় লিখতেন। এই অঞ্চলের মুক্তচিন্তার বিকাশ, সাম্প্রদায়িকতার উদ্ভব-স্বরূপ, বাংলা ভুখন্ডে বিজ্ঞান-দর্শনের ইতিহাস প্রকৃতি এসবেরও আপনিই ছিলেন অন্যতম বিশ্বকোষ।
আমরা একজন অভিজিত রায়কে হারাইনি; আমরা হারিয়েছি এক বিস্তীর্ণ তৃণভূমির মাঝে দাঁড়িয়ে থাকা এক মহীরুহকে; অন্ধ বর্বরদের দেশে এক অতিমানবকে; অন্ধকারে নিমজ্জিত একপাল মানুষের মধ্যে মশাল হাতে এক নির্ভিক অগ্রপথিককে।
প্রিয় অভিজিত রায়,
আপনি থাকবেননা জানি, কিন্তু আপনার জ্ঞ্যান-বিজ্ঞানের মশাল আমরা বহন করবো, আপনার কষ্টার্জিত অর্জন ত্থেকে যাবে মহাকালের পঞ্জিতে।