অচেনা একটা দেশে চেনা একটা শহর ছিল আমার । খুব প্রিয় শহর । সেই শহরের রাস্তায় একা একা হেঁটেছি আমি , ক্লান্ত হয়নি । শহরটা যেন অনেকটাই আমার মত। ভীষণ চুপচাপ; নিরিমিশে ।
সামারের দিনগুলোতে হেঁটে হেঁটে যখন ক্যাম্পাস যেতাম , উত্তর গোলার্ধের এই শহরটা আমার বন্ধু হয়ে উঠেছিল । খুব হাঁপিয়ে গেলে পথে একটা রেললাইন পড়ত , সেখানে বসতাম ।
শীতের সময় অনেকে খুব অবসন্ন হয়ে পড়ত । আমার বেশ লাগত । সত্যি বলতে কি তুষারপাত এর মত এত সুন্দর কিছু আমার জীবনে আর একটিও নেই । কি ভয়ঙ্কর শুভ্র । আকাশ থেকে নেমে আসা নরম তুলো।
তবে শীতের শেষ দিকটায় মনে হয়েছে এই বরফের নগরীর সব বরফ গলে কবে ঘাসের মুখ উঁকি দিবে । প্রথম যখন ঘাসের দেখা মিলত সবার সে কি আনন্দ , শর্টস পরে বেরিয়ে পড়ত সবাই ।
আমি ঘরে বসে দেখতাম , আমার জানালার ফাক গলে দেখতাম হেঁটে যাওয়া , দৌড়ে যাওয়া মানুষদেরকে ।মানুষ দেখা বরাবরি প্রিয় শখ আমার , স্কুলের রচনায় ও তাই লিখেছিলাম ।
মানুষ দেখতে দেখতে কখনও কখনও নিজেই বেরিয়ে পড়তাম । তখন দৌড়ে যাওয়া মানুষদের মত আমিও অপেক্ষা করতাম গাছ গুলো আবার কবে সবুজ হয়ে উঠবে ।
পাতাহীন একটি ন্যাড়া গাছ আমার সামনে ধীরে ধীরে উর্বশী হয়ে উঠত । সবুজ একটা শাড়িতে মুড়ে ফেলত নিজেকে । ভীষণ আফসোস হত তখন । গাছ হয়ে জন্ম না নেবার কারনে । ঋতু পরিবর্তনের এত বড় খামখেয়ালী এ শহর ছাড়া আর কোথায় আছে আমার জানা নেই । এখানে গাছের যৌবন যায়, আবার যৌবন আসে ।
মানুষের ক্ষেত্রে সে সুযোগ নেই ।
আমাকে যদি একটা সুযোগ দেওয়া হত কখনও , আমি অন্যদের মত শৈশবে ফিরতে চাইতাম না । শৈশবের তেমন কিছু মনে নেই আমার । খুব হাবা –গোবা ছিলাম । জীবনটা তেমন বুঝতাম না ।জীবনটা তখন ছিল শুধুর কোচিং এর ব্যাগ টানা আর ছেলে সঙ্গ এড়িয়ে চলা । এখন যে জীবন খুব বুঝি তা নয় , তবে আমার মত করে বুঝি ।
তাই একটা স্থির যৌবনের ভীষণ আকাঙ্ক্ষা হয় । একটা স্থির যৌবন পেলে আমি অনেক হাঁটতাম , পৃথিবীর পথে পথে হাঁটতাম , মানুষ গুলো দেখতাম । ছেলেদের দেখলে আর কুঁকড়ে যেতাম না । সহজ সত্য শিকার করতাম।
এ শহর আমায় অনেক শিখিয়েছে । ঋণী রয়ে গেলাম তার কাছে । যাচ্ছি নতুন শহরে , নতুন স্কুলে । হয়ত কদিনেই প্রিয় হয়ে উঠবে নতুন সে শহর । তবে মিস করব আমার চেনা এ শহরকে, তার তুষারপাতকে ।
বিয়ের দু মাসের মাথায় আমি তার কাছে যাচ্ছি । গত এক মাস ধরে আমরা অনলাইন এ সংসার গুছিয়েছি , কেনাকাটা করেছি । বিমানের পাখা মেলতে দেরী না হলে আগামীকাল দুপুরেই পৌঁছে যাব আমার নতুন সংসারে ।
আমার একটা সংসার ; খুব আনন্দ হবার কথা হয়ত। আমার সঙ্গিনীর অবশ্য আনন্দের সীমা নেই। জানিয়েছে এসেই আমাকে রান্না চাপাতে হবে । বেশ বড় সড় একটা লিস্ট তার । সব নাকি করে খাওয়াতে হবে ।
বলেছি ভীষণ ক্লান্ত যে আমি , প্রথমদিন ছুটি দিলে হয়না । উত্তর, সে আমি জানি নে ।
কি একটা মিষ্টি আবদার তার । এরকম একটা আবদারের জন্য তো ভীষণ অপেক্ষা ছিল আমার ।
তবুও খুশীতে কেন জানি ফেটে পড়ছিনে ।
কাল চলে যাচ্ছি । আজকেই আমার শেষ হাঁটা এ শহরের পথে । খুব ক্লান্ত আমি । থাকুক ক্লান্তি , আজ আমি অনেক হাঁটবো ।
বিরাট এই অচেনা দেশে খুব অল্প কিছু চেনা পথ আমার । সেই চেনা পথের সাথে বিদায় বেলাটা কাটাবো ।