somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

পুরোনো লেখা, ফিরে দেখা: ক্ষমা করবেন ড. শাহদীন মালিক

২৮ শে জুলাই, ২০১৪ রাত ১০:৫৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

ড. শাহদীন মালিককে নানা কারণে শ্রদ্ধা করি। আমার প্রিয় মানুষদের মধ্যে তিনি একজন। নানা ভাবে বিভিন্ন নমস্য ব্যক্তিদের কাছে তা প্রকাশও করেছি।

আমার পুত্র সানজীব যখন হঠাৎ করেই স্থির করল আইন বিষয়ে অধ্যয়ন করবে, তখন তাকে সঙ্গে নিয়ে সেগুনবাগিচায় ড. মালিকের চেম্বারে গিয়েছিলাম। তিনি ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগ খুলেছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে পোষ্য কোটায় বিজ্ঞান, প্রাণবিজ্ঞান ইত্যাদি বিষয়ে সানজীবের ভর্তির সুযোগ ছিল। সে অনুযায়ী ‘ও’ এবং ‘এ’ লেভেল করেছিল সানবীমস ও মাস্টারমাইন্ড স্কুল থেকে।

কিন্তু আইন বিষয়ে পড়বার তার হঠাৎ সিদ্ধান্তে সমস্যায় পড়লাম আমি ও আমার স্ত্রী। মূল সমস্যা অর্থনৈতিক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়লে অনেকটা বিনা খরচেই তার পড়া হত। আর আমি প্রাণবিজ্ঞানের ছাত্র হওয়ায় এবং বর্তমান শতাব্দীর সবচাইতে অগ্রসর বিষয় হিসেবে প্রাণবিজ্ঞানকে স্বীকার করে নেওয়া হয়েছে বলে, আমার ছেলে এ বিষয়ে পড়বে — তাই ছিল গভীর প্রত্যাশা।

বড় চিন্তায় পড়লাম। প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়বার খরচ যোগানো কঠিন হবে। আমি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পারডু বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিজিটিং অধ্যাপক হিসেবে গবেষণা করবার কারণে সানজীবের প্রাথমিক পড়াশুনা সেখানকার খুবই উঁচুমানের স্কুলে সম্পন্ন হয়েছিল। তাই দেশে ফিরে সানবীমস এবং পরে মাস্টারমাইন্ড স্কুলে ইংরেজি মাধ্যমে তাকে পড়াতে গিয়ে আমাদের অর্থকষ্টে পড়তে হয়েছে।

যাই হোক, সানজীবের কাছ থেকে যখন আইন বিষয়ে পড়বার মূল কারণটি জানলাম, তখন আমার স্ত্রী এবং আমি সকল দ্বিধা ঝেড়ে ফেলে তার ইচ্ছাই ফলবতী হোক– এই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম। এবারে তার ইচ্ছার কথাটি বলি। সে ঠিক করেছে আইন বিষয়ে পড়ে সে তার চাচা কর্নেল আবু তাহের বীরউত্তমকে গোপন বিচারে যে ফাঁসি দেওয়া হয়েছিল, তার বিরুদ্ধে আইনি লড়াই চালাবে।

ড. শাহদীন মালিক সানজীবের কথা মনোযোগ দিয়ে শুনলেন এবং তাকে তাঁর আইন স্কুলে ভর্তিপরীক্ষা দেবার সুযোগ দিলেন। সানজীব ভালো ফলাফল করেছিল। তার জন্য টিউশন ওয়েভারও পেয়েছিল প্রায় প্রতি সেমিস্টারে। ইতোমধ্যে সংবিধানের পঞ্চম ও সপ্তম সংশোধনী বাতিল হওয়ার কারণে জিয়া-এরশাদ সামরিক শাসকদের আমলে প্রদত্ত শাস্তির বিরুদ্ধে উচ্চতর কোর্টে আপিল করবার সুযোগও সৃষ্টি হয়ে গেছে।

এর মধ্যে আরও কিছু ঘটনাও ঘটেছে। ১/১১-এর সেনাচালিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার এসেছে ক্ষমতায়। ২০০৭ সালের ২৩ আগস্ট রাতে আমাকে ও আমার সহকর্মী ড. হারুন-অর-রশীদকে চোখ বেঁধে নিযে যায়। প্রথমে মোট বার দিনের রিমান্ড ও পরে পাঁচ মাস কারাভোগ করতে হয়েছে। সানজীবের ছোট জীবনে বড় পরিবর্তন হয়ে গেছে। সময় ও পরিস্থিতি যেভাবে ছোটদের বড় করে দেয়, তেমনটা হয়েছে তার জীবনে। অনমনীয় থেকে এবং বিজয়ী হয়েই ২০০৮ সালের ২২ জানুয়ারি কারাগার থেকে আমরা মুক্ত হয়েছি, যার পেছনে সানজীবের সুপরামর্শ ও দৃঢ়তা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।

ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়বার সময়ে সানজীবের নেতৃত্বে আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিদ্রোহী ঘটনাও ঘটেছে। তাতে আমার পূর্ণ সায়ই ছিল। একটু খুলে বলি।

বিষয়টি ড. শাহদীন মালিককে নিয়ে বলে। ব্রাক প্রশাসন ঠিক করেছে ড. শাহদীন মালিককে বিভাগ থেকে সরে যেতে হবে। সানজীবদের প্রতিবাদী বিদ্রোহ হল সে প্রশাসনিক সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে। একটি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে বহু কষ্টের উপার্জিত পয়সায় তাকে পড়াচ্ছি। সে নিতে যাচ্ছে এমন বিদ্রোহী সিদ্ধান্ত। জানি না অন্য কোনো অভিভাবক তাতে সায় দিতেন কিনা। কিন্তু যখন সানজীবের প্রত্যয়দীপ্ত সিদ্ধান্তের কথা শুনলাম, তখন সায় দিতে বিন্দুমাত্র সময় নিইনি।

একথা জোর দিয়ে বলতে পারি, সে বিদ্রোহের কারণে ড. শাহদীন মালিক তার প্রিয় বিভাগে থাকতে পেরেছিলেন। এ প্রসঙ্গে ড. জামিলুর রেজা চৌধুরীকে শ্রদ্ধায় স্মরণ করতে হবে। সানজীবের ব্যতিক্রমী বিদ্রোহে প্রচ্ছন্ন সায় তিনিও নিশ্চয়ই দিয়েছিলেন। সানজীবের এটা বড়ই সৌভাগ্য যে সে ড. শাহদীন মালিক এবং ড. জামিলুর রেজা চৌধুরীর নিবিড় তত্ত্বাবধান ও নীতিনিষ্ঠতা লাভের সুযোগ পেয়েছিল। একজন ছাত্রের জীবনে ভালো শিক্ষকের পরিচর্যা পাওয়ার চেয়ে আর বড় কোনো সৌভাগ্য হতে পারে না।

পঞ্চম ও সপ্তম সংশোধনী রদের কথায় আবার ফিরে আসি। যে পবিত্র ইচ্ছা হৃদয়ে ধারণ করে সানজীব আইন পড়েছে, তা ফলবতী হবার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। তাকে নিয়ে ড. শাহদীন মালিকের বাসার চেম্বারে গেলাম। ভর্তির সময়ে সানজীবের ইচ্ছার কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে তাঁকে অনুরোধ করলাম কর্নেল তাহেরকে যে সম্পূর্ণ বেআইনিভাবে গোপন বিচারে ফাঁসি দিয়ে হত্যা করা হয়েছে, তার বিরুদ্ধে রিট পিটিশনে আমাদের আইনজীবী হতে।

খুব সময় তিনি নেননি। বলতে কী, তেমন কোনো ফি ছাড়াই তিনি রিট মামলাটি করেন। প্রস্তুতির জন্য সময় নেওয়া হয় প্রায় তিন মাস। সে কাজের জন্য তো প্রস্তুত হয়েই ছিল সানজীব। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরি, জাতীয় আর্কাইভ, বিভিন্ন সংবাদপত্রের অফিস সাহায্যে এগিয়ে এল। ড. শাহদীন মালিকের নিবিড় তত্ত্বাবধানে ৬৪ পৃষ্ঠার রিটটি লিখে ফেলল সানজীব।

আগস্ট ২৩, ২০১০ মহামান্য বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দীন চৌধুরী মানিক ও বিচারপতি মো. জাকির হোসেনের বেঞ্চে রিট পিটিশনটি দায়ের করা হয়। প্রধান বাদী হিসেবে আমি ও আমার সঙ্গে আমার দুজন ভাবী, মিসেস লুৎফা তাহের ও মিসেস ফাতেমা ইউসুফের পক্ষ থেকে। সেদিনই রুল ইস্যু হয় এই মর্মে যে কেন মার্শাল ল’ রেগুলেশন নং ১৬ ও একই সঙ্গে সেই রেগুলেশনের অধীনে তাহরের বিচার অবৈধ এবং অসাংবিধানিক ঘোষণা করা হবে না। তারই ধারাবাহিকতায় র্পূণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয় মে ২০, ২০১৩।

সানজীবের প্রজন্ম জয়ী হল। এ জয়ের পেছনে বহু বছরের অশ্রু, বেদনা, সাহস ও দৃঢ়তা এবং সর্বোপরি বিচারকের কঠিন, নির্মোহ এবং সাহসী আইনি প্রজ্ঞা, দেশের প্রায় সকল প্রথিতযশা এমিকাস কিউরিদের বিজ্ঞ অভিমত এবং সরকারের সদিচ্ছা– এ সব কিছু যুক্ত হয়েই ফাঁসির ৩৭ বছর পর ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হল। একজন শ্রেষ্ঠ দেশপ্রেমিক তাহেরকে জেনারেল জিয়াউর রহমান যে ঠাণ্ডা মাথায় খুন করেছেন, তা উচ্চারিত হল রায়ে। তাহেরকে শহীদী মর্যাদা দিতে অনুরোধ জানানো হল সরকারকে।

ড. শাহদীন মালিক, আপনি এই ঐতিহাসিক আইনি বিজয়ের পর আরও দুটো আইনি লড়াইয়ে সাহায্য করতে এগিয়ে এসেছেন। তা ছিল বাংলাদেশের অন্যতম পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় জাহাঙ্গীরনগরকে অসুস্থতার ধারা থেকে রক্ষা করবার কাজে। দুটো রিট যার একটির মাধ্যমে সিনেটে উপাচার্য প্যানেল নির্বাচন সম্ভব হয়েছিল এবং অপরটি যার ফলে ৪৩ দিন পর প্রশাসনিক ভবনের তালা খুলে দেওয়া সম্ভব হয়েছিল।

প্রিয় এবং শ্রদ্ধেয় ড. শাহদীন মালিক, ১৫ ডিসেম্বর ২০১৩, বিজয় দিবসের আগের দিন– যে দিনে জামায়াত-শিবির দেশব্যাপী হরতাল ডেকেছে, কসাই কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকর হবার পর– ঠিক সেই দিনে ‘প্রথম আলো’ পত্রিকায় আপনার লেখা ‘‘শেখ হাসিনাকে প্রাণঢালা অভিনন্দন’’ শীর্ষক প্রবন্ধটি সম্পর্কে কিছু প্রাণের আকুতি জানাব বলে বড়ই কুণ্ঠিতভাবে পূর্বের দীর্ঘ বয়ানটি দিয়েছি। আপনি আমাকে ক্ষমা করবেন। অমর্ত্য সেনের সেই বিখ্যাত উক্তি যা তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন সভায় স্মরণ করেছিলেন– “বলতে পার মৃত্যু কী ভয়ঙ্কর, সবাই যখন কথা কইবে, রইবে তুমি নিরুত্তর”।

একটি উন্নত, উদার, যুক্তিবাদী সমাজে যে আমাদের বিতর্ক করা দোষের নয়, সে কথাটির ভরসায় এবারে আপনার প্রবন্ধ সম্পর্কে আমার অভিমত বলব।

একটু হলফ করেই বলি। আপনার লেখার শিরোনাম দেখেই মনটা খুশিতে ভরে উঠল। ভাবলাম ড. শাহদীন মালিকের তো এমন শিরোনামের লেখাই লিখা উচিত। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পরাক্রমশালী পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি, যিনি নিজেও ইতোপূর্বে প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী হয়েছিলেন, তাঁর অনুরোধ (আমাদের দেশের সরকার প্রধানদের কাছে যা নির্দেশ সমতুল্য), তাকে উপেক্ষা করেছেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

শত ষড়যন্ত্রে পরোয়া না করে (যাতে আমাদের আলোকিত মানুষদের সরব ও নৈঃশব্দের ষড়যন্ত্র যুক্ত আছে) শেখ হাসিনা ‘বাংলাদেশের জ্যেষ্ঠ রাজনীতিবিদ’ কাদের মোল্লার নয়, একাত্তরের কসাই কাদের মোল্লার ফাঁসির রায় কার্যকর করতে যে দৃঢ়তা দেখিয়েছেন– শুধুমাত্র তার জন্যই তো উদার, যুক্তিবাদী ও প্রগতিশীল বলে পরিচিত ড. শাহদীন মালিক তাঁর হৃদয়ের গভীর থেকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে প্রাণঢালা অভিনন্দন জানাতে পারতেন।

এ বিষয়ে ডেইলি স্টার পত্রিকায় ১২ ডিসেম্বরে সৈয়দ বদরুল আহসানের লেখা, War crimes, Kerry & history শীর্ষক প্রবন্ধটি ড. শাহদীন মালিককে পড়তে অনুরোধ করি। এক গভীর আনন্দ থেকে যখন ড. শাহদীন মালিকের প্রবন্ধটি পড়তে শুরু করলাম, তখনই খেলাম প্রচণ্ড ধাক্কা।

আমরা জানি, দেশের আসন্ন জাতীয় নির্বাচন নিয়ে সবার মনেই গভীর শঙ্কা আছে। তা নিয়ে বিভিন্ন চ্যানেলে অনেকের মধ্যে ড. শাহদীন মালিকও প্রায়ই মতামত দিচ্ছেন। অনেক সময় যুক্তিপূর্ণ মন্তব্য করলেও ইদানিং লক্ষ্য করছি, তিনি যেন অনেকটা ভবিষ্যদ্বাণী দেবার মতো করেই তাঁর বক্তব্য হাজির করছেন। যেমন তাঁকে বলতে শুনছি, আসন্ন নির্বাচনে আওয়ামী লীগ কতটি আসন পাবে তাও তিনি বলে দিচ্ছেন। তা কীসের ভিত্তিতে?

‘প্রথম আলো’ পত্রিকায় সারাদেশের মাত্র পাঁচ হাজার মানুষের মতামতের উপর ভিত্তি করে নির্বাচনী যে চিত্রটি দেওয়া হয়েছে, তার উপর ভিত্তি করে। তার সঙ্গে ছিল পাঁচটি সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে আওয়ামী লীগ প্রার্থীদের পরাজয়ের পরের আবহ। সে নির্বাচনের পরের কয়েকটি মাসে বাংলাদেশের রাজনীতির দৃশ্যপট যে দ্রুত পালটে যেতে শুরু করেছে, তা হয়েতো গ্রহণে তাঁর বিভ্রম হচ্ছে। দ্রুত পরিবর্তমান এসব বাস্তবতার প্রতিফলন ‘প্রথম আলো’ এবং ‘ডেইলি স্টার’ পত্রিকায় আমরা দেখতে পাচ্ছি।

এ প্রসঙ্গে গত ৬ ডিসেম্বরের ‘প্রথম আলো’র ১৩ পৃষ্ঠায় প্রকাশিত দুটো প্রবন্ধের প্রতি ড. শাহদীন মালিকের সুদৃষ্টি আকর্ষণ করছি। খোলা চোখে হাসান ফেরদৌস লিখেছেন “মুক্তিযুদ্ধ না গণতন্ত্র”। ঠিক তার নিচে “জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়– এ কোন নিরপেক্ষতায় সুশীল সমাজ’’ শীর্ষক প্রবন্ধটি লিখেছেন, কর্নেল আবু তাহের বীরউত্তমের সহধর্মিনী লুৎফা তাহের। হাসান ফেরদৌস লিখছেন–

“সাম্প্রতিক সময়ে বিরোধী দলসমূহের এই আন্দোলন ভয়াবহ রক্তপাতের কারণ হয়ে উঠেছে। সম্পূর্ন নিরীহ, রাজনীতির সঙ্গে কোনোভাবেই যুক্ত নয়, এমন নারী-পুরুষ ও শিশু হতাহত হয়েছে। যারা এই রক্তপাতের জন্য দায়ী, তারাই যদি ক্ষমতা দখল করে, ভাবা অযৌক্তিক নয়, তারা শুধু মুক্তিযুদ্ধের চেতনাই বিসর্জন দেবে না, সম্ভবত গণতান্ত্রিক মূল্যবোধও কার্পেটের নিচে লাথি মেরে ঢোকাবে। যারা এই যুক্তিতে বিশ্বাস করেন, তাদের প্রস্তাব, এই মুহুর্তে গণতন্ত্র রক্ষার চেয়ে অনেক বেশি জরুরি মুক্তিযুদ্ধের অর্জন ধরে রাখা। আর সে জন্য যদি গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও প্রাতিষ্ঠানিকতা নিয়ে কিছু ‘আপোস’ করতে হয় তাও ভালো।’’

“এ কোন নিরপেক্ষতায় সুশীল সমাজ”? এই শিরোনামের প্রবন্ধে লুৎফা তাহের জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের মানবাধিকার লঙ্ঘন বিষয়ে মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মিজানুর রহমানের মতো সুশীল সমাজের স্বনামধন্য ব্যক্তির বক্তব্য শুনে তার বিচলিত বোধ থেকে একই ধরনের প্রশ্ন উত্থাপন করেছেন। তিনি লিখেছেন–

“কিছুদিন আগে শিক্ষামন্ত্রী সংসদে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের চলতি আন্দোলন সম্পর্কে বললেন, এভাবে আইন অমান্য করতে থাকলে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী শক্ত ব্যবস্থা নিতে বাধ্য হবে। সে কথা শুধু কথা হিসেবেই রয়ে গেছে।’’ দেশের সুশীলদের প্রতি লুৎফা তাহের প্রশ্ন তুলেছেন, ‘‘আপনারা অধ্যাপক আনোয়ারের পক্ষ না নিন, অন্তত জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় বিষয়ে তদন্ত কমিশনের (যা গঠনের দাবি করেছিলেন উপাচার্য আনোয়ার হোসেন নিজেই) প্রতিবেদন প্রকাশিত হোক, সেই দাবিটি করতে এত কুণ্ঠিত বোধ করছেন কেন?’’

ড. শাহদীন মালিককে নিশ্চয়ই লুৎফা তাহেরের লেখাটি বিচলিত করবে। কারণ তারই মক্কেল বিশ্ববিদ্যালয়ের চারজন শিক্ষক এবং একজন ছাত্রের পক্ষ থেকে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের একাংশের অরাজকতা থেকে বিশ্ববিদ্যালয়টি রক্ষা করবার রিট আবেদন তিনিই করেছিলেন। এরপর যখন আন্দোলনকারীরা হাইকোর্টের নির্দেশনার চরম অবমাননা করেছেন, তখন উপর্যুপরি আবেদনের পরও তিনি আদালত অবমাননার আর্জিটি পেশ করেননি। হয়তো তিনি মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যানের মতো নিরপেক্ষ থাকতে চেয়েছেন।

শেখ হাসিনাকে ‘বিকট’ প্রাণঢালা অভিনন্দন জ্ঞাপনের অনুপুঙ্খ বর্ণনা দিয়েছেন ড. মালিক। তা একটি সংখ্যা নিয়ে– ‘ফাঁকা মাঠে ১২৭’। প্রধানমন্ত্রীকে সত্যিকার প্রাণঢালা অভিনন্দন জানাবার আর কোনো কারণ তিনি খুঁজে পেলেন না। ব্যঙ্গোক্তি করার এক পর্যায়ে তিনি এও বলেছেন, “আশা করি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মাননীয় উপাচার্যরাও অভিনন্দন-বিজ্ঞাপনের মিছিলে অগ্রদূতের ভূমিকায় নামবেন।’’

তা তিনি করুন, তবে তাঁকেসহ সুশীলদের জানাই– শিক্ষার্থী এবং দেশবাসীর প্রবল প্রত্যাশা অনুযায়ী আমি যখন জাকসু নির্বাচনের ঘোষণা দিয়েছিলাম, তখন তার বিরোধিতা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বা মহামান্য রাষ্ট্রপতির পক্ষ থেকে আসেনি। এসেছিল শিক্ষামন্ত্রী ও তার সচিব মহোদয়ের পক্ষ থেকে। ড. শাহদীন মালিক সেই শিক্ষামন্ত্রীর প্রশস্তি গেয়েছেন। বলেছেন–

“ ‘প্রথম আলো’র জনমত জরিপে শিক্ষা মন্ত্রণালয় আর শিক্ষামন্ত্রীর ব্যাপারে ইতিবাচক মূল্যায়ন ছিল যতদূর মনে পড়ে, ৯০ শতাংশের বেশি জরিপে অংশগ্রহণকারীর।’’

আমি শিক্ষামন্ত্রী মহোদয়কে জানিয়ে দিয়েছিলাম তাঁর মন্ত্রণালয়ের মতো এত দুর্নীতিগ্রস্ত প্রতিষ্ঠানের মন্ত্রীর বা তার সচিবের কাছ থেকে জাকসু নির্বাচন বিষয়ে এমন উক্তি ছাড়া আর কী-ই-বা আশা করতে পারি। এও বলেছি, This is none of your business, আমার আছে মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম ফসল বঙ্গবন্ধুর দেওয়া ১৯৭৩ সালের আইন, আমি তা অনুসরণ করব। সিনেটকে হালনাগাদ করব, সেখানে নিয়মমাফিক সকলের প্রতিনিধিত্ব থাকবে শুধুমাত্র তেমন সিনেটে উপাচার্য প্যানেল নির্বাচন দেব। যেখানে আমি নিজে কোনো প্রার্থী হব না, নির্বাচিত উপাচার্য হিসেবে আমি অপর একজন নির্বাচিত উপাচার্যের হাতে দায়িত্বভার হস্তান্তর করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে যাব। সেটাই ছিল মহামান্য রাষ্ট্রপতি ও চ্যান্সেলার মহোদয়ের নির্দেশনা।

গভীর পরিতাপের এবং শঙ্কার আরও কথা আছে ড. শাহদীন মালিকের অভিনন্দনে। তিনি বলছেন, “[...] ২০-২৫ বছর পর যখন ঘটনার অনেক দিন পর নির্মোহভাবে এ দেশের রাজনৈতিক ইতিহাস লেখা হবে, তখন স্বাধীনতার চার দশক পর এ দেশে জঙ্গি-মৌলবাদের উত্থানের পেছনে কার কত অবদান সেই বিশ্লেষণেও শেখ হাসিনার নাম কী অক্ষরে অর্থাৎ তামা, রুপা, সোনা না হীরা দিয়ে লেখা হবে, তা-ই বিশ্লেষণের বিষয়।”

অবাক না হয়ে পারি না। যেখানে বর্তমান সরকার মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে হওয়া আন্তর্জাতিক অপরাধসমূহের বিচার করছে সেখানে ড. শাহদীন মালিক বাংলাদেশে জঙ্গি-মৌলবাদের উত্থানের জন্য শেখ হাসিনাকে কিছুটা হলেও দায়ী করছেন। অথচ জেনারেল জিয়ার আমল থেকে শুরু করে জেনারেল এরশাদ এবং বেগম খালেদা জিয়ার আমলের মধ্য দিয়ে জামায়াতে ইসলামীর প্রতক্ষ সহায়তায় যেভাবে বাংলাদেশে জঙ্গি-মৌলবাদের উত্থান ঘটেছে, সে সম্পর্কে ড. মালিক কিছুই বললেন না।

একেবারে ভবিষ্যতদ্রষ্টার মতো তিনি নির্দ্বিধায় লিখে দিচ্ছেন, “আগামী অন্তত দুই যুগেও দেশের বেশ কিছু জায়গায় আওয়ামী লীগ একটি আসনও জিততে পারবে না।’’

বিএনপি-জামাতীদের হয়ে হুমকি দিচ্ছেন তিনি, ‘‘আগামী দুই সপ্তাহে লক্ষীপুর আর সাতক্ষীরা চলে আসবে ঢাকায়। চলে যাবে সিলেটে, টাঙ্গাইলে, বরগুনায়, অর্থাৎ দেশের আনাচে-কানাচে। সময় শেষ হয়ে গিয়েছে। বাকি এক সপ্তাহ।’’

এরপর তাঁর কিছু পরামর্শ আছে, বিজ্ঞজনেরা পড়ে নেবেন। কিন্তু বেগম খালেদা জিয়ার প্রতি কোথাও তাঁর পরামর্শ নেই। সংবিধান অনুযায়ী রাজনৈতিক আচরণ করতে তাঁর প্রতি ড. শাহদীন মালিকের কোনো আহবান নেই।

ড. মালিক, বেগম খালেদা জিয়াকে জামায়াত-শিবির ছাড়ার ঘোষণা দিতে বলুন। কাদের মোল্লার ফাঁসির রায় কার্যকর করার দৃঢ়তা দেখাবার জন্য বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনাকে অভিনন্দন জানাতে বলুন।

বন্ধু আমার, বড়ই রহস্যের দেশ এই প্রিয় বংলাদেশ। এই দেশের সামর্থ ও সম্ভাবনা আপনি বুঝতে পারেননি। বুঝতে পারেননি নতুন প্রজন্মের দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধের শক্তির কথা। বড়ই কষ্ট পাচ্ছি।

ক্ষমা করবেন ড. শাহদীন মালিক, অধমের এই বেদনাবোধের জন্য। তথ্যসূত্র: বিডিনিউজ২৪.কম, লেখক ড.মো. আনোয়ার হোসেন
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ধর্ম ও বিজ্ঞান

লিখেছেন এমএলজি, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৪:২৪

করোনার (COVID) শুরুর দিকে আমি দেশবাসীর কাছে উদাত্ত আহবান জানিয়ে একটা পোস্ট দিয়েছিলাম, যা শেয়ার হয়েছিল প্রায় ৩ হাজারবার। জীবন বাঁচাতে মরিয়া পাঠকবৃন্দ আশা করেছিলেন এ পোস্ট শেয়ারে কেউ একজন... ...বাকিটুকু পড়ুন

তালগোল

লিখেছেন বাকপ্রবাস, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৩৫


তু‌মি যাও চ‌লে
আ‌মি যাই গ‌লে
চ‌লে যায় ঋতু, শীত গ্রীষ্ম বর্ষা
রাত ফু‌রা‌লেই দি‌নের আ‌লোয় ফর্সা
ঘু‌রেঘু‌রে ফি‌রে‌তো আ‌সে, আ‌সে‌তো ফি‌রে
তু‌মি চ‌লে যাও, তু‌মি চ‌লে যাও, আমা‌কে ঘি‌রে
জড়ায়ে মোহ বাতা‌সে ম‌দির ঘ্রাণ,... ...বাকিটুকু পড়ুন

মা

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৩


মায়াবী রাতের চাঁদনী আলো
কিছুই যে আর লাগে না ভালো,
হারিয়ে গেছে মনের আলো
আধার ঘেরা এই মনটা কালো,
মা যেদিন তুই চলে গেলি , আমায় রেখে ওই অন্য পারে।

অন্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

কপি করা পোস্ট নিজের নামে চালিয়েও অস্বীকার করলো ব্লগার গেছে দাদা।

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:১৮



একটা পোস্ট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ আগে থেকেই ঘুরে বেড়াচ্ছে। পোস্টটিতে মদ্য পান নিয়ে কবি মির্জা গালিব, কবি আল্লামা ইকবাল, কবি আহমদ ফারাজ, কবি ওয়াসি এবং কবি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতকে জানতে হবে কোথায় তার থামতে হবে

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:৪৫


ইন্ডিয়াকে স্বপ্ন দেখানো ব্যাক্তিটি একজন মুসলমান এবং উদার চিন্তার ব্যাক্তি তিনি হলেন এপিজে আবুল কালাম। সেই স্বপ্নের উপর ভর করে দেশটি এত বেপরোয়া হবে কেউ চিন্তা করেনি। উনি দেখিয়েছেন ভারত... ...বাকিটুকু পড়ুন

×