somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বাংলাদেশে রাজনীতির ক্রমবিকাশ

১৫ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৪ সকাল ৮:৫৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

বর্তমান বাংলাদেশে কয়েকজন সাংবাদিক, সমাজ বিপ্লবের কর্মী-সংগঠক, লেখক পত্রপত্রিকায় তাদের লেখায় এবং মিডিয়ার টকশোতে ১৯৭২-৭৫ সালের সমাজ-বাস্তবতা ও রাজনীতি বিশ্লেষণ করে নিজেদের মতো রায়ও দিয়ে যাচ্ছেন। তাদের কাছে প্রশ্নÑ আপনারা বাংলাদেশের জন্মের আকাক্সক্ষা তথা স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ভিত্তিতে সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক, শিক্ষা-পদ্ধতি ও সাংবিধানিকভাবে বাংলাদেশকে কি হিসেবে দেখতে চেয়েছিলেন বা এখনো দেখতে চান? যারা যারা বাংলাদেশের সমাজ এবং রাজনীতি নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা করেন তাদের উচিত হবে, যে কোনো মতামত বা আলোচনা-সমালোচনার পূর্বে পরিষ্কারভাবে উপরোক্ত প্রশ্নের লিখিত উত্তর উপস্থাপন করা। তাহলেই বাংলাদেশের অতীত রাজনৈতিক কর্মকান্ডের সঠিক ও বস্তুনিষ্ঠ মূল্যায়ন এবং বর্তমান রাজনৈতিক সমস্যার প্রকৃত সমাধান বেরিয়ে আসবে।
১৯৭২-৭৫ সালে জাসদের ভুল রাজনীতির সমালোচকরা নিম্নোক্ত প্রশ্নের বা সমস্যার সমাধান কিভাবে করবেন?
স্বাধীনতা হচ্ছে শুধু ভৌগোলিক স্বাধীনতা। অর্থাৎ কাক্সিক্ষত মুক্তির বিষয়সমূহ বাস্তবায়ন করার জন্য, একটি নির্দিষ্ট জায়গা, যেখানে দাঁড়িয়ে সমাজের আকাক্সক্ষাসমূহ বাস্তবায়ন করার সুযোগ সৃষ্টি হবে। স্বাধীনতা মানে প্রকৃত এবং কার্যকরভাবে নির্দিষ্ট আকাক্সক্ষাগুলো অর্জন, বাস্তবায়ন এবং বিকশিত করার জন্য একটা নির্দিষ্ট প্লাটফর্ম বা মঞ্চ। মুক্তি হচ্ছে নির্দিষ্ট আকাক্সক্ষার ভিত্তিতে ভৌগোলিক স্বাধীনতা অর্জিত হওয়ার পর উক্ত আকাক্সক্ষাসমূহের বাস্তবায়ন পর্যায়। আমাদের সংবিধানের প্রস্তাবনায় বিষয়টি নিম্নরূপ : আমরা অঙ্গীকার করিতেছি যে, যে সকল মহান আদর্শ আমাদের বীর জনগণকে জাতীয় মুক্তিসংগ্রামে আত্মনিয়োগ ও বীর শহীদদিগকে প্রাণোৎসর্গ করিতে উদ্বুদ্ধ করিয়াছিল জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার সেই সকল আদর্শ এই সংবিধানের মূলনীতি হইবে। অর্থাৎ উপরোক্ত বিষয়গুলো বাস্তবায়ন করাই হচ্ছে আমাদের মুক্তি সংগ্রাম বা মুক্তিযুদ্ধ অর্থাৎ স্বাধীনতা অর্জিত হওয়ার পরবর্তী ধাপ।
নিম্নে সংযুক্ত সমাজ-দ্বান্দ্বিকতার কারণে এবং ৭ মার্চে বঙ্গবন্ধুর এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম অর্থাৎ স্বাধীনতা এবং মুক্তি হচ্ছে একই আন্দোলনের দুটি ধাপ বা পর্যায় একই ব্যক্তির দুটি অঙ্গ বা দুটি হাত সমতুল্য। একটিকে বাদ দিলে অন্যটি অসম্পূর্ণ বা অকার্যকর। আমরা যদি মুক্তি আন্দোলন শুরু এবং সমাপ্ত নাইবা করবো তাহলে স্বাধীনতা আন্দোলন কেন করেছিলাম? স্বাধীনতা আন্দোলন করা কি আমাদের ভুল ছিল? স্বাধীনতা অর্জিত হওয়ার পর মুক্তির আকাক্সক্ষাগুলো বাস্তবায়ন করতে না পারলে নিশ্চয়ই ভুল ছিল বা ভুল করেছি। বাংলাদেশের সব শ্রেণী-পেশার মানুষের মুখে নিম্নোক্ত বিষয়টি সব সময় উচ্চারিত হয়ে আসছে যে, স্বাধীনতা অর্জনের চল্লিশ বছর পরও আমরা স্বাধীনতার সুফল সাধারণ মানুষের ঘরে ঘরে পৌঁছে দিতে পারিনি। এ প্রসঙ্গে আমার প্রশ্ন :
ক) স্বাধীনতার সুফল কী কী? কেন এবং কী কারণে স্বাধীনতার সুফল ঘরে ঘরে পৌঁছাতে পারিনি? স্বাধীনতা অর্জনের পর মুক্তির বিষয়টিকে আমরা কিভাবে বিবেচনা করেছিলাম? আমরা যে চাওয়া নিয়ে স্বাধীনতা আন্দোলন করেছিলাম সেই চাওয়া বা আকাক্সক্ষা কেন পূর্ণ করতে পারিনি?
খ) আমাদের সংবিধানে অর্থনৈতিক সমতাভিত্তিক তথা সমাজতান্ত্রিক সমাজ বাস্তবায়ন করার কথা বলা হয়েছে। কোন পদ্ধতিতে এবং কিভাবে সমাজতান্ত্রিক সমাজ বাস্তবায়ন করতে হয় বা করা যায়? তৎকালীন বিশ্ব ব্যবস্থায় সমাজতন্ত্র বাস্তবায়ন করার উল্লেখযোগ্য পদ্ধতিসমূহ কী ছিল?
গ) ৭২-৭৫ সালের সমাজ-বাস্তবতার আলোকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বা আকাক্সক্ষা বাস্তবায়ন করার কী কী পথ বা পদ্ধতি ছিল? কোন পথে বা পদ্ধতিতে আন্দোলন-সংগ্রাম করলে উপরোক্ত আকাক্সক্ষা বাস্তবায়ন করা যেতো, ভুলভ্রান্তিও হতো না?
কী কী বিষয় বাস্তবায়ন করার জন্য ১৯৪৮-৭১ সাল পর্যন্ত বাঙালিরা আন্দোলন-সংগ্রাম করেছিল? অর্থাৎ আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলনের মূল লক্ষ্য কী ছিল? আপনাদের সুবিধার জন্য নিম্নে কিছু দিকনির্দেশনা প্রদান করা হলো।
আমাদের সংবিধান মোতাবেক বিষয়টি নিম্নরূপ :
ক) আমরা অঙ্গীকার করিতেছি যে, যে সকল মহান আদর্শ আমাদের বীর জনগনকে জাতীয় মুক্তিসংগ্রামে আত্মনিয়োগ ও বীর শহীদদিগকে প্রাণোৎসর্গ করিতে উদ্বুদ্ধ করিয়াছিল জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার সেই সকল আদর্শ এই সংবিধানের মূলনীতি হইবে।
খ) আমরা আরো অঙ্গীকার করিতেছি যে, আমাদের রাষ্ট্রের অন্যতম মূল লক্ষ্য হইবে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে এমন এক শোষণমুক্ত সমাজতান্ত্রিক সমাজের প্রতিষ্ঠা যেখানে সকল নাগরিকের জন্য আইনের শাসন, মৌলিক মানবাধিকার এবং রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্য এবং স্বাধীনতা ও সুবিচার নিশ্চিত হইবে।
গ) সংবিধানের উপরোক্ত বক্তব্যের আলোকে নিম্নের শব্দ বা বিষয়সমূহের ব্যাখ্যা প্রদানপূর্বক এগুলো সমাজে বাস্তবায়ন করার সঠিক প্রক্রিয়া বা পদ্ধতি দয়া করে বর্ণনা করবেন। তা হলেই সমাজে আর কোনো ভুল বোঝাবুঝির অবকাশ থাকবে না। জাসদ বা অন্যরাও এর বিরোধিতা করতে পারবে না। ইতিহাস প্রণেতারা এবং পাঠকরাও উপকৃত হবেন। নিন্মোক্ত শব্দ বা বাক্যাংশ সংবিধানের উপরোল্লিখিত অংশ থেকে নেয়া।
১) জাতীয় মুক্তি সংগ্রাম কি? ২) জাতীয়তাবাদ কি? ৩) সমাজতন্ত্র কি? ৪) গণতন্ত্র বলতে কি বুঝায় বা গণতন্ত্র কি জিনিস? ৫) ধর্ম নিরপেক্ষতা বলতে কি বুঝায়? ৬) গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে এমন এক শোষণমুক্ত সমাজতান্ত্রিক সমাজের প্রতিষ্ঠা বলতে কি বুঝায়? ৭) মৌলিক মানবাধিকার বলতে কি বুঝায়? ৮) রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্য বলতে কি বুঝায়? ৯) স্বাধীনতা ও সুবিচার নিশ্চিত হইবে বলতে কি বুঝায়?
উপরে উল্লিখিত সাংবিধানিক বিষয়গুলো বাস্তবায়ন করার প্রক্রিয়া বা পদ্ধতিসমুহ তৎকালীন সমাজ-বাস্তবতায় কী ছিল? জাসদ বা অন্যান্য সংগঠনের বিপ্লবী কর্মকান্ডের ভুলগুলো কী ছিল? উপরে আলোচ্য বিষয়ের ক্রমানুসারে ব্যাখ্যা করতে হবে। জাসদ বা অন্যান্য সংগঠন কী কী কর্মকা- পরিচালনা করলে উপরোক্ত বিষয়গুলো সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করতে পারতো? বাকশাল ব্যবস্থা কি ছিল? কি কারণে বঙ্গবন্ধু বাকশাল ব্যবস্থা বাস্তবায়ন করতে চেয়েছিলেন? বাকশাল ব্যবস্থা কি ভুল ছিল? বাকশাল না করে সংবিধানের উপরোক্ত বিষয়গুলো কিভাবে বাস্তবায়ন করলে বঙ্গবন্ধু সঠিক কাজটি করতেন?
মনে রাখবেন উপরোক্ত বিষয়গুলোর সময়কাল ছিল ১৯৭২-৭৫ সাল। অর্থাৎ তখনকার সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক দ্বন্দ্ব বা বিরোধ সমূহের ওপর ভিত্তি করেই ভুল-ত্রুটি, সঠিকতা-বেঠিকতা, সমস্যা এবং সমাধানের উপায় নিয়ে আলোচনা করতে হবে। উপরন্তু তৎকালীন আন্তর্জাতিক দ্বিধা-বিভক্ত রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক দ্বন্দ্বসমূহকেও বিবেচনায় নিতে হবে। কারণ বিভক্ত আন্তর্জাতিক শিবিরের দুই প্রধান শক্তিই আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধ এবং তৎপরবর্তী রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের সঙ্গে সরাসরি সংযুক্ত ছিল।
সংক্ষেপে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নিম্নরূপ: ১) বাঙালি জাতীয়তাবাদ তথা বাঙালির স্বাধীন জাতি-রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আকাক্সক্ষা বা স্বপ্ন। ২) ধর্ম নিরপেক্ষতা তথা অসাম্প্রদায়িকতা সমৃদ্ধ বাঙালি সমাজ গঠন। ৩) অর্থনৈতিক সমতাভিত্তিক ও মৌলিক মানবাধিকার সমৃদ্ধ সমাজ প্রতিষ্ঠা। ৪) আমলাতান্ত্রিক প্রশাসনিক ব্যবস্থা বাতিল করে গণমুখী এবং স্বাধীন রাষ্ট্র ও সমাজ উপযোগী প্রশাসনিক ব্যবস্থা চালু করা। ৫) ব্রিটিশ-পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক এবং সামন্তবাদী আইন-কানুন, সমাজ-কাঠামো ও শিক্ষা-ব্যবস্থা পরিবর্তন করে, স্বাধীন রাষ্ট্রের উপযোগী আইন, সমাজ কাঠামো এবং গণমুখী শিক্ষা ব্যবস্থা প্রচলন বা বাস্তবায়ন।
অন্যদিকে ভৌগোলিক স্বাধীনতা অর্জনের পর আমাদের আন্দোলন-সংগ্রাম ছিল অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জনসহ উপরোক্ত আকাক্সক্ষাগুলো বাস্তবায়নের। আকাক্সক্ষাসমূহ বাস্তবায়ন ব্যতীত ভৌগোলিক স্বাধীনতা অর্থহীন। এই মৌলিক বিষয়টি না বুঝতে পারলে ১৯৭২-৭৫ সালের রাজনৈতিক বিরোধে এবং তার চরিত্র বিষয়ক সমস্যাগুলো বুঝতে বা বিশ্লেষণ করতে সহজ হবে না। যে কারণে বর্তমান বিশ্লেষকদের বিশ্লেষণ একপেশে হয়ে যাচ্ছে।
ক) ১৯৭২-৭৫ সালে বাংলাদেশের সামাজিক এবং রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব বা বিরোধ ছিল নিম্নরূপ :
১) আমাদের রাজনৈতিক ব্যবস্থা কী হবে? অর্থাৎ কোন সামাজিক এবং রাজনৈতিক নিয়ম বা পদ্ধতিতে দেশ চলবে? ২) আমাদের অথনৈতির্ক ব্যবস্থা কী হবে? অর্থাৎ ধনতান্ত্রিক, সমাজতান্ত্রিক, নাকি মিশ্র অর্থনৈতিক-ব্যবস্থা? ৩) আমাদের সাংস্কৃতিক ব্যবস্থার ভিত্তি কী হবে? অর্থাৎ বাঙালি সংস্কৃতি, নাকি ধর্মভিত্তিক, জঙ্গিবাদী, পাকিস্তান মার্কা সংস্কৃতি? ৪) আমাদের প্রশাসনিক ব্যবস্থা কী হবে? অর্থাৎ উত্তারাধিকার সূত্রে পাওয়া ঔপনিবেশিক ধারার আমলা-নির্ভর প্রশাসন? নাকি স্বাধীনতার চেতনা উপযোগী, আধুনিক ও জনকল্যাণমূলক প্রশাসনিক ব্যবস্থা? ৫) আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার ধরন কী হবে? অর্থাৎ ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক তথা সনাতনী ধারার শিক্ষা ব্যবস্থা? নাকি স্বাধীনতার উপরোল্লিখিত চেতনা উপযোগী আধুনিক, গণমুখী বা জনকল্যাণমূলক তথা একমুখী শিক্ষা ব্যবস্থা?
১৯৭২-৭৫ সালে আমাদের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বা আকাক্সক্ষা বাস্তবায়নভিত্তিক, উপরোক্ত বিরোধসমূহের কারণে, মুজিববাহিনী, জাসদ, রক্ষীবাহিনী, গণবাহিনী, সর্বহারা পার্টি, পূর্ববাংলার কমিউনিস্ট পার্টি এবং বাকশাল ব্যবস্থাসহ অন্যান্য দল-উপদল বা সমাজ-শক্তির সৃষ্টি হয়েছিল। তখনকার সামাজিক এবং জাতীয় ও অন্তর্জাতিক পরিস্থিতিগত কারণে এটাই ছিল সমাজ-বাস্তবতা, তথা সমাজের বিকাশ বা বিবর্তনের অনিবার্য পরিণতি তথা স্বাধীনতার পরবর্তী ধাপ বা মুক্তি আন্দোলনের পর্যায়। জাসদ বা অন্যান্য সমাজ-শক্তি কোনো কিছু না করলেও কেউ না কেউ, উক্ত আকাক্সক্ষা বা বিষয়গুলো বাস্তবায়ন করার জন্য এগিয়ে আসতোই। প্রচলিত ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক ধারার আমলানির্ভর প্রশাসন ব্যবস্থা দিয়ে, স্বাধীন দেশ চলতে পারে না বিধায় এবং তখনকার সমাজ-বাস্তবতার কারণেই বঙ্গবন্ধুও বাকশাল ব্যবস্থার প্রচলন করতে বাধ্য হয়েছিলেন।
ষড়যন্ত্র, চক্রান্ত, হত্যা-ক্যু, সামরিক শাসন, মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ধ্বংস এবং সংবিধান পরিবর্তনের মাধ্যমে সমাজের গতিধারাকে যারা পরিবর্তন করে দিয়েছেন মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তির বর্তমান সফলতাকে ব্যর্থ করে দেয়ার জন্য তারাই আজকে বিভিন্নভাবে রাজনৈতিক ব্যর্থতার বগল বাজাচ্ছেন। তাদের অনেকেই তৎকালীন সামরিক শাসন ব্যবস্থার সুবিধাভোগী ছিলেন। মনে রাখবেন, ১৯৭২-৭৫ সালের অসফলতার কারণে আমরা ৪০ বছর পিছিয়ে গিয়েছি। বাঙালি জাতীয়তাবাদ এবং অসাম্প্রদায়িকতা প্রতিষ্ঠার বর্তমান সুযোগকে অপপ্রচার এবং চক্রান্তের মাধ্যমে ব্যর্থ করে দিলে আরো ৫০ বছর অপেক্ষা করতে হতে পারে।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পর থেকে আজ পর্যন্ত বাংলাদেশের সামাজিক দ্বন্দ্ব বা বিরোধসমূহ নিম্নরূপ : ১) বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রতিষ্ঠা নাকি বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের আড়ালে, ধর্মীয় জঙ্গিবাদী বা ইসলামিক জাতীয়তাবাদের প্রতিষ্ঠা? বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ হচ্ছে জগা-খিচুড়ি মার্কা জাতীয়তাবাদ-এর আড়ালে পাকিস্তানি মার্কা, ধর্মীয় জঙ্গিবাদই হচ্ছে আসল বিষয়। ২) অসাম্প্রদায়িক এবং মৌলিক মানবাধিকার সমৃদ্ধ বাঙালি-সমাজ বা রাষ্ট্র ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা? নাকি সাম্প্রদায়িক তথা ধর্মীয় জঙ্গিবাদী সমাজ বা রাষ্ট্র ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা? ৩) আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলনের মূল ভিত্তিই হচ্ছে বাঙালি জাতীয়তাবাদ। অর্থাৎ বাঙালির আলাদা জাতি-রাষ্ট্র, ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতিসহ হাজার বছরের বাঙালি ঐতিহ্যকে ধারণ, লালন, পালন এবং বিকশিতকরণ। এ বিষয়টি মাথায় রেখেই অন্য সবকিছু নির্ধারিত হবে অর্থাৎ সবকিছুই। যারা এর বাইরে গিয়ে অন্যকিছু চিন্তা করবেন তারাই উপরোল্লিখিত মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী শক্তি। তাদের গণতান্ত্রিক অধিকারও সীমিত থাকা উচিত। বাংলাদেশের জন্য গণতন্ত্র হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন। গণতান্ত্রিক অধিকারের দোহাই দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী কোনো কিছুই বলা বা করা যাবে না।
উপরোক্ত ক) এবং খ) ক্রমিকের সামাজিক দ্বন্দ্ব বা বিরোধের আলোচনা থেকে আমরা সহজেই এই সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারি যে : ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের হত্যাকান্ডের ঘটনা আমাদের সামাজ-দ্বান্দ্বিকতা বা বিরোধের অন্যতম মূল বিষয়, চেহারা এবং চরিত্র সম্পূর্ণ বদলে দিয়েছিল। আমাদেরকে ইউ-টার্ন করিয়ে, পুনরায় ১৯৪৮-৭১ সালের আন্দোলন-সংগ্রাম পর্যায়ে, ফেরত নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। এক কথায়, আমাদের স্বাধীনতাযুদ্ধের মূল-চেতনা অসমাপ্ত। এ পর্যায় বা স্তরকে সঠিকভাবে সমাপ্ত অথবা পরিত্যাগ না করে নতুন আন্দোলন-সংগ্রামের পর্যায়ে যাওয়া সম্ভব নয় এবং বিজ্ঞানসম্মতও নয়। আমাদের আন্দোলন-সংগ্রামের চরিত্রকে শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে বদলে দিয়ে, এখন অনেকেই বলছেন আমরা ব্যর্থ হয়েছি।
১৯৭২-৭৬ সালের রাজনৈতিক ব্যর্থতার সমালোচনা যারা করছেন তাদের কাছে নিম্নোক্ত প্রশ্নগুলো প্রাসঙ্গিক : ক) আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বা আকাক্সক্ষা কি ছিল? অর্থাৎ কি ধরনের সমাজ বাস্তবায়ন করার জন্য আমরা পাকিস্তানের বিরুদ্ধে দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রাম এবং সর্বশেষে জনযুদ্ধের মাধ্যমে বাঙালি জাতি-রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছিলাম? খ) আমরা যদি সমাজ-বিপ্লবের মাধ্যমে সমাজ পরিবর্তন না ঘটাবো, অর্থাৎ পুরোনো ব্রিটিশ-পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক ব্যবস্থাই যদি টিকিয়ে রাখবো তাহলে স্বাধীন বাঙালি জাতি-রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রয়োজন কি ছিল? পাকিস্তানের সঙ্গে থাকাই সঠিক ছিল না? গ) সমাজ কাঠামোর আমূল পরিবর্তন করতে হলে সমাজ-বিপ্লব অবশ্যম্ভাবী। এ সত্যটি মাথায় রেখে এবং তৎকালীন বিশ্ব-পরিস্থিতির আলোকে, সমস্ত ঘটনাপ্রবাহ বিবেচনা বা মূল্যায়ন করতে চেষ্টা করেছেন কি? ঘ) জাতীয়-আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র, চক্রান্ত, হত্যা-ক্যু এবং সামরিক শাসনের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ধ্বংস করে দিয়ে, বিগত ৪০ বছর আমাদের ইউ টার্নের মাধ্যমে পেছনে নিয়ে গিয়ে এখন সবাই বলছেন, আমরা ভুল করেছি। আমরা ভুল করেছি, কি সঠিক করেছি মুক্তি-আন্দোলনের কর্মকা-কে সমাপ্ত হতে না দিয়ে কেন এবং কি কারণে বলছেন আমরা ভুল করেছি? ঙ) ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট শেখ হাসিনাকে হত্যা করতে পারলে আজকে জয় বাংলা, বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও অসাম্প্রদায়িকতার পক্ষে কথা বলার আর কেউ থাকতো না। তখন কি এটা প্রমাণ হতো যে, বাঙালি জাতীয়তাবাদ, অসাম্প্রদায়িকতা এরং জয়বাংলাকে ধারণ করা বা উক্ত বিষয়গুলোকে প্রতিষ্ঠা করতে না পারা আওয়ামী লীগের ব্যর্থতা বা ভুল পদক্ষেপ ছিল?
বাংলাদেশের বর্তমান সমাজ-বাস্তবতা বা সঠিক রাজনৈতিক কর্মকান্ডের ভিত্তি হচ্ছে অসমাপ্ত জাতীয়তাবাদী আন্দোলন সমাপ্ত করা। অর্থাৎ ১৯৪৮-৭১ সালের সামাজিক এবং রাজনৈতিক আন্দোলন-সংগ্রামের পর্যায়। এ জন্যই বাংলাদেশের বর্তমান রাজনীতিতে নিম্নোক্ত দুটি পথ বা ধারা দৃশ্যমানভাবে বিরাজ করছে : ১) একটির নেতৃত্বে বিএনপি-জামাত-হেফাজত জোট অর্থাৎ স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী শক্তি। ২) অন্যটির নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন রাজনৈতিক জোট অর্থাৎ স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা পক্ষের শক্তি। ৩) গণভিত্তিসম্পন্ন তৃতীয় কোনো রাজনৈতিক শক্তির অস্তিত্ব বর্তমান বাংলাদেশে নেই। ৪) ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়কার অবস্থার মতো হয় রাজাকার সমর্থক নতুবা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সমর্থক। বর্তমান সময়ের রাজনীতি হচ্ছে হয় মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষে নতুবা বিপক্ষে। এ কারণেই জাসদ, ওয়ার্কাস পার্টিসহ অন্যান্য প্রগতিশীল সমাজ-শক্তির ঐক্য। সমাজ-দ্বান্দ্বিকতার নিয়ম অনুযায়ী ঐক্য-বিরোধ-ঐক্য এই বৈজ্ঞানিক সূত্রের সঠিকতা নিম্নোক্তভাবে : ১) ১৯৪৮-৭১ সাল পর্যন্ত ছিল ঐক্যবদ্ধ জাতীয়তাবাদী আন্দোলন-সংগ্রামের পর্যায়, ২) ১৯৭২-৭৫ সাল ছিল বিরোধাত্মক সামাজিক এবং অর্থনৈতিক মুক্তি আন্দোলন-সংগ্রামের পর্যায় এবং ৩) ১৯৭৬-২০১৪ তথা অসমাপ্ত জাতীয়তাবাদী আন্দোলন সমাপ্ত না হওয়া পর্যন্ত ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন-সংগ্রামের পর্যায় বা স্তর।
১৯৭২-৭৬ সালের রাজনৈতিক কর্মকান্ডের সঠিকতা-বেঠিকতা নিয়ে যারা আলোচনা-সমালোচনা করেন এবং চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত প্রদান করার মাধ্যমে ব্যর্থতার উপসংহার টেনে রায় প্রদান করতেও কুণ্ঠাবোধ করেন না তাদের কাছে উপরোক্ত প্রশ্নগুলোর ব্যাখ্যা দাবি করছি। ব্যাখ্যা প্রদানে ব্যর্থ হলে তাদের উচিত মিডিয়ার মাধ্যমে বক্তব্য প্রত্যাহার করে জনগণের কাছে নিঃশর্ত ক্ষমা চাওয়া।
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আপনি কি বেদ, উপনিষদ, পুরাণ, ঋগ্বেদ এর তত্ত্ব বিশ্বাস করেন?

লিখেছেন শেরজা তপন, ২২ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:৫২


ব্লগে কেন বারবার কোরআন ও ইসলামকে টেনে আনা হয়? আর এই ধর্ম বিশ্বাসকে নিয়েই তর্ক বিতর্কে জড়িয়ে পড়ে সবাই? অন্য ধর্ম কেন ব্লগে তেমন আলোচনা হয় না? আমাদের ভারত... ...বাকিটুকু পড়ুন

দুলে উঠে

লিখেছেন সাইফুলসাইফসাই, ২২ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:৫৬

দুলে উঠে
সাইফুল ইসলাম সাঈফ

মন খুশিতে দুলে দুলে ‍উঠে
যখনই শুনতে পাই ঈদ শীঘ্রই
আসছে সুখকর করতে দিন, মুহূর্ত
তা প্রায় সবাকে করে আনন্দিত!
নতুন রঙিন পোশাক আনে কিনে
তখন ঐশী বাণী সবাই শুনে।
যদি কারো মনে... ...বাকিটুকু পড়ুন

তরে নিয়ে এ ভাবনা

লিখেছেন মৌন পাঠক, ২২ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১০:৩০

তরে নিয়ে এ ভাবনা,
এর শুরু ঠিক আজ না

সেই কৈশোরে পা দেয়ার দিন
যখন পুরো দুনিয়া রঙীন
দিকে দিকে ফোটে ফুল বসন্ত বিহীন
চেনা সব মানুষগুলো, হয়ে ওঠে অচিন
জীবনের আবর্তে, জীবন নবীন

তোকে দেখেছিলাম,... ...বাকিটুকু পড়ুন

আপনি কি পথখাবার খান? তাহলে এই লেখাটি আপনার জন্য

লিখেছেন মিশু মিলন, ২২ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১০:৩৪

আগে যখন মাঝে মাঝে বিকেল-সন্ধ্যায় বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিতাম, তখন খাবার নিয়ে আমার জন্য ওরা বেশ বিড়ম্বনায় পড়ত। আমি পথখাবার খাই না। ফলে সোরওয়ার্দী উদ্যানে আড্ডা দিতে দিতে ক্ষিধে পেলে... ...বাকিটুকু পড়ুন

কষ্ট থেকে আত্মরক্ষা করতে চাই

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৯



দেহটা মনের সাথে দৌড়ে পারে না
মন উড়ে চলে যায় বহু দূর স্থানে
ক্লান্ত দেহ পড়ে থাকে বিশ্রামে
একরাশ হতাশায় মন দেহে ফিরে।

সময়ের চাকা ঘুরতে থাকে অবিরত
কি অর্জন হলো হিসাব... ...বাকিটুকু পড়ুন

×