আমি ছোট থাকতে যখন ফুফু আমাদের বাসায় বেড়াতে আসতেন তিনি তখন সকালে খুব মিষ্টি কন্ঠে সূরা আর রাহমান তেলাওয়াত করতেন।ফুফুর সেই মিষ্টি কন্ঠের কোরান তেলাওয়াত এখনও আমার কানে ভাসে।সূরা আর রাহমান মনে হয় ফুফু তেলাওয়াত করতে বেশি পছন্দ করতেন।فَبِأَيِّ آلَاء رَبِّكُمَا تُكَذِّبَانِ অতএব, তোমরা উভয়ে তোমাদের পালনকর্তার কোন কোন অনুগ্রহ অস্বীকার করবে?এই লাইনটাই আমার খুব ভাল লাগত।
আমার বাবারা এক ভাই দু বোন ছিলেন।আমার বড় ফুফু আমার জন্মের অনেক আগেই মারা গেছেন।ছোট থেকেই ছোট ফুফুকে দেখেছি তাই তখন থেকেই মনে করতাম আমার একটাই ফুফু।আমাদের গ্রামেই ফুফুর বিয়ে হয়েছিল।জামাই শহরে স্কুলের শিক্ষক ছিলেন সেখানেই বাড়ি করে থাকতেন তিনারা।
অনেক বড় সংসার ছিল ফুফুর,পাঁচ মেয়ে তিন ছেলে।ভাত কাপড়ের অভাব না থাকলেও নিত্য প্রয়োজনীয় অভাব ছিল ফুফুর সংসারে।আর সে কারনেই হয়তো আমাদের দিকে ঠিক অতটা খেয়াল দিতে পারেননি।আমার ফুফুর ছোট দুই মেয়ে আমার বয়সের কাছাকাছি ছিল।তাদের সাথে খেলার লোভে প্রায় ফুফু বাড়ি যাওয়ার আবদার করতাম কিন্তু পড়াশোনার জন্য মা যেতে দিতে চাইতেন না।ফুফু বাড়ি গেলে ফুফু হাতে টাকা দিতেন সেই টাকা দিয়ে দোকানে গিয়ে মিষ্টি কেনা ছিল আমার কাছে অনেক আনন্দের।ফুফুদের বাড়ি গেলে ফুফু কিছুতেই আসতে দিতে চাইতেন না।আসার সময় বার বার আমাকে বলতেন আবার তাড়াতাড়ি আসিস।আর ভাইকে বলবি আসতে।আমি বলতাম ফুফু তুমিও বেড়াতে যেও।তখন ফুফু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলতেন,গেলে দুএকদিন পরে চলে আসতে হয় গিয়ে কি করব বল?
আমিও সব সময় অপেক্ষায় থাকতাম ফুফু কখন আসবে।বেঁচে থাকতে বড় হয়ে যখন ফুফুর কাছে যেতাম তখন ফুফু একটা কথা বার-বার বলতেন,আমি মরে গেলে আমার কবরটা ভাইয়ের কবরের পাশে দিস।আমরা ফুফুর সে কথা গায়ে মাখতাম না।জীবনের প্রয়োজনে ব্যস্ততা বেড়ে গেলে আর আগের মত ফুফু বাড়ি যাওয়া হত না।যখন একটা চাকরি পেলাম তখন ফুফুর কাছে গেলে ফুফু হেসে বলত,তোর বেতনের টাকা দিয়ে আমার জন্য একটা শাড়ি কিনে দিস।আমি বলতাম কি শাড়ি নেবে ফুফু?ফুফু মিষ্টি হাসি দিয়ে বলতেন,তোর যেমন পছন্দ হয়।আমার ফুফু খুব হাসিখুশি একজন মানুষ ছিলেন।
শেষ যেবার দেখা করে এলাম তেমন কথা বলতে পারেননি।শুধু কাঁছিলেন।হয়তো বুঝে গিয়েছিলেন তিনার মৃত্যু খুব কাছে।
ফুফু তার ভাইকে খুব ভালবাসতেন।তাই মৃত্যুর আগে সবাইকে বলে গেছেন,মৃত্যুর পরে তিনার কবর যেন তার ভাইয়ের কবরের পাশেই হয়।
ফুফুর শেষ ইচ্ছৈ পূরন হয়েছে।তিনার ভাইয়ের পাশেই চির নিদ্রায় শায়িত হয়েছেন।
ফুফুর সাথে কত স্মৃতি মনে পড়ছে।বারবার একটি কথায় আমার কানে বাজে,আমি মরে গেলে আমার ভাইয়ের পাশে মাটি দিস।
ফুফু আমাকে যেভাবে ভাল বাসতেন সেটি একজন মায়ের প্রতি সন্তানের যেমন ভালবাসা থাকে ঠিক তেমনই।
যাদের ফুফু আছে তারা হয়তো বলতে পারবেন,ফুফুরা কেমন হয়। আমার সব সময়ই মনে হয়, ফুফুরা মায়ের মত।
** গত ২০.১২.২০১৭ ইং তারিখে ভোরে আমার ফুফু মৃত্যুবরন করেন।
মহান আল্লাহ তিনাকে জান্নাতুল ফেরদাউস দান করুন।আমিন।
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই জানুয়ারি, ২০১৮ বিকাল ৪:৪৯