এক লোক চিড়িয়াখানায় বেড়াতে গিয়ে বিভিন্ন প্রাণীর খাঁচা ঘুরে গণ্ডারের খাঁচার সামনে উপস্থিত হলও। এই দিকে কিছুক্ষণ পরে গণ্ডারটি হো-হো করে হেঁসে উঠলো। গণ্ডারের হাঁসি দেখে চিড়িয়াখনা ভ্রমণে আসা ব্যক্তিটি গণ্ডারের তত্বাবধায়কে প্রশ্ন করলো ভাই গণ্ডারের এই হাঁসির রহস্য কি? তত্বাবধায়ক প্রশ্নকারীকে বলল যে ৭ দিন পূর্বে গণ্ডারকে গোসল করানোর সময় কিছুটা কাতু-কুতু লেগেছিল। গণ্ডারের চামড়া ৭ স্তর পুরু তো তাই ৭ দিন পড়ে সেই কাতু-কুতু টের পেয়ে আজকে হাঁসতেছে।
টেকনাফ পৌরসভার কমিশনা ও যুবলীগ নেতা একরামের ক্রসফায়ারের অডিও শুনে বাংলাদেশের সুশীল সমাজের প্রতিক্রিয়া দেখে চিড়িয়াখানার মোটা চামড়ার ঐ প্রাণীর উপরোক্ত গল্পটা মনে পড়ে গেল।
আজ থেকে প্রায় ৪ বছর পূর্বে ঢাকা শহরের কোন ওয়ার্ডের মাত্র ২০-২৫ বছর বয়সী ছাত্রদল নেতা জনি ক্রসফায়ারের মুখে দাঁড়িয়ে মাত্র ১ মাস ১ সপ্তাহের জন্য প্রাণ ভিক্ষা চেয়েছিল যাতে করে মৃত্যুর পূর্বে নিজের ৯ মাসের গর্ভবতী স্ত্রীর প্রথম সন্তানের মুখটা দেখে মৃত্যুবরণ করতে পারে।
যুবলীগ নেতা একরামের নামে মাদক মামলা ছিলও; হোক না সেটা মিথ্যা মামালা; যে মামলায় একরাম কিছুদিন জেলেও ছিলও; ক্রসফায়ারে দেওয়ার পূর্বে জামিনে ছিলও। পক্ষান্তরে ছাত্রদল নেতা জনির নামে সরা বাংলাদেশে একটা মামলাও ছিলও না; এমনকি মিথ্যা বা রাজনৈতিক হয়রানী মামলাও না। একরামের দুইটি কিশোরি মেয়ের বাবার সাথে কিছু স্মৃতি আছে; কিন্তু জনির বাচ্চাটি মায়ের পেটে থাকতেই এতিম হয়ে যায়। কিন্তু গন্ডারের চামড়া ওয়ালা সুশীলদের গত ৪ বছরে দেখিনি কোনদিন পৃথিবীর আলো দেখার ৫ সপ্তাহ পূর্বেই এতিম হওয়া শিশুটির কথা কোনদিন বলেছে বা কোথাও লিখেছে। বরং প্রতিটি ক্রসফায়ারের পরে সরকারের মন্ত্রী-এমপি বা সরকারী বাহিনী যে প্রেস রিলিজ দিয়েছে সেটাই গ্র-গ্রাসে গিলেছে। সম্ভব হলে এই শুশিলরাও যোগ দেয় গুম বাহিনী বা ক্রসফায়ার বাহিনীর সাথে। যে শুশীলরা আজকে একরামের দুই কিশোরী মেয়ের চোখের পানি দেখে আবেগে কান্দালাইছে সেই একই শুশিলদের কর্ন-কুহূরে প্রবেশ করে নাই হবিগঞ্জের চুনারুঘাট পৌরসভা ৯ নং ওয়ার্ড়ের কমিশনার যুবদল নেতা ইউনুছ আলীর ৪ শিশু সন্তানের কান্না।
জনিকে ক্রসফায়ারে দেওয়ার পরেই আমরা কিছু মানুষ বলেছিলাম যে একদিন সরকারী এই বাহিনী ফ্রান্কেনস্টাইন হবে বা হতে বাধ্য। যে সরকারী বাহিনীকে সরকারী দল আজকে বিরোধীদলের নেতা-কর্মিদের ক্রসফায়ারের কাজে ব্যবহার করতেছে সেই বাহিনীকেই ভবিষ্যতে কেউ ব্যবহার করবে সরকারী দলের আভ্যন্তরীণ কোন্দল দমনের কাজে। নারায়ণগঞ্জে সরকারীদল সমর্থক এক কমিশনরা র্যাবকে ভাড়া করলো সরকারীদল সমর্থক অন্য কমিশনকে খুন করার কাজে। ঠিক একই ঘটনা ঘটলো টেকনাফে। সরকারী দলের একপক্ষ সরকারী বাহিনীকে ব্যবহার করলো অন্য পক্ষকে ক্রসফায়ার দেওয়ার কাজে। গত সপ্তাহেই পুলিশেরই এক সোর্স যে নিজেই এক মাদক ব্যবসায়ীর পক্ষে কাজ করে; সে মাদক ব্যবসায়ীর পরিবর্তে একই নামের অন্য একজন সাধারণ মানুষকে সরকারী বাহিনীর হাতে তুলে দেয় ও সেই নিরীহ ব্যক্তিকে ক্রসফায়ার দেওয়া হয়। পরবর্তীতে সেই ঘটনা জানা-জানি হলে পুলিশের সেই সোর্সকেই ক্রসফায়ার দেওয়া হয়।
আজ থেকে প্রায় ২ বছর পূর্বে দৈনিক বনিকবার্তা পত্রিকায় একটা উপ-সম্পাদকীয়তে লিখেছিলাম যে আমেরিকার দক্ষিণ পাশের দেশ মেক্সিকোর অর্থনৈতিক ভাবে মোটামুটি সমৃদ্ধ একটা দেশ। মাথাপিছু আয় ১০ হাজার ডলারের বেশি; উন্নত দেশের কাতারেই পড়ে। তবে মেক্সিকো দেশটা সারা বিশ্বে একটি মাফিয়া রাষ্ট্র হিসাবেই পরিচিত। সেই দেশে কোন মানুষের জীবনের নিরাপত্তা নাই। দিনে-দুপুরে শত-শত মানুষ গুম হয়; খুন হয়। কে কাকে গুম করে; খুন করে তার কোন তদন্ত হয় না; বিচার হয় না। বাংলাদেশে কয়টা গুমের তদন্ত হয়েছে? কয়টা খুনের বিচার হয়েছে খোঁজ নিয়া দেখেন।
বাংলাদেশ পুরোপুরি মেক্সিকোর মতো মাফিয়া রাষ্ট্র হওয়ার পথেই হাঁটছে। কেউ কি আছেন এই ব্যাপারে বাজী ধরতে চান?
বিভিন্ন সরকারী বাহিনীর লক্ষ-লক্ষ সদস্যকে হাজার-হাজার কোটি টাকা বেতন দিয়ে রাখার অর্থ কি? তারা যদি আইনের পথ অনুসরণ করে অপরাধীর বিচার নিশ্চিত করতে না পারে?
পত্রিকার সংবাদে জানতে পারলাম গতকালকেও হাই কোর্টে ১৯ জন বিচারপতি নিয়োগ দেওয়া হয়েছে? এই ১৯ জন বিচারপতি নিয়োগ দেওয়ার অর্থ কি? যদি অপরাধীর বিচারের ভার পুলিশ-র্যাবের হাতে তুলে দেওয়ার হয়?
জজ কোর্ট, হাইকোর্ট, সুপ্রিম কোর্ট বন্ধ করে দেন জনগণের ট্যাক্সের টাকা কিছু বাঁচুক। বেঁচে যাওয়া সেই টাকা দিয়া দুই-চরটা ব্রিজ-কালভার্ট বানান। লোহার পরিবর্তে বাঁশ দিয়া বানান সেই সকল ব্রিজ-কালভার্ট। বাঁশ তো দেশের জনগনকে এমনিতেও দিচ্ছেন সেটা না হয় বাঁশ দিয়ে দুইচারটা ব্রিজ-কালভার্ট বানিয়েই দিলেন।
সংবাদ মাধ্যম বিবিসি বাংলার শিরোনাম: 'বিচার-বহির্ভূত হত্যা বন্ধ করুন': সরকারপন্থী বুদ্ধিজীবীদের বিবৃতি"
গতকাল লিখেছিলাম যে বাংলাদেশের সুশীল সমাজের চামড়া চিড়িয়াখানার ৭ স্তর পুরু চামড়ার প্রাণীটার মতো যাকে শুক্রবার কাতু-কুতু দিলে বৃহস্পতিবার হো-হো করে হেঁসে উঠে। আজকে সকালে বিবিসির বাংলা সংবাদে দেখি বিচার-বহির্ভূত হত্যা বন্ধ করার আহবান জানিয়ে সরকার-পন্থী ১০ বুদ্ধিজীবী বিবৃতি দিয়েছেন। বিবৃতি দেওয়া ১০ বুদ্ধিজীবীকে সরকার পন্থি হিসাবে আমি চিহ্নিত করি নাই; সংবাদ মাধ্যম বিবিসি তাদের সংবাদ শিরোনামেই তাদেরকে সরকার পন্থি হিসাবে পরিচয় দিয়েছে। ঐ ১০ জনের মধ্যে দেখে জাতির বিবেক হিসাবে পরিচয় পাওয়া শ্রদ্ধেয় আনিসুজ্জামান স্যার ও কথাসাহিত্যিক হাসান আজিজুল হকও আছে। অবশিষ্ট ৮ জনকে অবশ্য সরকার পন্থি না বলে সরকারি দল কর্মী হিসাবে পরিচয় করিয়ে দিলেই যথার্থ সম্মান জানানো হয় তাদেরকে।
শ্রদ্ধেয় আনিসুজ্জামান স্যার ও কথাসাহিত্যিক হাসান আজিজুল হককে বলতে চাই যে আজকে টেকনাফ পৌরসভার কমিশনার ও যুবলীগ নেতা একরামের ক্রসফায়ারের অডিও শুনে ও একরামের মেয়ের কান্নায় ভেঙেপড়া ছবি দেখে যে বিবৃতিটা দিলেন সেই একই বিবৃতি যদি ছাত্রদল নেতা জনির বুকে ১৬ টা গুলি ও জনির মায়ের কান্নায় ভেঙেপড়া ছবি দেখার পড়েই দিতেন তবে আজকে হয়ত "আব্বু তুমি কান্না করতেছো যে?" প্রশ্নটা আপনার-আমার-আমাদের কানে ধ্বনিত হতোনা। হবিগঞ্জের চুনারুঘাট পৌরসভা ৯ নং ওয়ার্ড়ের কমিশনার যুবদল নেতা ইউনুছ আলীর ৪ শিশু সন্তানের কান্নায় ভেঙেপড়া ছবিটাও দেখতে হতো না। আপনাদের বিবৃতি দেখে বাংলা ভাষার প্রবাদ "সেই তো নত খসালী, তো মানুষ ক্যান হাঁসালি !" মনে পড়ে গেল।
শ্রদ্ধেয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামান ও কথাসাহিত্যিক হাসান আজিজুল হক স্যার, আমরা কিন্তু কোন প্রকার মামলাহীন ছাত্রদল নেতা জনির বুকে ১৬ টা গুলি দেখেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন জার্মান বুদ্ধিজীবী মার্টিন নিম্যোলার নাৎসি বাহিনীর গণহত্যা দখে নিশ্চুপ থাকা ও নিজের শেষ পরিণতির কথা মনে করিয়ে দিয়ে সাবধান করে দিয়েছিলাম। সেই সাথে মার্টিন নিম্যোলারের নিম্নোক্ত শেষ কবিতাটা আবারও আপনাদেরকে পড়ে দেখার অনুরোধ করেছিলাম।
"যখন ওরা প্রথমে কমিউনিস্টদের জন্য এসেছিল, আমি কোনো কথা বলিনি,
কারণ আমি কমিউনিস্ট নই।
তারপর যখন ওরা ট্রেড ইউনিয়নের লোকগুলোকে ধরে নিয়ে গেল, আমি নীরব ছিলাম,
কারণ আমি শ্রমিক নই।
তারপর ওরা যখন ফিরে এলো ইহুদিদের গ্যাস চেম্বারে ভরে মারতে,আমি তখনও চুপ করে ছিলাম,
কারণ আমি ইহুদি নই।
আবারও আসল ওরা ক্যাথলিকদের ধরে নিয়ে যেতে,আমি টুঁ শব্দটিও উচ্চারণ করিনি,
কারণ আমি ক্যাথলিক নই।
শেষবার ওরা ফিরে এলো আমাকে ধরে নিয়ে যেতে,
আমার পক্ষে কেউ কোন কথা বলল না, কারণ, কথা বলার মত তখন আর কেউ বেঁচে ছিল না।"
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা জুন, ২০১৮ দুপুর ১:১২