somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

কোটা সংস্কার আন্দোলন - বিকৃতি, বিভ্রান্তি এবং আমাদের রাজনৈতিক নির্বুদ্ধিতা

১১ ই এপ্রিল, ২০১৮ বিকাল ৩:৪৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে দমন-নিপিরনের ইতিহাস অনেক পুরনো। বিভিন্ন সময়ে ঔপনিবেশিক শাসনের কারনে, শোষকদের হাতে নিপীড়িত হওয়ার শিক্ষা আমাদের স্বাধীন দেশের শাসকরা ভালই রপ্ত করেছেন। স্বাধীনতার পর থেকে আজ পর্যন্ত আমাদের অনেক যৌক্তিক দাবী আদায়ের জন্যও রাজপথে রক্তাক্ত হতে হয়েছে। যদিও সেগুলোর বেশীরভাগই কোন না কোন ভাবে দলীয় বা রাজনৈতিক সার্থ হাসিলের জন্য। এই আন্দলোন আর রাজপথ দখলের লড়াইয়ে ছাত্র রাজনীতির প্রতিফলনটা সবসমই থেকে গেছে বিতর্কিত। বিগত কয়েক দশকের মধ্যে হাতে গুনা ২/৩ বার ছাত্রদের আন্দোলনকে সত্যিকার অর্থে ছাত্র আন্দোলন বলা যাবে, যেখানে ছাত্ররা কোন রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে রাজপথে নামে নি। তারা নেমেছিলো কিছু যৌক্তিক দাবি নিয়ে, যা সব ছাত্রের জন্য কাঙ্ক্ষিত।

সাম্প্রতিক সময়ের সবচেয়ে বড় এবং আলোচিত ছাত্র আন্দোলন “কোটা সংস্কার আন্দোলন”। এই আন্দোলনের কিছু বিষয় নিয়ে আমার দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরার চেষ্টা করছি মাত্র।

১। কোটা পদ্ধতির মূল উদ্দেশ্যঃ মুক্ত বাজার অর্থনীতি এবং রক্ষণশীল অর্থনীতিতে একটি তথ্য বেশ প্রচলিত – Feed the Baby, Protect the Child, Free the Adult! এই তথ্যের মূল কথাই হচ্ছে একটি অনগ্রসর বা নতুন প্রতিষ্ঠিত কোন শিল্পকে বিকশিত হওয়ার সুযোগ দেয়ার জন্য সরকার সম্ভাব্য সবকিছু করবে, কিন্তু সেটা একটা নির্দিষ্ট সময় (Free the ADULT)পর্যন্ত। বাংলাদেশে কোটা পদ্ধতিরও মূল উদ্দেশ্য দেশের অনগ্রসর জনগোষ্ঠীকে তুলনামূলকভাবে একটু বেশি সুযোগ-সুবিধা দিয়ে অগ্রসর গোষ্ঠীতে পরিণত করা। যাতে করে দেশে কোনো প্রকার বৈষম্যের সৃষ্টি না হয়। কিন্তু বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে কোটা পদ্ধতি বৈষম্যে কমানোর বদলে বৈষম্যে সৃষ্টি করছে। একটি কার্যকর এবং দায়িত্বশীল জন প্রশাসন তৈরির জন্য মেধাকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। আর মেধাকে অগ্রাধিকার দিতে হলে কোটা পদ্ধতির সংস্কারের কোনো বিকল্প নেই।

২। কোটা পদ্ধতি বিলুপ্ত নয় সংস্কার চাইঃ কোটা পদ্ধতি নিয়ে চলমান আন্দোলনের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দিক হচ্ছে এর সংস্কার প্রস্তাব। এই আন্দোলনের সাথে প্রতক্ষ্য এবং পরোক্ষ ভাবে জড়িত সবার এটা বুঝতে হবে যে এই আন্দোলন কোটা পদ্ধতি বিলুপ্ত করার দাবি নিয়ে। এই আন্দোলনের মূল বক্তব্যই হচ্ছে সরকারি চাকরিতে চলমান বৈষম্য কমাতে কোটা পদ্ধতির সংস্কার। আর এই সংস্কারের সবচেয়ে বড় যৌক্তিকতা বাংলাদেশের চলমান পরিতস্তিতি। বর্তমান সময় আর পরিস্তিতির বিবেচনায় যে কোটা পদ্ধতি চালু আছে তা নিতান্তই অমূলক এবং এই পদ্ধতির সংস্কার সময়ের দাবি।

৩। কোটা সংস্কার আন্দোলন মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিরোধী নয়ঃ কোটা সংস্কারের এই চলমান আন্দোলনের সবচেয়ে বড় ভ্রান্তি এটাকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিরোধী আন্দোলন হিসেবে প্রতিষ্ঠার চেষ্টা। মুক্তিযুদ্ধ আমাদের ইতিহাসের সবচেয়ে স্পর্শকাতর এবং শদ্ধার জায়গা। অতীতেও অনেকবার মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে চেতনা ব্যবসায়ীদের দৌরাত্ন আমারা দেখেছি। তরুণ প্রজন্ম অন্য যেকোন সময়ের চেয়ে বর্তমানে অনেক বেশী মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্ভূদ্য বলে মনে করি। বিদ্যমান কোটা পদ্ধতির সংস্কারের আন্দোলন বিসিএসে মুক্তিযোদ্ধা কোটা ৩০% সহ সর্বমোট ৫৬% কোটার বৈষম্য নিয়ে। সেখানে সংগত কারনেই মুক্তিযুদ্ধ কোটার প্রসঙ্গও আসছে, কিন্তু কেউই এককভাবে মুক্তিযুদ্ধের কোটার বিরুদ্ধে না। বাংলাদেশের দ্রোহের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশী উজ্জ্বল নাম আমাদের এই সূর্যসন্তান মুক্তিযোদ্ধাদের নাম। এই বৈষম্য দূর করলে সত্যিকার মুক্তিযুদ্ধদের স্বপ্ন সার্থক হবে বলেই বেশীর ভাগ মানুষের ধারণা।

৪। কোটা সংস্কার আন্দোলনকে রাজনৈতিক ভাবে ব্যবহারের সুযোগ নেইঃ দুঃখজনক হলেও এটা সত্য যে, কিছু মানুষ এই চলমান আন্দোলনকে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহারের চেষ্টা করছে। এখানে কোন রাজনৈতিক গুষ্টির ষড়যন্ত্র খোঁজা অযৌক্তিক এবং অবান্তর। একজন ছাত্রের অর্থনৈতিক নিরাপত্তা তার নিজের পাশাপাশি তার পরিবারের জন্য অস্তিত্বের প্রশ্ন, এটাকে রাজনৈতিক বিবেচনায় দমনের চেষ্টা না করে শান্তিপূর্ন সমাধানের চেষ্টা অনেক বেশী সহজ এবং প্রত্যাশিত। আর এ ক্ষেত্রে জনমত প্রাধান্য দিলে সরকারের জন্য কাজটা অনেক সহজই হবে কারণ শুধু সাধারণ মানুষ নয়, দেশের সুশীল সমাজও বিদ্যমান এই কোটা পদ্ধতির সংস্কার করে মেধাকে প্রাধান্য দেওয়ার পক্ষে মত দিচ্ছেন।


এবার আসি চলমান এই আন্দোলনকে ঘীরে ঘটে যাওয়া কিছু অপ্রত্যাশিত এবং অপ্রীতিকর ঘটনা প্রসঙ্গে। কোটা সংস্কারের এই আন্দোলনকে সামনে রেখে ঘটে যাওয়া কিছু ঘটনা এই যৌক্তিক দাবিকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার ইঙ্গিত দিচ্ছে। ছাত্রদের এই আন্দোলনকে সহিংস রুপ দিতে বা উস্কানি দিতে বেশ কিছু ঘটনা ইতিমধ্যে ঘটানো হয়েছে। নীচে তার মধ্যে কয়েকটি ঘটনার দিকে আলোকপাত করছি।

১। আন্দোলনরত ছাত্রদের উপর পুলিশের নিপীড়নঃ একটি স্বাধীন দেশে যৌক্তিক একটি দাবি নিয়ে রাষ্ট্র পক্ষের কোন ফলপ্রসূ আলোচনার চেষ্টা ছাড়াই আন্দোলনরত ছাত্রদের উপর পুলিশের দমননীতি সার্বিকভাবে মানুষের কাছে সরকারের অবস্থান দূর্বল করে দিচ্ছে। রাষ্ট্র পক্ষের এই নীতি ছাত্রদের মধ্যে ক্ষোভ আরো বাড়াবে, কমাবে না। এই আন্দোলনে বাধা দেওয়া কোন ভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। এই বৈষম্যমূলক কোটা পদ্ধতি একটি প্রজন্মকে পুরো রাষ্ট্র ব্যবস্থার বিরুদ্ধে দার করিয়ে দিচ্ছে।

২। ভিসির বাড়িতে হামলা এবং ভাংচুরঃ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মানিত ভিসির বাড়িতে হামলা এই আন্দোলনকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার প্রচেষ্টা মাত্র। যেখানে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকসহ দেশের জ্ঞানি-গুনিজন সবাই কোটা পদ্ধতি সংস্কারের পক্ষে মত দিচ্ছেন, সেখানে এই রকম ঘটনা আন্দোলনের সাথে জড়িতদের বিব্রতকর অবস্থায় ফেলতে পারে বলে মনে করি।

৩। কৃষি মন্ত্রীর ‘রাজাকেরের বাচ্চা’ তত্ত্বঃ শুধুমাত্র রাজনৈতিক অবস্থান বিবেচনায় মাননীয় কৃষি মন্ত্রীর জাতীয় সংসদে কোটা সংস্কারের আন্দোলনকারীদের ‘রাজাকারের বাচ্চা’ বলাটা চরম নিন্দনীয় এবং আপত্তিকর। উনার তত্ত্ব যদি মেনে নেই তাহলে বর্তমানে এই দেশের বেশিরভাগ লোকই রাজাকার অথবা রাজাকারের বাচ্চা। এবং যে সরকারের মন্ত্রিত্ব নিয়ে আপনি সংসদে সেই সরকার রাজাকারদের সমর্থন নিয়েই ক্ষমতায় আছে।

পরিশেষে বলবো, কোটা পদ্ধতির সংস্কার এখন সময়ের দাবি। দেশের বৃহত্তর বেকার জনগোষ্ঠীকে সরকারি চাকরিতে আরো বেশী সুযোগ দিলেই দেশের সার্বিক উন্নয়ন সম্ভব। আর মুক্তিযোদ্ধাদের মত সূর্য সন্তানদের বিতর্কিতভাবে এই আন্দোলনে জড়িয়ে তাদের অবদানকে ছোট না করার অনুরোধ করছি। একজন চাকরি প্রত্যাশী ছেলের ভিতরে কতটা আগ্নেয়গিরি সুপ্ত আছে তা শুধু সেই জানে। এই আন্দোলন কোন সৌখিন শোভাযাত্রা না, এটা কোন চেতনা ব্যাবসায়ীদের চেতনা বিক্রির বাজার না। একজন বেকার যুবকের চাকরি থেকে বঞ্চিত হতে হতে অক্ষমতার যন্ত্রনায় পরিবার-সমাজের বাঁকা চোখের চাহনিতে ক্ষতবিক্ষত বাঘের হুঙ্কার। প্রতি রাতে বালিশে মাথা গুঁজে বালিশ ভেজানো চাপা কান্নার রাজপথে দ্রোহের রুপ।
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই এপ্রিল, ২০১৮ বিকাল ৩:৪৭
১টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

কুড়ি শব্দের গল্প

লিখেছেন করুণাধারা, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:১৭



জলে ভাসা পদ্ম আমি
কোরা বাংলায় ঘোষণা দিলাম, "বিদায় সামু" !
কিন্তু সামু সিগারেটের নেশার মতো, ছাড়া যায় না! আমি কি সত্যি যাবো? নো... নেভার!

সানমুন
চিলেকোঠার জানালায় পূর্ণিমার চাঁদ। ঘুমন্ত... ...বাকিটুকু পড়ুন

ধর্ম ও বিজ্ঞান

লিখেছেন এমএলজি, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৪:২৪

করোনার (COVID) শুরুর দিকে আমি দেশবাসীর কাছে উদাত্ত আহবান জানিয়ে একটা পোস্ট দিয়েছিলাম, যা শেয়ার হয়েছিল প্রায় ৩ হাজারবার। জীবন বাঁচাতে মরিয়া পাঠকবৃন্দ আশা করেছিলেন এ পোস্ট শেয়ারে কেউ একজন... ...বাকিটুকু পড়ুন

তালগোল

লিখেছেন বাকপ্রবাস, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৩৫


তু‌মি যাও চ‌লে
আ‌মি যাই গ‌লে
চ‌লে যায় ঋতু, শীত গ্রীষ্ম বর্ষা
রাত ফু‌রা‌লেই দি‌নের আ‌লোয় ফর্সা
ঘু‌রেঘু‌রে ফি‌রে‌তো আ‌সে, আ‌সে‌তো ফি‌রে
তু‌মি চ‌লে যাও, তু‌মি চ‌লে যাও, আমা‌কে ঘি‌রে
জড়ায়ে মোহ বাতা‌সে ম‌দির ঘ্রাণ,... ...বাকিটুকু পড়ুন

মা

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৩


মায়াবী রাতের চাঁদনী আলো
কিছুই যে আর লাগে না ভালো,
হারিয়ে গেছে মনের আলো
আধার ঘেরা এই মনটা কালো,
মা যেদিন তুই চলে গেলি , আমায় রেখে ওই অন্য পারে।

অন্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

কপি করা পোস্ট নিজের নামে চালিয়েও অস্বীকার করলো ব্লগার গেছে দাদা।

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:১৮



একটা পোস্ট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ আগে থেকেই ঘুরে বেড়াচ্ছে। পোস্টটিতে মদ্য পান নিয়ে কবি মির্জা গালিব, কবি আল্লামা ইকবাল, কবি আহমদ ফারাজ, কবি ওয়াসি এবং কবি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×