গত কয়েক মাসে আনিস স্বপ্নে শুধু পাখি দেখতে পাচ্ছে। লাল, নীল, বেগুনী সহ নানা বর্ণের প্রচুর পাখি। প্রথম প্রথম পাখিগুলো কোন ডাকাডাকি না করে ওকে বৃত্তের কেন্দ্র বানিয়ে চারিদিকে শুধু উড়ে বেড়াতো। কিন্তু ইদানীং পাখিগুলো আরো নিচে এসে উড়ছে, কা কা করে ডাকছে। আনিস অত্যন্ত অবাক হয়ে লক্ষ্য করল, এই সবগুলো পাখি হচ্ছে কাক! মনে মনে ভাবল, কাক আবার রঙিন হয় নাকি?
হঠাৎ ও দেখল, একটা নীল রঙের কাক ডাইভ দিয়ে ওর পাশে এসে বসল। চমৎকার কিন্নর কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল, আচ্ছা আপনি কি বলতে পারেন এই শহরে কাকদের পরিচয় কি? শুধু কাউয়া না পাখি?
আনিস প্রশ্ন শুনে কিছুটা থতমত খেলো। সে কাকের জবাবে পাখি বলতে গিয়েও থমকে গেলো। মনে হলো চারিদিকে কারা যেন অট্টহাসি হাসছে। সেই অট্টহাসির মাঝে কে যেন ফিসফিস করে বলছে, এই শহরে কাক বলে কোন পাখি নেই, কাক মানে কাউয়া।
আবার অট্টহাসি শুরু। এবার আরো তীক্ষ্ণ।
হঠাৎ আনিসের মাথা ব্যথা শুরু হলো। অট্রোহাসির শব্দ মাথা থেকে দুর করতে নিজ হাতে ওর দুই কান সে চেপে ধরল। কিছুক্ষণ পর সব চুপচাপ, নিস্তব্ধ। সেই অপার্থিব ফিসফিসানি এখন আর নেই। দুরে মাইকে আজান শব্দ শোনা যাচ্ছে। ধীরে ধীরে আলো ফুটছে এই শহরে। আনিস বারান্দার গ্রীল ধরে কাঁপা কাঁপা পায়ে উঠে দাঁড়ালো। চেয়ে দেখল, ধূসর কালো চূড়ান্ত পরিণতি মেনে হারিয়ে যাচ্ছে মিষ্টি স্নিগ্ধ আলোতে। বাতাসে শীতের গন্ধ, আলস্যের হাতছানি।
বাসার সামনের ডাস্টবিনটা একেবারে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। কোন উপচে পড়া ময়লা তো দূরে থাক, সামান্য ময়লার টিকিও দেখা যাচ্ছে না। বরং একটা বেড়ালকে দেখা গেলো হতাশ হয়ে ডাস্টবিনের পাশের দেয়ালে ঝিম মেরে দাঁড়িয়ে আছে।
কা কা! হঠাৎ তীক্ষ্ণ ডাকে চমকে উঠল আনিস। একটা ছোট কালো কাক এসে রেলিং বসেছে। দূরে অনেকগুলো রঙিন কাক উড়াউড়ি করছে। স্পষ্টত বুঝতে পারল, তাকে দেখে কিছুটা অস্থিরতা বাড়ছে কাকগুলোর মধ্যে। ছোট কাকটা আবারও করুণভাবে কা কা করে উঠল। ওর ডাক শুনে মনে হলো সে যেন বলতে চাইছে - কালো কালো করিস না লো, ও গোয়ালের ঝি, আমায় বিধাতা করেছে কালো আমি করব কি?
আনিস রঙিন কিছুটা বিভ্রান্ত হয়ে কাকগুলোর দিকে আবারও তাকালো। সবগুলো কাক বারান্দার পাশের আম গাছে বসে ওর দিকে সর্তক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। যেভাবে পুলিশ কোন অপরাধীকে গ্রেফতার করার আগে তীক্ষ্ণ চোখে পর্যবেক্ষণ করে, ঠিক সেইভাবে।
আনিসের খুব ক্লান্ত লাগছে। রাত জাগা ক্লান্তি সকালে ঠাণ্ডা বাতাসে ওর চোখ বন্ধ হয়ে এলো। হঠাৎ দেখল, কাকগুলো সব উড়তে শুরু করেছে, ধীরে ধীরে ডাইভ দিয়ে তারা নেমে আসছে বারান্দার দিকে। আনিস নির্জীব ভাবে পড়ে আছে। কালো কাকটা তীক্ষ্ণ স্বরে শুধু কা কা করে ডেকেই যাচ্ছে।
একটা রঙিন কাক আনিসের কাঁধে সাবধানে এক পা দিলো। কিছুক্ষণ পর্যবেক্ষণ করে, আস্তে করে তুলে দিলো আরেক পা। এরপর আরো একটা, তারপর আরো একটা, আস্তে আস্তে সব কাক ঘিরে ধরল আনিসকে। আনিস টের পেলো, কাকগুলো প্রচণ্ড ক্ষুধার্ত। ক্লান্ত হয়ে খুঁজে বেড়াচ্ছে কিছু পচা, গলিত আবর্জনা। কয়েকটা কাক যেন পাগল হয়ে গেছে, প্রাণান্ত চেষ্টা করছে ওর বুক পকেট থেকে কিছু একটা টেনে করতে। আনিসও সমানে দুই হাত দিয়ে বুক পকেট আগলে রাখার চেষ্টা করছে। অদ্ভুত এক অসম লড়াই। কিন্তু দুরে হঠাৎ কে যেন ফিসফিস করে বলে উঠল, আর কত দিন আনিস? আর কত দিন? তারচেয়ে এই ক্ষুধার্ত পাখিগুলোকে খেতে দাও, এরাই তো আবর্জনা খেয়ে পরিষ্কার রাখে সব কিছু।
চারিদিক হঠাৎ করে যেন প্রচণ্ড গতিতে পিছনে চলতে শুরু করল। থামল, কয়েক বছর আগের এক পড়ন্ত বিকেলে। সেই বিকেলে কেউ একজন কথা রাখে নি। হাজারো রঙিন স্বপ্ন বুনা ক্যানভাস এক নিমিষে হয়েছে ধুসর। দুজনের ভালোবাসায় যে ছোট্ট ঘর আলোকিত হবার কথা ছিলো, সেই ঘরে আলো আর কখনও জ্বলে নি। বরং আলো জ্বলেছিলো শহরের সবচেয়ে বড় কমিউনিটি সেন্টারে, কৃত্রিম আলোয় এই অন্ধকার শহরও সেদিন আলোকিত হয়ে ছিলো। আভিজাত্য এবং অর্থের কাছে সেদিন পরাজিত হয়েছিলো একজন মানুষ। তিন বছরের প্রেম তখন একটি প্রহসন, ডাস্টবিনের নোংরা আবর্জনা।
ফিসফিসে কণ্ঠস্বরটা আরো জোরালো হয়েছে। প্রচণ্ড অনুনয় করে বলছে, প্লীজ, ছেড়ে দাও, আর কত?
আনিস ধীরে ধীরে বুকের উপর থেকে দুই হাত সরিয়ে নিলো। লড়াই শেষ বুঝতে পেরে কাকগুলোও ভীষণ আগ্রাসী। জ্ঞান হারাবার আগে আনিস টের পেলো, কয়েক জোড়া ঠোঁট ধীরে ধীরে ওর পকেট থেকে টেনে হিঁচড়ে বের করছে তানিয়া নামের একটি মেয়ের বিবর্ণ ছবি।
চোখ বন্ধ করেই টের পেল চারিদিকে শুরু হয়েছে ভোজন উৎসব।
সর্বশেষ এডিট : ১২ ই নভেম্বর, ২০১৮ সন্ধ্যা ৬:২৯