শিশুবয়সে আমারদেখা গৌরবময় মুক্তিযুদ্ধ-২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
Tweet
আমাদের কোয়ার্টারে ফিরে এসে দেখলাম সব আগের মতোই আছে।আমাদের গার্ড নিজামভাই এখানেই ছিল,তিনি আম্মাকে দেখে ঢুকরে কেধে উঠলেন।যাক আমি আর ভয়ে বাসা থেকে বের হইনা।তবে জানালার ফাক দিয়ে রাস্তার দিকে তাকিয়ে দেখতাম একদম ফাকা রাস্তা,শুধু মিলিটারীর টহল ট্রাক সামনে এক আর্মী স্টেনগান তাক করে দাড়িয়ে থাকতে দেখা যেত।এদিকে আব্বা অফিস যাওয়া শুরু করলেন নাহলে মিলিটারী নাকি ধরে নিয়ে যাবে।অন্যদিকে আস্তে আস্তে অনেক প্রতিবেশীরাই ফিরে আসা শুরু করলো।আমরাও মনে সাহস পেতে শুরু করলাম।দুই-তিন দিনের মধ্যে এখানে কিছু নুতন নেতার নাম শোনা যেতে লাগলো। তারা সবাই মিলিটারীদের সঙ্গে মিলে কিছু কমিটি গঠন করলো,যেমন শান্তি কমিটি।আমার মনে পড়ে তাদের একজন ছিল প্রফেসর খালেক। তার বাসা ছিল বিশ্বাস বেতকাতে।আগে আমরা তার বাড়ীর সামনে গোল্লাছুট/দারিয়াবান্দা খেলতে যেতাম।কিন্তু মিলিটারী আসার পর সে হয়ে উঠলো প্রবল প্রতাপশালী।তার বাড়ীতে নাকি প্রায় সব সময়ই মিলিটারীর আসা যাওয়া ছিল।এছাড়া আরেক জন ছিল ভাদুমিয়া কন্ট্রাক্টর।আমাদের এলাকাতে এরা দুজনই ছিলেন,যারা সবাইকে অভয় দিয়ে পাকিস্তানের সঙ্গে মিলে মিশে থাকার আহবান জানালেন।শান্তি কমিটির অনেক নেতার নাম আমার মনে নেই তবে তারা ঘড়ে ঘড়ে গিয়ে আমাদের মতো আটকেপড়া অসহায় লোকদের শান্তির বাণী শোনাতে লাগলো!সেই সঙ্গে গঠিত হলো কুখ্যাত আল-শামস ও রাজাকার বাহিনী!
মিলিটারীরা শহরে ঢুকেই তিন চারদিনের মধ্যে জামায়াত নেতাদের সহায়তায় হিন্দুদের সোনার দোকান সহ অন্যান্য ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলা চালিয়ে লুটপাটের ব্যবস্থা করে দিলেন।কিছু সংখ্যক লম্পট এই লুটপাটে অংশ নিলেন।এরপর দুই-তিন মাস টাংগাইল শহর বেশ শান্ত ছিল।আমরা বাইরে বের হতাম আইডেন্টিটি কার্ড (মিলিটারী ভাষায় ডান্ডি কার্ড)সঙ্গে করে এবং বুকে ছোট্ট আকারে পাকিস্তানী ফ্লাগ লাগিয়ে।তবে আমাদের বয়সের কাউকে তারা কিছু বলতনা।এদিকে একদিন আব্বাকে চেক পোস্টে ধরে খুবই নাজেহাল করলেন তিনি মুসলমান কিনা প্রমান দিতে সূরা পড়ে শোনাতে হয়েছিল।তাছারা মুসলমানদের মুখে দাড়ি থাকে তিনি কেন রাখেননি?এরপর আব্বা ওদের প্রচন্ড ঘৃনা করতে শুরু করেন।এদিকে কা্লো ড্রেস পড়ে রাজাকাররা সারা দিন টহল দেয়া শুরু করলো। তবে রাত আটটার পর তাদেরকে আর দেখা যেতনা।এই রাজাকার বাহিনীতে পাড়ার অনেক বেকার লোক এবং জামায়াত ইসলামীর ক্যাডাররা ঢুকে ছিল।আজ কাল টিভি টক শোতে দেখা জাতীয় পার্টির(মঞ্জু) মহাসচিব সাদেক সিদ্দিকীও এই রাজাকার বাহিনীতে অনেকদিন কাজ করেছেন। তবে দেশ স্বাধীন হওয়ার কিছুদিন আগে অস্রসহ মুক্তি বাহিনীতে যোগ দিয়েছিলেন।এভাবে অনেক রাজাকারই তখন দল বদল করেছিল!
আমরা মুক্তি যুদ্ধের খবর সাধারনতঃ বিবিসি বাংলা,আকাশবাণী কলকাতা আর স্বাধীনবাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে শুনতাম।এই অনুষ্ঠানগুলি খুবই গোপনে আস্তে আস্তে শুনতে হতো কারন রাজাকাররা জানতে পারলে ধরিয়ে দেয়ার ভয় ছিল।স্বাধীনবাংলা বেতারে মুক্তিসেনাদের বিরত্বগাথা চরমপত্র নামক একটি অনুষ্ঠানে খুব রসালোভাবে পড়ে শুনাতো। আমরা গোপনে শুনতাম আর আনন্দে হাসতাম।এই চরমপত্র অনুষ্ঠানে মুক্তিসেনাদের বিচ্ছু আর টাংগাইলের মুক্তিবাহিনী প্রধানকে বাঘা সিদ্দিকী বলা হতো।রেডিও থেকেই শুনেছিলাম বাঘা সিদ্দিকী টাংগাইলের আসপাশে চোরা গুপ্তা (গেরিলা) হামলা করে মিলিটারীদের ব্যস্ত করে রেখেছিল।ভূয়াপুর নদীতে তারা অস্র বোজাই জাহাজ ডুবিয়ে দিয়ে সব অস্র মুক্তিরা দখল করে নিয়েছিল।এইসব খবর তখন আমাদের যে কি আনন্দ দিত ভাষায় বুজানো যাবেনা।আমরা প্রায় প্রতি দিনই এই বাঘা সিদ্দিকীর বীরত্ব গাথা কাহিনী রেডিওতে শুনতাম।যাদের বয়স বারো-চৌদ্দ পেরিয়ে গিয়েছে এমন ছেলেরা তখন দলে দলে মুক্তি যুদ্ধে যোগ দেয়া শুরু করলো।প্রায় প্রতি রাতেই বাবা-মার অগোচরে তারা চলে যেত মুক্তি যুদ্ধে।আর এরাই ট্রেনিং শেষে ফিরে এসে শহরে গেরিলা অপারেশন শুরু করলো।তখন রুপবানী সিনেমা হলে খুব ঊর্দু সিনেমা চলতো।এক শো’তে মুক্তিরা সেখানে গ্রেনেড মেরে দিল, ফলে সেই হল হয়ে গেল বন্ধ!
তবে দিনের বেলায় শহর ছিল নিরাপদ।আমরা সকালে স্কুলে যেতাম আর ফিরে এসে ভাত খেয়েই দৌড় দিতাম খেলতে যেতে।একদিন যেতে যেতে দেখলাম এক হিন্দু বাড়ী হঠাৎ করে রাজাকার আর মিলিটারী মিলে ঘিড়ে ফেললো।আমি এগিয়ে যেতেই আমার এলাকার তারামিয়া রাজাকার আমাকে দূরে থাকতে বললো।আমি দূর থেকেই দেখলাম শুন্যবাড়ীতে পাউডার জাতীয় কিছু ছিটিয়ে ফায়ার করল।আর সঙ্গে সঙ্গে বাড়ীতে আগুন লেগে গেল!তাদের নাকি ধারনা ছিল রাতে এখানে মুক্তিরা থাকে।
ঈদের বাজার করতে আব্বার সঙ্গে একদিন কাচাবাজারে গেলাম।গিয়ে দেখি বাজার ভর্তি রাজাকারের দল। ব্যপার কি? শুনলাম তারা এসেছে বাজারদর স্থিতি রাখতে।আমরা দুধের বাজারে গিয়ে দেখি দাম একটু বেশি বেশি।এক খদ্দের গিয়ে খোকা রাজাকারকে অভিযোগ করলেন।দুধওয়ালা ছিল বুড়ো,খোকা এসে বললো কি রে চাচা দাম বেশী নেন কেন? দুধওয়ালা উত্তরে শুধু বলেছিল আমি এর কমে বেচবোনা।ব্যস তাকে কসাইয়ের টঙ্গে উঠিয়ে ঘোড়ার চাবুক দিয়ে সেকি মার।আমরা বাজার বাদেই ভয়ে সেদিন ফিরে এসেছিলাম। এই খোকা রাজাকার আর কেউনা আমাদের নায়ক মান্নার চাচা ছিলেন।
ডিসেম্বর মাসে শিবনাথ হাই স্কুলের মাঠে বিকালে টেনিস বল দিয়ে আমরা ক্রিকেট খেলতাম।সব বড়রা কেঊ মূক্তিসেনা কেউ রাজাকার কেউবা পালিয়ে আছে।তাই আমাদে্র ছোটদেরই রাজত্ব তখন।তবে আমরা যখন খেলতাম পাকিস্তানী মিলিটারীরা জীপে বসে আমাদের খেলার আমুদে দর্শক হতো।কখনো কখনো হাত তালি দিত আবার খেলা শেষে আমাদের চকলেটবার (তখন খোলা বাজারে পাওয়া যেতনা) উপহার দিত।একদিন এক ছেলে (ক্ষমা কর তুমি আমার ক্লাশমেট ছিলে অথচ নাম মনে নেই)খুউব ভাল খেলা খেললো।সে অনেক চকলেট আর বাহবা পেল।সে সন্ধ্যে বেলায় বাসায় যেতে যেতে আমাকে বলেছিল তারা গ্রামের বাড়ী চলে যাচ্ছে। পরদিন করোটিয়া ব্রিজে মুক্তিসেনাদের পুতে রাখা মাইন বিস্ফোরনে বাসের আরোহী হয়ে সে শহীদ হলো। শেষ দেখার দিন তার পড়নে ছিল ব্লু-সার্ট ,আমি আজও দেখতে পাই ব্লুসার্ট পরিহিত আমার সেই ছোট্ট শহীদ বন্ধুটিকে। (চলবে)
৩টি মন্তব্য ৩টি উত্তর
আলোচিত ব্লগ
কষ্ট থেকে আত্মরক্ষা করতে চাই
দেহটা মনের সাথে দৌড়ে পারে না
মন উড়ে চলে যায় বহু দূর স্থানে
ক্লান্ত দেহ পড়ে থাকে বিশ্রামে
একরাশ হতাশায় মন দেহে ফিরে।
সময়ের চাকা ঘুরতে থাকে অবিরত
কি অর্জন হলো হিসাব... ...বাকিটুকু পড়ুন
রম্য : মদ্যপান !
প্রখ্যাত শায়র মীর্জা গালিব একদিন তাঁর বোতল নিয়ে মসজিদে বসে মদ্যপান করছিলেন। বেশ মৌতাতে রয়েছেন তিনি। এদিকে মুসল্লিদের নজরে পড়েছে এই ঘটনা। তখন মুসল্লীরা রে রে করে এসে তাকে... ...বাকিটুকু পড়ুন
মেঘ ভাসে - বৃষ্টি নামে
সেই ছোট বেলার কথা। চৈত্রের দাবানলে আমাদের বিরাট পুকুর প্রায় শুকিয়ে যায় যায় অবস্থা। আশেপাশের জমিজমা শুকিয়ে ফেটে চৌচির। গরমে আমাদের শীতল কুয়া হঠাৎই অশীতল হয়ে উঠলো। আম, জাম, কাঁঠাল,... ...বাকিটুকু পড়ুন
= নিরস জীবনের প্রতিচ্ছবি=
এখন সময় নেই আর ভালোবাসার
ব্যস্ততার ঘাড়ে পা ঝুলিয়ে নিথর বসেছি,
চাইলেও ফেরত আসা যাবে না এখানে
সময় অল্প, গুছাতে হবে জমে যাওয়া কাজ।
বাতাসে সময় কুঁড়িয়েছি মুঠো ভরে
অবসরের বুকে শুয়ে বসে... ...বাকিটুকু পড়ুন
Instrumentation & Control (INC) সাবজেক্ট বাংলাদেশে নেই
শিক্ষা ব্যবস্থার মান যে বাংলাদেশে এক্কেবারেই খারাপ তা বলার কোনো সুযোগ নেই। সারাদিন শিক্ষার মান নিয়ে চেঁচামেচি করলেও বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরাই বিশ্বের অনেক উন্নত দেশে সার্ভিস দিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন