গণতান্ত্রিক শাসন ব্যাবস্থার অন্যতম প্রধান শর্ত হচ্ছে বাক স্বাধীনতা বা মতামত প্রকাশের স্বাধীনতা। একটি গণতান্ত্রিক শাসন ব্যাবস্থায় রাষ্ট্রের যে কোন ব্যাক্তি বা প্রতিষ্ঠান তাঁর নিজের মতামত স্বাধীন ভাবে প্রকাশ করতে পারবে এটাই বাক স্বাধীনতা। কিন্তু এখানে বিশদ ভাবে উল্লেখ করা না থাকলেও এটা সহজেই অনুমেয় যে বাক স্বাধীনতার সুযোগে আপনি কিছু কথা বলতে পারবেন না বা বলা উচিত না যেমনঃ কোন ব্যাক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে হেয় করতে পারে, বা সাধারন জনগনকে কোন খারাপ কাজে উতসাহিত করতে পারে এ ধরনের কোন মিথ্যা প্রচার করা।
গত কয়েকদিন আগে সম্পাদক পরিষদের নামে একটি বিবৃতি প্রকাশ করা হয়েছে যেখানে বলা হয়েছে যে দেশের সংবাদ মাধ্যম স্বাধীন নয়, এখানে সরকারের নগ্ন হস্তক্ষেপ আছে, সরকার মত প্রকাশে বাধা দিচ্ছে, টিভি চ্যানেল বন্ধ করছে এবং টক শো নিয়ন্ত্রন করছে ইত্যাদি ইত্যাদি। এই অভিযোগ গুলি কিন্তু করা হয়েছে বিভিন্ন গনমাধ্যমকে ব্যাবহার করেই। যারা এর পক্ষে নানা কথা বলছেন তাঁরা কিন্তু টক শো গুলিতে নিয়মিতই সরকারের বিপক্ষে নানা কথা বলে যাচ্ছেন, তাহলে সরকারের নিয়ন্ত্রন কোথায় ?
গতকাল রাতে চ্যানেল আই টিভিতে তৃতীয় মাত্রায় একমাত্র আলোচক ছিলেন নিউ এজ পত্রিকার সম্পাদক নুরুল কবীর সাহেব, এক ঘন্টার অনুষ্ঠানের প্রায় পুরোটাতেই উনি একাই কথা বলেছেন এবং সঞ্চালক জিল্লুর রহয়ান সাহেব যে প্রশ্নই করেনন না কেন উনি সব কিছুতেই সরকার এবং বর্তমান সরকারে আসীন আওয়ামী লীগের সমালোচনা করে গেছেন। রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক, জঙ্গিবাদ এমনকি অভিজিত রায় এর হত্যাকান্ডের মতো ইস্যুতেও তিনি সরকার এবং আওয়ামী লীগের সমালোচনা করে গেছেন। কোন কোন ক্ষেত্রে তিনি এমন কিছু কথাও বলেছেন, যা আমাদের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব এবং লিখিত ইতিহাসকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। এসব কথা বলার জন্য তাঁর বিরুদ্ধে আইনগত ব্যাবস্থা নেয়া উচিত বলে আমার মনে হয়। এখন এসব কথা বলার কারনে কেউ যদি তাঁর বিরুদ্ধে মামলা করেন এবং এতে উনি যদি গ্রেফতার হন তাহলে কিন্তু উনাদের (সম্পাদক পরিষদের) দেয়া সেই বিবৃতিটাই প্রমানিত হয়। তাহলে তো আমার মনে হচ্ছে উনি ইচ্ছে করেই এইসব বলেছেন যাতে তিনি গ্রেফতার হয়ে প্রমান করতে পারেন সরকার গনমাধ্যমের উপর দমন পীড়ন চালাচ্ছেন। এই ঘটনায় কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের একটি লেখা মনে পড়ে গেল “কাদম্বিনি মরিয়া প্রমান করিল সে মরে নাই”।
রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের নেতৃবৃন্দ তাঁদের বিপক্ষ রাজনৈতিক দল এবং তাঁদের কর্মকাণ্ডের সমালোচোনায় অনেক বক্তব্য বিবৃতি দিয়ে থাকেন, যেগুলোতে প্রায়শই আতিশয্য এবং অত্যুক্তি থাকে যা সমালোচিত হলেও নিন্দনীয় হিসেবে দেখা হয় না। এগুলো রাজনৈতিক বক্তব্য হিসেবেই ধরা হয়। কিন্তু কোন ব্যাক্তি যদি রাজনৈতিক পরিচয়ের বাইরে গিয়ে তাঁর পেশাগত পরিচয়ের গন্ডিতে কোন রাজনৈতিক দলের সমালোচনা করে তাহলে তাঁকে বিশেস সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত বলে আমি মনে করি। যেমন বর্তমানে বিএনপি আন্দোলনের মাঠে সরকারের নানাবিধ সমালোচনা করে আসছে, উদাহরন স্বরূপঃ গত ৫ ই জানুয়ারীর নির্বাচন অবৈধ, এবং এই সরকার অবৈধ। এটা রাজনৈতিক বক্তব্য, এতে সত্যতা নেই। গত ৫ ই জানুয়ারীর নির্বাচন অগ্রহণযোগ্য হতে পারে কিন্তু অবৈধ বলার সুযোগ নেই। কারন বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী এই নির্বাচন হয়েছে এবং যাতে জনপ্রতিনিধিত্ব আইন অনুসরন করা হয়েছে। এই আইনের কোথাও বলা নেই যে কমপক্ষে শতকরা কত ভাগ ভোট পরলে নির্বাচন বৈধ হবে। এবং এটাও বলা নেই যে কোন ভোট গ্রহন ছাড়া সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রার্থি একক প্রার্থিতার কারনে নির্বাচিত হলেও নির্বাচন অবৈধ হবে। তাঁর মানে সংবিধান এবং আইন অনুযায়ী এই নির্বাচন বৈধ, সুতরাং সরকার বৈধ। কিন্তু যেহেতু দেশের একটি অন্যতম বৃহত্তম দল এই নির্বাচনে অংশগ্রহন করেনি এবং ভোটার উপস্থিতিও অনেক অনেক কম ছিল তাই এই নির্বাচনে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের মতামত প্রতিফলিত হয়নি তাই এটি একটি অগ্রহণযোগ্য নির্বাচন। কিন্তু আবার এটা মনে করাও ঠিক হবে না যে, যেই সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ ভোট দানে বিরত ছিল তাঁরা সব সেই নির্বাচন বর্জিত দলের পক্ষে ভোট করতো। এই উপসংহারে পৌঁছানো ঠিক হবে না।
সুতরাং রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ তাঁদের রাজনৈতিক বক্তব্য হিসেবে এই সরকারকে অবৈধ, ফ্যাশিস্ট বা স্বৈরাচারী নানা ভাবে সমালোচনা করতে পারে কিন্তু কোন পেশাজীবী লোক তাঁর পেশাগত ক্যাপাসিটিতে এধরনের কথা বলা রাস্ট্রের বিরুদ্ধে কথা বলার শামিল, এটা বাক স্বাধীনতা নয়।
রাজনীতিতে একাধিক পক্ষ থাকে এবং এদের মধ্যে কমপক্ষে দুটি প্রধান পক্ষ বা জোট থাকে যারা একে অপরের প্রতিপক্ষ, এরা প্রায় সর্বদাই একে অন্যের বিরুদ্ধে লেগে থাকে, এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক কৌশল প্রয়োগ করে থাকে, যেমন বিরোধী পক্ষ সরকারের সমালোচোনা, গালি গালাজ এবং বিভিন্ন আন্দোলনের কর্মসূচি দিয়ে সরকারকে নাজেহাল করার চেস্টা করে আবার সরকারি দলও প্রশাসনিক বিভিন্ন ক্ষমতা ব্যাবহার করে বিরোধী পক্ষকে দমন করার চেস্টা করে, এখানে ন্যায় অন্যায় খুব বড় করে দেখা হয় না। এটা সব সময় সব সরকারের আমলেই হয়েছে কোন ক্ষেত্রে বেশী আবার কোন ক্ষেত্রে কম। কিন্তু একজন পেশাজীবী ব্যাক্তি যদি বিরোধী রাজনৈতিক নেতাদের মতো ভাষা ব্যাবহার করে সরকারের সমালোচনা করেন এবং সরকারও যদি সেই ব্যাক্তির বিরুদ্ধে প্রশাসনিক ক্ষমতা প্রয়োগ করেন তাহলে তো অন্যায় হয় না। তাই আমার হিসেবে পেশাগত দায়িত্বে থাকা ব্যাক্তিদের উচিত সরকারের কর্মকাণ্ডকে একটু হিসেব করে সমালোচনা করা, রাজনৈতিক বক্তব্য পরিহার করে আইন মেনে চলা।