এটি খুব ব্যস্ত পোর্ট ছিল না। আমাদেরকে বলা হল জাহাজ প্রায় এক সপ্তাহ এখানে থাকবে। তবু আমরা বাইরে যাবার জন্য ব্যস্ত ছিলাম। বিকাল পাঁচটায় ডিউটি শেষ করে ছয়টার একটু আগে ডিনার করে আমি আরো দুজনকে সাথে নিয়ে জাহাজ থেকে বের হলাম। এই পোর্ট থেকে মেইনলি কয়লা রপ্তানি হয়। ট্রেনের বগিতে করে কোন এক পাহাড় থেকে কয়লা আসে এখানে।
পুরো পোর্ট জুড়ে কয়লার স্তুপ করা। আমরা একেবারে জেটির কিনারা ঘেসে জাহাজগুলোর পাশ দিয়ে সামনের দিকে যেতে থাকলাম। বাইরে যাবার জন্য পথের নির্দেশনা জাহাজে থাকতে স্থানীয় ফোরম্যানের কাছ থেকে নিয়ে এসেছি। প্রায় পনেরো মিনিট হাটার পরে আমরা গেটে পৌছালাম। গেটে কর্তব্যরত অফিসার আমাদের গেটপাশ পরীক্ষা করে আমাদের ভেতরে যাবার অনুমতি দিল। এখানে ভেতর এবং বাহির শব্দদুটিতে একটু প্যাচ খেয়ে গেল। আমরা যখন জাহাজ থেকে নামি তখন বলি বাইরে যাচ্ছি। কিন্তু যখন পোর্টের গেট পার হই তখন কোন দেশের ভেতরে ঢুকি।
এখানে এখন শীতের শেষ সময় চলছে। বছরের দুই তিনটা মাস এখানে সামার থাকে। সেই সময়টা শুরু হবে হবে করছে। তাই রাস্তা ঘাটের বরফ গুলো গলে গেছে। গেট থেকে বেরিয়ে সোজা একটা রাস্তা চলে গেছে শহরের দিকে। আমরা হাটছিলাম। কতটা হেটে গেলে যে ঠিক শহরে পৌছাবো জানিনা। আমাদের প্রথম কাজ একটা সীম কার্ড কেনা। এর আগে রাশিয়ার মুরমান্সক থেকে কেনা সীম এখানে এক্টিভেট করেছিলাম এবং ফোরম্যানের মাধ্যেমে ১০ ডলার রিচার্জ করে বাসায় কল দিলে তিন মিনিটেই টাকা শেষ হয়ে গেল। রোমিং চার্জ যে এত বেশী হবে আমার জানা ছিল না।
হাটার পথে আমরা পথে দুই জন সঙ্গী পেলাম। ওলেগ এবং তার ইয়া বড় একটা ডগ। ওলেগ নিজেই আমাদের সাথে পরিচিত হল। সে পোর্ট থেকে বিশাল কুকুরটাকে শেকলে বেধে বাইরের দিকে যাচ্ছিল। আমি তাকে জিজ্ঞাসা করলাম সে কি করে? সে জানাল ‘পালিশ’। প্রথমটাতে আমি ভাবলাম বুট পালিশ নাকি?? পরে বুঝলাম সে আসলে পালিশ নয় পুলিশ। নিজের মনে মনে কতক্ষণ হাসলাম। ভ্যাগিস তাকে বুট পালিশ করে দিতে বলিনি।
ওলেগ আমাকে একটা সীম কার্ডের দোকান পর্যন্ত পৌছে দিল যে দোকানের ছেলেটা ইংরেজি জানে। এখানে বেশ সহজ ইন্টারনেট প্যাকেজের সীম পাওয়া যায়। আমি খুশিই হলাম। কিন্তু বিপত্তি বাধলো টাকা দেবার সময়। আমার কাছে রাশিয়ান লোকাল মানি নেই। এবং এই দোকানে ডলার চলবে না। দোকানের ছেলেটা আমাকে একটা ব্যাংকের পথ বাতলে দিল যেখান থেকে আমি দলার ভাঙিয়ে নিতে পারি। কিন্তু তখন প্রায় তার ৭ টা বেজে গিয়েছিল। কিছু ব্যাংকের ইভিনিং আওয়ার খোলা থাকবে বলে জানলাম কিন্তু আশেপাশে তেমন কোন ব্যাংক পেলাম না। শেষে আর এক রাশিয়ানের সহায়তায় একজন বয়স্কার সন্ধান পেলাম টাকা ভাঙানোর জন্য যে কিনা দৈনিক পত্রিকা এবং নানা ধরনের ম্যাগাজিন বিক্রি করে।
সীম কিনে আমরা বের হলাম শহরটা ঘুরে দেখতে। যতটুকু জেনেছি নাখোদকা শহরটা খুব বেশী বড় নয়। কাছাকাছি বড় শহরটার নাম ভ্লাডিভস্তোক। ঘড়িতে তখন সাতটার বেশী বাজে। কিন্তু সন্ধ্যা নামার কোন সম্ভাবনা নেই। এখানে সূর্যাস্ত হয় সাড়ে নয়টার পরে। আর আগে আমি যখন মুরমান্সক গিয়েছিলাম ওখানে দেখেছি রাত ১২ টার পরে সূর্যাস্ত হতে।
(১) সুন্দর একটা বিকেলে আমরা নাখোদকার রাস্তা ধরে হাটছিলাম।
শীত প্রধান দেশে মার্কেট গুলো একটু অন্যরকম হয়। আমাদের দেশে কোন দোকান যেমন বাইরে থেকে বোঝা যায় এখানে তেমনটি নয়। রাস্তার ধার ঘেষে বাড়ী গুলোর নিচ তলায় সব ডিপার্মেন্টাল ষ্টোর গুলো। এয়ারটাইট দরজা গুলো খুলে ভেতরে ঢুকলেই অবাক হতে হয়। বাইরে থেকে বোঝার বিন্দুমাত্র সম্ভাবনা নেই যে ভেতরে এত বড় মার্কেট আছে। রাশিয়ার অনান্য শহরেও আমি এমনটিই দেখেছি।
(২) স্কুলের ছেলেমেয়েদের কালচারাল এডুকেশনের জন্য থিয়েটার হল।
সোজা রাস্তা দিয়ে হাটতে হাটতে আমরা পৌছালাম বিশাল একটা থিয়েটার হলের সামনে। মেইন গেটের সামনে এসে অবাক হলাম। রাশিয়ান ভাষায় লেখা ঐশ্বরিয়ার ছবি সম্বলিত একটা পোষ্টার। ঠিক কোন ছবি বুঝতে পারলাম না। তবে ছবিটি দেখে দেবদাস বলেই মনে হল। আমরা হলটার ভেতরে ঢুকে গেলাম। ঠিক কোন শো দেখার উদ্দেশ্য নিয়ে নয়। জাস্ট কৌতূহল বসত। কিন্তু ভেতরে গিয়ে বোকা হয়ে ফিরে আসতে হলো। হলটি স্কুলের বাচ্চাদের কালচারাল এডুকেশনের জন্য ব্যবহৃত হয়। তবে জানলাম সানডে তে সবার জন্য উন্মুক্ত থাকে। কিন্তু সেদিন সানডে ছিল না।
(৩) ইন্ডিয়ান কালচার নিয়ে শিক্ষা দেয়া হয় রাশিয়ান ছেলেমেয়েদের।
আমরা থিয়েটার থেকে বেরিয়ে এলাম। এই বিল্ডিং এর এক কোনায় একটা অংশ জুড়ে মেরিনার্স ক্লাব। আমাদের কাঙ্খিত জায়গা। কিন্তু যে সমস্ত শহরে আমাদের জন্য লোকাল ইন্টারনেট ব্যবহার করা কিংবা শহরে ঘোরাঘুরির অনুমতি থাকে না আমরা সেই সমস্ত শহরে মেরিনার্স ক্লাবে সময় কাটাতাম। তাই আমাদের জন্য উন্মুক্ত এই শহরে মেরিনার্স ক্লাব নিয়ে আমাদের তেমন কোন আকর্ষন ছিলনা। তবু এতটা কাছে এসে একটু উঁকি না দিলে কেমন হয় তাই ঢুকলাম।
(৪) ইন্টারন্যাশনাল মেরিনার্স ক্লাবের নাখোদকা ব্রাঞ্চ।
(৫) কিছুক্ষণ আমরা বিলিয়ার্ড খেললাম।
(৬) ফিলিপিনো কিছু নাবিক খুব সুন্দর গান করছিল। যেন পুরো একটা ব্যান্ডদল একসাথে জাহাজ থেকে এসেছে। গান গাইবার সব ধরনের ইন্সট্রুমেন্ট ছিল এখানে।
(৭) এই খেলাটা কে আমার এখনো বাচ্চা দের খেলা বলেই মনে হয়।
মেরিনার্স ক্লাবের একটা ডায়েরী আছে রিভিউ লেখার জন্য। পেছেনের পাতা উল্টিয়ে দেখলাম বাংলাদেশী এক সেকেন্ড ইঞ্জিনিয়ার এখানে প্রায় এক বছর আগে এসেছিল। আমরা এখানে বেশী সময় নষ্ট না করে বেরিয়ে পড়লাম। রাস্তায় এসে অভূতপূর্ব এক দৃশ্য দেখলাম।
যেন মেঘের দল রাস্তায় নেমে এসেছে। দূরের পাহাড় গুলো কিছুই দেখা যাচ্ছে না। হিমশীতল একটা বাতাস বয়ে যাচ্ছে গায়ের ওপর দিয়ে। আমি টুপি পরে হাটা শুরু করলাম।
(৮) মেঘবালিকা আমাদের গায়ের ওপর আদরের পরশ বুলিয়ে যাচ্ছিল।
আমাদের গন্তব্য দ্যা কাজান আইকন অফ মাদার অফ গড। কিন্তু এই মেঘলা আবহাওয়ায় সেটা কতটা আরামদায়ক হবে ভাববার বিষয়। একটু পরেই গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি পড়া শুরু হল। আমরা দ্রুত একটা দোকানে ঢুকে গেলাম। ঘড়ি দেখলাম প্রায় নয়টার মতো বাজে। একটু পরেই সন্ধ্যা নামবে। সো কাজার আইকনের উদ্দেশ্যে আর কোন প্লান করার চিন্তা বাদ দিলাম।
(৯)পরদিন সুন্দর একটা সূর্য উঁকি দিচ্ছিল বাড়ী ঘরগুলোর ভেতর দিয়ে।
জাহাজে ফিরে কাজান আইকন সম্পর্কে আরো খোঁজখবর নিয়েছিলাম। নাখোদকা শহরের অন্যতম দর্শনীয় স্থান এই কাজান আইকন অফ দ্যা মাদার অফ গড। পরদিন আমরা প্রথমেই কাজান আইকন ভ্রমণের সিদ্ধান্ত নিলাম। কাজান আইকন সম্পর্কে কিছু বলে নেয়া প্রয়োজন।
(১০) দ্যা কাজান আইকন অফ দ্যা মাদার অফ গড।
১৫৭৯ সালে রাশিয়ার কাজান এর তাতার শহরের একটা অংশ আগুনে পুড়ে যায়। এই ডিজাষ্টারের পরে এক আর্মি অফিসারের ৯ বছর বয়সী মেয়ে ম্যাট্রোনাকে স্বপ্নে মা মেরি মেয়েটির বাবার একটা পুড়ে যাওয়া বাড়ীর একটী জায়গা খনন করার কথা বলে। মেয়েটি তার মাকে স্বপ্নের কথা বললে মা শহর কর্মকর্তাদের কে বিষয়টী জানান। কিন্তু তারা কেউ কথাটা বিশ্বাস করেন না। পরে মেয়েটি ও তার মা মিলে মা মেরীর নির্দেশিত জায়গা খুড়ে এক টুকরা পুরানো কাপড়ে জড়ানো একটা আইকন পান।
আইকনটিকে সবচেয়ে কাছের একটি গীর্জায় স্থানান্তর করা হয় এবং এটি অনেক অলৌকিক কাজ করতে শুরু করে। পরে ঐ জায়গায় একটি ক্যাথেড্রোল ও কনভেন্ট তৈরি করা হয়। পরের বছর ঐ আইকনের একটি হুবহু কপি মস্কোতে রুশ সম্রাট ইভানের কাছে পাঠানো হয় এবং ১৬১১ সালে কাজান ক্যাথেড্রোলে স্থানান্তর করা হয়। এবং এখানেই দ্যা আইকন অফ দ্যা কাজান মাদার অফ গড ব্যপকভাবে শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করা হয়।
কালক্রমে এই আইকনটি সমগ্র রাশিয়া খুবই জনপ্রিয় হয়ে ওঠে, এমনকি প্রত্যেকে ক্যাথালিক রাশিয়ান ঘরে এই পোষ্টারটি রাখতে শুরু করে। এছাড়া রাশিয়ার বিভিন্ন জায়গায় কাজান আইকনের গীর্জা তৈরি করা হয়। নাখোদকায় ঠিক এমনই একটা গীর্জা আছে যেটি তোবলস্কিয়া পাহাড়ে ওপর অবস্থিত।
(১১) তোবলস্কিয়া পাহাড়ে ওপর অবস্থিত কাজান আইকনের গীর্জাটি দেখা যাচ্ছে।
(১২) আংশিক বাধানো সিড়ি বেয়ে আমরা পাহাড়ে উঠছিলাম।
(১৩) সিড়ি শেষ হতেই চোখের পর্দায় ভেসে উঠলো গীর্জাটি।
(১৪) দ্যা কাজান আইকন অফ দ্যা মাদার অফ গড়ের গীর্জাটির সুন্দর স্থাপনা দেখে আমরা মুগ্ধ হয়েছিলাম।
(১৫) মূল গীর্জার পাশেই ছোট একটা মঠও ছিল।
(১৬) পাহাড়ে ওঠার পরে পুরো নাখোদকা শহরটা আমাদের চোখের সামনে ভেসে উঠলো।
(১৭) পাহাড়ের পেছন দিকে তাকিয়ে চোখ জুড়িয়ে গেল। সমুদ্র দেখা যাচ্ছে। আমরা ঘুরে ফিরে পোর্টের কাছাকাছি চলে এসেছিলাম। এখান থেকে আমাদের জাহাজও দেখা যাচ্ছিল।
গীর্জার ভেতরে ছবি তোলার ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা থাকায় ভেতরে কোন ছবি তুলতে পারিনি। গীর্জা দেখা শেষ করে আমরা আমরা যখন নেমে এলাম তখনও বেশ কিছুটা বেলা ছিল। আমরা প্রসস্ত একটা জায়গায় এসে লেলিনের একটা প্রতিকৃতি দেখলাম। জায়গাটা খুব সুন্দর ছিল।
(১৮) সমূদ্রের দিকে পিঠ রেখে মিস্টার লেলিন তাকিয়ে ছিলেন নব্য রাশিয়ার দিকে।
(১৯) লেলিনের মতো করে পোজ দেয়ার চেষ্টা করেছিলাম আমি।
আমরা রাস্তা ধরে হাটতে হাটতে সুন্দর একটা জিনিস দেখলাম। ফুলের গাছ দিয়ে বিশাল আকৃতির একটা ময়ুর বানানো হয়েছে।
(২০) ফুলের গাছের ময়ুর।
তখন সন্ধ্যা প্রায় নামবে নামবে করছিল। আমার সঙ্গী একজন ইতিমধ্যে বিদায় নিয়েছে। আমি আমার সাথের ক্যাডেটকে সাথে নিয়ে একটা মার্কেটের দিকে যাচ্ছিলাম কিছু খাওয়ার জন্য। মার্কেটের মুখে একটা মজার ঘটনা ঘটলো। দুটো রাশিয়ান মেয়ে যাদেরকে অনিদ্যসুন্দরী বললে ভুল হবে, আমাদের পাশ দিয়ে হেটে চলে গেল। অভ্যাসবশত আমরা ঘুরে তাকালাম। হঠাৎ মেয়েদুটোর মধ্যে সবথেকে বেশী সুন্দরটি দৌড়ে এল আমাদের দিকে। তার কথা শুনে অবাক হলাম। সে আমাদের সাথে ছবি তুলতে চায়। যদি আমাদের আপত্তি না থাকে। আপত্তির প্রশ্নই আসে না। সে পকেট থেকে মোবাইল ফোন বের করে তার বান্ধবীর হাতে দিয়ে আমাদের দুইজনের মাঝখানে এসে দাড়ালো। আমরা দুজন বোকার মতো দাড়িয়ে থাকলাম। বাইরে এসে আমরা সাদা চামড়ার মেয়েদের সাথে ছবি তোলার জন্য ছোক ছোক করি। কিন্তু এদের কেউ যে আমাদের সাথে ছবি তুলতে চাইতে পারে এই অভিজ্ঞতা আগে ছিলনা।
এবং আর একটা মজার ব্যাপার যেটা হল, আমার সাথে থাকা ক্যাডেট এত্তক্ষণ আমাদের অনেক ছবি তুলে দিয়েছিল, কিন্তু ওর কোন ছবি আমরা তুলতে পারিনি। তার এক কথা, সে নাকি ছবি তোলে না। মেয়ে দুটি চলে যাবার পরে আমি তার দিকে তাকালাম। সে মুচকি হেসে বললো, ‘স্যার আমি ছবি তুলি না মানে এই, যে আমি যে সে অবজেক্টের সাথে ছবি তুলি না’।
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে নভেম্বর, ২০১৪ সন্ধ্যা ৬:৩৯