অনুবাদ ও ভূমিকা : রেজওয়ান তানিম
ফারাহ সারাফা সাম্প্রতিক সময়ের একজন সমাজ ও রাজনীতিসচেতন কবি। নাগরিকত্বের দিক থেকে তিনি মূলত একজন আমেরিকান হলেও বৈচিত্র্যপূর্ণ পারিবারিক ইতিহাসের জন্য তাকে একজন বিশ্বনাগরিক বলে অভিহিত করা যায় সহজে। তার পিতা একজন ইরাকি খ্রিস্টান এবং মা একজন ফিলিস্তিনি মহিলা। তার বাবা-মা সংসার শুরু করেন মিশরে এবং জন্ম ও বেড়ে ওঠা আমেরিকায়। তার সাহিত্যকর্মের উপর যুদ্ধ ও আরববিশ্বের ঝঞ্ছাবিক্ষুব্ধ সময়ের বাস্তবতার দেখা মেলে। ফিলিস্তিন ইসরাইল যুদ্ধ, আমেরিকা ইরাক যুদ্ধ এসব তার সাহিত্যকে দিয়েছে আলাদা মাত্রা। তার লেখায় যুদ্ধের প্রভাব বিষয়ে তিনি বলেছেন, “যুদ্ধ আমাকে আর সবকিছুর চেয়ে বেশি আকৃষ্ট করেছে এবং কবিতা আমার যুদ্ধোত্তর অনুভূতির প্রাথমিক প্রকাশ।”
হুপউড সাহিত্য পুরস্কারে ভূষিত এই কবির কবিতায় যুদ্ধের ভয়াবহতা এবং আশাভঙ্গের বেদনা প্রবলভাবেই প্রকাশ পেয়েছে। নিজের মাতৃভূমিকে না দেখতে পাবার বেদনাও লক্ষণীয়। মধ্যপ্রাচ্যের বর্তমান নেতৃত্বের আপোষ-আলোচনার নিরীহ পথের চেয়ে প্রতিবাদী ও দৃঢ় চেতনার সংগ্রামের প্রতি তিনি তার আস্থা ব্যক্ত করেছেন। মাতৃভূমি ফিলিস্তিনের বর্তমান নেতৃত্বকে লোভী, বাজিকর ও পাচারকারীদের সহযোগী হিসেবে প্রত্যাখ্যান করে হামাসের দৃঢ় অবস্থান, যা কিনা ‘পিতামহের পথ ও সংস্কৃতি’ হিসেবে চিত্রায়িত করতে চেয়েছেন। এছাড়াও ইরাক আমেরিকা যুদ্ধে পরাজিত সাদ্দাম হোসেনের প্রতিও তার সহমর্মিতার প্রকাশ ঘটেছে লেখাগুলোতে। তিনি চান ইরাকে আবার অসাম্প্রদায়িক বাথ পার্টি দৃশ্যমান হোক রাজনীতির পটভূমিতে।
আরব অঞ্চলের কিংবা আরবি সাহিত্যে যুদ্ধ ও পাশ্চাত্য বিরোধিতা সঙ্গত কারণেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে প্রবল আকার ধারণ করেছে। মাহমুদ দারবিশ, আদোনিস, নাজিম হিকমতের লেখা থেকে আমরা সেসব নিয়ে অনেকটাই অবগত। তবে ফারাহ সারাফার কবিতা কিছুটা বৈচিত্র্যপূর্ণ এই কারণে যে ফারাহ মধ্যপ্রাচ্যের বংশোদ্ভূত হলেও তার জন্ম ও বেড়ে ওঠা মধ্যপ্রাচ্যের সকল সমস্যায় আরব দেশগুলোর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ হুমকি আমেরিকায়। আমেরিকার বকধার্মিকতা তিনি কাছ থেকে দেখেছেন বসবাস ও বেড়ে ওঠার সূত্রে। তাই তার কবিতা পাঠে আমরা পাই, আরববিশ্বের সাম্প্রতিক যুদ্ধপরিস্থিতির বিষয়ে নিবিষ্ট পর্যবেক্ষকের মতামত।
পাঠকেরা আরববিশ্বের ঘটে যাওয়া সাম্প্রতিক যুদ্ধপ্রসঙ্গ নিয়ে আমেরিকার নতুন প্রজন্মের ভাবনাও জানতে পারবেন এই কবিতাগুলো পাঠান্তে। ফারাহ সারাফা মূলত ইংরেজি ভাষায় লেখালেখি করে থাকেন। এই কবিতাগুলো তা থেকেই তর্জমা করা।
ইরাকি বাবা, ফিলিস্তিনের মা
বাগদাদে একটি বাসে মর্টার বর্ষণ, ১৫ জনের মৃত্যু
যুদ্ধের বৈরিতাই আজ প্রতিফলিত এ গৃহযুদ্ধে
আমেরিকা হামলে পড়েছে ইরাকি জনজীবনে
দীর্ঘ দুই বছর আগে।
কী করে এমনটা হল
কীভাবে এমন হতে পারে
আমি কখনও দেখতে পাব না
আমার প্রপিতামহের উর্বর জমিন?
আমার সংগ্রাম, আমার দীপ্ত উদ্দীপনা
বিভাজন ও অনৈক্য রোগের উপশম কল্পে
আমার এই দুর্ভাগা দেশ এবং ফিলিস্তিন
ভুক্তভোগী আজ অগণন যন্ত্রণার।
দখলদারদের পশ্চিমতীর ছেড়ে যেতে এবং
পূর্ব জেরুজালেমে ফিরিয়ে যেতে অনুরোধ করেছে, হামাস।
যেখানে দখলকারী বসত গড়েছে, ১৯৪৯ এ
নির্মাণ করেছে চেকপয়েন্ট এবং একটি বাঁধার প্রাচীর।
কী করে এমনটা হল
কীভাবে এমন হতে পারে
আমি কখনই দেখতে পাব না
আমার প্রপিতামহীর পুণ্য ভূমি?
আমি কাঁদি, আমি গোঙাই, বিরত
থাকি দেহমনের আনন্দ থেকে
নিঃশেষ শূন্যতায় আমি আটকে আছি
জীবনবঞ্চিত ইরাকের মাটিতে।
জলপাই
যদি জলপাই বৃক্ষটি পেত কথা বলার স্বাধীনতা
তবে হয়তো তারা এভাবে বলত
তোমার পিতা,
উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া স্বপ্নটুকু
ফেলে আসতে বাধ্য হন সরীসৃপ খোলসের মতন.
এরপর.. শুধু কাঁদেন।
উষর জলপাই ক্ষেতে হাঁটতে হাঁটতে
তিনি আশার আবাদ করেন, ভাবেন, ওদের শিকড় প্রোথিত হবে
জীবন্ত হবে আরও একবার, যেমন তারা ছিল
একদিন তাদের পূর্বপুরুষদের মতোই ফলবতী।
ফিলিস্তিনের গভীর কালো মাটির গন্ধ যেন
তরল সাদা পনির মাখানো আধপোড়া পিটা রুটি।
তিনি স্বপ্ন আঁকেন
তার সন্তানের চোখজোড়া জলপাই’র মতো সবুজ
চকচকে, ঝিলিক মারছে
যেন পান্না,
কিন্তু সে স্বপ্ন, গাছের শাখা নাড়াবার একটি শূন্য হাতের চেষ্টা–
যে শাখার জলপাই ফুলগুলো পলাতক, যা থেকে ফললাভ
লোভের কারুকার্যে ঘেরা।
তাদের বাজিকর ও পাচারকারীদের কপট কাতর কণ্ঠে
বিশ্বস্ত পরিবারগুলোকে ছুড়ে ফেলেছে অনুনয়ের পথে
তারা হাঁচি দেয়
নিষ্কৃতি পেতে, ফুসফুসের গভীরে জমা ধূমায়িত ক্রোধ
সঙ্কুচিত কালো ও ভীত কণ্ঠ; পূর্ব পুরুষের মাহাত্ম্যগীতি
না গাইবার বিচ্যুতিতে পতিত তিমির ঢাকা লক্ষ্য।
আমার পিতামহের হৃদয় নিংড়ে উৎসারিত এই জীবন
যেখানে তিনি বৃক্ষশাখা থেকে ছাই ঝেড়ে ফেলেন
যে ছাইয়েরা উড়ে যায় দৃষ্টির সামনে থেকে
খোলা চোখে, অগ্নিদৃষ্টি হেনে আসমান দিকে
তিনি দীর্ঘশ্বাস নেন, সুবাসিত দীর্ঘশ্বাস।
যে ছাইয়েরা সমাহিত ক্রিয়া ও প্রতিক্রিয়া কবরের নিচে
সেখান থেকেই বেড়ে উঠবে এ সংস্কৃতির ওঙ্কার!
শিরোনামহীন
তার গাড়ির সামনের কাচে ছোপ ছোপ রক্ত,
মায়ের আর্তচিৎকার
অগ্নিশিখায় এক আমেরিকানের ঘৃতাহুতি
বিস্ফোরিত ভূমিগর্ভ
ইরাকের জমিন অগ্নিশিখায় পুড়ে শুষ্ক হয়ে আসে
(মরুভূমি দ্বারা নয়)
ইরাকের মাটি মুখ গুজে সহ্য করে
সাদ্দাম হোসেনের অপমান.
মার্কিন বাহিনীর ৫০ সৈন্যদল ও ১৫০০ যুদ্ধবিমান
ঝাঁপিয়ে পড়েছে মৌমাছি ঝাঁকের উপর
যাদের মধুভাণ্ডারের চাক
রুদ্ধ করেছে বুশের দানবীয়
অগ্নিশ্বাস, সুমিষ্ট তরল শুকিয়ে
গোঁজানো খামিরের শক্ত আবরণে পরিণত করেছে
গোঁড়া মক্ষিকার মুখগহ্বরের আগুন।
আমি সেই উষর ভূমির আর্দ্রতা ফেরাতে সাহায্য চেয়ে কাঁদি,
ক্রোধের বিষফোড়াকে লালন করি
একমানুষের ক্রোধ, ভীতি ও শহীদি প্রেরণা রূপে ছড়ায়
মরিয়া হয়ে ওঠা একটি জনসমষ্টিতে।
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে জানুয়ারি, ২০১৬ সন্ধ্যা ৬:২৪