somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ভাঙ্গনের গল্পঃ অপেক্ষায় অনিন্দিতা

২৫ শে অক্টোবর, ২০০৯ দুপুর ২:১৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

১.

মতিঝিল। ছুটির পর মানুষের এলোমেলো ব্যস্ততা। পাখিদের মতন নীড়ে ফেরার জন্য ছুটে চলা। সন্ধ্যা নামতেই যেমন পাখি নীড়মুখো হয় তেমন। মানুষের হুড়োহুড়ি। চারদিকে বিচ্ছিরী জ্যাম। মানুষগুলো সব মাখামাখি। কার আগে কে উঠবে, কার আগে কে ছুটবে। 'পাখিদের মতন নীড়ে ফেরা' উপমাটা এখানে পুরোপুরি ঠিক হয় নাই। পাখিদেরতো ডানা আছে। কাজ সেরে ঠিক উড়াল দিয়ে বাসায় ফেরে। কিন্তু মানুষগুলোর কোনও ডানা নেই। থাকলে হয়তো তারা উড়ালই দিতো। ব্যস্ত এই শহরের এতসব জঞ্জাল এড়িয়ে সবাই উড়ে উড়ে এসে অফিস করতো।

ধরুন, কাশেম সাহেব। কোন অফিসের মাঝারি গোছের কর্মকর্তা। তাঁরতো আর নিজের গাড়ী নেই। তাঁর দুটো ডানা আছে। তিনি থাকেন ঢাকা থেকে ১২০ কিলোমিটার দুরবর্তী এক নিরিবিলি গাঁয়ে। তাঁর অফিসে আসতে কখনোই দেরি হয়না। কারণ, তিনি প্রতিদিন ডানা মেলে উড়ে অফিসে চলে আসেন। সবার আগে। যখন বড় সাহেব তাঁর গাড়ী নিয়ে অভিজাত গুলশান থেকে এখনো এসে পৌঁছাতে পারেননি,তারও আগে।

রফিক, সে এক অফিসের পিওন। প্রতিদিন সবার আগে তাকে আসতে হয়। অফিসে সবার আগে এসে তাকে গেট খুলতে হয়। সে থাকে বান্দরবান। ঢাকা শহর থেকে একটু দুরে হলেও রফিকের অফিসে আসতে কখনোই দেরি হয়না। কারণ, সে ফজর পড়েই উড়াল দেয় ঢাকা’র উদ্দেশ্যে। উড়তি পথে কতজনের সাথে তার দেখা হয়! তারা সবাই গল্প করতে করতে অফিসে উড়ে চলে আসে।
এসব কল্পনায় ছবি আঁকা যায়। মানুষের ডানা কখনোই হবেনা। যেমন আমারও কখনো ডানা হবেনা। দু’পাশে বিস্তৃত দুটি রঙিন ডানা। দিন শেষে সবাই বাসায় ফিরে যায়। আমার ইচ্ছে করেনা। আমার ইচ্ছে করে উড়ে চলে যেতে দুরে কোথাও। যেখানে সবুজ বন। যেখানে শস্যক্ষেত। বাসায় ফিরে গিয়ে আমি বা কি করবো। আমার জন্য কারও অপেক্ষা নেই। কেউ দ্বার খুলে বসে থাকেনা।
অবাক করা বিষয়ই বটে।
আমার বউ আছে। যাদের ঘরে বউ থাকে তাঁরা তাঁদের স্বামীদের জন্য নিশ্চয় প্রতীক্ষায় থাকেন। কিন্তু অনিন্দিতা কখনোই আমার জন্য অপেক্ষা করেনা। দরজায় দাঁড়িয়ে স্থিরদৃষ্টিতে অপেক্ষা করেনা। আমি ফিরে এলে অভিমান করে গীতাঞ্জলী থেকে বলে উঠেনা 'আমায় কেন বসিয়ে রাখো একা দ্বারের পাশে'।

২.

আমার বাসা মীরপুরে। আমি পোস্তগোলামুখী একটা 'ঝুলে থাকা সার্ভিসে' উঠে পড়লাম। বাসটার নাম্বার আছে। কিন্তু এই বাসের বেশিরভাগ যাত্রীকে যেহেতু ঝুলে ঝুলে যেতে হয় তাই বাসটার নাম 'ঝুলে থাকা সার্ভিস'। আজকে আমি বাসায় ফিরবোনা। চলে যাবো অজানা কোথাও। যেখানে আমাকে কেউ চিনেনা। মাঝে মাঝেই আমি এমন করি। যখন কিছু করার থাকেনা, তখন অচেনা একটা বাসের টিকেট কেটে উঠে পড়ি। যেখানে ইচ্ছে সেখানে গিয়ে নামি। চারপাশের সব অজানা-অচেনা। কেউ জিজ্ঞেসও করেনা 'ম্যাঁ ভাই যাবেন কই'? বেশ ভালোই লাগে তখন। নিজেকে স্বাধীন মনে হয়। আমার সাথে যদি অনিন্দিতার সর্ম্পক ভালো থাকতো তখন হয়তোবা অনিন্দিতা আমার আকস্মিক দুরে হারিয়ে যাবার ঘটনায় রাগ দেখাতো। ফোন করে বাষ্পরুদ্ধ কন্ঠে বলতো, 'কি সব ছেলে মানুষী কর বলতো ? আমি বাসায় উনার জন্যে প্রতীক্ষা করি, আর উনি যান দুর-অজানায় ! ফাজলামির একটা সীমা রাখো'।
এখন আর বলবেনা।
সর্বোচ্চ ফোন করে জিজ্ঞেসও করবেনা। যদি জানতে পারে আমি হারিয়ে যাচ্ছি কোথাও হয়তো অনুচ্চারিত কন্ঠে বলবে 'ঢং'।
আমি বাসের দরজা ধরে বাদুর ঝোলা ঝুলে আছি। দু’হাতে গেইটের রড ধরে হ্যাঙ হয়ে আছি। এই মূর্হুতে কেউ যদি আমাকে কাতুকুতু দেয় তাহলে নির্ঘাত আমি পড়ে যাবো। ধপাস! পা রাখার জায়গা পাচ্ছিনা। একজনের পায়ের উপর দাঁড়িয়ে আছি। ভদ্রলোক মনে হয় বিষয়টা খেয়াল করছেন না। নইলে এতক্ষণে কুরুক্ষেত্র হয়ে যেত। তবে তার পায়ের উপর দাঁড়িয়ে থাকলেও তার বগলের গন্ধ আমার নাক বরাবর এসে হালকা বাতাস দিয়ে যাচ্ছে। মরবি তুই মরে যা, এক্কেবারে মরে যা-অবস্থা।

লোকাল বাসটায় বেশি দুর যেতে পারলাম না। সায়দাবাদে নেমে পড়লাম। আজকে সাপ্তাহিক কর্মদিবসের শেষ দিন। মানুষের হাঙামা ডাবল। কুমিল্লা অভিমুখী একটা মোটামুটি মানের বাসে উঠে পড়লাম। সিটে গিয়ে আরাম করে বসলাম। ডান পা-টা মেলে বাম পা-টা বাঁকা করে রিলাক্স হতে চেষ্টা করলাম। আমার সিগ্রেটে অভ্যেস নেই। পান-সুরকিও না। আমার এই ব্যাপারটা অনিন্দিতা অত্যন্ত পছন্দ করতো। বিয়ের প্রথম ন’মাসতো শুধু 'আমার বাজে অভ্যেস নেই' এ প্রশংসায় পঞ্চমুখ থাকতো। আমাকে নিবিড় করে কাছে টেনে নিয়ে ঠোঁট ছুঁয়ে বলতো, 'ইশ ! যদি তোমার সিগ্রেট খাওয়ার অভ্যেস থাকতো আমার এত কাছে তোমাকে ঘেঁসতেই দিতাম না। বাপরে...কি বিশ্রি উদ্ভট গন্ধ'!

আমার পাশের সীটে এসে একজন মাঝ বয়েসী ভদ্রলোক ধপাস করে তার ঢাউস সাইজ ব্যাগ রাখলেন। জায়গা দখল করলেন মনে হয়। একবার আমার দিকে বিলক্ষণ তাকিয়ে বললেন, ভাই কই যাবেন?
আমি প্রথমে প্রশ্নটা বুঝিনি। তিনি আবার প্রশ্ন করলেন।
আমি বললাম, গাড়ীটাতো কুমিল্লা পর্যন্তই যাবে, তাই না?
-হে হে। না,জিগাইলাম আরকি! ভাই,মাইন্ড কইরেননা। মনে হয় যুদ্ধ জয় কইরা সীট পাইছি। এত ধ্বস্তাধ্বস্তি কত্তে কত্তে আমার এক নম্বরে ধইরা গ্যাছে। আমার আবার ডায়েবেটিস প্রবলেম। বুচ্ছেন তো। ব্যাগটা ইকটু দেইখে'। ভদ্রলোক তার একনাম্বার সেরে নিরাপদে ফিরে এলেন। মুখে পানের রঙ লেপ্টে আছে। সিগ্রেটের গন্ধও আছে। ধড়াম করে সীটে বসলেন। পায়ের জুতা খুলে একপাশে রাখলেন। পায়ের বিশ্রি গন্ধ এসে লাগলো নাকে । ততক্ষণে তিনি মোজাজোড়াও খোলার পায়তারা করছেন।। আমি প্রমাদ গুনছি। কাতর কন্ঠে বললাম, ভাই মোজা না খুললে হয়না! লোকটা আবার হে হে করে হেসে বললেন, গন্ধ পান? আমি মাথা নাড়ালাম, না !

আমি বাসায় ফিরলেই অনিন্দিতা দরজা খুলে প্রথমে বলতো,'মহোদয় মোজাজোড়া বাথরুমে ফেলে আসি তবে'। আমি হেসে উত্তর দিতাম। সে বলতো, 'জো-হুকুম মহারাজ'!
বাস কচ্ছপের মতন ধীর পায়ে এগোচ্ছে। প্রচন্ড যানজট। পাশের ভদ্রলোক বলে উঠলেন 'আইজকা হৈলো বিশ্যুদবার। আইজকার জ্যাম কি আর যা-তা ! ই...রি বাপরে..'!
আমি জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছি। আজকে যা হবার সেটা ভাবছি। আমার দেরি দেখে আমার শাশুড়ি মাতা কিছুটা অস্থির হতে পারেন। মহিলা আমাকে বেশ পছন্দ করেন। হয়তো তাঁর মেয়েকে বারবার ঘাটাবেন ফোন দেয়ার জন্য। তাঁর মেয়ে পাশ কাটিয়ে যাবে। বলবে, 'তোমার দরদতো ফোন তুমিই দাও। খামোখা বিরক্ত করোনা'।
তখন হয়তো শাশুড়ি মাতা ফোন দিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে বলবেন 'বাবা আপনি কোথায়? বাসায় ফিরতে দেরি হচ্ছে যে'! ভদ্রমহিলা আমাকে আপনি করেই বলেন।
............................................................

হায়! এই কি সেই অনিন্দিতা ! যার উদার কন্ঠের কবিতা আর মিষ্টি সে গান শুনে বাকি জীবন পার করে দেবার স্বপ্ন বুনেছিলাম। যার জোছনা ধোয়া হাসি আমায় জাগিয়ে দিতো জনম জনমে। অনিন্দিতা একদিন আমার সংসারে এসেছিল। বাঙ্গালী আর দশটা নারীর মত লাল শাড়ী পরেই এসেছিল। ঘোমটা পরে চুপটি করে বসেছিল পুষ্প বিছানো শয্যায়। মনে হচ্ছিল একটা পুতুল বসে আছে। আমি এগিয়ে গিয়ে পুতুলটার হাত ধরেছিলাম। মেহেদী রাঙা কোমল দুটি হাত । সে শুধু চোখ তুলে চেয়েছিল একবার । তারপর চোখ নামিয়ে নিয়েছিল। আমি হাত ধরে চাপ দিলাম। অনিন্দিতা বলেছিল 'এই হাত ধরে রেখো বাকি জীবন'।
কথাগুলো এখন হাস্যকর হয়ে উঠছে। আমার ভিতরে ফেটে যাচ্ছে। ভীষন কষ্টে ফেটে যাচ্ছে। আমি এক ঝটকায় মাথাটা ঘুরিয়ে নিয়ে মনযোগ ফিরালাম অন্যদিকে।

৩.

সবুজ জড়ানো রাস্তার মধ্যেখান দিয়ে বাস ছুটে চলছে। জীবনটাও এভাবে ছুটে চলে। কখন যে সন্ধ্যা নেমেছে টেরই পাইনি। ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। হাতের ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলাম আটটা বাজে। ওহো! মোবাইলের ভাইব্রেশনে সজাগ পেয়েছি। স্ক্রিনে যে নাম্বারটা ভেসে উঠছে সেটাতে 'অনিন্দিতা,বউমণি' লিখা থাকলেও আমি জানি অনিন্দিতা ফোন দেয়নি। আমি যথাসম্ভব ধাতস্থ হয়ে সালাম দিয়ে বললাম, কে?
'বাবা, আমি। আপনার শাশুড়ি'
'অ...
'আপনি কই বাবা'?
'এইতো। আছি। একবন্ধু’র বাসায় দাওয়াত। সেখানেই যাচ্ছি। আম্মা, আমার ফিরতে একটু রাত হবে আপনারা খেয়ে নিয়েন'।
'বাবা, খেয়ে নিবো কিভাবে ? অনি তো আপনার জন্য অপেক্ষা করছে'।
আমার হঠাৎ হাসি পেল কথাটা শুনে। অপেক্ষা ! হাসলাম না। বললাম, 'আম্মা আমার ফিরতে দেরি হবে। আপনারা খেয়ে ঘুমিয়ে পড়বেন। এখন রাখি আম্মা-বলে আমি লাইনটা কেটে দিলাম।
হুঁ ! কতরাত নিজে ফ্রিজ থেকে খাবার তুলে খেয়েছি।

৪.

অনিন্দিতা’র সাথে এই যে আমার দূরত্ব, এই যে সীমাহীন অভিমান যা ভাঙবার নয়। কত রাত দু’জনে এক বিছানায় থেকে কেউ কারো দিকে ফিরে চাইনি। কতদিন ক্লান্ত দেহে ঘরে ফিরেও কেউ কারো চোখে চেয়ে একটা হাসিনি। কতদিন কতদিন। আমার আর অনিন্দিতা’র এই যে দূরত্ব তা একদিনে সৃষ্টি হয়নি। ক্ষনে ক্ষনে হয়েছে। তিলে তিলে আমাদের পরষ্পরের মধ্যে বেড়ে উঠেছে ঘৃণা। আমি ছা’পোষা মানুষ। কোন রকমে যা আয় করি তা খেয়ে পরে বেঁচে থাকার মত নিরীহ লোক। অথচ অনিন্দিতা’র স্বপ্ন আকাশ ছোঁয়া। আমার মত সাধারণ পরিবারের সন্তান হলেও তার আকাঙখা সীমাহীন। বিয়ের বছর না গড়াতেই তার টানা আবদার পূরন করতে করতে আমার বাকি সব হারিয়ে যায়। মাস শেষে পরিবারকে পাঠানোর যে নিয়মটা ছিল সেটাও ভঙ্গ হয়ে যায় অনিন্দিতার চাহিদা পূরণে। সপ্তাহে নাট্যপাড়ায় গিয়ে নাটক দেখা, শপিং সেন্টারে গিয়ে বড়লোকদের মত যাচ্ছে-তাই শপিং করা অনিন্দিতা’র সাধারণ অভ্যেস হয়ে গিয়েছিল। যেন তার টাকার কোন সমস্যা নেই। চাইলেই পাওয়া যায়। মাসের শেষে আমি লোকাল বাসে ঘরে ফিরি। আমাকে বিয়ে করার জন্য দিনে কমপক্ষে দশবার ’হায় হায়’ করে। তার মেঝো মামা তার জন্য রাজপুত্তর ঠিক করেছিল। ইশ! কি ভুল হয়েছিল ছেলেটাকে ফিরিয়ে দিয়ে। ছেলেটার অঢেল টাকা ছিল। শুধু একটাই সমস্যা ছিল ছেলেটার 'নাকের উপর গোঁফখানা'। নইলে আজ কি আর এই জাহান্নামে তাকে থাকতে হতো। ইত্যাদি ইত্যাদি।

অনিচ্ছাসত্ত্বেও মাত্র বছরের মাথায় অনিন্দিতাকে ঢাকায় বাসা ভাড়া করে এনে রাখতে হয়। গ্রামে তার নাকি দম বন্ধ হয়ে আসে। গ্রামে তার ভাল লাগেনা। সে ছোটকাল থেকে শহরে মামার বাসায় থেকে অভ্যস্থ। আমার মা-বাবার অনিচ্ছা এবং আমার হিসেবি বেতন সত্ত্বেও তাকে ঢাকায় এনে রাখি। আমি অফিসে চলে গেলে তার একাকিত্ব ঘোছাতে তার মা কে এনে রাখে। সাথে তার এক ভাতিজিকেও। আমার মা-বাবা আমার পারিবারিক সুখের কথা ভেবেই তাঁদের জন্য মাসিক হাত খরচা দিতে আমাকে বারণ করেন। সমস্যাগুলো অনেক ছোট ছোট হলেও আস্তে আস্তে সেগুলো বড় আকার ধারণ করে। অনিন্দিতার দুলাভাইয়ের বাইপাস সার্জারি হবে। অনিন্দিতা আমাকে বললো সহযোগিতা করতে। আমার নুন আনতে পান্তা ফুরায়। অথচ আমি কি না সহযোগিতা করবো এক কাস্টম অফিসারকে! যার পকেট ভর্তি ...! অনিন্দিতা আমাকে বলে লাখ খানেক ব্যবস্থা করে দিতে। অথচ অনিন্দিতা জানে আমার মুরোদ। এক লক্ষ টাকা আমার জন্য দিবা স্বপ্ন। তারপরও পীড়াপীড়ি এবং চুড়ান্ত পীড়াপীড়িতে আমার শেষ সম্বল ডিপোজিট ভেঙ্গে তার কাস্টম অফিসার দুলা ভাইকে টাকা দিই।

ঈদে সবাই মা-বাবার কাছে ছুটে যায়। আমার বউ যায়না। তার কথা, শুধু শুধু টাকা খরচ করে বাড়ী যাবার দরকার কি? প্রতিদিনইতো ফোনে তাদের সাথে কথা হচ্ছে।’ আমি বুঝে উঠিনা। আমার কষ্ট হয়। আমি তার সাথে তর্ক করি। কথা কাটাকাটি হয়। দু’জনেই উত্তেজিত হয়ে উঠি।
আমি তাকে একবার তালাক বলে দেই। হঠাৎই সে মহাসমুদ্রের গর্জনের শেষে স্তিমিত হয়ে যায়। চুপসে যায়। আমার দিকে তাকিয়ে থাকে। কোন কথা বলেনা। আমিও বলিনা। চারদিকে শুণ্যতা সৃষ্টি হয়। বালুচরে বাধা বাসা মনে হয়। তারপর কতদিন কেটে গেছে। কত রাত কেটে গেছে। অনিন্দিতা অস্বাভাবিক হয়ে যায়। শুধু আমার সাথে। কোন কথা বলেনা। আমিও অনুতপ্ত হইনা। আজ এক বছর হলো দু’জনে কয়টা কথা বলেছি হিসেব করে বলে দেয়া যাবে। অথচ কত ঘুমহীন রাত দু'জনে কবিতা পড়ে কাটিয়েছি। কথার তুবড়ি ফুটিয়েছি।

৫.

এখন রাত তিনটা বাজে।
আমি ফিরে এসেছি ইটপাথরের ঢাকা শহরে। চার পাশে কবরের নীরবতা। শুধু মাঝে মাঝে ঘুমহীন কুকুর আর দুরে কোন দুরগামী ট্রাকের ’কুইউ’ হরণের শব্দ। আমি আমার অনেক চেনা নীড়ের সামনে। নিজেকে বেশ হালকা মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে কোথাও একটা নি:শ্বাস ফেলে এসেছি স্বাধীনভাবে। দো-তলা,তিনতলা,চারতলার সিঁড়ি ভেঙ্গে পাঁচ তলায় উঠি। দরজায় কলিং বেল না টিপে টোকা দিই। আগে যখন আমি কোন কারণে রাত করে বাড়ি ফিরতাম তখন টোকা দিয়েই ঘরে ঢুকতাম। অনিন্দিতার কাছে আমার টোকা চিহ্নিত ছিল। প্রথমে দুই টোকা আস্তে আস্তে। তারপর তিন টোকা ঘনঘন। অনিন্দিতা চট করে এসেই দরজা খুলে দিত। জড়িয়ে ধরে চুমো দিয়ে বরণ করতো। আবার টোকা দিলাম। দরজা খুলে দিলো একজন বয়স্ক মানুষ। তিনি সম্ভবত ড্রয়িংরুমে ঘুমিয়েছিলেন। আমি তাঁকে দেখে চিনলাম। অনিন্দিতার চাচা । বড় ভালো লোক। ড্রয়িং রুমে বাতি নেভানোই ছিল। বাহিরের আলো এসে আবছা দেখা যাচ্ছে। চাচা বাতি জ্বালাতে উদ্যত হলেন। আমি হাতের ইশারায় মানা করলাম। আস্তে করে আমি আমার করে ভেজানো দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকলাম।

যা দেখলাম সেটার জন্য আমার কোন রকম পূর্ব প্রস্তুতি ছিলনা। অনিন্দিতা ! লাল শাড়ি পরে বসে আছে। কপালে টিপ। সামনে একটা মাঝারী কেক। ডীম লাইটের আবছা আলোতে দেখতে পেলাম একটা মোম জ্বলতে জ্বলতে নিভে গেছে। পাশে আরেকটা মোম। অনিন্দিতা মোম জ্বালিয়ে বসে ছিল। এক্ষণে ঘুমিয়ে পড়েছে। আমার বুকের ভিতরে, ঠিক ভিতরে হঠাৎ একটা ঝড় বয়ে গেল। আমি মেঝেতে বসে পড়লাম। দেখতে পেলাম খাটের কানায় বালিশের পাশে আমার লাল পাঞ্জাবীটা প্রস্তুত আছে। অনিন্দিতা আজ সেজেছিল। বাসরের সাজে। আমি গাধা ভুলে গিয়েছিলাম
আজকে আমাদের বিয়ে বার্ষিকী। আজকের এই রাতে আমি অনিন্দিতাকে কথা দিয়েছিলাম 'আজীবন হাত দুটো ধরে রাখবো। অনিন্দিতা আজকে আমার প্রতীক্ষায় রাত কাটিয়েছে। আমার অনিন্দিতা! আমার!!
আমি অনিন্দিতার হাত দুটো আলতো করে ধরলাম। অনিন্দিতা জেগে উঠলো। কোন কথা বললোনা। আমিও অপরাধীর মত মাথা নীচু করে রইলাম। ক' ফোটা অশ্রু মেঝেতে ঝরে পড়লো। বুঝলামনা অশ্রুগুলো কার! আমার নাকি অনিন্দিতার? নাকি দু’ জনেরই!!

সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে জানুয়ারি, ২০১০ রাত ১১:৫১
৪৪টি মন্তব্য ৪৫টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

চুরি করাটা প্রফেসরদেরই ভালো মানায়

লিখেছেন হাসান মাহবুব, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৫৩


অত্র অঞ্চলে প্রতিটা সিভিতে আপনারা একটা কথা লেখা দেখবেন, যে আবেদনকারী ব্যক্তির বিশেষ গুণ হলো “সততা ও কঠোর পরিশ্রম”। এর মানে তারা বুঝাতে চায় যে তারা টাকা পয়সা চুরি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শিব নারায়ণ দাস নামটাতেই কি আমাদের অ্যালার্জি?

লিখেছেন ...নিপুণ কথন..., ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৫:৫৭


অভিমান কতোটা প্রকট হয় দেখেছিলাম শিবনারায়ণ দাসের কাছে গিয়ে।
.
গত বছরের জুন মাসের শুরুর দিকের কথা। এক সকালে হঠাৎ মনে হলো যদি জাতীয় পতাকার নকশাকার শিবনারায়ণ দাসের সঙ্গে দেখা করা সম্ভব... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঘুষের ধর্ম নাই

লিখেছেন প্রামানিক, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:৫৫


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

মুসলমানে শুকর খায় না
হিন্দু খায় না গাই
সবাই মিলেই সুদ, ঘুষ খায়
সেথায় বিভেদ নাই।

হিন্দু বলে জয় শ্র্রীরাম
মুসলিম আল্লাহ রসুল
হারাম খেয়েই ধর্ম করে
অন্যের ধরে ভুল।

পানি বললে জাত থাকে না
ঘুষ... ...বাকিটুকু পড়ুন

প্রতি মাসে সামু-ব্লগে ভিজিটর কত? মার্চ ২০২৪ Update

লিখেছেন জে.এস. সাব্বির, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:০৮

মার্চ ২০২৪ সালে আমাদের প্রিয় সামু ব্লগে ভিজিটর সংখ্যা কত ছিল? জানতে হলে চোখ রাখুন-

গত ৬ মাসের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ভিউ ছিল জানুয়ারি মাসে। ওই মাসে সর্বমোট ভিজিট ছিল ১৬... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইরান-ইজরায়েল দ্বৈরথঃ পানি কতোদূর গড়াবে??

লিখেছেন ভুয়া মফিজ, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:২৬



সারা বিশ্বের খবরাখবর যারা রাখে, তাদের সবাই মোটামুটি জানে যে গত পহেলা এপ্রিল ইজরায়েল ইরানকে ''এপ্রিল ফুল'' দিবসের উপহার দেয়ার নিমিত্তে সিরিয়ায় অবস্থিত ইরানের কনস্যুলেট ভবনে বিমান হামলা চালায়।... ...বাকিটুকু পড়ুন

×