ছয় বা সাত ক্লাসে পড়ি তখন৷ আব্বা কুমারখালীর ইউ এন ও বিধায় আমরা তখন কুমারখালীতে থাকি৷ একদিন শোনা গেলো প্রখ্যাত কণ্ঠশীল্পি ভূপেন হাজারিকা বাংলাদেশে আসছেন৷ তিনি এখানে একক গানের একটা অনুষ্ঠান করবেন আর বিটিভি অনুষ্ঠানটা সম্প্রচার করবে৷
পত্র পত্রিকায় ভূপেন হাজারিকাকে নিয়ে খুব লেখালেখি শুরু হয়ে গেলো৷ অত্যধিক লেখালেখিতে আব্বা কিছুটা বিরক্ত৷ কে ভূপেন হাজারিকা? তাকে নিয়ে এতো শোরগোল কেনো?
আব্বা কেন ভূপেন হাজারিকাকে চিনতেন না সে প্রশ্ন একটু বিস্ময়ের সৃষ্টি করতে পারে৷ এমন না যে আব্বা গান টান শুনতেন না৷ বরং উল্টো৷ একটা সময় তিনি নিজেই চলচিত্রের সাথে জড়িত ছিলেন৷ বাংলাদেশের প্রথম দিককার সিনেমা “নতুন নামে ডাকো”র প্রযোজক ছিলেন আমার নানা৷ তবে নানা প্রযোজক হলেও তিনি সক্রিয় ছিলেন না, নানার হয়ে আমার আব্বাই সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছিলেন৷
মনে রাখতে হবে, এটা সে সময়কার কথা যখন সবকিছু এমন জগাখিচুড়ি হয়ে যায়নি৷ এখন অনেক চ্যানেল আর অনুষ্ঠানের ভয়ে টিভির সামনে বসাই হয় না৷ কিন্তু তখন একটাই চ্যানেল, আর রাত ন'টা থেকে দশটা পরিবারের সবাই সে চ্যানেলের সামনে বসে থাকা মোটামুটি নিয়মের মতো ছিলো৷ ভূপেন বাবুর অনুষ্ঠানের রাতে টিভির সামনে বসে খেতে খেতে আমরা তার গান শুনলাম৷ দেখলাম আব্বার কণ্ঠ পুরোই পাল্টে গেছে৷ বললেন, শরৎচন্দ্রের মহেষ নিয়ে এমন গান লেখা যায়?
শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের “মহেষ” গল্পটা আব্বার খুব প্রিয়৷ এক সময় গল্পটা পড়ে আবেগাপ্লূত হয়ে পড়েছিলেন৷ আজ এতদিন পরে “শরৎবাবু খোলা চিঠি দিলাম তোমার কাছে, তোমার গফুর মহেষ এখন কোথায় কেমন আছে” গান শুনে আব্বা উত্তেজিত হয়ে পড়লেন৷ আর উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠলেন ভূপেন হাজারিকার প্রশংসায়৷
আরেকটা স্মৃতি৷ সেটা একটু বেশিই ব্যক্তিগত৷ এটাও সেই কুমারখালীতে থাকার সময়৷ সেবারে আমরা শিলাইদহে পিকনিকে গিয়েছিলাম৷ পিকনিক মাইকে কি সব হিন্দি গান বাজাচ্ছিলো, আমার পছন্দ হচ্ছিলো না৷ একটু বিরক্ত হয়ে মাউথপিস টেনে নিয়ে গাইতে শুরু করলাম - শরৎবাবু খোলা চিঠি দিলাম তোমার কাছে...
পিকনিকের আনন্দের সাথে গানটা বোধহয় ঠিক যায় না৷ কিন্তু আমি গান শেষ করতে কে একজন (অন্য এক পিকনিক পার্টির) এসে বলল, খুব ভালো গেয়েছো গানটা, আরেকবার গাও, হ্যাঁ!
হা হা৷ গান গেয়ে এমন স্বীকৃতি আমার সেই প্রথম৷ এবং সেই শেষ৷ আর কখনো আমি মাউথপিস হাতে গান করার সাহস করি নি৷
আমার জীবনে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন গায়কের মৌসুম এসেছে৷ যখন যার মৌসুম এসেছে দেখা যাচ্ছে তার গানই একটানা শুনে যাচ্ছি৷ এক সময় ভূপেন হাজারিকার গান প্রচুর শুনেছি৷ এখন গান শোনার সীমা হেমন্ত-মান্না দে, জগজিৎ সিং আর সুমন-অঞ্জনের মথ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে গেছে৷ বহুদিন আর ভূপেনবাবুর গান শোনা হয় না৷ আজ ঘুম থেকে উঠে যখন ভূপেন হাজারিকার মৃত্যুর খবর পেলাম, তখন অনেক স্মৃতি মাথার মথ্যে নড়েচড়ে বসলো৷
প্রথম যৌবনের সেইসব উত্তাল দিনগুলোতে, বইমেলা বা অন্য কোথাও হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ যখন মাইকে ভূপেন হাজারিকা দরাজ গলায় গেয়ে উঠতেন- গঙ্গা আমার মা... পদ্মা আমার মা... তখন শরীর কেমন শিউরে উঠতো৷ টের পেতাম, গায়ের রোমগুলো সব দাঁড়িয়ে যাচ্ছে৷ অথবা কোন শীতের রাতে বন্ধুর বাসার ছাদে আড্ডা দিতে দিতে হঠাৎ যখন ভেসে আসতো- চোখ ছল ছল করে ওগো মা...
বন্ধু বিস্মিত হয়ে বলতো- দেখ দেখ, রোমগুলো কেমন দাঁড়িয়ে যাচ্ছে!
সেই সব স্মৃতি ভুলবো কি করে?
(একই সাথে গুগল প্লাসে প্রকাশিত)
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই নভেম্বর, ২০১১ রাত ৯:২৯