somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

হাছন রাজার গল্পকথা

০৬ ই ডিসেম্বর, ২০০৮ রাত ১:৫০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

হাছন রাজার গল্পকথা
এম এস রানা


হাওড় অঞ্চলের প্রভাবশালী এক জমিদার। নাম তার আলী রাজা। আলী রাজার পূর্বপুরুষ রাজা বিজয় সিংহদেব থেকে শুরু করে সবাই নামের সঙ্গে রাজা শব্দটি ব্যবহার করেছেন কেবল এই বংশের প্রথম মুসলমান বাবু খান ছাড়া। সিলেটে ওই সময়কার [ইংরেজ আমলে] কালেক্টর আলী রাজাকে দেওয়ান উপাধি লেখার অনুমতি দেন। এরপর থেকে সবাই নামের আগে এ উপাধি ব্যবহার করেছেন।
রামপাশার বিশাল সম্পত্তির মালিক আলী রাজা। সে অঞ্চলের সবচেয়ে বড় হাওড় ছিল আকালুকি। সে হাওড়ের সঙ্গে তুলনা করে আলী রাজার পৌরুষত্ব নিয়ে তখন একটা প্রবাদ প্রচলিত ছিল, হাওড় তো আখালুকি আর যত কুয়া, বেডা তো আলী রাজা আর সব ফুয়া। ফুয়া বা পুয়া মানে পোলা বা ছেলে। আলী রাজার স্ত্রী ছিলেন তিনজন। প্রথম জন নিঃসন্তান অবস্থায় মারা যান। দ্বিতীয স্ত্রীর ঘরে জন্ম নেন ওবেদুর রাজা।
আলী রাজার দ্বিতীয স্ত্রী প্রয়াত হওয়ার পর ওবেদুর রাজা যখন যুবক, তখন সুনামগঞ্জে আলী রাজার মামাতো ভাই কলেরায় মারা গেলে তার স্ত্রী হুরমতজান বিবি বিশাল সম্পত্তি সামলাতে হিমশিম খেতে থাকেন। একপর্যায়ে তিনি আলী রাজাকে বিয়ের প্রস্তাব দেন। আলী রাজা তার ছেলে ওবেদুর রাজার সঙ্গে আলোচনা করে বিয়েতে সম্পত্তি জানান। এই ঘরেই জন্ম নেন আলী রাজার দ্বিতীয সন্তান বাংলার মরমী শিল্পী হাছন রাজা। হাছন ছিলেন তার মায়ের একমাত্র সন্তান।
রামমাশার সম্পত্তি হাছন পয়েছিলেন পৈত্রিকসূত্রে। আলী রাজার জীবদ্দশাতেই মারা যান ওবেদুর রাজা, তার কিছুদিন পরেই মারা যান আলী রাজা। এমতাবস্থায় ওবেদুর রাজার স্ত্রী অর্থাৎ নিজের ভাবিকে বিয়ে করেন হাছন এবং রামপাশা ও সুনামগঞ্জ উভয় অংশেরই সম্পত্তির একমাত্র মালিক হন হাছন রাজা। হাছন রাজারও বহুবিবাহ ছিল।

একমুঠো গল্প
একবার হাছন খাজনা বাবদ দশ হাজার টাকা পেলেন। সেই আমলে ১০ টাকার মূল্য অনেক ছিল। সে টাকা তিনি টেবিলের উপর রেখে সে টেবিলের চারপাশে ঘুরতে লাগলেন। হাছন আপন মনেই কিছু একটা ভাবছিলেন আর ক্ষণে ক্ষণে টেবিলে রাখা টাকাগুলো দেখছিলেন। হঠাৎ করেই তিনি বলে উঠলেন, আল্লাহ আমারে এই দশ হাজার টাকা দিয়ে ভুলাতে চায়? বলেই টেবিল থেকে টাকাগুলো নিয়ে বেরিয়ে গেলেন এবং পুরো টাকাই মানুষের মাঝে বিলিয়ে দিলেন।
বিশ্বনাথ থেকে সিলেটে যাওয়ার পথে হাছন দীঘি নামে একটা দীঘি আছে। শোনা যায় যাওয়ার পথে একবার হাছন ওই এলাকায় পানি খেতে চেয়েছিলেন। কিন্তু কেউ তাকে পানি খাওয়াতে পারছিল না। হাছন রাজা খাবে, তাকে তো আর যেনতেন পানি দেওয়া যায় না। কিন্তু এই গ্রামে রাজাকে খাওয়ানোর মতো সুপেয় পানি নেই। হাছন রাজা সেখানেই ঘোড়া থেকে নেমে গেলেন। রামপাশা থেকে লোকবল আনিয়ে সেখানে দীঘি খুঁড়লেন। তারপর সেই দীঘির পানি পান করে সেখান থেকে গেলেন। ততদিনে পেরিয়ে গেছে তিন মাস সময়!
হাছনের কয়েকটি প্রিয় শখ ছিল। নৌকা ভর্তি করে কমলালেবু নিয়ে বাজারে যেতেন হাছন। তারপর দুই হাত ভরে সেই কমলালেবু ছুড়ে মারতেন মানুষের দিকে। মানুষ সেসব কমলালেবু কুড়িয়ে নিত আর হাছন প্রাণভরে তা দেখতেন। এমনও শোনা যায়, থলে ভরে কাঁচা পয়সা নিয়ে স্কুলঘরে গিয়ে হাছন ছেলেমেয়ের দিকে সেসব পয়সা ছুড়ে মারতেন। ছেলেমেয়েরা সেসব পয়সা কুড়িয়ে নিত আর হাছন তা প্রাণ ভরে দেখতেন।
জোছনা রাতে কদম তলায় রাধা-কৃষেষ্ণর গানের আসর বসত। সেখানে সারারাত নাচ-গান হতো আর হাছন ঘোর লাঘার মতো তা উপভোগ করতেন।

গানের চর্চা
হাছন রাজার বাড়িতে প্রায়ই গানের আসর বসত। পূর্ণিমা রাতে কদম তলায় গানের আসর মাতিয়ে রাখতেন ডিলারাম বিবি, সোনারজান বিবি প্রমুখ। জীবনের শেষদিন পর্যন্ত গানের মাধ্যমে তিনি আত্মশুদ্ধি আর সৃষ্টির রহস্য খুঁজেছেন। কিন্তু হাছন রাজার বহুবিবাহের কারণেই তার মৃত্যুর পরে হাছনের উত্তরাধিকার এবং সম্পত্তির ভাগাভাগি নিয়ে হাজারো রেষারেষি শুরু হয়। ফলে হাছন রাজার পরে এই পরিবারে ধীরে ধীরে ধীরে কমে আসে সঙ্গীত চর্চা। তবে হাছনের ছেলে একলিম রাজা প্রচুর গান লিখেছেন, সুরও করেছেন। তার গানের সংকলন নিয়ে একটি গ্রন্থও প্রকাশ হয়েছে। হাছন রাজার ছেলে একলিম রাজার সর্বকনিষ্ঠ নাতনী ছাজিদা [সাজিদা] বেগমের ঘরের একমাত্র সন্তান রাজবদন। পুরো নাম জিননুরিন নাহার রাজা। কবি একলিম রাজাই এ নামটি রেখেছিলেন। তবে আদর করে তিনি তাকে ডাকতেন রাজন বলে।

প্রসঙ্গ সিনেমা
বাংলাদেশে হাছন রাজাকে নিয়ে একটি চলচ্চিত্র নির্মাণ হয়েছে। হেলাল খান পরিচালিত ও অভিনীত এ ছবির চিত্রনাট্য করেছেন অধ্যাপক মমতাজ উদ্দীন আহমদ। কিন্তু এ চলচ্চিত্রটি নিয়ে রাজবদন তো বটেই, হাছন রাজার বংশধরদের অনেকেরই অভিযোগ আছে। তাদের দাবি এ ছবিতে প্রকৃত হাছনকে তুলে আনা হয়নি বরং তার নামে কিছু কাল্কপ্পনিক দৃশ্যের অবতারণা করা হয়েছে।

এখনো হাছন...
বাংলার মরমী শিল্কপ্পী হাছন রাজা বেঁচে থাকবেন তার সৃষ্টি দিয়ে। এখনো প্রতিবছর তার জন্মদিন ৭ পৌষ তারিখে সুনামগঞ্জে আয়োজন করা হয় হাছন উৎসব। এছাড়া, হাছন রাজার জন্মস্থান লক্ষণ শ্রীতে হাছনের বাসবভনে নির্মাণ হচ্ছে হাছন একাডেমী।
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই ডিসেম্বর, ২০০৮ রাত ১:৫৩
৩টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

খুলনায় বসবাসরত কোন ব্লগার আছেন?

লিখেছেন ইফতেখার ভূইয়া, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৪:৩২

খুলনা প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় তথা কুয়েট-এ অধ্যয়নরত কিংবা ঐ এলাকায় বসবাসরত কোন ব্লগার কি সামুতে আছেন? একটি দরিদ্র পরিবারকে সহযোগীতার জন্য মূলত কিছু তথ্য প্রয়োজন।

পরিবারটির কর্তা ব্যক্তি পেশায় একজন ভ্যান চালক... ...বাকিটুকু পড়ুন

একমাত্র আল্লাহর ইবাদত হবে আল্লাহ, রাসূল (সা.) ও আমিরের ইতায়াতে ওলামা তরিকায়

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৬:১০



সূরাঃ ১ ফাতিহা, ৪ নং আয়াতের অনুবাদ-
৪। আমরা আপনার ইবাদত করি এবং আপনার কাছে সাহায্য চাই।

সূরাঃ ৪ নিসার ৫৯ নং আয়াতের অনুবাদ-
৫৯। হে মুমিনগণ! যদি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। মুক্তিযোদ্ধা

লিখেছেন শাহ আজিজ, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:২১



মুক্তিযুদ্ধের সঠিক তালিকা প্রণয়ন ও ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা প্রসঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেছেন, ‘দেশের প্রতিটি উপজেলা পর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধা যাচাই বাছাই কমিটি রয়েছে। তারা স্থানীয়ভাবে যাচাই... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতীয় রাজাকাররা বাংলাদেশর উৎসব গুলোকে সনাতানাইজেশনের চেষ্টা করছে কেন?

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:৪৯



সম্প্রতি প্রতিবছর ঈদ, ১লা বৈশাখ, স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস, শহীদ দিবস এলে জঙ্গি রাজাকাররা হাউকাউ করে কেন? শিরোনামে মোহাম্মদ গোফরানের একটি লেখা চোখে পড়েছে, যে পোস্টে তিনি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঘুষের ধর্ম নাই

লিখেছেন প্রামানিক, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:৫৫


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

মুসলমানে শুকর খায় না
হিন্দু খায় না গাই
সবাই মিলেই সুদ, ঘুষ খায়
সেথায় বিভেদ নাই।

হিন্দু বলে জয় শ্র্রীরাম
মুসলিম আল্লাহ রসুল
হারাম খেয়েই ধর্ম করে
অন্যের ধরে ভুল।

পানি বললে জাত থাকে না
ঘুষ... ...বাকিটুকু পড়ুন

×