somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

দ্যা রাইড

২৯ শে এপ্রিল, ২০১৮ সন্ধ্যা ৬:৩২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :




গুড়িগুড়ি বৃষ্টির মধ্যে হাইওয়ে ধরে মাইক্রোবাসটি এগিয়ে চলছে সাঁই সাঁই করে। ড্রাইভারসহ ৭ জন মাত্র লোক গাড়িতে। ড্রাইভারের পাশের সিটে বসেছে রফিক সাহেবের ছোট ভাই শফিক ও তার একমাত্র নাতি রোহান; পেছনে রফিক সাহেবের পাশে তার ছেলে শাহেদ ও তার স্ত্রী নীলা বসেছে। সবাই চুপচাপ, কেউ কোন কথা বলছে না। একমনে রাস্তার দিকে তাকিয়ে আছে সবাই। রফিক সাহেবের কাছে ব্যপারটা ভালো লাগছে না। তিনি মোটেও চুপচাপ থাকার মানুষ নন। যেখানেই থাকেন আসর মাতিয়ে রাখেন তিনি। সবার এমন একসাথে চুপ মেরে থাকায় গাড়ির ভেতর কেমন যেন একটা গুমোট ভাব ফুঁটে উঠেছে। রফিক সাহেব চাচ্ছেন নিরবতাটা ভাঙুক। কিন্তু কি বলে যে কথা শুরু করবেন, তা ভেবে পাচ্ছেন না। সবার চেহারায় কেমন যেন একটা উদাসীনতার ছাপ। সবার একসাথে কিছু একটা যেন হয়েছে, যেটা রফিক সাহেব জানেন না। আর যার কারণে তিনি গল্প শুরু করবেন করবেন করেও কিছু বলতে পারছেন না।

এদিকে আশপাশের অন্য সব গাড়িকে পেছনে ফেলে যাওয়ার এক দুর্ণিবার নেশায় পেয়ে বসেছে যেন ড্রাইভারকে। এঁকেবেঁকে এগিয়ে চলছে বাস-ট্রাক-অন্যসব গাড়িদের সাইড কাটিয়ে। গাড়ি ভর্তি লোকজনের সেদিকে কোন ভ্রুক্ষেপ নেই। সবারই শূন্য দৃষ্টি। এদিকে রফিক সাহেবের ভয়ে আত্মাছাড়া অবস্থা। এই গাড়িভর্তি লোক নিয়ে যদি কোন দুর্ঘটনা ঘটে, তবে তো তার পরিবার একসাথে নিশ্চিহ্ণ হয়ে যাবে, কাঁদার জন্য কোন লোক আর তেমন কোন লোক অবশিষ্টই থাকবে না। বারবার চাইছেন যে ড্রাইভারকে একটু সতর্ক করে দিবেন, যেন একটু সাবধানে আর আস্তে চালায়। আরে বাবা এত তাড়ার কি আছে! একটু দেখেশুনে চালাও বাপু। সময়ের চেয়ে জীবনের মূল্যটা যে অনেক বেশি, তিনি ড্রাইভারকে মনে করিয়ে দিবেন। কিন্তু রফিক সাহেবের গলা দিয়ে ঠিক স্বর বের হতে চায় না। গাড়ির আবহাওয়াটাই কেমন যেন অস্বাভাবিক আজ। তিনিও চুপচাপ সবাইকে দেখছেন। মাঝে মাঝে রাস্তার দিকে তাকাচ্ছেন।

পুরনো দিনের স্মৃতিগুলো সব মনে পড়ছে তার আজকে হঠাৎ। এই যে হাইওয়ে- তার চিরচেনা। ইন্টারমিডিয়েট এর পর এই রাস্তা দিয়েই তো ঢাকা এসেছিলেন তার বাড়ি থেকে। এসে ভর্তি হয়েছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। এরপর অনার্স-মাস্টার্স শেষ করে ঢাকাতেই একটা চাকুরি জুটিয়ে নিয়ে ঢাকাতেই স্থায়ী হলেন। বাবা-মা গ্রামে থাকায় বছরে ঈদ বা কোন অনুষ্ঠানে যেতে হতোই। এরমধ্যে বিয়ে করে বউ নিয়ে ঢাকাতেই চলতে লাগলো তার ব্যস্ত জীবন। বাচ্চাটা হলো। সংসার বাড়লো, তবু নিয়মিত গ্রামের বাড়ি যাওয়া হতোই। তবে বাবা-মা দু'জনেই মারা যাবার পর তার নিয়মিত আর তেমন একটা যাওয়া হয় নি। অফিসের ব্যস্ততা আর সন্তানদের স্কুল, এরপর কলেজ-ভার্সিটির ব্যস্ততায় পুরো পরিবান নিয়ে গ্রামে আর যাওয়ার ফুসরতই যেন হয় না। এরপরও রফিক সাহেব বছরে একবার অন্তত একা হলেও গ্রামে আসতেন। আত্মীয়-পরিজনদের সাথে দেখা, পুরনো বন্ধুদের সাথে আড্ডা আর পৈত্রিক সম্পত্তির একটা দেখভালের ব্যাপারও ছিলো। গত কয়েক বছরে অসুস্থতার জন্য আর আসা হয় নি। পুরনো চেনা পথ ধরে বাড়ি ফিরছেন। অদ্ভুৎ অনুভূতি হচ্ছে। সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম দিকে হলের অনাদরভরা দিনগুলোর পর ছুটিতে গ্রামে ফেরার যে আনন্দ হতো সেটা যেন ফিরে পাচ্ছেন রফিক সাহেব। এবার আর একা নন, পুরো পরিবার নিয়েই গ্রামে ফিরছেন তিনি। ভাবতেই বুকের ভেতরটা একটা মৃদু আনন্দে ভরে উঠলো তার। ঠোঁটের কোণে যেন হাসি চিকচিক করছে তার, তিনি ঠিক টের পেলেন।

আশে-পাশের গাড়িগুলোও সরে গিয়ে তাদের যাওয়ার জায়গা দিতে বাধ্য হচ্ছে। একটানা চলতে চলতে একঘেয়ে লাগছে খুব রফিক সাহেবের। কখন যে গাড়ির যাত্রা থামবে, আর কখন তার প্রিয় গ্রামে ফিরে যেতে পারবেন। নাহ, আর ভাল লাগছে না তার। ফাঁকে ফাঁকে পেছনের স্মৃতিগুলো খুব করে মনে পড়ছে তার। সেই শৈশবের বন্ধুদের কথাও মনে পড়ছে খুব। সেই মনসুর, হামিদ, ওমর আলি, শশীভূষণ, ইদ্রিস- সবার কথা মনে পড়ছে। শৈশবে একসাথে কত দূরন্তপণা ! কত স্মৃতি! ওমর আর ইদ্রিস এখন আর গ্রামে থাকে না। ঢাকাতেই থাকে। তবুও ওদের সাথে দেখা-সাক্ষাৎ করা হয়ে ওঠে না। কোন ঈদে কিংবা অনুষ্ঠানে গ্রামে সবাই গেলেই দেখা হয়। আর শশীভূষণ গ্রামেই ছিল। গত বছর মারা গেল। অসুস্থ থাকায় রফিক সাহেবের আর শেষ দেখা হয় নি। বাকিরা গ্রামেই থাকে। তাদের সাথে দেখা হবে। ভেবেই ভাল লাগছে। পুরনো বন্ধুদের সাথে কতদিন দেখা নেই! রফিক সাহেবের ভাবনায় ছেদ পড়ে না। এদিকে গাড়ি চলছে, কোন থামাথামি নেই। একটার পর একটা গাড়ি পাশ কেটে এগিয়ে চলছে।

বেশ কয়েক ঘন্টা ধরে হাইওয়ে ধরে চলার পর অবশেষে গাড়ি গ্রামের রাস্তায় নামল। ঝাঁকুনিতে রফিক সাহেব সম্বিত ফিরে পেলেন। আহ সেই গ্রামের বাতাস! মাটির ঘ্রাণ! কতদিন পর বাড়ি এলেন। বর্ষায় রাস্তার খানাখন্দে কাঁদাপানি জমে আছে। ড্রাইভারের বেশ বেগ পেতে হচ্ছে গাড়িটিকে রাস্তায় ধরে রাখতে। একটু এদিক-সেদিক হলেই গাড়ি রাস্তা থেকে পাশের খাদে যেয়ে পড়তে পারে। ড্রাইভারটি বেশ কায়দা করে গাড়ি চালাচ্ছে। এতক্ষণ বিরক্ত হলেও এবার রফিক সাহবে ড্রাইভারকে বাহবা না দিয়ে পারলেন না। যাক বাবা, ভাল ড্রাইভারই সাথে এসেছে। পুরো রাস্তার বিতশ্রদ্ধ ভাব মুহুর্তেই স্তূতিতে রূপান্তরিত হলো। একেই বলে যেন পল্টি মারা! নিজেই অবাক হলেন রফিক সাহেব।

সামনে কিছুদূর পর পাঁকা রাস্তা শেষ হয়েছে। এখানেই এই অবস্থা! সেখানে গেলে না জানি কি হয় ! রফিক সাহেব চিন্তিত হয়ে পড়েন। গাড়ির চাকা হঠাৎ করেই অতিরিক্ত স্কিড করতে লাগলো। সবাই ভয়ে আঁতকে উঠলো। গ্রামের প্রকৃতির সৌন্দর্য চিড়ে সবার মনে রাস্তা নিয়ে বিরক্তি ফুঁটে উঠল। সত্যি-সত্যিই গাড়িটি কিছুদূর যেয়ে কাঁদায় আটকে গেল। নাহ এ গাড়ি আর যাবে না। শাহেদ ড্রাইভারকে বলছে, আরে ভাই আরেকটু সামনে যায় নাকি দেখেন না। কিন্তু ড্রাইভার অনেক চেষ্টা-চরিত্র করেও গাড়িকে আর সামনে নিয়ে যেতে পারলো না। নাহ, এ গাড়ি আর সামনে যাবে না। সামনে একেবারে হাঁটুকাঁদা। সামনে গেলে এ গাড়ি আর ঢাকা ফিরবে না। এখানেই থাকতে হবে পুরো বর্ষা। রফিক সাহবেও ভাবেন, এ রাস্তায় মাইকেল শুমাখার এলেও গাড়ি চলবে না। সে তুলনায় ড্রাইভারটি ভালই!

এদিকে শফিক সাহেব বাড়িতে কাকে যেন ফোন দিলেন। সবাই গাড়িতেই অপেক্ষা করতে লাগল। কিছুক্ষণ পর কাঁদা ভেঙে একদল লোকজন ছুটে এল। সবাই উৎসুক হয়ে উঁকিঝুকি মারতে লাগলো। রফিক সাহেব ভেবে পান না, এমন উৎসাহের কি আছে। তারা তো আর কোন তারকা পরিবার না। যদিও অনেকদিন পরপর আসার কারণে এলাকার লোকজন তারা এলেই খুব আগ্রহী হয়ে থাকে। কিন্তু এমন উৎসাহ দেখানোর কি আছে? রফিক সাহেব ভেবে পান না।

বিকেল গড়িয়ে যাচ্ছে। ঝিরিঝির বৃষ্টি শুরু হলো এদিকে। রফিক সাহেবের দূর-সম্পর্কের কিছু ভাই-ভাতিজা চলে এল। গাড়ি থেকে সবাই নামল। এবার রওনা দেবার পালা। সবাই গাড়ি থেকে নেমে জুতা হাতে নিয়ে কাঁদা মাড়িয়ে হাঁটা শুরু করল। রফিক সাহেবের জন্য এল একটি খাঁটিয়া। রফিক সাহেবকে খাটিয়ায় শুইয়ে কাঁধে নিয়ে তারা যাত্রা শুরু হলো। গাড়ির যাত্রা শেষ। এবার নতুন যাত্রা শুরু। বৃষ্টি বেড়ে চলছে। বৃষ্টি এসে সবাইকে ভিজিয়ে দিচ্ছে। রফিক সাহেবের উপরে অসীম আকাশ। টুপটুপ বৃষ্টির ফোঁটায় ভিজে যাচ্ছেন। বড় ভাল লাগছে তার। সেই ছোটবেলায় এমন ভিজেছেন খুব। শহরে জীবনে এমন ইচ্ছেমতন ভেজা হয় নি বহুদিন তার। আহ কাঁদামাটির ঘ্রাণ! সীসাবিহীন বৃষ্টির জলে সবুজ গ্রাম তার ! তিনি চলেছেন এক অন্য জীবনের পথে।
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে এপ্রিল, ২০১৮ রাত ১:২৭
৫টি মন্তব্য ৫টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

বাংলাদেশের লোকসংস্কৃতিঃ ব্যাঙের বিয়েতে নামবে বৃষ্টি ...

লিখেছেন অপু তানভীর, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:০০



অনেক দিন আগে একটা গল্প পড়েছিলাম। গল্পটা ছিল অনেক এই রকম যে চারিদিকে প্রচন্ড গরম। বৃষ্টির নাম নিশানা নেই। ফসলের মাঠ পানি নেই খাল বিল শুকিয়ে যাচ্ছে। এমন... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাংলাদেশি ভাবনা ও একটা সত্য ঘটনা

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১০:১৭


আমার জীবনের একাংশ জুড়ে আছে; আমি চলচ্চিত্রাভিনেতা। বাংলাদেশেই প্রায় ৩০০-র মত ছবিতে অভিনয় করেছি। আমি খুব বেছে বেছে ভাল গল্পের ভাল ছবিতে কাজ করার চেষ্টা করতাম। বাংলাদেশের প্রায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাকি চাহিয়া লজ্জা দিবেন না ********************

লিখেছেন মোহাম্মদ সাজ্জাদ হোসেন, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১০:৩৫

যখন প্রথম পড়তে শিখেছি তখন যেখানেই কোন লেখা পেতাম পড়ার চেষ্টা করতাম। সেই সময় দোকানে কোন কিছু কিনতে গেলে সেই দোকানের লেখাগুলো মনোযোগ দিয়ে পড়তাম। সচরাচর দোকানে যে তিনটি বাক্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

=এই গরমে সবুজে রাখুন চোখ=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:২১

০১।



চোখ তোমার জ্বলে যায় রোদের আগুনে?
তুমি চোখ রাখো সবুজে এবেলা
আমায় নিয়ে ঘুরে আসো সবুজ অরণ্যে, সবুজ মাঠে;
না বলো না আজ, ফিরিয়ো না মুখ উল্টো।
====================================
এই গরমে একটু সবুজ ছবি দেয়ার চেষ্টা... ...বাকিটুকু পড়ুন

কুড়ি শব্দের গল্প

লিখেছেন করুণাধারা, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:১৭



জলে ভাসা পদ্ম আমি
কোরা বাংলায় ঘোষণা দিলাম, "বিদায় সামু" !
কিন্তু সামু সিগারেটের নেশার মতো, ছাড়া যায় না! আমি কি সত্যি যাবো? নো... নেভার!

সানমুন
চিলেকোঠার জানালায় পূর্ণিমার চাঁদ। ঘুমন্ত... ...বাকিটুকু পড়ুন

×