দেবী- মিসির আলি প্রথমবার
হুমায়ূন আহমেদ মানেই এদেশে একটা আলাদা ক্রেজ। সেই ক্রেজের সাথে সেই ছোট্টবেলাতেই পরিচয়। যখনই কোন কিছুর সাথে হুমায়ূনের নাম জড়িয়ে থাকে, তখনই এদেশের পাঠক সমাজ হুমড়ি খেয়ে পড়বে সেটাই স্বাভাবিক। দেবী-র ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম হবে না, তা ধর্তব্যই ছিল। গত ১৯ অক্টোবর মুক্তি পেল দেবী-মিসির আলি প্রথমবার চলচ্চিত্রটি। একযুগেরও বেশি সময় আগে পড়া উপন্যাসটি যখন সিনেমার পর্দায় তখন স্বভাতই একটা আকর্ষণ কাজ করেছে আমার মতো আরও অনেক হুমায়ূন পাঠককে।
গত দু'দিন খানিকটা ব্যস্ততার কারণে আর হলমুখো হই নি। আজকে সারাদিন ফ্রি থাকবো জেনে বন্ধু সাগরের দেবী দর্শনের প্রস্তাব পাই। অলসতার কারণে যদিও খানিকটা গড়িমসি ছিল, তবে শেষমেষ হুমায়ূনের নাম আমাকে দেবীর সাথে সাক্ষাতে উদ্বুদ্ধ করে। সাগরের বাসা শ্যামলীর কাছাকাছি হওয়ায় ও আজ সকালেই শ্যামলী সিনেমাতে যেয়ে দুপুর ২.৪০ এর দু'টি টিকেট কেটে নিয়ে আসে। আরও কয়েক বন্ধুকে আমন্ত্রণ জানাই আমাদের দেবী দর্শনের সঙ্গী হতে। কিন্তু আবীর বাংলা মুভি দেখবে না, আর বাপ্পি জয়া আহসানের মুভি পছন্দ করে না। অগত্যা আমি আর সাগর দু'জনেই যাবো বলে স্থির করি। ওদিকে আমার আরেক বন্ধু রাতুল যাবার আগ্রহ প্রকাশ করেও কনফার্ম করে নি। শো শুরুর ঘন্টাখানেক আগে সে জানায় সে ফ্রি আছে। সে শ্যামলীর কাউন্টারে যোগাযোগ করেও টিকেট পায় নি। বোঝাই গেলো দেবী ভালই ক্রেজ তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে।
২.৪০ এর শো। লাইন ধরে প্রবেশ করি। আমরা দু'জন আমাদের আসন খুঁজে নিয়ে বসে পড়ি। শো শুরু হতে মিনিট দশেক দেরি হয়ে যায়। এরপর পর্দা খুলে দু'টো বিজ্ঞাপণের পর জাতীয় সংগীত পর্ব শেষে শুরু হলো আকাঙ্ক্ষিত দেবী। প্রথমেই ১৭৫৭ সালের ফ্ল্যাশব্যাক। এক কিশোরীকে বলী দেবার দৃশ্য। এরপরই চলে আসে ২০১৮ সালের কাহিনীতে। তারপর ভৌতিক আবহের সাথে গল্প এগুতে থাকে।
বহুল পঠিত দেবী উপন্যাসটি পড়া হয় নি এমন হুমায়ূন পাঠক নেই বললেই চলে। তেমনি আমিও বাদ যাই নি। তবে বহুবর্ষ পূর্বে পঠিত উপন্যাসের কাহিনী আমার ঠিক সম্পূর্ণ মনে আছে সে দাবী করা যাবে না। বলতে গেলে আমি ভুলেই গিয়েছিলাম। ভেবেছিলাম সিনেমা আগাবে, আর আমার গল্পের কাহিনী মনে পড়বে। কিন্তু স্মৃতিশক্তি তেমন কিছু মনে করতে না পারায় বলতে গেলে প্রায় সম্পূর্ণরূপে সিনেমার সাসপেন্স কাজ করেছে।
যুগপূর্বে আমি উপন্যাস পাঠকালে যেমন আবহে গল্পটি কল্পনা করেছিলাম, সিনেমাটি আমাকে সে আবহ দিতে সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ। কারণ হিসেবে বলা যায়, চিত্রনাট্যটি সম্পূর্ণ নতুন করে লেখা। কিশোরী বধূ রানু এখানে ছাব্বিশ বছরের যুবতী। আর গল্পের বাড়িটিও অনেক বেশি আধুনিক। আমি কল্পনায় খানিকটা নির্জন জায়গায় বাড়িটি ভেবেছিলাম। সিনেমায় সবই আধুনিক, শুধু বাড়িওয়ালার গাড়িটিই সেই প্রাচীণ আমলের সেডান। গল্প যেহেতু ২০১৮ এর সবকিছু আধুনিক করা হলেও বাড়িওয়ালার গাড়িটিও আধুনিক হতেই পারতো বলে আমার মনে হলো। মিসির আলির সাথে প্রথম পরিচয়ে খানিকটা চটুলতা আছে। আছে খানিকটা বর্ধিত দৃশ্য। পুরো সিনেমা জুড়ে খানিকটা অদল-বদল যা কিনা সিনেমার স্বার্থেই।
মিসির আলি চরিত্র চিত্রায়ণে চঞ্চল চৌধুরিকে খুবই ভালো মানিয়েছে। রানু জয়া আহসানও অভিনয় বেশ ভালোই করেছেন। তবে অনেক বয়সী নারীকে অল্প বয়সী চরিত্রে খানিকটা খটকা লেগেছে। ক্লোজ আপে চেহারার ভাঁজগুলো বারবার ফুঁটে উঠছিল। তারপরও ফিটনেস আর অভিনয় দক্ষতাকে ভালোই বলতে হয়। আনিস চরিত্রে অনিমেষ আইচও ভালো ছিলেন। নিলু চরিত্রে শবনম ফারিয়ার অভিনয় কিছুটা দুর্বল ছিল। ইরেশ যাকের ছিলেন, তবে অভিনয়ের সুযোগ ছিল না তার। বাকি সব চরিত্র আসলে তেমন ফোকাসই হয় নি।
সত্যি বলতে কি দেবীর মতো উপন্যাস ফুঁটিয়ে তোলা অনেক কঠিন। তবে আরও লম্বা সময় নিয়ে করলে হয়তো গল্পটা আরেকটু সুন্দর হতো। তবে সিনেমার দৈর্ঘ্যের একটা সীমা থাকা জরুরী। এর বেশি টানা সম্ভব ছিলো না। একটু দ্রুত আর খানিকটা খাপছাড়া করে গল্পটি শেষ করা হয়েছে। কিছু কিছু সিনে হঠাৎ ঝটকা দিতে সক্ষম ছিলো। ক্যামেরার কাজও ভালো ছিলো। সাউণ্ডের কাজও খুব সুন্দর ছিল। কিছু জায়গায় হাস্যরস দেবার চেষ্টাও চোখে পড়েছে। দেবী হলে যেয়ে দেখার মতো সিনেমাই। আশা করছি পস্তাবেন না।
এবার যদি রেটিং দিতে বলেন, তবে আমি বাংলা সিনেমা হিসেবে ১০ এ ৮ দিবো। তবে পরিচালক অনম বিশ্বাস তার সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছেন, তাকে অভিনন্দন। আরও ভালো পরিচালক হলে হয়তো আরো ভালো কিছু সম্ভব হতো। সবচেয়ে ভালো হতো যদি হুমায়ূন আহমেদ নিজ হাতে কাজটি করে যেতেন। সার্বিক দিক বিবেচনায় কাজটি ভালো হয়েছে। তবে সবচেয়ে বড় কথা পরিচালকের মুন্সিয়ানার চেয়েও একটা ভালো গল্প একটা সিনেমাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে। দেবীর ক্ষেত্রে একথাটি সর্বোতভাবে প্রযোজ্য। আশা করছি সামনে পরিচালকেরা দক্ষিণ ভারতীয় সিনেমা (কাট + কপি + পেস্ট) বা (কাট + এডিট + পেস্ট) বাদ দিয়ে ভালো ভালো মৌলিক গল্প নিয়ে কাজ করবেন। এতে সিনেমা ব্যর্থ হবে না শতভাগ নিশ্চয়তা দর্শকরা দেবে।
বাংলা চলচ্চিত্রের জন্য এমন কাজ আরও দরকার। হলে যান। ভালো বাংলা সিনেমার জন্য অনুপ্রেরণা যোগান। ভালো থাকবেন। আর একটা কথা, বাংলা চলচ্চিত্র দেখবার সময় অবশ্যই হলিউড-বলিউড এর সাথে তুলনায় যাবেন না। ভুল-ত্রুটি ক্ষমা করবেন।
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে অক্টোবর, ২০১৮ ভোর ৪:৪১