হেমন্তকাল চলে এসেছে বেশ কিছুদিন হলো। প্রকৃতিতে শীতের আগমনী বার্তা। বাতাসে শীতের গন্ধে মন চনমন করে ওঠে। সারাটি বছর এই শীতকালের জন্যে অপেক্ষা করি। শীতে যতই কষ্ট হোক কষ্ট মনে হয় না, গরম কালে যতটা কষ্ট লাগে। গরম কালে খালি দোয়া করি আল্লাহ আমাকে বরফের একটা দেশে যাওয়ার সুযোগ দাও, যেখানে ৭-৮ মাস ঠান্ডা, বরফ থাকবে।
আমার রুমের পশ্চিমের জানালা দিয়ে ঠান্ডা বাতাস যখন আসে প্রাণ মন সব জুড়িয়ে যায়। এই সময়ে বান্দার পশ্চিম-উত্তর কোনে দাড়ালে বাতাসে গ্রামের গন্ধ পাই। বুক ভরে শ্বাস নেই। খড়-মাটির মিশেল মাতাল করা সেই গন্ধে যে কী সুখ, কী যাদুকরি ভাললাগা সেটা আমি কাউকে বোঝাতে না পারলেও নিজে ঠিকই উপভোগ করি ।
শীতকাল এলে আমি গ্রামকে প্রচন্ড ভাবে মিস করি। কোথায় হারিয়ে গেল আমার সেই কুয়াশা ভেজা সকাল! আমার বুকটা হাহাকার করে সেই সব স্মৃতি মনে করে! বাড়ী ভর্তি মানুষ। সকালে ঘুম থেকে উঠে কাজিনদের সাথে কলসি হাতে যেতাম গাং পাড় (পদ্মার কাছাকাছি) উদ্দেশ্য খেজুর রস আনা। পেঁয়াজ, রসুন, গম, ধনিয়া ইত্যাদি ক্ষেতের আল দিয়ে যেতাম। সরসে ক্ষেতের মাঝ দিয়ে যাওয়ার সময় হতো সবচেয়ে মজা। খালি কলসি ফুলের সাথে ঘসা দিতে দিতে গেলে শিশিরে ভেজা ফুলের পাপড়িতে কলসি হলুদ হয়ে যেতো। ফেরার পথে শিশির ভেজা মাটি স্যান্ডেলে লেগে স্যান্ডেল ভারী হয়ে যেতো। ঐ ভারি স্যান্ডেল পড়ে হাটতেই আমার ভাল লাগত! ওজন বেশী হয়ে গেলে রাস্তায় থেমে পাটকাঠি বা কোন ডাল দিয়ে খুঁচিয়ে মাটি ফেলতাম, নতুবা একেবারে বাড়ী এসেই।
সরষে খেতের এই ছবি দেখে মনে হচ্ছে এটা যেন আমাদের বাড়ীর পেছনের গ্রামের ছবিটা
বাংলাদেশের সব গ্রাম মনে হয় দেখতে একই রকম।
(ছবি: নেট)
বাড়ী এসে চলত জ্বাল দেওয়ার আগেই কাঁচা রস খাওয়ার উৎসব। বাটি বা গ্লাসে নেওয়ার আগেই ভাল দেখে পাটকাঠি ভেংগে পানি দিয়ে ধুয়ে পাইপ বানিয়ে হাতে নিয়ে রেডী থাকতাম। সেই কাঠি দিয়ে খেতাম রস। ঠান্ডা রস খেয়ে শীতে হিহি করা, আহ কী যে মজা ছিল! একই সিস্টেমে খেতাম ডাবের পানি। কাঁচা রস খাওয়ার পালা শেষ হলে সেটা দিয়ে চলত পিঠা, পায়েস রান্নার ধুম। রস দিয়ে বানানো দুধ চিতই...ওফ শেষ কবে খেয়েছি ভুলে গেছি! তবে এখনো দুধ চিতই ই আমার সব চাইতে পছন্দের পিঠা, যদিও যেই রস পাওয়া যায় তা দিয়ে পিঠা তেমন ভাল হয়না। গ্রামে গেলে রসের পিঠা না খাওয়া গেলেও আলহামদুলিল্লাহ রসটা এখনো খেতে পারি, তবে পরীক্ষার গ্যাড়াকলে পড়ে গত বছর পারিনি খেতে। এই বছরও মনে হয় হবেনা।
পাশের বাড়ীতে ছিল এক গাছি। সারা এলাকার খেজুর গাছ কাটতো সে। মাঝে মাঝে রস নিয়ে বাড়ীতে এলে পিচ্চি পাচ্চারা বাটি নিয়ে যেতো তার কাছে রসের জন্যে। আমার খুব ইচ্ছে করলেও সংকোচে যেতে পারতাম না। আমার মনে পড়েনা তার কাছে থেকে রস খেয়েছি কিনা।
শীতের শেষে খেজুর গাছে মাথি হয়। আহা কী যে মজা সেই মাথি! এটা খেজুর গাছের একদম মাথার দিকের কচি অংশ মনে হয়। গতবছর খেয়েছিলাম অনেক বছর পরে।
ইদানীং নিপাহ ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব থাকায় কাঁচা খেজুরের রস খাওয়া নিরাপদ নয়। যারা খাবেন দেখে-জেনে খাবেন। পরিচিত গাছির রস খাবেন, গাছে ঠিকঠাক জাল দিয়ে হাড়ি ঢাকা কিনা জেনে নেবেন।
একটু দুপুরে হলে শিশির কমলে যেতাম কলই (খেসারী) শাক তুলতে ক্ষেতে। অন্যদের মত আমি ভাল তুলটে না পারলেও খুব ভাল লাগত ঐ একটা দুটো করে তুলতে। বেশীর ভাগ সময়-ই হঠাৎ কোন ছটকা পোকা চোখহে পড়লে চিৎকার দিয়ে বের হয়ে যেতাম ক্ষেত থাকে। ঐদিনের মত শাক তোলা শেষ। এই শাক অনেক এলাকাতেই খায়না, গরুর জন্যে মুলত বোনা হয়। আমাদের এলাকায় গরুর জন্যে বুনলেও কচি শাক প্রায় সবারই খুব প্রিয় খাবার। শীতকালে প্রায় সব বাড়ীতেই প্রতিদিনের কমন একটা খাবার এই কলই শাক ভাজি শুকনও মরিচ ভাজা।
সকাল বেলা রোদে বসে মুড়ি দিয়ে এই কলই শাক খেতে যে কী মজা, যে না খেয়েছে তাকে বোঝানো সম্ভব নয়। সকালে কয়েক বাড়ীর মানুষ একসাথে রোদে বসে মুড়ি, গুড়, কলই শাক খাওয়া হয়। যে শীতে বেশী কাবু সে হাত ধুতে হবে সেই ভয়ে শুকনো খাবারই খেতো আবার যার ক্ষুধা বেশী সে ভাত খেতো। ঠান্ডা কড়কড়ে ভাত সাথে আগের রাতের জমে যাওয়া তরকারী। আমি ঘ্যান ঘ্যান করতাম ভাত খেতে, আম্মা ধমকে টমকে দেরী করাতো শীত একটু কমার জন্যে। এখনো গ্রামে গেলে আমি সকালে যত ঠান্ডাই হোক আমি পিঠা হাত দিয়ে খাই। আগের সেই ঠান্ডা ভাব পাওয়ার জন্যে। এটার মজাই আলাদা।
কোথায় পাবো আমি আমার সেই শীতকাল, কোথায় হারিয়ে গেলো আমার সেই দিন গুলো।
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই নভেম্বর, ২০১৫ বিকাল ৫:১৬