"যার নাই কোন গতি সে করে পন্ডিতি"- এরকম কথাই প্রচলিত আমাদের সমাজে। স্বেচ্ছায় শিক্ষকতাকে পেশা হিসেবে নেওয়ার মত মানুষ এখনো অনেক কম। আমি সেই কম সংখ্যকের মাঝেই একজন হয়ত। পেশা নিয়ে যখন থেকে ভাবতে শিখেছি তখন থেকেই মনে হয় মাথায় গেঁথে গেছে আমি শিক্ষক হবো, একজন আদর্শ শিক্ষক। মুগ্ধ হয়ে যখন কোন শিক্ষকের লেকচার শুনতাম নিজেকে ঠিক ঐ জায়গায় কল্পনা করতাম, ভাবতাম আমি কবে ঐ টেবিলের সামনে দাড়িয়ে এরকম লেকচার দিতে পারবো। রুম ভর্তি ছাত্র-ছাত্রী আমার লেকচার মুগ্ধ হয়ে শুনছে কত যে কল্পনা করেছি এই দৃশ্য ! ঠিক পেশা নয় এটা নেশার মত। দিনের পর দিন লালিত স্বপ্ন। নেশাটাকে, স্বপ্নটাকেই পেশা হিসেবে নিতে চেয়েছি।
একটা সময় ভাবতাম আমি যদি টিউশনিও করতে পারি তাহলেও আমার শিক্ষকতার ইচ্ছে পূরণ হবে। কিন্তু বাস্তবতার মুখোমুখি হয়ে বুঝলাম ভাবনা আর বাস্তবতার মাঝে অনেক তফাৎ আছে। প্রইভেট টিউশনি আপাতত কিছু প্রয়োজন মেটাতে পারে হয়ত, কিছু টাকা হাতে এনে দিতে পারে কিন্তু তৃপ্তিটা ঠিক দিতে পারেনা, আমাকে অন্তত দেয়নি। প্রাইভেট টিউশনির অভিজ্ঞতা আমার খুব একটা ভাল নয় তাই তেমন একটা করাইনি।
মাস্টার্সের একটা কোর্স ছিল প্র্যাক্টিস টিচিং ,সেটার সুবাদে খুবই অল্প কিছু দিনের জন্যে শিক্ষক হয়েছিলাম। বেশ ভাল একটা অভিজ্ঞতা নিয়ে এসেছিলাম সেই অল্প কয়েকদিনে। মাস্টার্স শেষ করলাম। ফুলটাইম বেকারের খাতায় নাম উঠে গেল। হঠাৎ একদিন অফার পেলাম এক স্কুল থেকে। খুবই অল্প সময়ের জন্যে তবে পছন্দের কাজ এবং ভবিষ্যতের জন্যে অভিজ্ঞতাটা কাজে লাগবে তাই দ্বিতীয়বার না ভেবেই সম্মতি দিয়েছি প্রস্তাবে।
কোথাও কাজের ক্ষেত্রে অন্যতম একটি মুখ্য বিষয় হচ্ছে পরিবেশ যেটা খুবই আন্তরিক পেয়েছি। আমার সহকর্মীগণ আমার মায়ের চাইতে বড় থেকে শুরু করে আমার বয়সের। প্রথম দিনেই আমার মায়ের বয়সী একজন ম্যাডাম বললেন, "আসছ তো অল্প দিনের জন্যে কিন্তু যাওয়ার সময় তো কানতে কানতে যাবা" । কথাটা মিথ্যে যে বলেননি সেটার প্রমান প্রথম দিনেই পেয়েছিলাম সবার আন্তরিকতা দেখে।
আমার যেই সাব্জেক্ট তা ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণিতে। ভেবেছিলাম রুটিন সেরকম-ই হবে। কিন্তু রুটিন পেয়ে একটু না, বেশ ভয়ে ছিলাম। কারন ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণিতো আছেই সাথে তৃতীয় শ্রেণির দুই শাখায় ক্লাশ নিতে হবে! এত ছোট বাচ্চাদের কিভাবে সামলাবো সেটা ভেবে অস্থির ছিলাম। কিন্তু সব সময় আমাদের ভাবনা আর বাস্তবতার মিল হয় না। ক্লাশে গিয়ে দেখলাম ছোট্ট ছোট্ট বাচ্চারাই আমাকে খুব সহজে গ্রহন করেছে। প্রথম দিনেই এক বাচ্চা এসে আমাকে চেইনের সাথে পড়ার একটা পাথরের লকেট আমার হাতে দিয়েছিল ! একেবারেই অপ্রত্যাশিত এই ভালবাসার উপহার গ্রহণ করতে পারিনি ঠিক তবে ভালবাসা টুকু যত্ন করে রেখেছি।
যাদের নিয়ে কোন চিন্তা করিনি তাদের সামলাতেই বেগ পেতে হচ্ছে বরং। গল্প কর না, কথা বলো না এই কথা গুলো বলার সময় আমার মনে পড়ে যায় আমিও এসব করে এসেছি! অনার্স-মাস্টার্সেও ক্লাসে বসে বসে গল্প করেছি মাথা নিচু করে, সামনের বেন্ঞ্চের কারো পিঠের আড়ালে বসে। ভেবেছি টিচার হয়ত খেয়াল করছেন না। কিন্তু আজ এই টেবিলের সামনে দাড়িয়ে উপলব্ধি করতে পারি যে এটা এমন একটা টেবিল সেখানে দাড়ালে সব দেখা যায়, শোনা যায়! কোন কিছুই আগোচরে থাকে না। নিজেকে খুব অপরাধী মনে হয় যখন ভাবি আমাদের গল্প, অমনোযোগীতায় শিক্ষকগণ এমন বিরক্ত হতেন। আবার পরক্ষনেই মনে হয় আমার করা কাজ-ই বুমেরাং হয়ে ফিরে এসেছে, পর্যায় ক্রমে এভাবেই এসেছে, আসছে, আসবে।
প্রতিটা স্কুল, কলেজেই সেরা দুষ্টু একটা ব্যাচ বা গ্রুপ থাকে। আমি যেখানে আছি সেখানেও আছে। যদিও আমি এখনো সেই ক্লাশে যাইনি , তবে আশা রাখছি সব শিক্ষকের মুখে যেমন ভয়ংকর শুনছি তেমনটা হবে না।
দোয়া রাখবেন সবাই স্বপ্ন পূরণের যে পথে হাঁটা শুরু করেছি সেটা যাতে থেমে না যায়। সেই দিনটায় যাতে পৌছাতে যেদিন বলতে পারবো, "আমার স্বপ্ন পূরণ হয়েছে, আমি আজ তৃপ্ত"
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে জুলাই, ২০১৭ রাত ১১:২৯