বিশ্বে বসবাসের সবচেয়ে অযোগ্য শহর বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা। গত বছরও ইকোনমিস্ট ইনটেলিজেন্স ইউনিট এর করা এই মন্দ তালিকায় ঢাকার অবস্থান ছিল দ্বিতীয়, ১৪০টি বসবাসযোগ্য শহরের মধ্যে ঢাকার অবস্থান ছিল ১৩৯। আর এবার আমরাই প্রথম। অপরাধের মাত্রা, সংঘাতের ঝুঁকি, স্বাস্থ্যসেবার মান, বাধানিষেধের মাত্রা, তাপমাত্রা, বিদ্যালয় এবং যোগাযোগব্যবস্থা বিবেচনায় নিয়ে মূল্যায়ন করা হয়েছে শহরগুলোর বসবাসের ভালো-মন্দ দিক।
তবুও প্রতিদিন মানুষ ছুটছে শহর পানে। শুধু ঢাকা শহর নয়, দেশের প্রায় সকল শহরই ঘনবসতিপূর্ণ । এর প্রধান কারন সমূহঃ নাগরিক সুবিধাগুলো অতিমাত্রায় শহর কেন্দ্রিক, আধুনিক সুযোগ সুবিধা, শিক্ষা, চিকিৎসা , কর্ম , বিনোদন প্রায় সকল জৈবিক সুবিধার জন্যই মানুষ আজ শহরমুখী।
খুব সকালে ঘুম থেকে জেগে শহরের কাঁচা বাজারে গিয়ে পাবেন তরতাজা শিশির মাখা সব্জি ( যদিও তা কৃত্তিম অথবা ক্ষতিকর রাসায়নিক উপাদানে সমৃদ্ধ),দাম নাগালের মধ্যে না থাকলেও দেখবেন বিশাল বড় রুই মাছ যেটা নড়ে চড়ে প্রানের অস্তিত্ত জানান দিচ্ছে। অপর দিকে গ্রামের বাজারে এই বড় মাছ উৎসবে পার্বণেও খুঁজে পাবেন না। অথচ এই মাছ গ্রামেরই কোন পুকুরে চাষ হয়ে বেশী দামের আশায় চলে আসে শহরের মনোরঞ্জনে।
গ্রামের কোন মেধাবী সন্তান চায় উচ্চ শিক্ষা, তার জন্য দৌড়াতে হবে শহরে। পড়াশুনা শেষে কর্ম দরকার, সেটার জন্যও যেতে হবে শহরে। কেউ গুরতর অসুস্থ, দরকার ভাল চিকিৎসা , সেটাও সেই শহরে। কেউ গ্রামের চায়ের দোকানের রাজনীতি ছেড়ে বড় নেতা হতে চান, তার জন্যও যেতে হয় শহরে আরও বড় নেতার আশীর্বাদ নিতে। চোর, বদমাশ, সন্ত্রাসী তারাও দৌড়ায় শহর পানে। আর কিছু মানুষ দুবেলা দুমুঠো ভাতের জন্য চরম এক অনিশ্চয়তাকে সঙ্গি করে শহর মুখে পাড়ি জমায়। আবার গ্রামে যাদের বিত্ত আছে তারা আধুনিক জীবনের টানে সোনার দামে আবাসন কিনে নগরের নাগরিকত্ত লাভ করে।
হয়তো সোনার সাথে নগরের আবাসনের তুলনা করলে, নাগরিক আবাসন কে অবমুল্যায়ন করা হবে। টাকা থাকলেই সোনা কেনা যায় , সোনার গয়না ব্যবহার করা যায়। কিন্তু শহরের আবাসনের জন্য টাকা এবং প্রত্যক্ষ বা পরক্ষ ক্ষমতা থাকা চাই।
এ ভাবেই এক বুক স্বপ্ন, অনিশ্চয়তা আর ক্ষমতা নিয়ে মানুষের দৌড়ের প্রধান গন্তব্য হয়েছে ঢাকা এবং তার পর অন্যান্য শহর। পাল্লা দিয়ে জনসংখ্যা বাড়লেও সেই হারে নাগরিক সুযোগ সুবিধা বাড়েনি। ফলে আজ ঢাকার নামে কলঙ্ক “ বিশ্বের সবচেয়ে বসবাস অযোগ্য শহর”।
কিছুদিন আগে আমার এক সিলেটী বন্ধু সিলেটের শহরতলীতে এক টুকরো জমি কিনেছে প্রায় ১৫ লক্ষ টাকা দিয়ে। তার জন্মস্থান সিলেটের হবিগঞ্জ জেলা সদর থেকে ১০ কি মি দূরে। সেখানে তাদের সুন্দর একটি বাড়িও আছে। কিন্তু যোগাযোগ ব্যবস্থা এতটাই খারাপ যে প্রতিদিন শহরে এসে শিক্ষা নেওয়া তো দূরের কথা,জরুরী চিকিৎসা সেবার জন্যও জেলা সদরে যাওয়া দুরহ ব্যপার। আর তাই সে প্রবাসের কষ্টে অর্জিত টাকা দিয়ে এক টুকরো জমি কিনে এখন ভাবছে জমির উপর বাড়ি বানানোর অর্থ সে কোথায় পাবে! শুধু মাত্র যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো হলে কষ্টে অর্জিত এই টাকা দিয়ে শহরে জমি না কিনে গ্রামে থেকেই শহরে গিয়ে আধুনিক নাগরিক সুবিধা নিতে পারতো। এই টাকাটা অবদান রাখতো আমাদের অর্থনীতির অন্য কোন খাতে।
অথচ পৃথিবীর অনেক উন্নত দেশেও মানুষ শহর থেকে একটু দূরে নিরিবিলিতে বসবাস করতে ভাল বাসে। নিউইয়র্ক শহরে মানুষ ২০০ কি.মি. দূরে বাস করেও প্রতিদিন অফিস শেষে বাড়ী ফিরতে পারে। উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থার জন্যই সেটা সম্ভব হয়।
আমদের ঢাকা শহর কে বাসযোগ্য করার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহনে দেরী হলেও সময় শেষ হয়ে যায়নি। সেই সাথে অন্য শহর গুলকে বাঁচানোর জন্য দরকার সরকারী বেসরকারী পর্যায়ে পর্যাপ্ত উদ্যোগ। প্রথমেই দরকার গ্রাম মুখী উন্নয়ন নীতি। গ্রামের উন্নয়নের মাধ্যমে শহরের নাগরিক সুবিধা সমূহ পৌঁছে দিতে হবে গ্রাম পর্যায়ে।
করতে হবে সরকারী বেসরকারি সেবা ও প্রশাসনিক প্রতিষ্ঠানের বিকেন্দ্রিকরন। যেন সকল সেবার জন্য মানুষ কে শহর মুখী না হতে হয়। যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন করতে হবে, দাম কমাতে হবে মোটর গাড়ির, যেন গ্রামে বাস করেও খুব সহজে স্বল্পতম সময়ে শহরে পৌঁছানো যায়। বিদ্যুৎ ব্যবস্থা ও ডিজিটাল যোগাযোগ ব্যবস্থার মধ্যে শহর ও গ্রামের মধ্যে বিভেদ দূর করতে হবে। দেশের বিখ্যাত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং চিকিৎসা কেন্দ্রের শাখা বিস্তার করতে হবে গ্রামের মানুষের নাগালের মধ্যে। কর্মক্ষেত্র গুলো শহর কেন্দ্রিক না রেখে বিকেন্দ্রীকরণের মধ্যমে ছড়িয়ে দিতে হবে গ্রাম পর্যায়ে। সেই সাথে মানসিকতার ও পরিবর্তন করতে হবে। বিত্তবানদের শহরে একটি বাড়ী না থাকলে কেমন দেখায়, এই মানসিকতা দূর করতে হবে। আর এ সব গুলোর জন্য চাই সরকারী বেসরকারী ভাবে আন্তরিক গ্রাম মুখী উন্নয়ননীতি। চাই ইলেক্ট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়ার উৎসাহপূর্ণ সচেতনতা মুলক প্রচার। মানুষ গ্রামে বাস করেও পাবে শহরের নাগরিক সুবিধা। শহরমুখি মানুষের স্রোত কমবে , মানুষ হবে গ্রাম মুখী। শহর হবে বাসযোগ্য।