কাগজে কলমে ভারত আমাদের বন্ধু রাষ্ট্র, তারা বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন জিনিস দিয়ে আমাদের উপকার করে, বিনিময়ে কি কি নেয় সেই কথা আর নাই বা বললাম।
কিন্তু ভারতের শতকরা ৬০ জনই মনে করে যে বাংলাদেশ কে দখল করে ভারতের অংগরাজ্য বানানো ভারতের অন্যতম কর্তব্য। ২০০৯-১০ এর দিকে ফেসবুকে তখন বাংলাদেশী ব্যাবহারকারী কম ছিলো, অনেকের লিস্টেই ভারতের ব্যাবহার কারী ছিলো। তাদের সাথে কথা বললে বাংলাদেশ সম্পর্কে তাদের মনোভাব বোঝা যেতো। কথায় কথায় “গরীবরাষ্ট্র” “ছোটোদেশ” বলাটা ছিলো অতি কমন।
তো যাই হোক, মনে করি ভবিষ্যতে ভারত তাদের ৬০ভাগ জনগনের কথা শুনে জোশের বসে বাংলাদেশ আক্রমন করে ফেললো, দেশ বাচাতে তখন সেনাবাহিনীর পাশাপাশি আমাদেরও যুদ্ধ করতে হবে। এখানেও অবশ্যই ২টা দলের সৃষ্টি হবে, বাংগালী মাত্রই দলে বিভক্ত। ৪৩বছর আগে যেহেতু কিছু “খানকির ছেলেরা” ফাকিস্তানের সহায়তা করেছে, নিশ্চিত থাকেন ভারত আক্রমন করলেও এরকম আরেকটা রাজাকারের দল সৃষ্টি হবে। এরকম অবস্থার সৃষ্টি হলে আমি চোখ কান গলা নাক মুখ সব ফুটা বন্ধ করে রাজাকারের দলে নাম লেখাবো।
প্রশ্ন আসতে পারে কেনো রাজাকারে নাম লেখাবো? আসাটাই স্বাভাবিক। একটা কথা বলি, বাংলাদেশ আক্রমন করে ভারত কোনো সুবিধা করতে পারবে না, দেখা যাবে ৪-৫ মাস পর ভারতীয় বাহিনী বাংগালির ধাওয়া খেয়ে ভাগতেছে। ৪৩বছর আগে তৎকালীন বিশ্বের ৩নম্বর সেনাবাহীনি যদি আমাদের বাপ চাচাদের হাতে গো হারা হারে, তাহলে ৪৩ বছর পরে এই বিশ্বের ৬নম্বর সেনাবাহীনির কোনো চান্স নাই।
তারপরও কেনো রাজাকারি করবো? জবাব টা একটু পরে দেই, তার আগে কিছু কাহীনি বলি। ৭১এ যখন পাকিস্তানি বাহীনি হামলা করলো, তখন মোশারফের বয়স ছিলো মোটে ১৭। বাসা থেকে ৭৩০টাকা নিয়ে পালিয়ে যেয়ে মুক্তিযুদ্ধে নাম লেখায়। ৩মাসের সংক্ষিপ্ত ট্রেনিং নিয়ে দেশে আসে। যুদ্ধকরে তার নিজ জেলার পাশের জেলায়। যুদ্ধের মাঝামাঝি অবস্থা, হঠাৎই তাদের কানে খবর আসে যে পাশের গ্রামে বাশু রাজাকারের খুব উৎপাত। সে রাতেই মুক্তিযোদ্ধারা বাশু রাজাকারের ক্যাম্পে হামলা করে, সাথে মোশারফও ছিলো। পায়ে গুলি খায় সে, না একে বারে পঙ্গু হয় নি সে, তবে এরপরে সারাজীবন খুড়িয়ে হাটতে হয়। যাই হোক ঘটনায় ফিরে আসি, ক্যাম্পে আক্রমন হয়। না, বাশু রাজাকার ধরা পরে নি, পালিয়ে যায়। যুদ্ধ শেষে প্রায় ৩মাস পর বাড়ী ফিরে আসে মোশারফ, এসে খারাপ কিছু দেখে না, ঘর যেমন ছিলো তেমনই আছে। খালি লোকগুলো নেই। মোশারফ কে দেখে আসে পাশের বাড়ী থেকে লোকজন আসে, কেউ একজন তাকে জানায় যে তার মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার খবর পেয়ে পাকিস্তানি বাহীনি তার বাসায় হানা দেয়। কাউকে বাচিয়ে রাখার প্রয়োজন মনে করেনি। তার ৬বছর বয়সী ছোটো বোনটাকেও না। বাড়ির পাশে বাশ ঝারে ৭টা কবরও কেউ একজন চিনিয়ে দেয়। এরপরে আর স্বাভাবিক জীবনে ফেরা হয় নি তার। দিন যায়, মাস যায়, বছর যায়। ঘরবাড়িও তার চোখের সামনে বেদখল হয়ে পড়ে। আসেপাশের বাড়িও কেউ তাকে এক বেলা খাওয়ালে খাওয়া জুটতো, নাহলে অভুক্তই থাকতো। টানা তিন দিন অভুক্ত থেকে ক্ষুদার জ্বালায় টিকতে না পেরে এক বাসা থেকে কিছু খাবার চুরি করতে যায় সে, ভাগ্য অতটা ভালো ছিলো না, ধরা পড়ে সে। এরকম চোর এলাকায় থাকলে সবার বিপদ, এর বিচার হওয়া উচিত। তার বিচার হয়, বিচার করে এলাকার চেয়ারম্যান আলহাজ্ব বশির আহমেদ সহ আরো কিছু গন্যমান্য ব্যাক্তি। মোশারফ তার বিচারকদের দেখে শুধু একটু হেসেছিলো। হাসার কারন? কারন আলহাজ্ব বশির আহমেদ কে সে চিনতে পেরেছিলো। বাশু রাজাকার, জীবন বাচাতে পালিয়েছিলো। বিচারে কি হয়েছিলো সে দিকে না যাই, ওল্ড স্টোরি ম্যান। ৪৩বছর আগের জিনিস। পুরানো জিনিস মনে রাখলে উন্নতি করবো কিভাবে আমরা? তাইনা?
ছোটো থেকেই পত্রিকা পড়ার বদ অভ্যাস টা ছিলো। জনকন্ঠ পরতাম। মাঝে মাঝেই খবরে দেখতাম এমুক মুক্তিযোদ্ধা রিকশা চালায়, অমুক মুক্তিযোদ্ধা ভিক্ষা করে অথবা তমুক মুক্তিযোদ্ধা টাকার অভাবে চিকিৎসা করাতে পারছে না। কয়েকদিন পরে খবরে দেখতাম যে সেই তমুক মুক্তিযোদ্ধা চিকিৎসার অভাবে মারা গেছে, পুর্ণসামরিক মর্যাদায় দাফন সম্পন্ন।
একজন লোক, যেকিনা একজন মুক্তিযোদ্ধা। যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর দেশকে মুক্ত করার জন্য অথবা নিজের পরিবার হত্যার প্রতিশোধের জন্য অথবা নিজের দেশকে স্বাধীন করার জন্য অথবা শুধুই আবেগের বশে অথবা কোনো কারন ছাড়াই যুদ্ধ করলো। দেশ স্বাধীনের পরে সে কি পাইলো? না কোনো কিছু পাওয়ার জন্য তারা যুদ্ধ করে নাই। যুদ্ধ শেষে দেখা গেলো রিকশা চালাচ্ছে, শেষে শরীরে কুলাতে না পেরে ভিক্ষা করা শুরু করছে। শেষে বিনা চিকিৎসায় মারাই গিয়েছে।
যে লোকটা সারাজীবন একটা ঘিঞ্জি বস্তিতে চকিতে শুয়ে জীবন কাটিয়েছে, সে বেচারা মারা যাবার পর তাকে সেগুন কাঠের কফিনে ভরে জাতীয় পতাকা মুরে ২১ বার গান স্যালুট দিয়ে পরিপূর্ন সামরিক মর্যাদায় কোনো একটা গন্যমান্য ব্যাক্তিদের কবরস্থানে দাফন করা হলো। বাহ, জিনিসটা ভাল্লাগছে না?
৭১ এ পাকিস্তানি সেনাবাহীনি কোনোভাবেই এই অচেনা একটা জায়গায় গনহত্যা চালাতে পারতো না যদি না খানকির ছেলে রাজাকারেরা অদের সাহায্য না করতো, পথ না দেখাতো। তো যুদ্ধের ৪৩ বছর পর এই রাজাকারেরা রাজার হালে আছে, কারো কোনো বিচার নেই অপরদিকে মুক্তিযোদ্ধারা রিকশা চালায়, ভিক্ষা করে, বিনা চিকিৎসায় মারা যায়।
গনহত্যার মাস্টারমাইন্ড গোয়াজম ৯০ বছরের আরামদন্ড পায়, জনগনের ভ্যাটের টাকায় সুখবিলাস করে। একটু অসুস্থ হলে বঙ্গবন্ধু মেডিকেলে ১১ তলায় রাজার হালে সুপ খায়, আর সেই বঙ্গবন্ধু মেডিকেলেরই ২ তলায় বীর মুক্তিযোদ্ধা রহীম মিয়ারা বেড না পেয়ে ফ্লোরে শুয়ে ধুকে। এর চেয়ে রসিকতা আর কিই বা হতে পারে।
যাই হোক, কথা হচ্ছিলো আমি কেনো রাজাকারি বেছে নেবো। নাহ্, উত্তর টা আপনি ই ধারনা করে নেন