ভূ-পৃষ্ঠ থেকে পুরোপুরি বিলীন হয়ে যাওয়া এই বাংলাদেশেরই একটি শহরের গল্প এটি। বাংলা সাহিত্যের একজন দিকপাল বুদ্ধদেব বসু, যিনি বাংলা সাহিত্যের নিবিষ্ট পাঠকের কাছের মানুষ। যাঁর জন্ম ছিলো এই শহরেই। প্রথম বিশ্বযু্দ্ধের পূর্ব থেকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরুর আগ পর্যন্ত্য যিনি এই শহরে কাটিয়েছেন। আজ যে শহরের কোন অস্তিত্ব এই ভূ-পৃষ্ঠে নেই। শুধু একটি নামই তার প্রতিনিধিত্ব করছে। তাঁরই নিজের স্মৃতিকথা থেকেই এখানে কিছুটা তুলে দিলাম -
"রোদ্দুর মাখা বিকেল টেনিস খেলা। একটি সুগোল মসৃন ধবধবে বল এসে লাগলো আমার পেরাম্বলেটরের চাকায়, বলটি আমি উপহার পেয়ে গেলুম। কিন্তু সে কোন দেশ কোন বছর, আজ পর্যন্ত আমি জানিনা। আমার জীবনের ধারাবাহিকতার সঙ্গে তাদের যোগ নেই। তারা যেন কয়েকটি বিচ্ছিন্ন ছবি। আনেকআগে দেখা স্বপ্নের মতো। বছরের আবর্তনেও সে স্বপ্ন ভূলতে পারিনি। সচেতন জীবন অনবিচ্ছিন্ন ভাবে আরম্ভ হলো নোয়াখালীতে। প্রথম যে জনপদের নাম আমি জানলুম তা নোয়াখালী। নোয়াখালীর পথে এবং আপথে আমার ভূগোল শিক্ষা, আর সেখানেই এই প্রাথমিক ইতিহাস চেতনার বিকাশ যে- বছর বছর আমাদের বয়স বাড়ে। আমার কাছে নোয়াখালী মানেই ছেলেবেলা আর ছেলেবেলা মানেই নোয়াখালী’। অনিন্দ্য সুন্দর সে শহরে ছিলো বাগবাগিচা আর ফলের রকমারি বাগান। গ্রীক পর্তুগীজ আরবীয় ইংরেজ সভ্যতার ছিলো এক মিশ্র ঐতিহ্য।
আগের বাড়িটি একটি বৃহৎ ফল বাগানের মধ্যে। লোকে বলতো কেরুল সাহেবের বাগিচা। জানিনা কেরুল কোন পর্তুগীজ নামের অপভ্রংশ। ফলের এত প্রাচুর্য যে, মহিলারা ডাবের জল দিয়ে পা ধুতেন। খুব সবুজ, মনে পড়ে একটু অন্ধকার, কাছেই গীর্জা। সাদা-কোট পরা জমকালো লোকদের অনাত্মীয় লাগতো। গীর্জার ভিতরে গিয়েছি, ভিতরটা ছমছমে থমথমে। বাইরে সবুজ ঘাস, লম্বা ঝাউগাছ রোদ্দুর। বনবহুল ঘন সবুজ দেশ। সমুদ্র কাছে, মেঘনার রাক্ষুসী মোহনার ভীষন আলিঙ্গনে বাঁধা। সবচেয়ে সুন্দর রাস্তাটির দুদিকে ঝাউয়ের সারি। সেখানে সারাদিন গোল গোল আলো ছায়ার ঝিকিমিকি আর ঝাউয়ের ডালে দীর্ঘশ্বাস। সারাদিন সারারাত দলে দলে নারকেল গাছ উঠছে আকাশের দিকে; ছিপছিপে সখীদের পাশে পাশে।
দেখতে দেখতে কুঁকড়ে ছোট হয়ে গেলো নোয়াখালী। আমি শেষ দেখেছি, শহরের ঠিক মাঝ খানটিতে টাউন হলের দরজায় এসে দাঁড়িয়ে- অমিতক্ষুধা জল। তারপর শুনেছি আরো ক্ষয়েছে। যে নোয়াখালী আমি দেখেছি, যাকে আমি বহন করেছি আমার মনে, আমার জীবনে, আমার স্মৃতিসত্তায়, আজ তার নাম মাত্রই হয়তো আছে, কিংবা কিছু নেই--কিছু নেই’।"
নোয়াখালী জেলার বর্তমান কেন্দ্রস্থল মাইজদীর দক্ষিণে সোনাপুর পেরিয়ে ছিল মূল বৃটিশ আমলের নোয়াখালী সদর। সেখানে ছিল রেসকোর্স মাঠ, বাংলার প্রাচীন স্কুলগুলির একটি নোয়াখালী জিলা স্কুল, ঐতিহাসিক মসজিদ, খ্রিস্টানদের বিখ্যাত গির্জা, পুলিশলাইনসহ অনেক অনেক বিখ্যাত স্থাপনা। তৎকালীন বৃটিশ বাংলার সমুদ্র উপকুলীয় সবচাইতে সুন্দর শহর হিসেবেও এই শহরের সুনাম ছিলো। অপরূপ সেই শহরটিকে গ্রাস করেছে মেঘনা। হারিয়ে গেছে সবকিছু, সবস্মৃতি।
এই শহরটার ভাঙ্গন শুরু হয় ১৯২২ সালে যা ১৯৪৮ সালে সব শেষ করে দিয়ে শান্ত হয়। শহরের সম্পূর্ণ ভাঙ্গন তিনি দেখেননি, তার আগেই নোয়াখালী ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন সারাজীবনের জন্য। শহরের ভাঙ্গন যখন ঠিক মাঝামাঝি এলো তখন তিনি প্রকৃতির ভয়াল রুক্ষতাকে সচক্ষে প্রত্যক্ষ করলেন, প্রত্যক্ষ করলেন একটি গর্বিত শহরের হারিয়ে যাওয়াকে ।
প্রাচীন ভুলুয়া রাজ্যের ইতিহাসেরই পথ পেরিয়ে অনেক শতাব্দি পর নোয়াখালী জেলার গোড়াপত্তন হয় ১৮২১ সালে। বৃটিশ প্রশাসন ১৮২২ সালে নোয়াখালীর জন্যে একটি জয়েন্ট ম্যাজিস্ট্রেটের পদ সৃষ্টি করে। একজন স্বতন্ত্র কালেকটরও নিযুক্ত হন ১৮৩০ সালে। জেলা হিসেবে নোয়াখালী পূর্ণ মর্যাদা লাভ করে ১৮৭৬ সালে। ঐ বছরেই নোয়াখালীতে একজন সেসন জজ ও সিভিল জজ নিয়োগ করা হয় এবং প্রথম পৌরসভা গঠিত হয়।
মেঘনার করালগ্রাসে বুদ্ধদেব বসুর এই অনিন্দ্যসুন্দর শহরটি ভূ-পৃষ্ঠ থেকে হারিয়ে যায়। নোয়াখালী শহর নদীগর্ভে বিলুপ্তির কাজটি ত্বরান্বিত করেছিলো শহরের পানি নিষ্কাসনের জন্য বৃটিশ সরকার কর্তৃক নির্মিত নোয়াখালী খাল। মেঘনার মোহনা হয়ে সাগরের প্রবল জোয়ার এই খালটির মধ্যদিয়ে এসে জেলার তীরবর্তী এলাকায় প্রচন্ডভাবে আঘাত হানতো। কিন্তু প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ডামাডোলে তৎকালীন বৃটিশ সরকারের অনাগ্রহ ও উদাসিনতায় জাঁকজমকপূর্ণ এ শহরটি তার সকল ঐতিহ্য নিয়ে ক্ষুদ্ধ মেঘনার করাল গ্রাসে বিলীন হয়ে যায়। বর্তমান কালিতারা বাজারের কাছে মিউনিসিপ্যালিটির যে শেষ লাইটপোস্ট ছিলো, ঠিক সেখানে এসে নদীভাঙন বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু ততদিনে মূল শহরটির আর কোন অস্তিত্বই রইলোনা।
১৯২২ থেকে ১৯৪৮ সাল পর্যন্ত্য পর্যায়ক্রমে মোট চারদফা ভাঙনের পর পুরোনো মূল নোয়াখালী শহরটি তার বাগ-বাগিচা এবং সৌধমালাসহ চিরকালের মতো হারিয়ে যায় ভূ-পৃষ্ঠ থেকে।
পুরনো শহর নদী গর্ভে বিলুপ্ত হওয়ার পর ১৯৫০ সালে জেলার সদর দপ্তর অস্থায়ীভাবে মাইজদীতে স্থানান্তর করা হয়। ততদিনে বৃটিশরা গিয়ে পাকিস্তানি আমল শুরু হয়ে যায়। যদিও নোয়াখালী শহরটিকে বর্তমান বেগমগন্জে নিয়ে যাবার সিদ্ধান্ত ছিলো। আবার নদীর ক্রমাগত ভাঙ্গনের কারনে বর্তমান ফেণী শহরে (তখন যেটা নোয়াখালী জেলার অন্তর্ভুক্ত ছিলো)নোয়াখালী শহরকে নেয়ার মত প্রশাসনের অনেকের ছিলো। কিন্তু হঠাৎই নদীভাঙ্গন বন্ধ হয়ে যাওয়ায় এবং প্রশাসনিক সিদ্ধান্তহীনতায় শহরটি মাইজদীতেই রয়ে যায়। পুরনো শহরের নদী ভাঙা মানুষগুলো তাদের বাড়ী-ঘর, দোকান-পাট, ব্যবসা-বাণিজ্য ও সহায় সম্পত্তি সবকিছু হারিয়ে মাইজদীতে কোন রকম মাথা গোঁজার মত ঠাঁই করে নেয় মূল রাস্তার দুপাশে। ক্রমান্বয়ে এখানে বসতি ও জনপদ গড়ে উঠে। ১৯৫৩ সালে বর্তমান এলাকা নিয়ে এক সরকারী বিজ্ঞপ্তিতে নোয়াখালী পৌর এলাকা ঘোষণা করা হয়। ১৯৬২ সালে মাইজদীকে নোয়াখালী জেলার স্থায়ী সদর দপ্তর হিসাবে সরকারিভাবে স্বীকৃতি দেয়া হয়। আমার দৃষ্টিতে বর্তমান নোয়াখালী শহর তথা মাইজদী শহরটি বাংলাদেশের বিভাগীয় শহরগুলির বাইরে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ও সুন্দর একটি শহর। যদিও বর্তমান অবস্থা আমি জানি না, কারন বর্তমান শহরেও আমার যাওয়া হয়নি আজ প্রায় ১৫ বছর।
যদিও নোয়াখালী আমার জন্মশহর নয়, অরিজিনও নয়, তথাপি বুদ্ধদেব বসুর মতই আমিও এই শহরেই আমার জীবনের মূ্ল্যবান ১০টি বছর কাটিয়েছি বাবার চাকুরীসুত্রে। আমার স্কুলটিও এই বাংলারই প্রাচীন স্কুলগুলির একটি, নোয়াখালী জিলা স্কুল। যার স্থাপনাকাল ১৮৫৩ সাল। বুদ্ধদেব বসু বর্ণিত পুরোনো শহরে যে স্কুলটির শুরু। শহর ভেঙ্গে যাবার পর মাইজদীতে ১৯৫০ সালে স্কুলটি বর্তমান স্থানে নতুন করে গড়ে তোলা হয়। বুদ্ধদেব বসুর মতই সারাজীবনই আমিও একই নামের শহরটার স্মৃতি সাথে নিয়ে বেড়াব।
মেঘনা নদীর মোহনা বা বঙ্গোপসাগর এখন আর কাছে নেই। চর পড়তে পড়তে দক্ষিণে সরে গেছে পঞ্চাশ কিলোমিটারের ও বেশি, গুগল আর্থে দেখলেই বোঝা যায় আগামী কয়েক বছরে সমুদ্র আরও অনেক কিলোমিটার দক্ষিনে সরে যাবে। সমুদ্রগর্ভ থেকে জেগে উঠেছে বিশাল ভূমি। নতুন করে গড়ে উঠেছে জনবসতি।
বুদ্ধদেব বসু একজায়গায় বলেছেন - "অপূর্ব এক নৈসর্গিক সৌন্দর্যে ভরা ছিলো সেই পুরোনো শহর। পথে পা বাড়ালেই ছিলো কাব্যের উপমা। প্রকৃতিতে থাকতো অপরুপ ব্যাঞ্জনা। এমন কোনো পথ ছিলোনা নোয়াখালীর, যাতে হাঁটিনি। এমন মাঠ ছিলোনা যা মাড়াইনি, দূরতম প্রান্ত থেকে প্রান্তে। শহর ছাড়িয়ে বনের কিনারে। নদীর এবড়ো থেবড়ো পাড়িতে, কালো কালো কাদায়, খোঁচা খোঁচা কাঁটায়, চোরাবালির বিপদে’।"
তাঁর ৭০ বছর পরে আমার অনুভূতিও প্রায় একই..........যদিও আমি পুরোনো শহরটিকে দেখিনি।
তথ্য ও সহযোগীতা সুত্র :
১) নোয়াখালীর ঐতিহাসিক ও ভূতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য : সানাউল্লাহ নূরী
২) মেঘনা গর্ভে নোয়াখালীর প্রাচীন শহর : সালাদিন
৩) বুদ্ধদেব বসুর নোয়াখালী : মাহমুদুল হক ফয়েজ
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা মার্চ, ২০১২ রাত ১০:৩৭