বাংলাসাহিত্যের জীবন্ত কিংবদন্তী লেখক হুমায়ূন আহমেদ। তিনি শুধু বাংলাদেশে নয়, উপমহাদেশের সব লেখকদের চেয়ে জনপ্রিয় লেখক। আজ তার ৬৩তম জন্মদিন বিশ্বের বিভিন্ন উদযাপিত হচ্ছে। প্রিন্ট মিডিয়া ও ইলেকট্রি মিডিয়াও বিপুল আয়োজন করেছে। আজ থেকে ১৩ ব্ছর আগে তিনি জন্মদিনে দৈনিক প্রথম আলোয় লেখেছিলেন," যে যারে নিন্দে, সে তার দুয়ারে বসে কান্দে"। তিনি এর ব্যাখ্যায় বলেছিলেন, "তিনি ছোট্রবেলায় বড়দের জন্মদিন পালন দেখলে বা শুনলে বলতেন বুড়ুদের আবার জন্মদিন পালন করতে হয় কি? তারা কি বুড়ুখুকু? এখন নিজের বেলায় তাই হয়েছে।"
এখন আমার কাছে মনে হচ্ছে তিনি হয়তো ১৩বছর আগে হয়তো ভাবেন নি তার জন্মদিন বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এভাবে জাকজমক ভাবে পালন করা হবে। বর্তমানে তিনি ১৩ সেপ্টেম্বর থেকে সস্ত্রীক নিউইয়র্কে এসেছেন ক্যান্সার চিকিৎসার জন্যে। কুইন্সের জ্যামাইকায় একটি বাড়ি ভাড়া করে থাকছেন। সেখানে অবস্থানরত হুমায়ূন আহমেদ চিকিৎসার পাশাপাশি লেখালেখীও অব্যাহত রেখেছেন।
গত ৯ নভেম্বর থেকে লেখকের জন্মদিন উপলক্ষে জ্যাকসন হাইটসের মুক্তধারার ইলেকট্রনিক বিলবোর্ডে প্রদর্শিত হচ্ছে—‘Happy 63rd Birthday to Humayun Ahmed, 13th Nov 2011, Humayun Mela in NY’। আর আজ মুক্তধারায় হবে দিনব্যাপী হুমায়ূন আহমেদের বইয়ের মেলা। লেখককে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জ্ঞাপন, আলোচনা অনুষ্ঠান, কেক কাটা এবং থাকছে নতুন গ্রন্থ ‘রংপেন্সিল’-এর মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠান। জন্মদিন উপলক্ষে অন্যপ্রকাশ থেকে প্রকাশিত গ্রন্থটির মোড়ক উন্মোচন করবেন বিশিষ্ট লেখক ও গবেষক গোলাম মুরশিদ। ৬৩টি বেলুন, গোলাপ আর মোমবাতি ছাড়াও লেখকের বিভিন্ন ধরনের পোর্ট্রেট দিয়ে মুক্তধারাকে সাজানো হয়েছে। আজ থেকে এবং -এ লেখকের ৬৩টি বই বিশ্বব্যাপী বিক্রির ব্যবস্থা করা হয়েছে। নতুন গ্রন্থ ছাড়াও এ মেলায় লেখকের প্রকাশিত শতাধিক গ্রন্থ প্রদর্শন করা হবে। বিকাল ৬টা থেকে শুরু হবে আলোচনা অনুষ্ঠান। চলবে রাত ১১টা পর্যন্ত।
আজ থেকেই আমাজন ডট কমে হুমায়ূন আহমেদের বই বিক্রি শুরু হবে। নিউইয়র্কের মুক্তধারার কর্ণধার বিশ্বজিৎ সাহা জানান, আমাজন ডট কমে এটি হবে প্রথম কোনও বাংলাদেশি লেখকের বই বিক্রির কার্যক্রম।
তিনি জানান, লেখকের শরীর ভাল থাকলে তিনি মুক্তধারায় আসতে পারেন ভক্ত-অনুরক্তদের সঙ্গে জন্মদিনের শুভেচ্ছা বিনিময় করতে।
অন্যদিকে আজ শাহবাগে পাবলিক লাইব্রেরি চত্বরে আয়োজন করা হয়েছে সাত দিনব্যাপী হুমায়ূন আহমেদের একক বইমেলা। এদিন বিকাল সাড়ে ৩টায় মেলা উদ্বোধন করবেন লেখক-জননী আয়েশা ফয়েজ। একই সঙ্গে তিনি জন্মোত্সব উপলক্ষে প্রকাশিত হুমায়ূন আহমেদের আত্মজৈবনিক গ্রন্থ ‘রংপেন্সিল’-এর মোড়ক উন্মোচন করবেন। মেলার উদ্বোধনী দিনসহ প্রতিদিন সন্ধ্যায় মঞ্চে থাকছে অনুগল্প পাঠ, স্বরচিত কবিতা পাঠ, আবৃত্তি ও পথনাটক। মেলা ১৯ নভেম্বর পর্যন্ত প্রতিদিন সকাল সাড়ে ১০টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত খোলা থাকবে।
এদিকে সকল আশংকা পিছনে ঠেলে দিয়ে ৭ নভেম্বর নিউইয়র্কে বিশ্বখ্যাত মেমরিয়াল স্লোন-ক্যাটারিং ক্যান্সার হাসপাতাল সেন্টারে জনপ্রিয় লেখক হুমায়ূন আহমেদের চতুর্থ কেমোথেরাপি প্রদানের কাজ সম্পন্ন হয়েছে। হাসপাতালের ইন্টারন্যাশনাল অনকোলজি ডিপার্টমেন্টের ক্লিনিক্যাল পরিচালক ক্যান্সার বিশেষজ্ঞ ড. ভেচ স্টিফেনের তত্বাবধানে ১৬ সেপ্টেম্বর থেকে হুমায়ূন আহমেদের কেমোথেরাপি শুরু হয়েছে এবং ১৪ দিন অন্তর থেরাপি দেওয়া হচ্ছে। তিনটি থেরাপি দেয়ার পর তার শরীরে চতুর্থ কেমোথেরাপি দেয়ার মত পরিস্থিতি রয়েছে কিনা তা যাচাই করা হয় ৭ নভেম্বর সকালে।
এদিন সকাল সাড়ে ৯টায় হুমায়ূন আহমেদ স্ত্রী অভিনেত্রী মেহের আফরোজ শাওন এবং বিশ্বজিৎ সাহাকে নিয়ে ম্যানহাটানের ক্যান্সার হাসপাতালে যান। এরপর তার রক্ত পরীক্ষার জন্যে নেওয়া হয়। ঘন্টাখানেক পর কিছুটা স্বস্তিবোধ নিয়ে বের হন। এরপরই বেলা ১২টায় চতুর্থ কেমোথেরাপি শুরু হয় অর্থাৎ তার শরীরে কেমোথেরাপি না নেয়ার মত কোন সমস্যা ছিল না। আড়াই ঘন্টা পর তিনি হাসপাতাল ত্যাগ করেন। ১৮ নভেম্বর পুনরায় তাকে যেতে হবে ঐ হাসপাতালে ক্যাটস্ক্যান করতে। সে সময় চিকিৎসকরা তার সর্বশেষ পরিস্থিতি পর্যালোচনা করবেন। সেদিনই স্থির করা হবে যে তার চিকিৎসার জন্যে সার্জারির প্রয়োজন রয়েছে কিনা।
হুমায়ূন আহমেদ একধূব্রতারা। যারা তার নিন্দুক,তারাও এসত্য স্বীকার করেত বাধ্য। কেউ কেউ বলে থাকেন তিনি বানিজ্যিক ভাবে লেখেন, এগুলি সাহিত্যে বিবেচিত হবে না। এগুলি ক্ষণিকের আবেদন সৃষ্টিশীল। তাকেও জিজ্ঞেস করা হলে কিছু কালজয়ী উপন্যাস লেখতে যার আবেদন কাল থেকে কালান্তর পর্যন্ত থাকে। তিনি হেসে বলেন, আমার মধ্যে কালজয়ী কিছু থাকলে তা আপনাআপনি বেরিয়ে আসবে। জোর করে কালজয়ী লেখা আসেনা। এই কথাগুলি শুনার এক যুগের বেশী হয়ে গেছে। তিনি কিছু কালজয়ী উপন্যাস রচনা করেছেন। যেমন `জননী ও জোসনার গল্প' , মাতাল হাওয়া' গৌরীপুর জংশন সহ আরো কিছু। তবে সব পাঠকের চাহিদা তো আর এক নয়। কয়েকবছর আগে ইন্টারনেটে তার একটি সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন বাড়তি আয়ের জন্য লেখালেখি শুরু করেছিলেন। সাহিত্য সৃষ্টির জন্য নয়। এখন তার সৃষ্টিসম্ভার আমাদের জন্য আলোকবর্তিকা।
হুমায়ূন আহমেদ ১৯৪৮ সালের ১৩ নভেম্বর নেত্রকোনার কুতুবপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবার নাম ফয়জুর রহমান আহমেদ এবং মা আয়েশা ফয়েজ। তিনি বগুড়া জিলা স্কুল থেকে ১৯৬৫ সালে মাধ্যমিক, ১৯৬৭ সালে ঢাকা কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৭০ সালে রসায়নে স্নাতক (সম্মান), ১৯৭২ সালে স্নাতকোত্তর (রসায়ন) পাস করেন। পিএইচডি করেন ১৯৮২ সালে নর্থ ডাকোটা ইউনিভার্সিটি থেকে।
পেশাগত জীবনে তিনি ঢাকা বিশ্ববদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগে অধ্যাপনা করেছেন। পরে তিনি স্বেচ্ছায় অবসর নিয়ে লেখালেখি ও চলচ্চিত্র নির্মাণে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। তার উল্লেখযোগ্য উপন্যাসের মধ্যে রয়েছে—নন্দিত নরকে, লীলাবতী, কবি, শঙ্খনীল কারাগার, দূরে কোথায়, সৌরভ, নী, ফেরা, কৃষ্ণপক্ষ, সাজঘর, বাসর, গৌরীপুর জংশন, নৃপতি, অমানুষ, বহুব্রীহি, এইসব দিনরাত্রি, দারুচিনি দ্বীপ, শুভ্র, নক্ষত্রের রাত, কোথাও কেউ নেই, আগুনের পরশমণি, শ্রাবণ মেঘের দিন, মেঘ বলেছে যাবো যাবো, জোছনা ও জননীর গল্প ইত্যাদি।
উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্রের মধ্যে রয়েছে আগুনের পরশমণি, শ্যামল ছায়া, শ্রাবণ মেঘের দিন, দুই দুয়ারী, চন্দ্রকথা এবং নয় নম্বর বিপদ সঙ্কেত। সাহিত্য ও চলচ্চিত্রে বিশেষ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি একুশে পদক (১৯৯৪), বাংলা একাডেমী পুরস্কার (১৯৮১), হুমায়ূন কাদির স্মৃতি পুরস্কার (১৯৯০), লেখক শিবির পুরস্কার (১৯৭৩), মাইকেল মধুসূদন দত্ত পুরস্কার (১৯৮৭), জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার (১৯৯৩ ও ১৯৯৪), বাচসাস পুরস্কার (১৯৮৮) ইত্যাদি পেয়েছেন।
আমরা এই জনপ্রিয় লেখকের সুস্থতা ও শতায়ূ কামনা করছি। তিনি যেন ফিরে আসেন স্বজনদের মাঝে। ফিরে আসেন পৃথীবির লক্ষ লক্ষ পাঠকের কাছে সবসময় নতুন বই নিয়ে। যেভাবে তিনি দীর্ঘ তিন যুগ থেকে পাঠকের দুয়ারে কড়া নাড়েন, হৃদয়ে হানা দেন।
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই নভেম্বর, ২০১১ ভোর ৪:৪৩