ডোভার রোড, সিংগাপুর।
গত শুক্রবার রাতে (5ই মে, 2006। সিংগাপুর) মাশীদ তার প্রতিশ্রুতি অনুসারে কাঁচকি মাছ রান্না করে খাওয়ার জন্য নিমন্ত্রন করে আমি সহ আমাদের ল্যাবের আরেক বাংলাদেশী এবং আমাদের আরেক ব্যাচমেইটকে সস্ত্রীক। ল্যাব শেষ করে বাসায় ফিরে রান্না গুছিয়ে উঠতে উঠতে ওর প্রায় রাত দশ। এর ভিতরে কয়েক প্রস্থ এসএমএস বিতরণ করে মাশীদ নিশ্চিত করলো দশটার ভিতরে সব প্রস্তুত হয়ে যাবে, তখন যেন আমরা যাই।
সময় মতো বাস ধরে চলে যাই পোস্ট গ্রাজুয়েটদের বাসস্থান গিলম্যান হাইটসে। মাশীদের এ্যাপার্টমেন্ট প্রায় আঁকাশ ছোয়া পনেরো তলায়। গিয়ে দেখি টেবিল ভর্তি আয়োজন। বারবার কম আইটেম, কম আইটেম বলার পরেও দেখি অবিশ্বাস্য দ্রুততায় মাশীদ তৈরী করে রেখেছে আলু ভতর্া (বেস্ট), ঢেড়স ভাজি (সেকেন্ড বেস্ট), শশা দিয়ে চিংড়ি মাছ (আমার ভাগে ইচ্ছে করে বুড়ো শশাগুলো ছিলো, তবু খাবারটা যথেষ্ট সুস্বাদু, তাড়িয়ে তাড়িয়ে ওটার ঝোল দিয়ে ভাত মাখিয়ে খেয়েছি), ঘন ডাল (সিংগাপুরে ওর প্রথম রান্না ডাল, তবুও বলবো এ ক্লাস) আর মেইন আইটেম কাঁচকি মাছ (এই জিনিস সিংগাপুরে আবিস্কার করাটা একটা বিস্ময়) .. আর কি ছিলো? ও ভাত, আচার (2 পদ)। এত দ্রুত (2 ঘন্টারও কম সময়ে) 'খুব বিরক্তিকর একটা হটপ্লেট' আর একটা মাইক্রো ওভেনে এতগুলো আইটেম কিভাবে রাঁধলো এটা নেক্সট টাইম কাছ থেকে দেখে তবেই রহস্য মীমাংসা করতে হবে! আন্দাজে বলতে পারছি না।
কনুই ডুবিয়ে খেয়েছি। আমি নিজে রান্না বান্না করি কম। যা করি জোড়া তালি, ভাত আর আরেকটা পদ। আলস্য লাগলে পাউরুটি দিয়ে সেরে নেই। বেশিরভাগ সময়ে ভার্সিটির ক্যান্টিনে দক্ষিন ভারতীয় খাবার, মালে, চীনা বা জাপানী খাবার খেয়ে দিন কাটে। আমার জিহ্বায় তাই প্রত্যেকটা খাবার বিশেষ অমৃত লেগেছে। ছড়িয়ে ছিটিয়ে কেউ ডাইনিং টেবিলে, কেউ সোফায় পা উঠিয়ে বসে খেলাম। কে বলে জীবন সুন্দর না?! উপভোগ করতে জানলে শর্ষে দিয়ে আলু ভতর্াও স্বগীর্য় মনে হয়।
খাওয়ার মধ্যে হঠাৎ মাশীদের হাক, এই গরুর মাংশ রান্না করা আছে আগের একটু, কেউ খাবি? বাকিদের খাওয়া তখন প্রায় শেষ, আমি উৎসাহে ওকে আশ্বস্ত করি .. 'আমি আছি'। নিজের ভাত খাওয়া ফেলে দৌড়ে ফ্রিজ থেকে বের করে নিয়ে, ওভেনে গরম করে ফ্যালে মুহুর্তের ভিতরে। আমি দীর্ঘশ্বাস লুকিয়ে সোফায় বসে বসে মনে মনে ভাবি, এই মেয়েটা এত ভালো কেন !!
আগের রান্না করা গরুর মাংশটা ছিলো কাস!! মাংশ যত বাসী হয় তত মজা হয় এই তথ্যতো সবাই জানেন। আর তারচেয়ে বড় কথা ওটার মসলার ব্যবহার ছিলো জটিল, সাথে ছোট আলু, তলানীর ঝোল। আর কিছু বলতে হবে? ভাত খাওয়া শেষ তখন, পেট টইটুম্বুর ... তবুও ভাত টাত ছাড়াই মাংশের টুকরোগুলো খেয়ে নিলাম। শুকর আলহামদুলিল্লাহ।
খাওয়ার পরে কিঞ্চিৎ বাতচিত, আমি মাশীদের বিছানায় পাওয়া গেমবয়টা নিয়ে হালকা বিভিন্ন গেম ট্রাই করছিলাম (শ্রেক টু বেশি ভালো ছিলো)। সেটা হাইজ্যাক করার চিন্তাটাও বলে ফেলেছি, কিন্তু পরে আবার ভুলেও গ্যাছি। হঠাৎ প্রস্তাব সুইমিং পুলের পাড়ে চলো, বাতাস আছে ওখানে; ল্যাপটপে নাটক দেখা হবে।
নাটক দেখা (2টা), শিশুদের কর্ণারে দোলনায় দোল খেতে খেতে আড্ডা, সুইমিং পুলে গভীর রাতে সাতার কাটা দুইজন মানুষের কান্ডজ্ঞান নিয়ে সমবেত গবেষণা, সামহোয়্যারের ব্লগ থেকে বেছে হিমুর দুটি চরম হাসির পোস্ট জোরে জোরে পড়া (মাশীদ পড়ে শুনিয়েছে) সবাই হাসিতে লুটিয়ে পড়া (একই সাথে হিমু ব্যাটা এত ভালো ক্যামনে ল্যাখে এইটা নিয়ে আমাদের হা হুতাশ ও গোপন গর্ব) ইত্যাদি সব শেষ করে বাসায় ফিরতে ফিরতে ভোর তখন প্রায় 6টা। মাশীদ তখন আমাদের ক্যাবে উঠিয়ে বিদায় জানাচ্ছে গিলম্যান হাইটসের সিড়ির কাছে দাড়িয়ে।
আকাশে তখন পরম রহস্যময় তার অপরূপ মোহনীয় আলোর বর্ণচ্ছটা ছড়াতে শুরু করেছেন। জীবনের অসংখ্য রাতের ভিতরে এক রাতের স্মরণীয় কিছু স্মৃতি মস্তিষ্কের কোঠরে ধারন করে নিয়ে আমরা ফিরে যাই নিজ নিজ ঘরে।
ভালো থাকিসরে মাশীদ। থ্যাংকস ফর দা ট্রাবলস। তোর জন্য আজীবন শুভ কামনা।
ছবি: কোন এক বাংলাদেশী অনুষ্ঠানে আমাদের এক বন্ধু সহ, আমি ও মাশীদ।
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই মে, ২০০৬ দুপুর ১:১৫