১৯৭১ সালের মার্চ মাসে কুমিল্লা ময়নামতি ক্যান্টনমেন্টে গণহত্যার হাত থেকে আমার আব্বাসহ যে কয়জন বাঙালি ডাক্তার বেঁচে গিয়েছিল তাদেরকে পাকিস্তানি মিলিটারিরা জুলাই মাস পর্যন্ত বন্দী করে রাখে। আগস্ট মাসের শুরুর তাদের ছেড়ে দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পশ্চিম পাকিস্তানে বদলির অর্ডার দেয়। বাকি সব ডাক্তাররা তাদের ফ্যামিলি সহ পাকিস্তানে গেলেও আমার আব্বা একলাই ২০শে সেপ্টেম্বর, ১৯৭১ সালে পশ্চিম পাকিস্তানে যান। আব্বা যাওয়ার পর থেকে আমি অপেক্ষায় ছিলাম আমরা সবাই কবে আব্বার কাছে যাব তার জন্য।
পাকিস্তান আমলে পূর্ব আর পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে যাতায়াত করতে হত বিমান যোগে। ভারতের উপর দিয়ে পাকিস্তানি এয়ারলাইন্স (পি. আই. এ.) এর বিমানগুলি উড়ে যেত। তবে ১৯৭১ সালের জানুয়ারী মাসে কাশ্মীরে ভারতীয় বিমান হাইজেকিং এর ঘটনার পর থেকে ভারত তাদের আকাশ সীমায় পাকিস্তানি বিমান চলাচল নিষিদ্ধ করে দেয়। যার ফলে পি. আই. এ. বিমানগুলি পাকিস্তান থেকে শ্রীলঙ্কা ঘুরে ঢাকায় আসত। ১৯৭১ সালে পাকিস্তান মিলিটারি তাদের সি-১৩০ সামরিক পরিবহন বিমান ছাড়াও পি. আই. এ. যাত্রিবাহী বিমানগুলিও সেনা পারাপারের কাজে ব্যাবহার করছিল। তাই সেই সময়ে সাধারন লোকের পক্ষে পশ্চিম পাকিস্তানে যাওয়ার টিকেট পাওয়া দুস্কর ছিল।
আমার আম্মারা ৪ ভাই, ৮ বোন। তাদের মধ্যে ছয়জন খালাম্মা আর দুই মামা তখন ঢাকায় ছিলেন। আব্বা পাকিস্তানে যাওয়ার সময় আমাদেরকে ঢাকার পুরানা পল্টনে হেনা খালাম্মাদের বাসায় রেখে গিয়েছিলেন। আব্বা চলে যাওয়ার পরে আম্মা আমাদেরকে সাথে নিয়ে পুরানা পল্টনের খালাম্মা সহ অন্য বেশ কিছু খালাম্মা আর মামাদের বাসায় ঘুরে ঘুরে কয়দিন থাকলেন। তখন আমরা পল্টন ছাড়াও সুখন খালাম্মা, বড় খালাম্মা, মেঝ খালাম্মা আর সেজ মামার বাসায় কিছু দিন ছিলাম বলে মনে আছে।
আমার চতুর্থ খালাম্মার ডাক নাম ছিল সুখন। খালুজানের নাম আমির হোসেন, উনি পি-ডাব্লিউ-ডির ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন। ওনারা তখন ঢাকার ইস্কাটন গার্ডেনের সরকারী স্টাফ কলোনীতে অরুনিমা নামের বিল্ডিংটায় থাকতেন। সেখানে আরো বিল্ডিং ছিল, সেগুলির নাম ছিল - সাগরিকা আর নীহারিকা। তাদের ছেলে মেয়েদের নাম - বেবি আপা, রীতা আপা, অপু ভাইয়া, দীপু ভাইয়া আর বাবুল ভাইয়া। এছাড়াও আমার নানু, ছোট মামা (আব্দুস সোবহান জিন্নাহ মামা) আর ছোট খালাম্মা (রানী খালাম্মা) তখন অরুনিমার খালাম্মার বাসায় থাকতেন।
আমার বড় খালাম্মার নাম বেগম রোকেয়া রহমান। খালুজানের নাম ফজলুর রহমান, উনি কাস্টমস অফিসার ছিলেন। ওনারাও ঢাকায় ইস্কাটনে অরুনিমার খালাম্মার রাস্তার উলটা দিকের সরকারী কলোনীতে থাকতেন। তাদের ছেলে মেয়েদের নাম - মুজিবুর রহমান (চন্দন ভাইয়া), ফেরদৌস ভাইয়া, রিয়া আপা, শাহীন আপা, নীলা আপা আর শম্পা। চন্দন ভাইয়া তখন সদ্য ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করেছেন আর ফেরদৌস ভাইয়া ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজে পড়তেন। মেঝ খালাম্মার নাম কাওসার বেগম। খালুজানের নাম মোঃ হাবিবুল্লাহ, উনি বাংলা একাডেমীর মহাপরিচালক ছিলেন। তাদের বড় মেয়ে রুবি আপার বিয়ে হয়ে গিয়েছিল তখন। আর পাখী নামের এক খালাতো বোন ছিল আমার একই বয়সী। ওনারা ভুতের গলিতে থাকতেন। সেজ মামা আব্দুল কাদের (খোকা) আর সেজ মামী সেগুন বাগিচায় থাকতেন।
ঢাকায় খালা-মামাদের বাসা ছাড়াও আমরা কুমিল্লার গ্রামে আমাদের দাদা বাড়িতে ফেরত যেতে পারতাম। কিন্তু সেখানে আমার ছোট বোন শাহীন মারা যায়, আর আমাদের পড়া লেখার অসুবিধা হবে বলে আম্মা আমাদের নিয়ে তখন আর রায়তলা গ্রামে ফেরত যান নাই। অবশেষে আমাদের এই বাসা, ঐ বাসা ঘোরাঘুরি থেকে উদ্ধার করলেন আমার চাচাতো ভাই হাবিবুর রহমান ভাইয়া। আমার মেঝ চাচা আজমত আলী ঢাকার এ জি বি অফিসে চাকরী করতেন। ১৯৭০ সালে উনি হঠাত মারা গেলে ওনার বড় ছেলে হাবিব ভাইয়া সেই একি অফিসে চাকুরীতে ঢুকেন। মেঝ চাচি তার বাকি ছেলে মেয়েদের - সিদ্দিক ভাইয়া, মোখলেস ভাইয়া, নুরজাহান আপা আর হাসিনাকে নিয়ে আমাদের দাদা বাড়ি রায়তলা গ্রামে চলে যান। যার ফলে ১৯৭১ সালে মতিঝিল কলোনীতে তাদের কোয়ার্টার প্রায় ফাঁকা ছিল। হাবিব ভাইয়া আমাদেরকে তাদের মতিঝিল কলোনীর বাসায় থাকতে বললেন যতদিন না আমরা আব্বার কাছে যেতে পারি। পুরানা পল্টনের হেনা খালাম্মা আমাদের জন্য খাট-পালং, বিছানা বালিশ, হাঁড়ি পাতিল, বাসন কোসন সব জোগাড় করে আমাদেরকে মতিঝিল কলোনীর বাসায় পৌছায় দিলেন।
১৯৭১ সালের যুদ্ধের সময় আর তার পরবর্তী দিনগুলিতে হেনা খালাম্মা আমাদের সব চেয়ে বেশী খোজ খবর নিতেন আর দেখা শোনা করতেন। পুরানা পল্টনের খালুজানের নাম ছিল মমতাজ আহমেদ। উনি হয়ত রিটায়ার্ড ছিলেন, সব সময় বাসায় থাকতেন। ওনাদের চার ছেলে মেয়ে ছিল। তাদের নাম হচ্ছে কামাল আহমেদ (তপন ভাইয়া), শামীম আহমেদ (স্বপন ভাইয়া), শাহ্ নাজ বেগম (রিনা আপা) আর মুনির আহমেদ (বাবু ভাইয়া)। তপন ভাইয়া তখন নটরডেম কলেজে পড়তেন। আর স্বপন ভাইয়া আর বাবু ভাইয়া কুমিল্লার কোটবাড়ীতে রেসিডেন্সিয়াল মডেল স্কুলে পড়তেন হোস্টেলে থেকে। ভাগ্যক্রমে খালুজান ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চের আগেই তাদেরকে সেখান থেকে ফেরত নিয়ে আসেন। ১৯৭১ এর যুদ্ধের সময় বেশীর ভাগ সময়ে তারা ঢাকায় ছিলেন। তবে যুদ্ধের শেষ দিকে কুমিল্লার কোটবাড়ীতে পাকিস্তানি মিলিটারিরা ঘাটি স্থাপন করে এবং রেসিডেন্সিয়াল মডেল স্কুল আবার চালু করার নির্দেশ দেয়। তখন স্কুলের প্রিন্সিপাল খালুজানকে চিঠি পাঠান যে ছেলেদের স্কুলে ফেরত না পাঠালে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর বেবস্থা গ্রহণ করা হবে।
তখন খালুজান প্লেনে করে স্বপন ভাইয়া আর বাবু ভাইয়াকে কুমিল্লার কোটবাড়ীতে স্কুলে দিয়ে আসেন। সেটা বোধ হয় ১৯৭১ সালের নভেম্বর মাস হবে। ঢাকা থেকে কুমিল্লা পি আই এর সেটাই সর্বশেষ বেসামরিক যাত্রিবাহী ফ্লাইট ছিল। বাবু ভাইয়ার মনে আছে যে প্লেনে উঠার পরে পাইলট সব যাত্রিকে নির্দেশ দিয়েছিল পা নড়াচড়া না করার জন্য। কারণ প্রত্যেক্টা যাত্রির সিটের নীচেই পাকিস্তানি বাহিনীর জন্য গোলা বারুদ ভরে নিয়ে যাচ্ছিল সেই প্লেনে করে। সেই সময় যাত্রিবাহী বিমান গুলিকেও সেনাবাহিনীর কাজে লাগিয়েছিল পাকিস্তানিরা। ডিসেম্বরের ৩ তারিখে ভারত পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করলে স্কুলের প্রিন্সিপাল তৎক্ষণাৎ স্কুল বন্ধ ঘোষণা করে দেন। বাবু ভাইয়া আর সপু ভাইয়া তখন স্কুল থেকে রিক্সা করে কয়েক মাইল দূরে কুমিল্লার বাগিচা গাঁওয়ে তাদের দাদা বাড়িতে চলে যান।
পুরানা পল্টনের খালুজান তার চার ভাইদের মধ্যে সব চেয়ে বড় ছিলেন। তার তিন ভাইদের নাম ছিল - আশরাফ উদ্দিন আহমেদ (মেঝ কাকা) উনি ডাক্তার ছিলেন, বেশির ভাগ সময়ে লন্ডনে থাকতেন, তবে ১৯৭১ সালে উনি সিলেটের লংলা টি গার্ডেনের চিফ মেডিকেল অফিসার ছিলেন। নোয়াব আহমেদ (সেজ কাকা) ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন, তিনিও তখন সিলেটে পোস্টিং ছিলেন। আর শফিক আহমেদ (ছোট কাকা) পুরানা পল্টনেই থাকতেন। ওনার শ্বশুর বাড়ি খালাম্মাদের বাসার রাস্তার ঊল্টা দিকেই ছিল। ছোট কাকীমা তখন ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে পড়তেন। ওনার ছোট ছেলে মাহফুজকে হেনা খালাম্মার কাছে রেখে ক্লাস করতে যেতেন কাকীমা। মাহফুজ মনে হয় তিন বা চার বছর বয়স ছিল, খুব চঞ্চল। তার পিছনে হেনা খালাম্মাকে বেশ দৌড়াতে হত।
খালুজানদের পুরানা পল্টনে তখন দুইটা বাড়ি ছিল পাশপাশি। টিনের চাল দেওয়া বাড়িটায় তারা নিজেরা থাকতেন। আর দেয়ালের অপর পাশে বিল্ডিংটায় এক গুজরাটি ব্যবসায়ী ফ্যামিলি সহ ভাড়া থাকতেন। তাদের দুইটা ছোট ছেলে মেয়ে ছিল, রাশিদা আর আবিজার নাম। সেই গুজরাটি ভদ্রলোক খুব ভাল মানুষ ছিলেন। ১৯৭১ এ যুদ্ধের সময় শফিক কাকা তার শ্বশুর বাড়ির সব লোকসহ তাদের বাসায় আশ্রয় দেন। শফিক কাকার তিন জন অল্প বয়সী শালা ছিল, খালেদ মামা আর গালিব মামা ইউনিভার্সিটিতে পড়তেন আর জামিল মামা কলেজে ইন্টারমিডিয়েট পড়তেন তখন। একবার পাকিস্তানি মিলিটারিরা পুরানা পল্টনে এসে জামিল মামাকে মুক্তিবাহিনী সন্দেহ করে ধরে নিয়ে যায়। মিলিটারিরা ঘরে ঢুকার আগে জামিল মামা তাদের দেখতে পেয়ে তার বড় ভাই খালেদ মামাকে সাবধান করে দেয় যে, "তোমাকে ধরতে আসছে"। তখন খালেদ মামা বাথ্রুমে লুকিয়ে ছিলেন। আর মিলিটারিরা জামিল মামাকে সামনে পেয়ে তাকেই ধিরে নিয়ে যায়। আর গালিব মামাকেও মিলিটারিরা স্বামীবাগে তার নানা বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে যায়। তার পরে বহু চেস্টা করে কিভাবে কিভাবে যেন ছয় দিন পরে তাদেরকে জীবিত ছাড়িয়ে আনা হয়।
১৯৭১ সালের যুদ্ধের সময় আর তার পরবর্তী বছরগুলিতে পুরানা পল্টনের হেনা খালাম্মার বাসা আমার সব চেয়ে প্রিয় বেড়ানোর জায়গা ছিল। খালাম্মারা একটা বেশ বড় সুন্দর টিনের চাল ওয়ালা বাড়িতে থাকতেন। বাড়ির সামনে বড় উঠান ছিল, সেখানে পেয়ারা গাছ ছিল আর বেশ সুন্দর ফুলের বাগানও ছিল। খালাম্মা বিড়াল পছন্দ করতেন এবং সব সময় বাসায় বিড়াল পুষতেন। তাদের বিড়াল্টার নাম ছিল মিনি বিড়াল। তার অনেক গুলি বিড়াল ছানা ছিল, সেগুলির নাম মনে নাই এখন। খালাম্মাদের বাসায় আমার সবচেয়ে প্রিয় জায়গা ছিল তাদের ছোট একটা কোনার ঘর যেখানে একটা বইয়ের আলমারি ছিল। সেটা ভর্তি গল্পের বই ছিল। ১৯৭১ সালের প্রথম দিকে আমি বেশী ভালো বাংলা পড়তে পারতাম না। কারন পাকিস্তানে থাকতে আম্মা আমাদের বাসায় বাংলা লিখতে পড়তে শিখিয়েছিলেন আর ক্যান্টনমেন্টের স্কুলে খালি উর্দু আর ইংরেজী পড়াতো। খালাম্মাদের গল্পের বইয়ের আলমারি থেকে বাংলা বই পড়তে পড়তে কিছুদিনের মধ্যেই আমি দ্রুত বাংলা পড়তে শিখে ফেলেছিলাম। হেনা খালাম্মা নিজেও খুব বই পড়তে ভালবাসতেন আর তার ছেলেমেয়েদের সব সময় বই কেনার জন্য টাকা দিতেন। সেখানে বাংলা ইংরেজী সব রকমের বই ছিল। শরতচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ থেকে শুরু করে নীহার রঞ্জন দত্ত আর সেবা প্রকাশনীর কুয়াশা, মাসুদ রানা সিরিজ পর্যন্ত।
আমরা মতিঝিল কলোনীতে তিন তলায় থাকতাম, আবার কবে আব্বার কাছে যেতে পারব সেই অপেক্ষায় ছিলাম। কিন্তু আব্বা আমাদের নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করার আগেই ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরের ৩ তারিখে ভারত যুদ্ধ ঘোষণা করে। ভারতীয় বিমান বাহিনীর মিগ ফাইটার বিমানগুলি ঢাকার সব বিমান বন্দরগুলির রানওয়ে বোমা মেরে ধূলিসাৎ করে দেয়। ফলে তখন পাকিস্তানের সাথে বিমান যোগাযোগ সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। তারপর থেকে আমরা আব্বার আর কোন খবর পাই নাই। এর আগে মাঝে মধ্যে ডাক যোগে আব্বার কাছ থেকে সেন্সর করা দুই একটা চিঠি আম্মা পেতেন, এখন সেটাও বন্ধ হয়ে গেল।
(To be continued)
প্রথম খন্ডের লিঙ্ক - Click This Link
দ্বিতীয় খন্ডের লিঙ্ক - Click This Link
তৃতীয় খন্ডের লিঙ্ক Click This Link
৪র্থ খন্ডের লিঙ্ক - Click This Link
৫ম খন্ডের লিঙ্ক - Click This Link
৬ষ্ঠ খণ্ডের লিঙ্ক - Click This Link
৭ম খণ্ডের লিঙ্ক - Click This Link
৮ম খণ্ডের লিঙ্ক - Click This Link
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে মার্চ, ২০১৫ রাত ৮:২৬