সম্প্রতি একজন প্রবাসী ব্লগারকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছে। এ নিয়ে আমার বন্ধু এবং পরিচিত-অপরিচিত অনেকের মন্তব্য পড়লাম। আমি নিজেও এই হত্যাকান্ডে ব্যথিত। রাস্তায় অভিজিৎ এর রক্তাক্ত মৃতদেহ দেখে হতবাক হয়ে গিয়েছিলাম। মনে হল বেশ অনেক্ষন তিনি এভাবেই পড়েছিলেন, প্রচুর লোক আশেপাশে ছিল, ছবি তুলছিল, কিন্তু কেউ তাকে ঢাকা মেডিক্যাল নিয়ে যাওয়ার কথা ভাবেনি। এরকম হবে জানলে প্রয়াত অভিজিৎ হয়ত ধর্ম বাদ দিয়ে প্রগতিশীল মানুষের মানবিকতা নিয়ে লেখালেখি বেশী করতেন। এখন এই হত্যাকান্ডের দায় কার? আমি মনে করি তিনটি পক্ষের। একজন হল ভিকটিম নিজে, দ্বিতীয় পক্ষ হল যারা তাকে খুন করেছে, আর তৃতীয় পক্ষ হল রাষ্ট্র। আমরা এমন দেশে বসবাস করি যেখানে প্রতিদিন নিরীহ মানুষ কোন কারণ ছাড়াই আগুনে পুড়ে বোমায় উড়ে মারা যাচ্ছে। সেখানে একজন অভিজিৎ কি আলাদা কেউ ছিলেন? তার পরিচয় তিনি ব্লগার ছিলেন। প্রচলিত ধ্যান ধারনার বিরুদ্ধে লিখতেন। তার মত এরকম অনেকেই এই দেশে আছেন। কিন্তু একটু খেয়াল করলে তাদের সবার লেখালেখি এবং চিন্তাধারার মাঝে একটা সাধারন মিল খুঁজে পাওয়া যায়। তা হল জেনে বুঝে ইচ্ছাকৃতভাবে ধর্মের ও ধর্মীয় বিশ্বাসের উপর আঘাত হানা। আর "মুক্তচিন্তা" তকমাধারী এই লেখকরা এটা করে থাকেন মূলত একটা ধর্মের বিরুদ্ধেই, আর তা হল ইসলাম। আমি এই সার্কেলের কাউকে কখনো খুব যোশ নিয়ে অন্য আর কোন ধর্মকে সমালোচনা বা বিষেদ্গার করতে দেখিনি। আবার অন্যান্য ধর্মাবলম্বী ব্লগারদেরকে দেখিনি যে তারা নিজ নিজ ধর্ম নিয়ে কথা বলছেন। ঘুরে ফিরে এরা সবাই ইসলামকেই আঘাতের উপযুক্ত বলে মনে করছেন। এটা স্বাভাবিক যে আমাদের কাছে যে ধর্মীয় আচারকে স্বাভাবিক বলে মনে হয়, অন্যদের কাছে সেটা অস্বাভাবিক ঠেকতে পারে। যেমন আমরা কেন কালো একটা ঘরের চারপাশে ঘুরি, এটা অনেকে প্রশ্ন করে। আবার অন্যরা কেন আগুনের চারপাশে ঘুরে, সাপ, ব্যাং, গাছের চারপাশে ঘুরে এরকম প্রশ্ন আমাদের মনে জাগে। কিন্তু আমি আজ পর্যন্ত কোন হিন্দুকে তার নিজের ধর্ম নিয়ে প্রশ্ন বা সমালোচনা করতে দেখিনি, কোন খ্রীস্টান বা বৌদ্ধ বা নাস্তিককে নিজের বিশ্বাস নিয়ে আত্মসমালোচনা করতে দেখিনি। সবাই যার যার মত করে পূজা, পার্বণ, চীবর দান, নিজ নিজ দেবতাদেরকে তুষ্ট করে এসে তারপর নিজ ব্লগে ইসলাম, মুহাম্মাদ, তিনি কয়টা বিয়ে করেছিলেন, তাঁর কোন বৌর কত বয়স ছিল ইত্যাদি বিষয় নিয়ে সূক্ষ্ম বিশ্লেষণে বসে যান। অথচ এরা অন্যধর্মের মধ্যে বাস করে ইসলামকে কতটুকু ভালোভাবে জানতে পেরেছেন? এরা বড়জোর নিজের ধর্ম নিয়ে জানতে পারেন। অনেকে হয়ত নিজের ধর্ম ও জানে না। সেক্ষেত্রে চোখে কালো কাপড় বেঁধে সব ধর্মকেই হেয় করা উচিৎ নয় কি? কিন্তু সেটা তারা কয়জন করেছেন? ঘুরে ফিরে, ঐ মুসলমান তুই এতো ধার্মিক ক্যারে!! বা ওই হুজুর তোর বৌ হিজাব পড়ে থাকে কেন (আমাদের সৌন্দর্য দেখতে দেসনা ক্যারে), এই টাইপের আক্রমণ করা হয়। তবে কেউ কেউ ব্যতিক্রমও আছেন, ধর্মের নামে অধর্ম বা বক ধার্মিকদের বিরুদ্ধে তারা কথা বলেন, বিশেষ করে পাকিস্তানের নিষ্ঠুরতা এবং জামাত শিবিরের ধর্মের নামে যে সুবিধাবাদী রাজনীতি হচ্ছে, যার বিরুদ্ধে আমরা সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানরা অনেক সময়ই বিভ্রান্ত থাকি, কিছু বলব, না কি চুপ থাকব এরকম অবস্থায় থাকি, তখন তারা অন্যায়ের প্রতিবাদ করে আমাদের সাহস যুগিয়েছেন। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অন্যরা সীমা অতিক্রম করছেন, উদ্দেশ্যপ্রোণোদিতভাবে, যা কাম্য নয়। ফারুকী হুজুর ইসলামে গভীর পান্ডিত্য অর্জন করেছিলেন। তাঁর মত লোক যখন ধর্মান্ধতা ও জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে কথা বলেন, তার পিছনে শক্ত সারবস্তু থাকে। তিনি ইসলাম দিয়েই তথাকথিত নব্য ইসলামকে রুখে দিয়েছিলেন। কিন্তু নাস্তিক্যবাদীরা কিসের ভিত্তিতে আমাদের বিশ্বাসের বিরুদ্ধে কথা বলে যান? তাদের তো এর উপর ন্যূনতম জ্ঞান নেই। কেন তারা এভাবে অন্যের বিশ্বাসে আঘাত করছেন? অন্য ধর্মের অজস্র অসামঞ্জস্য, লুপ হোল কি তাদের মুক্ত চোখে ধরা দেয় না? নাকি আসলে অন্য সব ধর্মই বাস্তবে অকার্যকর হয়ে যাওয়ায় এখন ইসলামই শুধু বাকি আছে? তাদের লেখা পড়লে জংগি তো জংগি যে কোন সাধারন মানুষ অসুস্থ হয়ে যায়। তাদের কারো কারো লেখার উদ্দেশ্যই অন্যকে খোঁচানো, ক্ষেপানো, উত্তেজিত করা, দৃষ্টি আকর্ষন করে। ১০০ কোটি মুসলমানের মধ্যে ৯৯ লক্ষ ৯৯ হাজার ৯৯৯ জন যদি নাস্তিকদের ক্ষমাও করে দেয়, কিন্তু একজন যদি তাদের বিরুদ্ধে যায়, সেটা কি খুব অন্যায় হবে? প্রতিবাদ করার অধিকার কি শুধু মুক্তমনাদেরই? মুক্তমনারা নিজেরা অনেক কিছু বললেও অন্যের বেলায় সেটা মানতে নারাজ। ওনারা শুধু শোনাতে চান কিন্তু শুনতে চাননা। ইচ্ছাকৃতভাবে অন্যদের উত্তেজিত করে তারা যেমন সীমা অতিক্রম করছেন, তেমনি ধর্মের নিষেধকে গুরুত্ব না দিয়ে, ব্যক্তিগত আক্রোশ থেকে ব্লগারদের উপর আক্রমন করে সীমা অতিক্রম করেছে অতি ধার্মিক জংগিরা। আর দেশের একজন নাগরিককে নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হয়ে অন্যায় করেছে সরকার। তাই এই হত্যাকান্ডের দায় এই তিন পক্ষকেই নিতে হবে। তিনপক্ষই সীমা অতিক্রমকারী।
কিন্তু এই হত্যার দায় আমরা এড়াতে পারি কি? আল্লাহর রাসূল (সা) যখন অনেক বছর ইসলামের আহবান করেও সফল হলেননা, অল্প কিছু মানুষ ইসলামে শামিল হল, তিনি কি পারতেন না বাকি নাস্তিক গুলোকে রাতের অন্ধকারে পিছন থেকে ছুরি দিয়ে মাথায় আঘাত করে করে মেরে ফেলতে, এবং নিজের জন্য জান্নাতের পথ "প্রশস্ত" করতে? কারণ নবী হিসেবে তখনো তার সাফল্য আসেনি, আর সেজন্য আল্লাহর কাছে তাকে জবাব দিতে হত। কিন্তু তিনি কি তা করেছেন? বহু বছর পর সেই নাস্তিকরাই নিজেদের ব্যবহারের কারনে লজ্জিত, অনুতপ্ত হয়ে ক্ষমা চেয়েছিল, ইসলাম গ্রহন করেছিল, এর নামই তো ইসলাম!! অথচ সেই সুযোগটা আমরা অভিজিৎকে দিলামনা। বরং যে বিচার আল্লাহ হাশরের ময়দানে করার কথা, সেই বিচার আমরা নিজেরাই করে দিলাম!! ধিক্কার জঙ্গিবাদকে, ধিক্কার যারা টাকা দিয়ে মানুষকে জঙ্গী বানায় তাদেরকে, ধিক্কার যারা সহীহ হাদিস কোরানের নামে নিজেদের বানানো ইসলাম চাপিয়ে দেয় তাদেরকে!! আমরা অবশ্যই নাস্তিক্যবাদের বিরুদ্ধে কথা বলব, তারাও আমাদের বিরুদ্ধে বলুক, কিন্তু এভাবে যেন আমরা কাউকে মেরে না ফেলি, এটা জঘন্য অন্যায়। একজন মানুষকে অন্যায়ভাবে হত্যা করা মানে পুরো মানব জাতিতেই হত্যা করা (আল হাদিস)
আমার বক্তব্য এখানে পরিষ্কার। তা হল মধ্যমপন্থা এবং সীমারেখা অতিক্রম না করা। আর হ্যা আমি পরোক্ষ নই সরাসরিভাবেই অভিজিৎ এর পক্ষে বলছি, তার আদর্শের নই, তার বিরুদ্ধে যে অন্যায় হয়েছে সেটার জন্যে। আমি মধ্যমপন্থী এবং শোষিত, অত্যাচারিতের পক্ষে। এখানে অবশ্যই তিনি অত্যাচারের শিকার। কারণ সভ্য সমাজে কথার জবাব কথা দিয়েই দেয়া উচিত। কথার জবাবে আক্রমণ কি ইসলাম সমর্থন করে?ইসলাম এই হত্যাকান্ড কতটুকু সমর্থন করে? ইসলামে কি ধৈর্য ধারন করতে বলা হয়নি? এমনকি ইসলামী রাষ্ট্রেও এভাবে কাউকে মেরে ফেলার সুযোগ নেই। বরং এই আক্রমণের মধ্য দিয়ে নাস্তিক্যবাদের জয় হল, তারা যে ইসলামকে আগাগোড়া একটি জঙ্গি ও হত্যার ধর্ম বলে আসছিল, সেটাই আবার প্রমান করা হল। তাই যারা এই হত্যাকান্ড করেছে, তারা আল্লাহকে খুশি করার জন্য বা ইসলামের ভালোরজন্য তা করেনি, বরং নিজের স্বার্থে, নিজের অহমকে অক্ষত রাখতে, নিজেদের শক্তিমত্তা প্রমান করার জন্য এসব করেছে। যা আল্লাহ করতে বলেননি তা করে আল্লাহর তৈরি বেহেসতে কেউ যেতে পারবেনা।
আর আমি মুসলিম হিসেবে লজ্জিত কারণ আমরা তাকে মেরে ফেলেছি। খুনিরা জানে যে শেষ পর্যন্ত সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানরা তাদের এই অপকীর্তিকে নীরবে মেনে নেবে, তারা সহজেই গা ঢাকা দিতে পারবে। কিন্তু প্রগতীশীল বা নাস্তিক্যবাদীরা যা লেখেন, সেসব যুক্তি দেখান, ধর্ম সম্পর্কে জ্ঞান থাকলে খুব সহজেই তাদের যুক্তির মধ্যে যেসব দূর্বলতা আছে তা বের করা যায়, তাদের আক্রমণের জবাবও দেয়া যায়। তার জন্য মাথায় কোপ মারা লাগে না। কিন্তু জঙ্গিবাদীরা সেটা জানেনা, কারণ তাদের সেই জ্ঞান নেই, তারা শুধু বোঝে ইসলামের বিরুদ্ধে, নবীর বিরুদ্ধে কথা লেখা আছে, তখনই "হা রে রে ৯০% মুসলমানের দেশে....এই কথা বলেই ছুরি চাকু নিয়ে হামলা করে, দ্বিগবিদিক হারিয়ে। তাই আসুন আমরা জঙ্গিবাদকে না বলি, একে ঘৃনাভরে প্রত্যাখ্যান করি, মানুষ হত্যা বন্ধ করি, ইসলামের খাতিরে, মানবতার খাতিরে। আর অভিজিৎ, আমরা আপনাকে বাঁচাতে পারিনি, আমরা ক্ষমাপ্রার্থী..
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা মার্চ, ২০১৫ রাত ১২:০৯