"দুটি পা'এর মধ্যে একটিও নেই, কেটে ফেলতে হয়েছে, তাতে কি, ভিক্ষা করছিনা নিজের সাধ্যমত পরিশ্রম করে খাই। দোআ করবেন স্যার"
আজ আপনাদের সাথে এমন একজনকে পরিচয় করিয়ে দেবো যার দুটি পা'ই পুরোপুরিভাবে কাটা তবুও সে নিজের উপার্জনের অর্থে বেঁচে আছেন, দুই সন্তানসহ চার সদস্যের সংসার চালাচ্ছেন, তবুও ভিক্ষা বা হাত পাতছেন না কারো কাছে। কোন ধনবান টাকাওয়ালার কাছে নিজের ব্যক্তিত্ব বিসর্জন দেননি, দয়া ভিক্ষা করেননি তিনি কারো কাছে। আমি মন থেকে শ্রদ্ধা জানিয়েছি সেদিন তাকে দেখে। স্যালুট জানাই তার পর্বতসদৃশ ব্যক্তিত্বকে। আল্লাহ্ তার সহায় হবেন নিশ্চয়।
বর্তমান সমাজে ভিক্ষাবৃত্তি করাও একপ্রকার লাভজনক ব্যবসা কারো কারো কাছে। অসহায়তার সুযোগে নিজের ব্যক্তিত্ব বিসর্জন দিয়ে পরের দয়ায় বেঁচে থাকার লোকের সংখ্যা একেবারে কম নয়। শুনেছি ভিক্ষাবৃত্তি যারা করেন, তাদেরও নাকি সংগঠক সংগঠন আছে, এলাকা ভাগ করা আছে কে কোন এলাকায় ভিক্ষা করবেন তা নাকি সেইসব সংগঠক থেকে নির্ধারণ করে দেয়া হয়। শুনেছি ভিক্ষুক'রা অনেকেই চার পাঁচজন নারীকে বিবাহ করে ভিক্ষার কাজে লাগান। অনেকদিন আগে খবরের কাজগে দেখেছিলাম কোন ভিক্ষুকের নাকি পাঁচতালা ফ্ল্যাটে বাসাবাড়ি! কোন কোন ভিক্ষুক নাকি ছোট বাচ্চা কিনে হাত পা ভেঙে ভিক্ষা করার কাজে লাগানো হয়! আবার অনেকে সুস্থ থাকার পরও হাত পা ভাঙা বা পুঙ্গ অভিনয় করে ভিক্ষাবৃত্তি করে থাকেন! তারমানে, বর্তমানকালে ভিক্ষুক হওয়াটাও অনেকের কাছে সম্মানের, কারণ, ভিক্ষুকদের নাকি অনেক টাকা পায়সা, আর সমাজে যার টাকা আছে তার মূল্য মর্যাদা বেশিই থাকে। টাকা যেভাবে খুশি আসুক, টাকার মালিক হলেই হচ্ছে, ব্যাস। আমাদের গ্রামের বাজারে একজন এমন লোক দেখেছিলাম। তখন আমি ছোট, বাজারে দেখেছি, আয়রণ করা শার্ট, দামি লঙ্গী, হাতের আঙুলে সিগারেট, বাজারের সেরা জিনিষটা কিনে নিচ্ছে। তাকে চেনে জানে এমন লোকের কাছে শুনেছিলাম, সে নাকি ঢাকাশহর ভিক্ষা করে। করুক, তাতে কি, বাড়িতে তো করে না, গ্রামের বাড়িতে তার খুব মর্যাদা, সবাই সমীহ করে কথা বলেন তার সাথে, কারণ, তার টাকা আছে!
তাই তো সেদিন মোঃ মোবারক হোসেন'কে দুই পা' না থাকার পরও রিক্সা চালাতে দেখে বিস্মিত হয়েছিলাম, মনে মনে তার ব্যক্তিত্বকে স্যালুট জানিয়েছিলাম, গর্ববোধ করেছি এমন ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মানুষ কূলে জন্ম নিয়েছি ভেবে। সেদিন চলতি পথে তাকে রাস্তার মোড়ে দেখে বিস্ময়ে কিছুক্ষণ তার দিকে তাকিয়ে ছিলাম, মনে মনে কথা বলার অনেক ইচ্ছে থাকার পরও তার সাথে কোনপ্রকার কথা বলার সুযোগ হয়ে ওঠেনি। কিন্তু, আমার ইচ্ছে পূরণ হতে বেশিদিন লাগেনি, তার সাথে কথা বলার সুযোগ হয়েছিল দুদিন আগে তার নিজ গ্রামেই। আমারও তেমন ব্যস্ততা ছিল না, তাই মোটামুটি অনেককিছু জানতে পারলাম তার সম্পর্কে। প্রায় এক মিনিটের মতো একটা ভিডিও'ও করে রেখেছি তার নাম ঠিকানা ভুলে না যাওয়ার জন্য।
মোঃ মোবারক হোসেন
নেত্রকোনা জেলার মদন উপজেলার গোবিন্দ শ্রী ইউনিয়নের গোবিন্দ শ্রী পশ্চিম পাড়া তার পৈতৃক ভিটেমাটিতে জন্ম, সেখানেই থাকেন দুই সন্তান ও স্ত্রী নিয়ে। আট বছর আগেও তার দুটি পা'ই ছিল, সবার মতো চলতেন ফিরতেন ইচ্ছে মতো। খুব বেশি স্বাচ্ছন্দ্য পরিবার না হলেও একেবারে দরিদ্র ছিলেন না মোবারক হোসেন। নিজেদের জমিজমা ছিল, চাষবাস করতেন। নিজের হাতের কাজ রপ্ত ছিল, তিনি ইঞ্জিন মিস্ত্রী ছিলেন। এইসব হাওড় এলাকায় যারা ইঞ্জিন মিস্ত্রী তাদের আলাদা একপ্রকার কদর মর্যাদা সবসময় থাকে। কারণ, ট্রলারে(নৌকা) ইঞ্জিন ব্যবহৃত হয়, আবার ইরি ধানের মৌসুমে প্রতিটি হাওড়ে অনেক অনেক ইঞ্জিন (সেলু মেশিন) চলে ধান জমিতে পানি সেচ কাজে। তাই মোবারক হোসেনের মতো ইঞ্জিন মিস্ত্রীদের একটা আলাদা মর্যাদা থাকাটাই স্বাভাবিক, ছিলও। ভালোই চলতেন মোবারক হোসেন। নিজের জমিতে চাষবাস করে সারাবছর ভাত খাওয়ার পরও ধান বিক্রির টাকায় চলে যেতো সংসার খরচ। তার মিস্ত্রী কাজে যা পেতো তা দিয়ে স্বাচ্ছন্দ্যে চলতেন তিনি। কিন্তু, দুর্ভাগ্য তার, বিধিবাম হলে যা হয় আরকি। গত আট বছর আগে তার দুটি পা'ই কেটে ফেলা হয়েছে। আর যে অসুখের কারণে পা কাটতে হয়েছে তা জানলে আপনারও জিহ্বায় কামড় পড়বে নিশ্চিত। আসলে ভাগ্য যখন খারাপ হয় তখন সবকিছু খারাপের ভাগেই পড়ে যায়! দুঃখ'রা নাকি সাত ভাই, যখন আসে তখন চতুর্দিক থেকেই আসে! মোবারক হোসেনের বেলায়ও তাই হয়েছিল।
আমরা অনেকসময় ছোটখাটো কোন অসুখ বা কাজ ঘটনা অন্যায় অপরাধ 'কোন ব্যাপার না' বলে হেলায় এঁড়িয়ে যাই, তেমন গুরুত্ব দেই না। কিন্তু, ছোট থেকেই যে বড়'র সৃষ্টি তা ভুলে যাই, মনে রাখি না। যখন ছোট কোনকিছু অনেক বড় আকার ধারণ করে তখন আমাদের মুখ থেকে একটা কথাই বের হয় 'এমন হবে কে জানতো'! মোবারক হোসেনেরও ছোট্ট একটা ব্যাপার অনেক ব্যাপক হয়ে গিয়েছিল, সেও আগে বুঝতে পারেনি যে এমনটি হবে। পায়ের সর্ব কনিষ্ঠ অাঙুলে কাদামাটি ঢুকেছিল, অনেকেই আমরা বলে থাকি নখের কানি ডাবা। সেই পায়ের কনিষ্ঠ আঙুলের নখের কানি ডেবেছিল বলেই জানান মোবারক হোসেন। কানি ডাবা নখে মনে হয় খুঁচানো হয়েছিল, আর সেখানে সেপ্টি ধরে ধীরেধীরে যখন বাড়তে ছিল, তখন ডাক্তারি যুক্তিতে তার হাটুর অনেকটা উপরে কোমরের নিচে থেকে দুটি পা কেটে ফেলা হয়েছে। এখন তিনি সুস্থ, তবে পা দুটি হারাতে হয়েছে তাকে।
পা হারিয়ে মোবারক হোসেন ভেঙে পড়েননি, নিজের মতো করেই বাঁচতে থাকেন। ইঞ্জিন মেরামত করার কাজ করে আর জমি বিক্রি করা টাকায় এতদিন মোটামুটি সংসার চালিয়ে এসেছেন। পা না থাকায় ইঞ্জিনের মেরামত কাজেও ভাটা পড়ে তার। তাছাড়া অনেকপ্রকার সমস্যা হয় তার ইঞ্জিন মেরামতের কাজে। নিজের জায়গা জমি যা ছিল বেঁচে চিকিৎসা খরচ আর সংসার খরচ করতে শেষ পর্যায়। এখন বাধ্য হয়ে গত তিন-চারমাস যাবত তিনি রিক্সা চালিয়ে সংসার খরচ চালান।
রিক্সা চালাতে কোনপ্রকার সমস্যা হয় কিনা জিজ্ঞেস করলে বলেন,"দুটি পা'এর মধ্যে একটিও নেই, কেটে ফেলতে হয়েছে, তাতে কি, ভিক্ষা করছিনা নিজের সাধ্যমত পরিশ্রম করে খাই। দোআ করবেন স্যার" ব্যাটারি চালিত রিক্সা চালাতে তেমন অসুবিধা না হলেও অনেক সমস্যা তাকে এখানেও বাঁধাগ্রস্ত করে। তবুও বাঁচার তাগিদে স্ত্রী সন্তানের জীবন বাঁচাতে তাকে রোজ রিক্সা চালাতেই হয়। তাছাড়া ভিক্ষা করতেও সে পারবেনা, ভিক্ষা করাটা তার আত্ম সম্মানে বাঁধে বলে জানান তিনি। তাই রোজগারের একমাত্র পথ রিক্সা। কিন্তু, বয়স বাড়ছে, এখন আর আগের মতো পরিশ্রম করতে পারেননা তিনি। আবার পরিশ্রম না করলে পেটে ভাত পড়ার কোন পন্থা নাই তার! ছেলে মেয়ে দুটির ভবিষ্যৎ চিন্তায় মাঝেমধ্যে হতাশা তাকে গ্রাস করছে বলে জানান তিনি।
এমন কর্ম-প্রিয় হাসি খুশি মানুষের দুর্দশা দেখে শুনে কি লিখবো ঠিক ভেবে উঠতে পারছিনা। হ্যা, তার সাথে শেষ কথা দিয়েই শেষ করবো ভাবছি। আমি যখন তার ছবি তুলতেছিলাম তখন তিনি জিজ্ঞেস করলেন কি করবেন ভাই ছবি নিয়ে? আমি বলে ছিলাম তোমাকে নিয়ে একটা পোষ্ট লিখবো। আমার কথা শুনে মোবারক হোসেন একগাল হেসে বলেছিলেন, লেইখেন ভাই, একটু করুণভাবে লিইখেন, যাতে আমার কোন একটা পথ হয়, ছেলে মেয়ে দুটির যেন কোন গতি করতে পারি দোআ করবেন।
আমি তার কথা শুনে অনেকটা চিন্তায় পড়ে গেলাম মনে হয়েছিল। কারণ, আমি তো লেখক নই, মানুষের মন জয় করার মতো লেখা তো আমি লিখতে পারিনা। কি করি কিছু ভেবে পাচ্ছিলাম না। তাই কয়েকদিন শুধু ভাবলাম কি লিখবো, কিভাবে লিখবো। কোনকিছু যখন মিলছে না, তখন মনে করলাম যেটুকু জেনেছি সেটুকুই না হয় লিখে রাখি। নাইবা কাড়লো কারো সুনজর।
মোবারক হোসেনের জন্য মহান আল্লাহ্'র নিকট প্রার্থনা করা ছাড়া আমার মতো গরীবের আর কিইবা করার আছে। হে আল্লাহ্! তুমি মোবারক হোসেনকে দেখো, সহায় থেকো, তার আত্ম মর্যাদাটুকু ধরে রাখার তৌফিক দিও।
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে জানুয়ারি, ২০১৮ ভোর ৫:২০