ইভ টিজিং নামক সামাজিক ব্যাধিতে সমাজ অনেকদিন ধরেই আক্রান্ত। কিন্তু ইদানীং এটা মহামারী আকার ধারণ করেছে। প্রতিদিনই দেশের কত মেয়ে যে ইভ টিজিং এর শিকার হচ্ছে আর কত মেয়ের জীবন যে অন্ধকারে গ্রাস করে নিচ্ছে তার হিসেব কি আমাদের কারো কাছে আছে? সম্প্রতি মিজানুর রহমান স্যার আর চাঁপা রাণী ভৌমিক এর প্রাণের বিনিময়ে ইভ টিজিং নিয়ে বেশ আলোচনা- সমালোচনা হচ্ছে। ব্লগে এ নিয়ে হাজার হাজার পোস্ট দেখে খানিকটা আশার আলো দেখতে পেলাম যে আমরা বোধহয় সচেতন হতে শুরু করেছি। কিংবা, সচেতন হতে হবে এই বোধটা বোধহয় জেগে উঠছে।
আমি বেশ কিছু পোস্ট পড়ে দেখলাম যে আমরা আসলে এখন পর্যন্ত কোন সিদ্ধান্তে আসতে পারিনি।
কারো কারো মতে ইভ টিজিং এর কারণ শুধুই মেয়েদের উগ্রতা ( যদিও এরা শালীন পোষাক পরা ভদ্র ভুক্তভুগী মেয়েদের ব্যাপারে কিছুই বলছেনা)। আবার কেউ কেউ সব দোষ ছেলেদের উপর চাপিয়ে দিচ্ছে, কেউ ধর্ম কে বাধা মনে করছে, কেউ ধর্মীয় অনুশাসন চাচ্ছে ( যদিও ধর্মীয় অনুশাসনের ব্যাপ্তি টা নিয়ে কেউ কথা বলছেনা।) কারো কারো মতে টিজারদের পিটিয়ে মেরে ফেলা দরকার, কেউ বলছে সব মেয়েদের বোরকা পরিয়ে দেয়া দরকার... ইত্যাদি।
এতসব মতের ভীড়ে আমার অতি স্বল্পজ্ঞান নিয়ে কিছু বলতে চাই, আমার দূর্বল পর্যবেক্ষণ এবং তারচেয়েও দূর্বল লেখনী দিয়ে কি বোঝাতে পারবো জানিনা।
আমার মতে ইভ টিজিং রোধে দরকার প্রতিবাদ এবং কাউন্সেলিং। আমার দৃষ্টিতে ইভ টিজাররা তিন ধরণের। এক ধরণের টিজার আছে যারা মোটামুটি ভদ্র পরিবারের, খারাপ বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে টিজিং শুরু করেছে। এবং কিছুদিন পরে আস্তে আস্তে নিজেই টিজিং ছেড়ে দিবে,কিংবা দুই-একদিন উত্তম-মধ্যম দিলেই ঠিক হয়ে যাবে, কিন্তু এরই মধ্যে হয়তো কোন মেয়ের জীবনটা অন্ধকারে আচ্ছন্ন করে ফেলবে। এদেরকে সুপথে আনতে কাউন্সেলিং টা বেশী জরুরী। স্কুল-কলেজে কাউন্সেলিং করা যায় ঠিক, কিন্তু সত্যি কথা হলো নিজের পরিবারই হচ্ছে শিক্ষার আসল জায়গা। পরিবারের লোকেরা সচেতনতটা সৃষ্টি করতে পারলে টিজিংটা অনেকটা কমে যেত। অনেক পরিবারে ছেলেদের অনেক অপরাধ হালকা দৃষ্টিতে দেখা হয়।"ছেলেরা একটু-আধটু এমন করবেই","ছেলেদের কি মানা করে ফিরানো সম্ভব?" এই ধরণের দৃষ্টিভঙ্গী অনেকেরই। আর মেয়েরা টিজিং এর শিকার হলে নিজেরাই লজ্জায় চুপ করে থাকে, যেন এটা মেয়েদেরই অপরাধ। অথচ এটা এমন হওয়ার কথা ছিলো যে, ইভ টিজারই অনুতপ্ত ও লজ্জিত হবে এই ধরণের অপরাধের জন্য। কাউন্সেলিং করে এটাই সবাইকে ছেলে-মেয়ে বোঝানো দরকার।
আরেকধরণের ইভটিজার আছে যারা বেশ ভয়ংকর। এদেরকে একা একা আক্রমণ করা মানে এরপরের দিনগুলো আরও রিস্কের মধ্যে টেনে আনা। এরা যে কোনদিন এর প্রতিশোধ নিবে। এদেরকে শুধু বুঝিয়ে কোনদিনই সুপথে আনা যাবেনা, সবাই এক হইয়ে এদের কোনাঠাসা করতে হবে, একদিকে কাউন্সেলিং করতে হবে অন্যদিকে টিজিং এর দৃষ্টান্তমূলক এবং লজ্জাজনক শাস্তিও দিতে হবে।
আরেকধরণের টিজার আছে এরা খুবই ভয়ংকর, রাজনৈতিক আশ্রয়ে চলাফেরা করে। এদের আসলে পিটিয়ে মেরে ফেলা ছাড়া আর কোন পথ দেখিনা। দয়া করে আইনের হাতে তুলে দিতে বলবেন না, কোন লাভ নেই। পরের দিনই জামিনে ছাড়া পেয়ে মেয়েটার মুখ এসিডে ঝলসে দিবে। এবং দয়া করে মানবতার কথা বলার আগে মেয়েদের কথা চিন্তা করে নিবেন।
যারা ধর্মীয় অনুশাসনের কথা বলছেন তাদের আমি বলবো ধর্মীয় অনুশাসন বলতে তারা কি বুঝেন? শুধু মেয়েরা বোরকা পড়লে জীবনেও টিজিং বন্ধ হবেনা, দুই-এক ক্ষেত্রে কমবে অবশ্য। কিন্তু সেটা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই নগন্য। আর অন্যান্য ধর্মের বেলায় এটা কিভাবে সম্ভব?
ধর্মীয় অনুশাসনে চললে ইভ টিজিং অনেকটা কমবে তখনই যখন প্রত্যেকে ধর্ম মানবে। ইসলাম ধর্মে যেমন নর-নারী উভয়েরই পর্দার কথা বলা আছে, প্রত্যেক নারী-পুরুষের দৃষ্টি নত রাখতে বলা হয়েছে, তেমনি কোন ধর্মেই অশ্লীলতা গ্রহণযোগ্য নয়। ছেলেদের পর্দার কথা বললেই অনেক বলে বসবে মেয়েরা যদি অশালীন পোষাকে চলাফেরা করে তাহলে ছেলেরা তাকাবেই। তাদের ক্ষেত্রে আমার কথা হলো, দুই-চারটা মেয়ের উগ্রতার জন্য যদি তারা টিজার হয়ে যায়, এবং এর জন্য যদি সব মেয়েকেই টিজিং এর শিকার হতে হয়, এতোটা দুর্বল যদি হয় ঐসব ছেলেদের ধর্মীয় মূল্যবোধ, তাহলে তাদের মুখে "ধর্মীয় অনুশাসন" কথাটা মানায় না।
এর মানে এই না যে, আমি উগ্রতা সমর্থন করছি, অশালীন পোষাক পরা অবশ্যই পরিহার করতে হবে। আমি শুধু বলতে চাচ্ছি এটাই একমাত্র সমাধান নয়। তাহলে বোরকা পরা মেয়েরা টিজিং এর শিকার হতোনা কখোনই।
আমার কথা হলো নৈতিকতা শিখতে হবে, সেটা ধর্ম থেকে নিয়েই হোক বা অন্য কোনভাবেই হোক।
ইভ-টিজিং এর বিরুদ্ধে অনেক কর্মসূচীর চিন্তা করা হচ্ছে, অনেক অনেক গ্রুপ হচ্ছে, তাদের কাছে আমার একটা অনুরোধ তারা যেন অন্যান্য কর্মসূচীর পাশাপাশি কাউন্সেলিং এ গুরুত্ব দেয়। আমরা এটা "ভুত থেকে ভুতে" পদ্ধতিতে ছড়িয়ে দিতে পারি। যেমন আমি পাঁচজনকে টিজিং এর ভয়াবহতা সম্পর্কে বুঝিয়ে বলে তাদেরকে বলবো এরা প্রত্যেকে যেন আরও পাঁচজনকে বুঝিয়ে বলে। এতে করে যে সচেতনতা সৃষ্টি হবে বলে আশা করা যায়, তাতে টিজ করার প্রবণতা অনেকটা কমে যাওয়ার কথা।
এই কথাগুলো আমার একান্তই নিজস্ব ভাবনা। এর চেয়ে ভালো পথের সন্ধান জানা আছে যাদের তারা একটু আওয়াজ দিবেন।
ব্লগে এতো এতো পোস্ট এসেছে টিজিং এর বিরুদ্ধে, এর মধ্যে একটা ভালো মানের পোস্ট স্টিকি করে সেখানে মতামত বিনিময় করা যেতে পারে।
যাই করা হোক, দ্রুত করতে হবে,আমাদের হাতে সময় খুব কম। আর একটি প্রাণও যেন ঝরে না যায়। আর একটি মুখও যেন ঝলসে না যায়।
যোগ দিন
( কোন অপ্রাসঙ্গিক মন্তব্য কাম্য নয়)
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা নভেম্বর, ২০১০ রাত ২:৫০