শেখ মুজিবুর রহমান আমাকে স্নেহ করতেন। তাকে প্রথম চিনি আমার বড় ভাইয়ের বন্ধু হিসেবে কলকাতায়। কলকাতার ইসলামিয়া কলেজে পড়তেন তিনি, আর বেকার হোস্টেলে থাকতেন। আমরাও থাকতাম তার আধ মাইলের মধ্যে। বিলেত আসার আগে যখন পূর্ব পাকিস্তানে সাংবাদিকতা করতাম তখন মাঝে মাঝে দেখা হতো তার সঙ্গে। বলতে পারেন আমি যখন জুনিয়র সাংবাদিক ছিলাম মুজিব ভাই তখন জুনিয়র রাজনীতিক ছিলেন। ব্রিটিশ ইনফরমেশন সার্ভিসে চাকরি ছাড়াও (সেজন্য মুজিব ভাই আমাকে ব্রিটিশ বলে ডাকতেন) ১৯৫৪ থেকে ১৯৫৯ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত খণ্ডকালীনভাবে দৈনিক ইত্তেফাকে সম্পাদকীয় লিখতাম। আতাউর রহমান খান, কামরুজ্জামান, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী প্রমুখ আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতারা প্রায় প্রতিদিন সন্ধ্যায় ইত্তেফাক অফিসে আসতেন। সম্পাদক তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়ার আফিসে তাদের রাজনৈতিক আলোচনা-পরিকল্পনা হতো।
সবচেয়ে বেশি আসতেন শেখ মুজিবুর রহমান। তাদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনায় যোগ দিতে মানিক ভাই সম্পাদকীয় লেখকদের উত্সাহিত করতেন। মুজিব ভাইয়ের সঙ্গে অনেক গল্প করেছি আমি। আমি আজীবন তাকে মুজিব ভাই বলেছি, যখন প্রধানমন্ত্রী ছিলেন তখনও। এ নিয়ে খায়রুল কবির একদিন লন্ডন বিমানবন্দরে তাকে আমার বিরুদ্ধে চটিয়ে দেয়ার ব্যর্থ চেষ্টা করেছিলেন।
ঊনষাট সালের ২৬ কিংবা ২৭ ডিসেম্বর বিবিসিতে যোগ দিতে আমি ঢাকা ছেড়ে যাই। মুজিব ভাইয়ের সঙ্গে যোগাযোগে ছেদ পড়ে। কিন্তু মাঝে মাঝে যখন দেশে যেতাম তার সঙ্গে দেখা করার চেষ্টা করতাম, দেখা হলে তার সাক্ষাত্কার নিয়েছি। ১৯৬৯ সালের সেপ্টেম্বরে পাকিস্তানের রাজনীতি সম্পর্কে এক সিরিজ সাক্ষাত্কার নিতে আমি দেশের উভয় অঞ্চলে সফর করি। মওলানা ভাসানী, নূরুল আমিন থেকে পূর্ব পাকিস্তানের বেশ কয়েকজন নেতার সাক্ষাত্কার (এবং জুলফিকার আলী ভুট্টোরও—তিনি তখন মুজিবের সঙ্গে জোট বাঁধার চেষ্টায় ঢাকায় এসেছিলেন) নিয়েছিলাম।
মুজিব ভাই যেতে বলেছিলেন অতি ভোরে। পাকিস্তান অবজারভার পত্রিকার ফটো সাংবাদিক ফিরোজকে সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলাম। ভাবী আমাদের নাস্তা খেতে দিয়েছিলেন পরোটা আর মাংসের ঝুরিভাজা। অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটা সাক্ষাত্কার নিয়েছিলাম মুজিব ভাইয়ের। কথায় কথায় কয়েক মাস আগে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় জেল থেকে তাকে মুক্ত করার জন্যে গণ-আন্দোলনের প্রসঙ্গ উঠল। আমি বললাম, শুনছি পাকিস্তানিরা নির্বাচন দেবে; কিন্তু আপনার যা জনপ্রিয়তা ওরা সাহস পেলেই হয়।
তিনি বললেন, জানি রে, দেশে অনেকে আমাকে সমর্থন করে; কিন্তু বিদেশে কে চেনে আমাকে? আমি বললাম, আপনি ও নিয়ে চিন্তা করবেন না। একবার লন্ডন বেড়িয়ে যান। ওটা বিশ্বের মিডিয়ার রাজধানী। আপনার সঙ্গে বিভিন্ন দেশের কয়েকজন সাংবাদিকের পরিচয় করিয়ে দেব। তিনি এসেছিলেন সে বছরেরই নভেম্বরে। আমি প্রতিদিনই সন্ধ্যেবেলা তার হোটেলে গিয়েছি। বিশেষ করে উচ্চশিক্ষার্থী কয়েকজন পূর্ব পাকিস্তানিও আসতেন মাঝে মাঝে। ব্রিটিশ এবং অন্যান্য দেশীয় ৪১ সাংবাদিকের সঙ্গে তার সাক্ষাত্কারের ব্যবস্থা করে দিয়েছিলাম। গার্ডিয়ান পত্রিকার কূটনৈতিক সংবাদদাতা প্যাট্রিক কিটলি তার সঙ্গে সাক্ষাতের ওপর ভিত্তি করে পুরো এক পৃষ্ঠার প্রতিবেদন লিখেছিলেন।
বিবিসির জন্য আমি তার ‘ইন-ডেপথ’ (সবিস্তার) সাক্ষাত্কার নিই। তেমনি সবিস্তার একটা সাক্ষাত্কার নিয়েছিলেন বিবিসির ভাষ্যকার (আগে স্টেটসম্যান পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন) এভান চার্লটন। বিবিসি থেকে প্রচারিত আরও বেশ কয়টি ভাষায় অনুবাদ করে এভানের ইংরেজি সাক্ষাত্কার প্রচারিত হয়। বিশ্বের সঙ্গে এভাবে তার পরিচয় করিয়ে দেয়ার জন্য মুজিব ভাই খুব খুশি হয়েছিলেন। দেশে ফিরে চিঠি লিখেও জানিয়েছিলেন সেকথা।
এর পরে তার সঙ্গে আবার দেখা হয় ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি শনিবার। সেদিন অতি ভোরে অপ্রত্যাশিতভাবে পিআইএর বিমানে (জনৈক কর্নেল রিয়াজুল ইসলামের তত্ত্বাবধানে) তিনি লন্ডনের হিথরো বিমানবন্দরে নামেন। ব্রিটিশ পররাষ্ট্র দফতরে আমি পরিচিত ছিলাম বিবিসির সুবাদে—বিশেষ করে মুক্তিযুদ্ধের সম্প্রচারে আমার ভূমিকার জন্যে। পররাষ্ট্র দফতরের বার্তা বিভাগের জনৈক সদস্য টেলিফোন করে আমার ঘুম ভাঙিয়ে খবরটা আমাকে দিলেন। তিনি আরও বলেন, ভারতের হাইকমিশনার আপাভাই পন্থ (ব্রিটেন তখনও বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়নি, নতুন স্বাধীন বাংলাদেশের স্বার্থ তখন দেখত ভারতীয় হাইকমিশন) বিমানবন্দরে গেছেন, শেখ মুজিবুর রহমানকে তিনি ক্ল্যারিজেস হোটেলে নিয়ে যাবেন। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তৈরি হয়ে আমি ক্ল্যারিজেসে গিয়ে পৌঁছলাম।
আপাভাই পন্থ এবং র’য়ের স্টেশন চিফ শশাঙ্ক শঙ্কর ব্যানার্জি (ইনি রাজকীয় বিমানবাহিনীর কমেট বিমানে শেখ মুজিবুর রহমানের ‘এইড’ (সহকারী) হয়ে ঢাকায় গিয়েছিলেন) ছাড়া আর কেউ তখন সেখানে ছিলেন না। কিন্তু কয়েক মিনিটের মধ্যেই একে-দুয়ে বাংলাদেশীরা আসতে শুরু করেন। মুজিব ভাইকে আমি দেশ স্বাধীন হওয়ার এবং ক্ষয়ক্ষতির কথা সংক্ষেপে বলি। কোনো অজ্ঞাত কারণে সেসব কথাবার্তার বিবরণ আওয়ামী লীগ ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর গ্রহণযোগ্য মনে হয় না। (আমার স্মৃতিকথা ‘এক জীবন এক ইতিহাস’ দ্রষ্টব্য)
তার কয়েকদিন পরই আমি ঢাকা যাই। লন্ডনের হাইকমিশন অফিস থেকে আমাকে জানানো হয়, মুজিব ভাইয়ের প্রিয় তামাক ‘এরিনমোর’ ঢাকায় পাওয়া যাচ্ছে না। আমি দু’পাউন্ড তামাক এবং ডানহিলের একটা পাইপ (নিহত হওয়ার পর সিঁড়ির ওপর তার কাছেই পড়ে থাকা পাইপটি) নিয়ে গিয়েছিলাম। সে সফরে অন্তত তিনবার আমি তার সঙ্গে দেখা করি। এর পরেও আরও কয়েকবার ঢাকায় এবং লন্ডনে তার সঙ্গে দেখা হয়েছে, কয়েকটি সাক্ষাত্কার নিয়েছি তার। তিয়াত্তর সালে একদিন তিনি তাকে দেয়া রুশ হেলিকপ্টারে নির্বাচনী সফরে লন্ডন টাইমস পত্রিকার এশিয়া বিশেষজ্ঞ রিচার্ড হ্যারিস ও আমাকে সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলেন।
স্তব-স্তুতির ট্র্যাজিক নেশা
ক্রমেই লক্ষ্য করছিলাম, প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান আর আমার প্রায়-আজীবন পরিচিত মুজিব ভাই নন। প্রতি মুহূর্ত তিনি স্তাবকদের দ্বারা পরিবৃত হয়ে থাকতেন। তারা তাকে ফুলের মালা কিংবা তোড়া উপহার দিত, কবিতা শোনাত কেউ কেউ, আর মুক্তিযুদ্ধে নিজেদের কৃতিত্ব কিংবা সমস্যার কথা শোনাত। ঢাকায় প্রধানমন্ত্রীর অফিসে যতবার তার সঙ্গে দেখা করতে গেছি আওয়ামী লীগ নেতা তোফায়েল আহমেদ অথবা আবদুর রাজ্জাক সেখানে উপস্থিত থাকতেন। বুঝতে পারছিলাম কে তাকে কী কথা বলে কিংবা কী সদুপদেশ দেয়, সে সম্পর্কে তারা অত্যন্ত সতর্ক থাকতেন।
তিয়াত্তর সালের নির্বাচনের তিন-চারদিন পরে হবে, প্রধানমন্ত্রীর জামাতা ড. ওয়াজেদ মিয়া এলেন শেরাটন হোটেলে আমার কামরায়। তিনি আমাকে বললেন, দেশ সঠিকপথে যাচ্ছে না, যাচ্ছে উল্টোপথে। একদিকে অর্থনীতিতে সঙ্কট দেখা দিয়েছে, অন্যদিকে দুর্নীতি হু-হু করে বেড়ে চলেছে। রক্ষীবাহিনীর খুন-খারাবিতে মানুষ ভীত, ক্রুদ্ধ। দেশে প্রশাসন নেই বললেই চলে, পুনর্গঠন নিয়ে কে মাথা ঘামাবে? ওয়াজেদ মিয়া আমাকে বললেন, তার শ্বশুর ভোরবেলা অফিসে আসেন, আর বাড়ি ফেরেন মাঝরাতেরও পরে। গোটা সময়টা তাকে ফুলের মালা আর স্তব-স্তুতি দিয়ে ব্যস্ত রাখা হয়। দেশে যে কী হচ্ছে, তাকে মোটেই জানতে দিচ্ছেন না তার ঘনিষ্ঠ আমলারা। ওয়াজেদ মিয়া আমাকে অনুরোধ করলেন, আমি যেন তার সঙ্গে মুজিব ভাইয়ের কাছে যাই। বললেন, আপনাকে উনি বিশ্বাস করেন, পরিস্থিতি আপনি ওঁকে বুঝিয়ে বললে হয়তো ওঁর সংবিত্ ফিরে আসবে।
আমরা হেঁটেই মিন্টো রোডে তার অফিসে গেলাম। বরাবরের মতোই মুজিব ভাই আমাকে পাশে বসালেন, আমার কাঁধে হাত রাখলেন, কর্মচারীদের ডেকে আমাকে রসগোল্লা আর চা খাওয়াতে বললেন। একের পর এক স্তাবক দল আসছিল। নিশ্চয়ই সুপরিকল্পিতভাবে এদের প্রধানমন্ত্রীর অফিসে পাঠানো হচ্ছিল, যাতে আমি তার সঙ্গে কোনো গুরুত্বপূর্ণ কথা বলার সুযোগ না পাই। বেশ কিছুক্ষণ বসে থাকার পর বুঝতে পারলাম, মুজিব ভাইয়ের সঙ্গে সিরিয়াস কোনো কথা বলার সুযোগ পাব না। দু-তিনবার বললাম, মুজিব ভাই, আমি এখন উঠি, পরে আবার দেখা করব। কিন্তু তিনি বললেন—বস, তোর সঙ্গে অনেক কথা আছে। ঘণ্টা দুই পরে ওয়াজেদ মিয়া দরজায় দাঁড়িয়ে ইশারায় আমাকে উঠে আসতে বললেন। মুজিব ভাইকে বললাম, আমাকে এবার উঠতেই হবে, আমার আরেকটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে।
ওয়াজেদ মিয়া বললেন, এই হচ্ছে সমস্যা। এ অবস্থায় দেশ শাসন কি তিনি করছেন? তিনি বললেন, যাবেন নাকি আমার সঙ্গে আমার শাশুড়ির কাছে? পরিস্থিতি তাকে বুঝিয়ে বলুন। হয়তো ওনার কথা শুনবেন আমার শ্বশুর। ভাবী (বেগম মুজিব) বললেন, তিনি তো কথা বলার সময়ই পান না স্বামীর সঙ্গে। তিনি ভোরে ভোরে বেরিয়ে যান, কোনো কোনো দিন ফেরেন রাত ১২টারও পরে। আমি তার সঙ্গে অনেক কথা বললাম। মুজিব ভাইকে পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়ার পরবর্তী সময়ের অভিজ্ঞতা মূলত। তিনি বললেন, ‘সে (মুজিব ভাই) বলেছিল পাকিস্তানিদের ভাতে মারবে। কিন্তু তার ভাত খেয়ে গেছে পাকিস্তানিরা। সে বালাম চাল আর শুঁটকি খেতে ভালোবাসে। আমি চাল আর শুঁটকি মজুত করে রেখেছিলাম। আর আমকাঠের লাকড়ি। সে লাকড়ি দিয়ে বালাম চাল আর শুঁটকি রান্না করে খেয়ে গিয়েছিল পাকিস্তানি সৈন্যরা।’
বিলম্বে উপলব্ধি এবং চাটার দল
তখনকার অর্থনৈতিক সমস্যার কথাও বললেন তিনি। বললেন, হারুনরা মাসের দশ হাজার টাকা বন্ধ করেনি, না হলে ছেলেপুলে নিয়ে আমি না খেয়ে মারা যেতাম। (শেখ মুজিব সিন্ধি ব্যবসায়ী হারুন পরিবারের বীমা কোম্পানির উপদেষ্টা হিসেবে মাসিক ১০ হাজার টাকা সম্মানী পেতেন।) মুজিব ভাই ফিরবেন আশায় আমরা অনেক রাত পর্যন্ত দেরি করেছিলাম। শেষে ভাবী আমাদের দু’জনকে খেতে দিলেন। হোটেলে ফিরে তার কথাবার্তার একটা সংক্ষিপ্ত বিবরণ লিখে ফেললাম।
আমার স্থির বিশ্বাস, ১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত তার নামে যেসব অপকর্ম হয়েছে, তার অনেক কিছুই শেখ মুজিব জানতেন না। এদিকে দেশের অর্থনৈতিক সঙ্কট চরমে উঠেছে। দুর্নীতি তার নিজের পরিবারেও ঢুকে পড়েছে। যখন তিনি কিছু কিছু জানতে পারলেন ততদিনে অনেক দেরি হয়ে গেছে। ‘চাটার দলের’ কথা তখন তিনি বলেছিলেন। কিন্তু চাটার দলের খপ্পর থেকে তখন আর তার মুক্তির আশা ছিল না। তাদের পরামর্শে তিনি জরুরি ক্ষমতা আইন পাস করে ৩০-৪০ হাজার সমালোচককে জেলে পোরেন, সরকারি চারখানি পত্রিকা ছাড়া সব পত্রপত্রিকা এবং সাময়িকীর প্রকাশ নিষিদ্ধ করে দেন।
তার পরও এদেরই পরামর্শে তিনি সংবিধান পরিবর্তন করে বাকশাল পদ্ধতি চালু করেন, সব রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করে দিয়ে প্রথম দফায় সাত বছরের জন্যে তিনি স্বৈরতন্ত্রী নির্বাহী রাষ্ট্রপতি হন। মুজিব এককালে সব বাংলাদেশীর ‘হিরো’ ছিলেন। কিন্তু দেশ ও সমাজের সর্বনাশ করা এবং গণতন্ত্রকে হত্যা করার জন্য ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট তিনি চরম মূল্য দেন। তাকে হত্যা করেছিলেন কয়েকজন সেনা অফিসার, কিন্তু সে হত্যার পেছনে জনসমর্থন ছিল। লন্ডনে আমার স্ত্রী আর আমি কেঁদেছিলাম। কিন্তু বাংলাদেশে কেউ চোখের পানি ফেলেনি, বরং মিষ্টি বিতরণ করা হয়েছিল সেদিন। যে জন্য হাসিনা এখন বাংলাদেশের ওপর প্রতিশোধ নিচ্ছেন।
তারপর থেকে পদ্মা-যমুনা দিয়ে অনেক পানি বঙ্গোপসাগরে পড়েছে। বাংলাদেশে অন্তত চারটি সামরিক অভ্যুত্থান হয়েছে, আরও একজন রাষ্ট্রপতি সেনা অফিসারদের ষড়যন্ত্রে নিহত হয়েছেন। সময়ে সবকিছুই সয়ে যায়। শেখ মুজিবুর রহমানের স্মৃতির ব্যাপারেও তা-ই ঘটেছে। তার ব্যর্থতার স্মৃতি অনেকের মনেই ঝাপসা হয়ে এসেছিল। তাছাড়া নতুন প্রজন্ম ’৭২-৭৫ সালের ইতিহাস জানত না। আওয়ামী লীগের অপপ্রচার ও ইতিহাস বিকৃতিও একটা বড় ভূমিকা নিয়েছে। সব মিলিয়ে সাধারণ মানুষের হৃদয়ে তিনি ক্রমেই আবার স্থান করে নিচ্ছিলেন। জনসাধারণের মুখে মুখে এবং কলামিস্টদের লেখায় তিনি আবার জাতির পিতা হিসেবে স্বীকৃতি অর্জন করেছিলেন।
তার মেয়ে হাসিনা আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব পাওয়ার পরে বলেছিলেন, বাংলাদেশের মানুষ তার বাবা-মা ও ভাইদের হত্যা করেছে, তাদের জন্য কেউ চোখের পানি ফেলেনি, সেজন্যে তিনি প্রতিশোধ নিতে রাজনীতিতে এসেছেন এবং আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব গ্রহণ করেছেন।
ইতিহাস গুরুত্বপূর্ণ এজন্য যে তার আলোকে মানুষ অতীতের ভুলভ্রান্তি এড়িয়ে সঠিক পন্থা অনুসরণ করতে পারে। বাংলাদেশের মানুষ আশা করেছিল বাবার ভুলভ্রান্তি থেকে শিক্ষা নিয়ে হাসিনা সঠিক এবং সাফল্যের পথে দেশকে নিয়ে যেতে পারবেন। দুর্ভাগ্যবশত ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেয়ার পরিবর্তে হাসিনা বাবার ভুলভ্রান্তি ও ত্রুটি-বিচ্যুতিগুলোর অন্ধ অনুকরণ শুরু করেন। শুধু তা-ই নয়, ’৭২-৭৫-এর মর্মান্তিক ভুলভ্রান্তি ও অন্যায়গুলোকে তিনি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেন।
স্বৈরতন্ত্রী প্রবণতা ও দুর্নীতি
হাসিনার কাজকর্মে গোড়া থেকেই স্বৈরতন্ত্রী প্রবণতা লক্ষ করা গিয়েছিল। একথা তিনি অস্বীকার করেননি যে, বাবার অন্ধ অনুকরণে তিনি একটা বাকশালী স্বৈরতন্ত্র সৃষ্টি করতে চান। মন্ত্রিসভা এবং দলে তার কোনো কোনো সহকর্মী স্পষ্ট করেই বলেছেন সে কথা। হাসিনা নিজেও বলেছেন, ২০২১ সাল পর্যন্ত তিনি ক্ষমতায় থাকতে চান। শেখ মুজিবের সরকারের আমলে রক্ষীবাহিনী ৪০ হাজার ভিন্ন মতাবলম্বীকে হত্যা করেছিল। হাসিনা প্রথম বার প্রধানমন্ত্রী হয়ে একটা সশস্ত্র ক্যাডার গঠন করেছিলেন। রাজনৈতিক হত্যা তারা তখন থেকেই শুরু করেছিল। তার বর্তমান মেয়াদে অন্তত ২৫ থেকে ৩০ হাজার সরকারবিরোধী ও সমালোচককে হত্যা করেছে তার ক্যাডার ও আওয়ামী লীগ গুণ্ডা বাহিনী।
মুজিব সরকারের আমলে দুর্নীতি ভয়ঙ্কর আকার ধারণ করেছিল। প্রধানমন্ত্রীর পরিবারের কোনো কোনো সদস্যের বিরুদ্ধেও দুর্নীতির ব্যাপক অভিযোগ ছিল। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট কয়েকটি ব্রিটিশ ও অন্য দেশীয় মিডিয়া টেলিফোনে আমার সাক্ষাত্কার নিয়েছিল। সকলেরই একটা প্রশ্ন ছিল—শেখ মুজিবুর রহমান দুর্নীতিপরায়ণ ছিলেন কিনা। প্রত্যেককে আমি জবাব দিয়েছিলাম, তার আশপাশে প্রচুর দুর্নীতি ঘটেছে; কিন্তু মুজিবকে ব্যক্তিগতভাবে আমি দুর্নীতিপরায়ণ মনে করি না। কিন্তু তার হাইকমিশনার আইটিএন টেলিভিশনকে বলেছিলেন, ‘মুজিব সম্ভবত দুর্নীতিপরায়ণ ছিলেন।’ রাতে উত্তর-পশ্চিম লন্ডনের হেন্ডন লেনে ডেপুটি হাইকমিশনার ফারুক আহমেদ চৌধুরীর বাসায় বসে আমরা কয়েকজন আইটিএনের সে খবরটি দেখেছিলাম।
বর্তমান সরকারের আমলে দুর্নীতিই স্বাভাবিক নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রধানমন্ত্রীকে ঘিরে আত্মীয়-স্বজনসহ কিছু লোক আছেন এ সরকারের আমলেই বাংলাদেশের সব সম্পদ লুণ্ঠন করা যাদের ব্রত হয়ে দাঁড়িয়েছে। পণ্যের বাজারে সিন্ডিকেট গঠন করে তারা পাগলা ঘোড়ার মতো হু-হু করে মূল্যবৃদ্ধি ঘটিয়েছেন এবং রক্তচোষার মতো সাধারণ মানুষের সম্পদ শুষে নিয়েছেন। শেয়ারবাজার থেকে ৩৩ লাখ স্বল্পবিত্ত মানুষের লগ্নি করা অর্থ লুণ্ঠন করেছেন সরকারের পৃষ্ঠপোষক বলে কথিত কিছু ব্যক্তি। কুইক রেন্টাল বিদ্যুেকন্দ্র বাবদ বিনা টেন্ডারে কন্ট্রাক্ট দিয়ে ২০ হাজার কোটি টাকা লুট করার সুযোগ দেয়া হয়েছে যেসব ব্যবসায়ী ও শিল্প গ্রুপকে, তাদের মধ্যে প্রধানমন্ত্রীর নিকট আত্মীয়রাও আছেন বলে শুনেছি।
বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতুর অর্থায়ন বন্ধ করেছে কনসালট্যান্সি পর্যায়েই ৩৫ মিলিয়ন ডলারের দুর্নীতির অভিযোগ করে। বিশ্বব্যাংক সংশ্লিষ্টদের নাম উল্লেখ করে বাংলাদেশ সরকারের কাছে চিঠি লিখেছে এবং দোষী ব্যক্তিদের শাস্তি দাবি করেছে। প্রধানমন্ত্রী ও অন্য কোনো কোনো মন্ত্রী উল্টো বিশ্বব্যাংকের বিরুদ্ধেই দুর্নীতির অভিযোগ করে যাচ্ছেন। প্রধান বিরোধী দল ও মিডিয়া থেকে শুরু করে বহু বিশেষজ্ঞ বিশ্বব্যাংকের চিঠি প্রকাশ করার দাবি জানিয়েছেন। বিশ্বব্যাংকের বাংলাদেশ প্রতিনিধি এলেন গোল্ডস্টেইন বলেছেন, চিঠি প্রকাশের ব্যাপারে বিশ্বব্যাংকের কোনো আপত্তি নেই। কিন্তু সরকার সে চিঠি প্রকাশের সত্ সাহস দেখাতে পারছে না।
মাথায় যখন বিষ ঢোকে
এই দুর্নীতির ব্যাপারে বিশ্বব্যাংক একটি কানাডীয় কনসালট্যান্সি প্রতিষ্ঠানকে কালো তালিকাভুক্ত করেছে। কানাডীয় পুলিশের (রয়্যাল কানাডিয়ান মাউন্টেড পুলিশ) আট সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল সম্প্রতি বাংলাদেশ সফর করে অন্যদের সঙ্গে দুর্নীতি দমন কমিশনের (লোকে বলে প্রধানমন্ত্রীর নিয়ন্ত্রণাধীন একটা সরকারি বিভাগ) সঙ্গেও কথাবার্তা বলেছে।
কানাডীয় পুলিশ বিগত কয়েক দিনের মধ্যে দু’জন বাংলাদেশীর কানাডীয় পাসপোর্ট জব্দ করেছে, তবে তারা আগেই বাংলাদেশী পাসপোর্ট ব্যবহার করে কানাডা ছেড়ে গিয়েছিলেন। কানাডা ও যুক্তরাষ্ট্রে জোর গুজব—এই দুই ব্যক্তি প্রধানমন্ত্রীর অতি নিকট আত্মীয়। কানাডার পুলিশ এ ব্যাপারে তাদের দেশে এবং যুক্তরাষ্ট্রে তদন্ত চালাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রে যেসব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে তদন্ত হচ্ছে, তাদের মধ্যে ওয়াজেদ কনসালট্যান্সি নামে একটি কোম্পানিও আছে।
মানুষের যখন সমস্যা থাকে, তখন তারা সমালোচনামুখর হয়ে ওঠে। বর্তমানে বাংলাদেশের মানুষের সমস্যা ১৯৭৩-’৭৪ সালের চেয়েও বেশি। দ্রব্যমূল্য এককথায় সাধারণ মানুষের ক্রয়সীমার বাইরে। সঞ্চয় ভাঙিয়ে মধ্যবিত্ত কোনো রকমে বেঁচে আছে। কিন্তু তাদের চোখের সামনে চলছে পর্বতপ্রমাণ দুর্নীতি, বিলাস-ব্যসন। বাইরে বেরুলে চাঁদাবাজ আর ছিনতাইকারীর হাতে প্রাণ যাচ্ছে, ডাকাতরা বাড়িতে ঢুকে মানুষ হত্যা করছে। এর প্রতিকারের কোনো চেষ্টা নেই। মিথ্যাবাদী স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী দাবি করেন, তার আমলে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। সাধারণ মানুষ দেখছে পুলিশ ও র্যাব সরকারবিরোধীদের মারপিট করে; খুন ও গুম করে। অন্য সময় তারা দুর্নীতি করে, দরগার টাকা লুট করে, প্রকাশ্যে চাঁদাবাজি করে।
বিচিত্র নয় যে সমালোচনা বেড়েই চলেছে। শেখ মুজিবের আমলের সঙ্গে বর্তমান সময়ের তুলনা হচ্ছে। মুজিবের আমলের স্মৃতি অধিকাংশের মনেই অস্বচ্ছ ঝাপসা হয়ে গেছে, নতুন প্রজন্মের মনে সম্পূর্ণ অনুপস্থিত। তবু পত্রিকার কলাম পড়ে, অন্যের মুখে শুনে শুনে অনেকেই এখন সে দুঃস্বপ্নের সময়ের কথা বলাবলি করছে, মুখে মুখে অতিরঞ্জিত হয়ে তিল তাল হয়ে যাচ্ছে। স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতা (স্বাধীনতার ঘোষক নন) আর জাতির পিতা হিসেবে মুজিবের ভাবমূর্তি যতটা পুনর্বাসিত হয়েছিল তার চেয়ে অনেক বেশি পিছিয়ে গেছে, ম্লান হয়ে গেছে শেখ মুজিবুর রহমানের ভাবমূর্তি। হাসিনা তার বাবাকে শ্রেষ্ঠতম বাঙালি কিংবা শ্রেষ্ঠতম এশীয় নেতা প্রমাণ করার জন্য কিছুকাল আদা-জল খেয়ে নেমেছিলেন। কিন্তু বাবার ভাবমূর্তি তিনি কীভাবে হত্যা করেছেন উপলব্ধি করার মতো প্রজ্ঞা তার নেই।
আমার দেশ
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে আগস্ট, ২০১২ রাত ৩:১৪