somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ছোটগল্প

২৫ শে ফেব্রুয়ারি, ২০০৬ সকাল ৯:৫৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

অনেকদিন আগে গল্পটি লিখেছিলাম । মনে হয় এখানকার কাঠামোয় বেশ লম্বা। তারপরও পড়ে মন্তব্য জানালে খুশী হব।

পর্দা

ইদানীং চোখের সামনে প্রায় মাঝে মাঝেই একটা ঝলমলে পর্দা দেখতে পাই। তারপরেই চোখটা কেমন করে যেনো আটকে যায় ওটার গায়ে। অনেক সময় মনে হয় পর্দাটাই যেনো আটকে যায় চোখে। তখন ডানদিক, বাঁ'দিক যেদিকেই তাকাই না কেনো, আমাকে স্বাধীনভাবে আর অন্যকিছু দেখতে দেয় না ওটা। যতোটা অদ্ভুত সে পর্দার তার ডিজাইন, তারচে' বিকট তার রংএর সমারোহ। মনে হয় যেনো বেছে বেছে পৃথিবীর সবগুলো বেমানান রং, আর সে রংগুলোর সবচে' বেমানান সংমিশ্রণের কদাকার মাপের স্লাইডগুলো পাশাপাশি সাজানো হয়েছে। পর্দাটা সামনে আসার মূহুর্তের মাঝেই তী্ন এক যন্ত্রণায় অবশ হয়ে আসে চোখদুটো, তারপর ছড়িয়ে পড়ে সে যন্ত্রণা আরো তীব্র হয়ে কপাল বেয়ে মাথার পেছন দিকটায়। কোনকিছু স্থিরভাবে করার আর মতা থাকে না তখন আর। তারপরেও সে পর্দার কোন এক অজানা আকর্ষনে বন্দী আমি সে সময়গুলোতে। এ আকর্ষন কোনো, বুঝতে পারিনা একেবারেই। রং আর ডিজাইনের প্রশ্নে মোটামুটি রুচিবান বলেই নিজেকে জানি, অন্যরাও সেরকমই জানে। আমার পোষাক-আসাক, চাকুরী, ড্রয়িংরুমের সাজসজ্জা, এমনকি স্ত্রীভাগ্য নিয়ে অনেকেই ঈর্ষা করে, দরকারে পরামর্শ নিতে দ্বিধা না করলেও। তারপরেও এই বিবর্ণ রংচঙ্গে পর্দার আকর্ষণ থেকে আমি আমার চোখকে একেবারেই মুক্ত করতে পারিনা। নিজের মতার উপর বিশ্বাস হারিয়ে ফেলি, পর্দার ক্রীতদাস যেনো হয়ে যাই তখন। যতোন ওাটা থাকে, ততোন এমনি চলে, সরে গেলে ফিরে আসি আমার আগের জায়গায়।

দিন রাতের বিশ্রামের সময় থেকে শুরু করে কাজের জীবনেও প্রভাব ফেলা শুরু করলো পর্দাটা। স্থিরভাবে কোন কিছু করাই কঠিন হয়ে দাঁড়ালো। সেদিন কাশে এ্যটমিক এনার্জীর একটা চ্যাপ্টার নিয়ে বেশ মেতে ছিলাম ছাত্রদের সাথে। ভালো শিক হিসেবে আমার যথেষ্ট সুনাম, যে কোন রসহীন বিষয়কেও রসালো করে মাতাতে জানি ছাত্রদেরকে। কিস্তু হঠাৎ করেই পর্দাটা চোখের সামনে এসে ওলটপালট করে দিল সবকিছু। কাশ, ছাত্র সবাইকে ভুলে গিয়ে চোখদুটো ওটার শরীরে রেখে কোথায় যে চলে গেলাম কে জানে ! ছাত্রদেরই কেউ একজন হঠাৎ কথা বলে মনযোগ ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করলো। তাতে কতোটা কাজ হলো, তা জানা নেই আমার। কিন্তু আমি সে পর্দার শরীরে চোখ রেখে সাঁতার কেটে গেলাম আরো অনেকন। একসময় ফাঁকা হয়ে গেলো কাশ। দারোয়ান এসে না ডাকলে হয়তো ওখানেই থেকে যেতাম। বাইরে এসে দেখলাম শায়লা অপো করছে বারান্দায়।

-- কি হলো। সবাই তো বেরিয়ে গেলো। তোমার এতোন ?
আমি শায়লার মুখের দিকে তাকালাম। চৈত্র মাসের ভ্যপসা গরমে বিন্দু বিন্দু ঘাম ওর কপালে। চোখে রাজ্যের কান্তির ছাপ।
-- কাগজপত্র গোছাতে তো দশ মিনিটের মতো লাগেই।
উত্তর শুনে অবাক হয়ে আমার চোখের দিকে তাকালো ও। হাতের রুমালটা দিয়ে মুখ মুছলো আবার।
-- দশ মিনিট, কিন্তু আমি তো প্রায় আধঘন্টা দাঁড়িয়ে রইলাম বাইরে।

আমি অবাক হলাম। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলাম ঠিকই বলছে শায়লা। একটু আদর করলাম ওকে। ওর সমস্ত রাগ গলে গিয়ে একটা প্রশ্নবোধক চিহ্ন বাড়তি রাখলো মাত্র। সেটাকে ভাঙতে খুব একটা দেরী হলোনা আমার।
-- তোমার কাশ কেমন হলো ?
-- বেশ ভালো। কিন্তু কাশের ভেতরে গরমে কষ্ট হয়েছে খুব। লোড শেডিং ছিলো।
উত্তর দিলো শায়লা। গাড়ীতে উঠলাম ওকে নিয়ে। স্টার্ট দিয়ে এসি টা পুরো ছেড়ে দিলাম। ওর কপালের বিন্দু বিন্দু ঘাম বাতাসে উড়ে গেলো একসময়। আবার কমনীয়তা বাসা বাঁধলো ওর চেহারায়। আমার মনটাও ভালো হয়ে উঠলো একটু। গাড়ীর ভেতরের শীতলতায় ও শায়লার সান্মিধ্যে কাশের সেই গ্লানি ভুলে গেলাম ধীরে ধীরে।

খুব ভালো মেয়ে শায়লা। সহজভাবেই দেখতে চায় জীবনকে, তাই বাড়তি চাহিদা নেই তেমন একটা। সামাজিক সন্মান, শাড়ি, গহনার প্রতি আকর্ষণ থাকলেও সেটাকে লোভ বলা চলেনা, একটু আদর পেলেই মনে হয় সন্তুষ্ট। রাঁধতে ভালোবাসে যদিও খাবার দাবারে আমার তেমন একটা লোভ নেই। একটা কলেজে ইংরেজী পড়ায়, শিকিা হিসেবে ভাল সুনাম। অন্যান্য ভালো ভালো কলেজ, এমনকি 'ভার্সিটি থেকেও ডাক আসে ওর। আমাকে ছাপিয়ে অনেক আগেই অনেক উপরে উঠে যেতে পারতো। কিন্তু করেনি। হয়তো বাধ্য স্ত্রী হিসেবে স্বামীকে ছাড়িয়ে যাওয়া ঠিক নয় বলেই মনে করে। আমি এসব নিয়ে খুব একটা ভাবি না, নাকও গলাই না, কিন্তু উপভোগ করি।

সকালে 'ভার্সিটি যাওয়ার তেমন একটা তাড়া ছিলনা। প্রথম কাসটিই এগারোটার দিকে শুরু হওয়ার কথা। শায়লা চলে গেছে অনেকন হলো। টেবিলে নাস্তা রেখে গিয়েছিল। আমি খবরের কাগজটা হাতে নিয়ে আরাম করে বসলাম। খবর আর কি থাকবে ? দেশে খুন, ধর্ষন আর অরাজকতা, বিদেশে সাদ্দাম হোসেন, তালিবান আর এগারোই সেপ্টেম্বর। তারপরেও প্রতিদিন পড়ি, পড়তে হয়। শিক হিসেবে দেশে বিদেশের খবর রাখতে হয় বৈকি। শায়লাকে খুব একটা খবরের কাগজ পড়তে দেখি না। কিন্তু তারপরেও দেশবিদেশের খবর আমার চেয়ে কম রাখে বলে মনে হয়না। এসব নিয়ে ভাবতে ভাবতে প্রথম পাতাটায় চোখ রাখার সাথে সাথেই রঙ্গিন পর্দাটা এসে ঢেকে দিল কাগজটাকে। খালেদা জিয়া, বুশ আর বিন লাদেন আর যা কিছু ছিল, সবই পর্দার কর্কশ রংএর সাথে একাকার হয়ে গেলো। ঘর ছেড়ে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালাম। পর্দাটাও আমাকে অনুসরণ করে সামনের বাড়ী, তার এক চিলতে বারান্দা ও রাস্তার দাঁত বের করা ইটগুলোর উপর তার বিচিত্র রং ঢেলে দিল। বাথরুমে গিয়ে মুখে জল ঢেলেও কাজ হলোনা কোন। অনেকন সোফায় হেলান দিয়ে বসে বসে একসময় ঘুমিয়েই পড়লাম। প্রথম কাশটায় পৌঁছাতেই দেরী হলো বেশ।

বেশ চিন্তায় পড়ে গেলাম। কখন যে পর্দাটা চোখের সামনে এসে হাজির হতে পারে, সেই ভয়েই তটস্থ থাকতাম সারাণ। যতোদিন পারা যায় নিজের কাছে রেখে একদিন শায়লাকেই খুলে বললাম আমার সমস্যার কথা। শুনে খুব চিন্তিত হলো ও। ডাক্তারের কাছে যেতে বললো, আমার খাবার দাবারে পুষ্টির পরিমাণ বাড়িয়ে দিল, ও সেসাথে শুরু করলো আমার বিশ্রাম ও ঘুমের দিকে আরো বেশী নজর রাখার। এক সপ্তাহের মাঝেই আমার ওজন বেড়ে গেলো বেশ কিছুটা, কিন্তু পর্দার দৌরাত্ব কমলো না একেবারেই। ডাক্তারের কাছে গেলাম অবশেষে। বেশ নামী একজন ডাক্তার। তার চেম্বারের ঠিকানা, দামী ফাির্নচার, ফি'র পরিমাণ সবকিছুই তার পেশার সাফল্যের প্রমাণ। মাথায় ব্যকব্রাশ করা কাঁচাপাকা চুল। চোখে দামী সোনালী ফ্রেমের চশমা। বয়েস পঞ্চাশ থেকে পঞ্চান্ন মাঝে। আমার সমস্যাটা বাইরে বাইরে বেশ মনোযোগের সাথে শুনলেও, তার লুকানো বাঁকা হাসিটা আমার চোখ এড়াতে পারলো না। ওনি আমাকে তীর্যক কিছু প্রশ্ন করলেন।
-- আপনার পেশা কি ?
-- আমি একজন টিচার।
-- কোন স্কুলে ?
-- স্কুলে নয়।
-- তাহলে ?
-- 'ভার্সিটিতে।
ওনি এতোনে আমার দিকে একটু সমীহ নিয়ে তাকালেন। একটু গর্বিত বোধ করলাম তাতে। আমাদের দেশের সবচে' মতাধর হচ্ছেন সফল রাজনীতিবিদ ও তাদের আমলারা, তারপরেই ডাক্তারদের স্থান। তাদের মতো একজন যদি সমীহের দৃষ্টিতে তাকান, গর্ববোধ তো হতেই হবে।
-- আপনি কি বিবাহিত ?
-- হ্যা।
-- বাচ্চা ক'জন ?
-- বাচ্চা নেই।
-- কেনো ?
-- বাচ্চা চাইনা বলেই।
-- স্ত্রীকে ভালোবাসেন ?
-- আমার স্ত্রী সুন্দরী।
একটু ভ্রু কুঁচকালেও আর কোন প্রশ্ন করলেন না ডাক্তার। আমার জিব দেখলেন, নাড়ি টিপলেন। চোখের উপর টর্চ ফেললেন। এতোকিছুর পরও তার চেম্বারটাই যে আমার সে পর্দায় ঢেকে গেলো, তা আমি আর তাকে বলতে সাহস পেলাম না। ওনি আমাকে কিছু ভিটামিন লিখে দিয়ে পরামর্শ দিলেন একজন সাইক্রিয়াটিঙ্রে কাছে যাবার। আমি তার প্রেস্কিপশানটা পকেটে পুরে ধন্যবাদ জানিয়ে বেরিয়ে এলাম।

শায়লা খুব সুন্দরী তো বটেই। ওকে আরো সুন্দর দেখার জন্যে কোন এক শিাসফরে ভারতে গিয়ে অন্যান্য শাড়ীর সাথে খুব সুন্দর আকাশী রংএর একটা শাড়ী কিনে দিয়েছিলাম। শায়লাও অন্যান্য শাড়ীগুলোর চেয়ে এই শাড়ীটাই পছন্দ করলো বেশী। সুযোগ পেলেই পরতো ওটা। ঘরে বাইরে সবখানেই। নিজের পছন্দে কেনা বলে আমারও ভালো লাগতো প্রথম প্রথম। ওর সুন্দর দেহের আকাশী রংএর নিপূন বাঁধন বেশ পাগলই করে তুলতো । শাড়ীর ভাঁজের ভেতরে লুকানো শরীরের ভাঁজগুলোকে উন্মুক্ত করতে করতে সে ভাঁজেই বিলীন হয়ে যেতাম আমি। এসব ব্যপারে আমার ভেতরে এমনিতেই একটু বাড়াবাড়ির ধাঁচ রয়েছে। সেটা জেনেই একটু ন্যকামো করে মাঝে মাঝে বকতো শায়লা।
-- কি পাগলের মতো করছো। এতো আদিখেতা ভালো না।
-- ভালো না কেনো ?
আমি অবাক হয়ে তাকাতাম ছেলেমানুষের মতো। তাতে আরো বেশী বকার ভান করতো সে।
-- যদি ভেঙ্গে পড়ে আকাশটা তোমার আদরের চাপে ?
আমাদের শোবার ঘরটা শায়লার মনের মতো সাজনো। বিছানা, চাদর, ড্রেসিং টেবিল যা কিছু আছে আমাদের এই ঘরে, সবকিছুই ওর মনের মতো প্লান করে, যত্ন করে কেনা। আমি নিজে কখনো কিছু বলিনি, প্রয়োজনও মনে করিনি।
-- এতো রাতে আমাদের এই শোবার ঘরে ভেঙ্গে পড়বে আকাশ ?
শায়লা হাসতো আওয়াজ করে। আমি আদর করতাম, চোখ বুজে সে আদর নিতো ও। পাগলের মতো বলতাম,
-- শালু, শালু, কি সুন্দর তুমি।
এতেই খুশী হয়ে যেতো ও। নিজেকে সমর্পন করতো নির্দ্বিধায়। আরেকটু বাঁধা পেলে হয়তো ভালোই লাগতো আমার। কিন্তু শায়লা কখনোই তা করতো না বা করতে সাহস পেতো না। আমি একসময় চুপ হ'তাম। শায়লাও তাই। কিন্তু ওকে মনে হতো যেনো একটা মৃত প্রজাপতি তার উজ্জল রংবিন্যাস নিয়ে শুকিয়ে আছে আমার চোখের সামনে। একটা মালিন্য আসতো নিজের ভেতর। কিন্তু সে মালিন্যের উৎস কোথাও না খুঁজে পেয়ে অস্থির হতো মন।

সত্যি কথা বলতে কি, শায়লা আমাকে আমি যা চেয়েছি, অকাতরে তাই দিয়েছে। হাত বাড়নোর আগেই বুঝে নিয়েছে, কিসের জন্যে হাত বাড়াতে চাই আমি। কোথাও কোনকিছুর কমতি ছিলনা। আমার বন্ধুরা, আত্মীয়রা আমার এই স্ত্রীভাগ্যের কথা জেনে, কেউ খুশী হয়েছে, কেউ কেউ হয়েছে ঈর্ষায় জর্জরিত। কেউ কেউ বলতো, স্ত্রীভাগ্যে মাটিতে পা পড়েনা ওর। কোন অনুষ্ঠানে একা যোগ না দিতে চাইলেই স্ত্রৈণ আখ্যা পেয়ে যেতাম অনায়াসে। শায়লা সামনে থাকলে লজ্জা পেতাম, না থাকলে অপ্রস্তুত হতাম। শায়লাকে কিন্তু এসব েেত্র খুশী ও সপ্রতিভ বলেই মনে হতো। সেদিন একটা বড়সড় পার্টি ছিল আমাদেরই এক কলিগের বাড়ীতে। সস্ত্রীক দাওয়াত ছিল সবার। আমরাও গেলাম। হরহামেশা হয়েই যাচ্ছে এ ধরণের পার্টি, বড় ধরণের কোন বৈচিত্র না থাকায় অনেক সময় উদ্ভট কিছু একটা বেরিয়ে আসে কারো মাথা থেকে। আর এবার বেরুলো এমনি একজনের মাথা থেকে, যার এ বিষয়ে কোন কথা বলারই থাকতে পারে না। নিতাই কুন্ডুর বয়স তেতালি্লশ পেরূতে চললো, অথচ কোন সঙ্গীনি দেখা মেলেনি এ পর্যন্ত। অংকের শিক হলেও রসবোধের প্রশ্নে তার জুড়ি নেই কেউ। কাশের ভেতরে নিতাই অংক ছাড়া কোনকিছু ভাবতে পারে বলে মনে হয়না, কিন্তু এর বাইরে আমরা তো বটেই, অনেক ছাত্ররাও ওর রসিকতার জন্যে ওকে দেখতে পেলেই হাসে। নিতাই কুন্ডু সে পার্টিতে বিশাল এক ফুলের তোড়া টেবিলে রেখে বললো,
-- আজকের পার্টিতে সবচে' সুখী দম্পতির পুরস্কার এটা।
হই হই করে সম্মতি জানালো সবাই। এমনকি যারা সঙ্গী বা সঙ্গীনিহীন তারাও। সাথে সাথে উপস্থিত দম্পতিদের একটা তালিকা করা হলো, নম্বর দেয়া হলো। প্রত্যেককে একটা করে কাগজ দেয়া হলো, তাদের পছন্দসই নম্বর গোপনে লেখার জন্যে।

হাততালি উচ্ছাসের মাঝে বিজয়ী দম্পতিকে তাদের পুরষ্কার দেয়া হলো। কারো কারো দৃষ্টিতে ঈর্ষা থকলেও তা প্রকাশ করার মতো বোকামী করলো না কেউ।

গোলাপের তোড়াটা গাড়ীর পেছনে রেখে অনেক রাতে ঘরে ফিরলাম আমরা দু'জন। কান্তিতে বা কিসে এতোটা চুপচাপ ছিলাম, জানিনা। আমাদের নীরবতাকে গাড়ীর একঘেয়ে ঘড়ঘড় আওয়াজও ভাংতে পারলো না। মধ্যরাতের চরিত্রের সাথে একাত্ম হয়ে অনেকটা নীরব ঢাকার রাস্তাঘাট, তারপরেও ধোঁয়াটে একটা আবরণে মলিন ল্যাম্পপোষ্টের আলোগুলো। মাঝে মাঝে দুরন্ত গতিতে ছুটে যাচ্ছে একটা দু'টো ট্রাক ধোঁয়ার আস্তরণে সে আলোকে আরো মলিন করে। পথে একবার আমার হাত ধরলো শায়লা। আমি কতোন পর গাড়ীর গিয়ার পাল্টাতে গিয়ে সরিয়ে ফেললাম হাত। বাকী পথটুকুতে শায়লা আর সে হাত ধরলো না।

জামা কাপড় পাল্টে বিছানায় গিয়ে জড়িয়ে ধরলাম শায়লাকে। কোন আপত্তি জানালো না ও। তৃপ্ততার কান্তিতে ঘুমিয়ে পড়লাম কিছুনের মাঝেই।

ভোররাতের দিকে হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে গেলো আমার। টের পেলাম পাশে নেই শায়লা। বিছানা থেকে উঠে দেখলাম বারান্দায় একটা চেয়ারে মাথা এলিয়ে বসে আছে ও। ওর বসার ভঙ্গীটাই মনে হলো ওর কষ্টের সত্যিকারের প্রকাশ। আমার বুকের ভেতরটা কেঁপে উঠলো মুহূর্তের মাঝেই। মনে হলো ওকে এখন একা থাকতে দেয়াই ভালো, তারপরেও কাছে গিয়ে ডাকলাম,
-- শায়লা।
ও চমকালো না একটুও আমার ডাক শুনে। একবার তাকালোও না। বাইরের দিকে তাকিয়েই মৃদু গলায় বললো,
-- রাতের কোন বন্ধু নেই কেনো বলতো ?
ওর কন্ঠস্বরের বিষাদ আমাকে চকিত করলেও ওর বেদনার কাছাকাছি পেঁৗছুতে পারলাম না আমি। বারান্দার রেলিংএ হেলান দিয়ে দাঁড়ালাম যাতে ওর মুখ দেখতে পারি। কিন্তু সে মুখ আমার কাছে অনেক অনেক দূরের বলে মনে হলো।
-- রাতের বন্ধুরা রাতের মতোই একা, তাই।
উত্তর শুনে আমার দিকে তাকালো একবার শায়লা। বাইরে ঝলমলে পূর্ণিমার আলো, আশে পাশের বাড়ীর ছাদগুলোতে, আমাদের হাস্নাহেনা গাছের ফুলে-ডালে ঝলসে পড়ছে সে আলো, কিন্তু আমাদের বারান্দায় আবছা আঁধার। ওর মুখটা স্পষ্ট দেখতে পেলাম না । হয়তো সেকারণেই ওর ভেতরের বিষাদের দেয়ালটা আরো বেশী অনুভব করলাম। এই প্রথমবারের মতো ওর পাশাপাশি নিজেকে অসহায় মনে হলো। তারপরেও কোনক্রমে আলতো করে ওর হাতটা ছুঁয়ে বললাম,
-- শায়লা, আমরা কি ভুল করেছি এতোদিন ?
-- না সুজন, ভুল আমরা করিনি। রাত আর দিনের আবর্তনে আমাদের যেখানে অবস্থান ভুলের অবকাশ কোথায় ?
রাতের শিশিরের মতো ভেজা শায়লার গলার আওয়াজ। একটা টোকা দিলেই যেনো কান্নার মতো ঝরে পড়বে শিশিরের বিন্দুগুলো।
-- নিজেরা ভূল না করেও কোন এক ভুলের সীমানাতেই আবদ্ধ আমরা।
-- হ্যা, তাইতো ভাবি, মুখোমুখি আমরা, অথচ একজন আরেকজনকে দেখতে পাইনা কেনো ?
এ প্রশ্নের উত্তর আমাদের কারোই জানা ছিলনা। থাকার কথাও না। যদি থাকতো, তাহলে কাছে থেকেও এতোটা দূরত্বের যন্ত্রনা সইতে হতোনা আমাদের। শায়লার দৃষ্টি যেনো আবার জোৎস্নার উজ্জল আলোতে ফিকে হয়ে যাওয়া তারাগুলোকে আকাশের গায়ে গায়ে খুঁজে বেড়ালো। চাঁদটা এতটু হেলে যাওয়ায় আলোতে শায়লার মুখটা দেখতে পেলাম। সে মুখে যন্ত্রনা আর একাকীত্বের যে ছবি দেখলাম, তা সহ্য করার মতা আমার আর রইলো না। কোন কথা না বলে তাই ঘরে ফিরে গেলাম আবার।

বাকী রাত ঘুম হলোনা আর। কিছুন পর শায়লাও এলো পাশে। সে ও জেগে রইলো। কিন্তু সে বিনিদ্র রাতের সাী হিসেবে আমরা কেউ কাউকেই রাখতে চাইলাম না।

কোথায় কোন সমুদ্দুরের অতলে হারিয়ে গেলাম আমরা কে জানে ! একজন আরেকজনকে ধরে রাখার চেষ্টা করে ব্যর্থ হ'লাম বারবার। প্রতিবারই কি এক অজানা প্রতিরোধে আলাদা হলো আমাদের মুষ্টিবদ্ধ হাত। একসময় হাল ছেড়ে দিয়ে কোন এক লুকোনো স্রোতের খাঁচায় এলিয়ে দিলাম আমরা আমাদের শরীরকে।

পরদিন কাশ থেকে ফিরে এসে বাড়ীতে পেলাম না শায়লাকে। সাধারণতঃ ওর এসময় বাইরে থাকার কথা নয়। বিছানার উপর রাখা একটা খামে ওর চিঠি পেলাম।

সুজন,
গত রাতে আমরা দু'জনেই উত্তর খুঁজে পেয়েছি আমাদের প্রশ্নের। মনে হলো দূরত্বকে ধরেই ভালো থাকবো আমরা আমাদের নিজস্ব বৃত্তে। আমাকে কাছে চেয়ে কষ্ট পেয়োনা আর। আমাকেও তা দিয়োনা। একজন আরেকজনকে তো কখনোই ভালোবাসতে পারিনি। রাতের মতোই একা ছিলাম তাই পাশাপাশি থেকেও।
আমাদের বাগানের গাছগুলো শুকিয়ে যাচ্ছে একটার পর একটা। আমরা চুপচাপ দেখেই গেলাম, করতে পারলাম না কিছুই।
ভুলে যাওয়ার চেষ্টা করো, সেকথা কি বলবো তোমাকে ? কখনোই না। আমি নিজেও সে চেষ্টা করার সাহস পাবোনা। জীবনের পাঁচটি বছর কি ভুলে থাকা যায় কখনো ?
তুমি তো যতটুকু পেরেছো দিয়েছো আমাকে। পারলে এবারও মা করো।
শায়লা

আচমকা একটা ব্যাথার চিহ্ন রেখে আমার চোখের সামনের পর্দাটা সরে গেলো হঠাৎ। চোখদুটো স্থির রেখে অনেক দূর পর্যন্ত তাকালাম জানলা পেরিয়ে। অনেক দুরে, আকাশের প্রান্তসীমার প্রায় কাছাকাছি, বাতাসের গায়ে দোল দেয়া, হেলে দুলে নাচা একটা রঙ্গীন ঘুড়ির শরীরে আটকে থাকলো আমার দৃষ্টি। জানলাটা বড় করে খুলে দিতে গিয়েও সে ঘুড়ি থেকে চোখ সরলো না আমার।

সর্বশেষ এডিট : ৩১ শে ডিসেম্বর, ১৯৬৯ সন্ধ্যা ৭:০০
৫টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

খুলনায় বসবাসরত কোন ব্লগার আছেন?

লিখেছেন ইফতেখার ভূইয়া, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৪:৩২

খুলনা প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় তথা কুয়েট-এ অধ্যয়নরত কিংবা ঐ এলাকায় বসবাসরত কোন ব্লগার কি সামুতে আছেন? একটি দরিদ্র পরিবারকে সহযোগীতার জন্য মূলত কিছু তথ্য প্রয়োজন।

পরিবারটির কর্তা ব্যক্তি পেশায় একজন ভ্যান চালক... ...বাকিটুকু পড়ুন

একমাত্র আল্লাহর ইবাদত হবে আল্লাহ, রাসূল (সা.) ও আমিরের ইতায়াতে ওলামা তরিকায়

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৬:১০



সূরাঃ ১ ফাতিহা, ৪ নং আয়াতের অনুবাদ-
৪। আমরা আপনার ইবাদত করি এবং আপনার কাছে সাহায্য চাই।

সূরাঃ ৪ নিসার ৫৯ নং আয়াতের অনুবাদ-
৫৯। হে মুমিনগণ! যদি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। মুক্তিযোদ্ধা

লিখেছেন শাহ আজিজ, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:২১



মুক্তিযুদ্ধের সঠিক তালিকা প্রণয়ন ও ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা প্রসঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেছেন, ‘দেশের প্রতিটি উপজেলা পর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধা যাচাই বাছাই কমিটি রয়েছে। তারা স্থানীয়ভাবে যাচাই... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতীয় রাজাকাররা বাংলাদেশর উৎসব গুলোকে সনাতানাইজেশনের চেষ্টা করছে কেন?

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:৪৯



সম্প্রতি প্রতিবছর ঈদ, ১লা বৈশাখ, স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস, শহীদ দিবস এলে জঙ্গি রাজাকাররা হাউকাউ করে কেন? শিরোনামে মোহাম্মদ গোফরানের একটি লেখা চোখে পড়েছে, যে পোস্টে তিনি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইরান-ইজরায়েল দ্বৈরথঃ পানি কতোদূর গড়াবে??

লিখেছেন ভুয়া মফিজ, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:২৬



সারা বিশ্বের খবরাখবর যারা রাখে, তাদের সবাই মোটামুটি জানে যে গত পহেলা এপ্রিল ইজরায়েল ইরানকে ''এপ্রিল ফুল'' দিবসের উপহার দেয়ার নিমিত্তে সিরিয়ায় অবস্থিত ইরানের কনস্যুলেট ভবনে বিমান হামলা চালায়।... ...বাকিটুকু পড়ুন

×