somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

Slum dog

২৩ শে অক্টোবর, ২০১৭ সকাল ১০:৪৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



একের পর এক বিয়ের প্রস্তাব গুলো প্রত্যাখ্যান করে চলেছে ইরা! বিদেশ থেকে পড়াশোনা করে আসা, ইন্জিনিয়ার, ব্যবসায়ী, শিল্পপতির মত বাঘা বাঘা সব পাত্রদেরকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে নিষ্কর্মা, ফকির পরিবারের Slum dog টাইপের ছেলে ফয়সালের পিছে পরে আছে সে। তার পরেও ফয়সাল টা যদি মানুষের বাচ্চা হত! দীর্ঘ একটা বছর সবকিছু ঠিকঠাক চলছিল। যে দুটো মন আর শরীরের মাঝে চুল পরিমাণ দুরত্ব ছিলনা, আজ যেন তাদের মাঝে বিস্তর ফারাক! কিচ্ছু হয়নি তাদের মাঝে। না কোন ঝগড়া, না তর্ক, নেই কোন মনোমালিন্যতাও। তাহলে কেনো? কেনো ফয়সাল দিনের পর দিন ইরাকে উপেক্ষা করছে? কেনো সে নতুন করে আবার সিগারেটে হাত দিতে শুরু করেছে? কেনইবা সম্পর্ক টা এতটাই ফিকে হয়ে গেল তার কাছে?
এসমস্ত লক্ষ কোটি চিন্তা যখন ইরার মাথায় রেললাইন তৈরী করতে শুরু করেছে, এমন সময় ফয়সালের একটা SMS এলো ইরার ফোনে।

"বাবা মার পছন্দমত বিয়ে করে নাও, আমিও জেরিন কে নিয়ে ভালো আছি! ভালো থাকবো "

জেরিন!! কে এই মেয়ে? আগে তো কখোনো নাম শুনেছে বলে মনে পরলো না! নিশ্চয়ই নতুন কোন খেলা খেলছে হারামি টা! কল করল ফয়সাল কে। ফোন বন্ধ! ক্রমশই পায়ের নিচ থেকে মাটি সরতে থাকলো ইরার! দ্রুত ফেইসবুকে ঢুকলো।
"Naem Faisal in a relationship with Jerin Khan "!!!

একটানা ১০ মিনিট অপলক চেয়ে থাকলো Status টার দিকে! পরমুহুর্তেই নিজেকে সামলে তার Wall এ বড়বড় করে লিখল সে -"আসলেই রাস্তার কুকুর সারাজীবন রাস্তার কুকুর হয়েই থাকে "
ফয়সালের প্রতি সীমাহীন ক্ষোভ আর ঘৃণা নিয়ে কল করল তার বাবা কে!
"বাবা আমি বিয়েতে রাজি! "
"আলহামদুলিল্লাহ, মা, আল্লাহ তোর মঙ্গল করুন "
.
.
.
এদিকে ফয়সাল ---
একটা প্লাস্টিকের খামের মুখ সিলগালা করে জীবনের সবথেকে বিশ্বস্ত বন্ধু বাবুর হাতে খামটা দিয়ে বলল -" আজ থেকে ঠিক দশ বছর পর এই খামটা ইরার হাতে পৌঁছে দিবি "
"কিন্তু তার আগেই যদি আমি মারা যায়? " মশকরা করে বলল বাবু!
ফয়সাল তার কন্ঠে কঠোরতা আর দৃষ্টিতে প্রখরতা এনে গর্জন দিয়ে বলল -"দশ বছরের একদিন আগেও মৃত্যু হবেনা তোর "
'আমার হায়াৎয়ের বিনিময়ে হলেও তুই বাঁচবি! বাচতে তোকে হবেই, অনেক বড় গুরু দ্বায়িত্ব তোর কাধেঁ!' বিড়বিড় করে কথাগুলো বলতে বলতে বাবুকে বুঝতে না দিয়েই শেষ বিদায় নিলো সে বাবুর কাছ থেকে!
.
.
.
১০ বছর ৩ মাস পর ----
" এ্যাই ইরা! " আজমপুর ওভার ব্রিজের নিচে কালো একটা Pajero তে ওঠার সময় পিছন থেকে ডাক দিলো বাবু।
"আরে বাবু ভাই! কেমন আছেন আপনি? After a Long Long gap! " হাস্যজ্জ্বল ইরা বাবুকে বলল।
"হ্যাঁ চিনতে পেরেছ তাহলে! "
"কেন চিনবো না বাবু ভাই? আমি কি আপনার বন্ধুর মত অকৃতজ্ঞ নাকি! "
"ফয়সালের কথা বলছ? "
"তো আর কার কথা বলব বলেন? "
"ও! হ্যাঁ ঠিক বলেছ! আসলেই অকৃতজ্ঞ, শয়তান টা! এই দেখোনা ১০ বছর আগে আমাকে এমন এক দ্বায়িত্ব দিয়ে কোথায় যে হারিয়ে গেল বদমাশ টা আর কোন খোঁজ নাই! কতো খোঁজ করেছি তোমাকে! এবার আমার দ্বায়িত্ব শেষ! আমাকে দায়মুক্ত করো ভাই "
একটু বিষ্মিত হয়ে জিজ্ঞাসা করল ইরা -"কেন কি হয়েছে বাবু ভাই? কিসের দ্বায়বদ্ধতা? "
ইরাকে সব খুলে বলল বাবু। সব শুনে ইরা বলল -"গাড়ীতে আমার বাচ্চারা আছে, আমি ওদেরকে বাসায় ড্রপ করে আপনার বাসায় আসছি খামটা নিতে "
ফুটফুটে কিউট দুইটা পুতুল পুতুল বেবি হয়েছে ইরার। ঈদের ছুটিতে কানাডা থেকে স্বামী সন্তান নিয়ে বেড়াতে এসেছে দেশে।almost happy family তাদের।
.
.
হয়তো এতবড় ত্যাগ স্বীকার করে এই সুখ টুকুই দেখতে চেয়েছিল Slum Dog ফয়সাল!!!

********************************************

২০৩৪ সাল!

চোখে মোটা ফ্রেমের চসমা তে বেশ বয়স্কা লাগছে ইরা কে। দিনরাত খাটাখাটনির ফলে চোখের নিচে কালিও পরেছে তার। তিল তিল করে গড়ে তোলা একটি "Mental Hospital " এর মালিক সে। যেখানে তার নেতৃত্বে দেশব্যাপী বিভিন্ন হাসপাতাল, ক্লিনিকে চিকিৎসারত অসহায় দুস্থ মানসিক রোগীদের বিনামূল্যে চিকিৎসা সেবা প্রদান করা হয়। দেশে বিদেশে ব্যাপক পরিচিতি লাভ করে তার Hospital. প্রথমে নিজের উদ্যোগে শুরু করলেও পরে দেশের বিভিন্ন দাতা সংস্থা, বিত্তবান ব্যাক্তিবর্গের সহোযোগীতার হাত ক্রমেই তার প্রতিষ্ঠান কে আরো জোরালো অবস্থান নিশ্চিত করে। এমনকি দেশের বাইরে থেকেও আসতে থাকে মোটা অংকের অনুদান। ফলে আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি তাকে। এভাবেই দীর্ঘ সাতটা বছর ধরে মানসিক রোগীদের সেবা করে চলেছে সে। আর খুজে চলেছে হাজারো রোগীর ভীড়ে পরিচিত একটি মাত্র মুখ!

আজ সাতটি বছর ফয়সালের চিঠিসহ খামটা স্বযত্নে রেখে দিয়েছে ইরা। বাবু'র কাছ থেকে খামটা পাওয়ার পর আর কানাডায় ফেরত যাওয়া হয়নি তার। ইরার Husbandও কানাডা ত্যাগ করে সম্পূর্ণ সহযোগিতা করছে ইরাকে। ভালোবাসাকে কত রকম ভাবে লালন করা যায়, ভাবে ইরা। তার Husband অবশ্যই ভিষণ ভালো মানুষ। ফয়সালের প্রতি ইরার ভালোবাসা কে কি চমৎকার ভাবেই না শ্রদ্ধা করেন তিনি। চিঠিটা পড়ার পর তাকেও পড়তে অনুরোধ করে ইরা। আজো সময় পেলে স্বযত্নে চিঠির ভাজ গুলো খুলে তার উপরে হাত বোলায় সে! কি ভিষণ ছটফট করেই না লিখেছে চিঠিটা! কিছু ভুল শব্দের গুচ্ছ আর অস্পষ্ট অগোছালো ভাঙা ভাঙা চিঠির ভাষা!

"ইরা,
খুব ভালোবাসি তোমাকে! খুব সপ্ন দেখি তোমাকে নিয়ে ঘর বাধার। কি হবে আল্লাহই জানে। ২২ শে জানুয়ারি ২০১৭ তারিখে আমার আব্বাজান কে কবরে ঘুম পাড়িয়ে দিয়াশলাম। তুমিতো জানো আমার আব্বা আমার কাছে কি! তারপর থেকে মাথার মধ্যে ওলোট পালোট হয়ে যাচ্ছে ইরা। কাউকে কিছু বলতে পারছিনা। আমি পাগল হয়ে যাচ্ছি! আসলেই তাই হচ্ছে! অনেক কিছু ভুলে যাচ্ছি। কিছুতেই মনে করতে পারছিনা কিভাবে আমাদের পরিচয়, প্রথম কবে আমাদের দেখা হয়, কিভাবে তোমাকে প্রপোজ করলাম,আমাদের নৌকা বিলাস ছিলো কথায়! হাতিরঝিলে নাকি ধানমন্ডি লেক! ইত্যাদি খুটিনাটি অনেক কিছুই মনেকরার চেষ্টা করছি কিন্তু কিছুতেই পারছি না! এমনকি তোমার চোখ দুটোও ঝাপসা লাগছে, মাঝে মাঝেই ভুলে যাচ্ছি তোমার অবয়ব। এমনটা কি হওয়ার কথা বলো? বলোনা ইরা, এমনটা কি হওয়ার কথা?? আমার ইরার সৃতিগুলো গুলো ভুলে যাবো এমনটা কি আদৌ হওয়ার কথা?? শুধু তুমি নও! মাঝে মাঝে তো আমার এটাও মনে পরেনা আমার নাম কি? আমরা কভাই বোন? হাহাহা! শুধু আব্বা কে দেখি চোখের সামনে। স্বপ্নে দেখি আব্বা আমাকে তার কবরের কাছে ডাকে। আমি সত্যি পাগল হয়ে যাচ্ছি ইরা! আমাকে ক্ষমা করে দিও। এই চিঠি যখন তুমি পড়ছো তখন হয়ত আমার সৃতি তোমার কাছে অনেকটাই ঝাপসা হয়ে গেছে! আর তোমার সৃতি আমার কাছে নেই হয়ে গেছে। জানি আমার এই অসহায়ত্ব দেখলে তুমি সহ্য করতে পারবে না, আমার সাথে সাথে তুমিও পাগল হয়ে যাবা, তোমার জীবনো নস্ট হয়ে যাবে। কোনো ভাবেই আমি তা হতে দিতে পারিনা! কোন ভাবেই না! রাস্তার কুকুর কে যেমন আমরা ঘৃণা করি, তেমনি আমার প্রতি তুমি ঘৃনা আনতে না পারলে তুমিও বাচতে পারবা না, ভুলতে পারবা না আমাকে। তাই ১০ বছরের জন্য তোমার কাছে Slum Dog হয়েই বেচে থাকবো! কিন্তু ১০ বছর পর যখন এই চিঠি পড়বা তখন কিন্তু আর আমাকে Slum Dog বা রাস্তার কুকুর বলতে পারবা না। মনে রেখ তুমি ছাড়া আর কেউ ছিলোনা আমার জীবনে। বৃথাই খুজোনা কোথাও আমাকে, আমি নেই কোথাও!
ইতি
ফয়সাল। ৩০/০১/১৭"

চিঠির নিচে আবার বিশেষ দ্রষ্টব্যও আছে!! কলমের কালি এখানে কিছুটা ঝাপসা! কালি ফুরিয়ে এসেছে বোধহয়। ফার্ষ্ট ব্রাকেড এর ভিতরে এক লাইনে লেখা "আব্বার কবরে বসে যখন তোমার কথা ভাবি তখন আব্বা আমার কানে কানে বলে -একদিনের জন্য হলেও নাকি আমি আমার ইরা কে পাবো!! তবে সেই পাওয়া হবে সুন্দর, পবিত্র, নিস্কলঙ্ক! "

হুহু করে কেঁদে ফেললো ইরা! কোনবারই চিঠিটা হাতে নিয়ে কান্না আটকাতে পারেনি সে! আজও পারলোনা।
একটা বার আমাকে সুযোগ দিয়ে দেখতে পারতো Slum dog টা!! একটা বার!! প্রচন্ড শব্দে বাজ আর বৃষ্টির রূপ ধরে ইরার আক্ষেপ গুলো যেনো ঝরে পরলো আকাশ থেকে!

ইদানিং ইরাও অনেক কিছু মনে করতে পারেনা। কেউ কিছু বললে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে! তার ফোনে রিং হচ্ছে। সেভ করা নম্বর! নাম দেখেও মনে করতে পারছে না কে কল দিচ্ছে! বুঝতে পারে তারো মাথায় কোন সমস্যা দেখা দিচ্ছে। তারপরেও ইচ্ছা করেই রোগ টাকে প্রশ্রয় দিচ্ছে সে!
"হ্যালো, আস্সালামু-আলাইকুম "
"ইরা কেমন আছো? "
"সরি কে বলছেন প্লিজ? "
"আমি বাবু ভাই! চিনতে পারছো না? "
"কিছু মনে করবেন না আমি আসলে মনে করতে পারছি না "
"হা হা - তুমিও দেখি ফয়সালের মত অকৃতজ্ঞ হয়ে যাচ্ছো! "
অবশেষে মনেপরল এবং লজ্জিত হয়ে বলল ইরা-
"সরি বাবু ভাই, খুব কাজের চাপ তাই "!
"থাক থাক সরি বলতে হবেনা" ইরা কে থামিয়ে দিয়ে বলল বাবু, "একটা জরুরি কথা বলার জন্য ফোন দিলাম "
"জী বলেন বাবু ভাই "
"আজ সকালে ফয়সালের খোঁজ পেয়েছি, বাকিটা তোমার অফিসে এসে বলব, তুমি কখন ফ্রি আছো? "
!
!
!
!
হাত থেকে ফোনটা পরে গেলো ইরার!ওপাশ থেকে খুব মৃদু স্বরে ভেসে এলো -
"হ্যালো ....হ্যালো .... ইরা শুনতে পাচ্ছো? ...... হ্যালো ......!"

-------------------------------------------

২০৫৭ সাল!

ডক্টর সাব্বির রহমান এর চেম্বারে Waiting room এ বসে আছে ইরা। দৃষ্টি স্থির। সাদা শাড়ি নীল পাড়ে বেশ মানিয়েছে ইরা কে। কপাল, গাল, হাতের চামড়ায় ভাজ পরায় চেহারার সেই জৌলুস বিলিন হয়ে গেলেও আপন আলোয় আজো উজ্জ্বল সে। জীবনের উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া সমস্ত ঝড় তুফানকে উপেক্ষা করে বেচেঁ থাকার প্রাকৃতিক লড়াই লড়ে চলেছে 62 বছরের বৃদ্ধা ইরা। স্বামী গত হয়েছে আরোও বছর পাঁচেক আগে! শুধুমাত্র হাতের খামটা ছাড়া আর কিচ্ছু স্বরনে নেই তার। যদিও কার খাম, কিসের চিঠি কিভাবে এলো তার কাছে কিছুই মনে নেই তার! আছে শুধু খাম আর চিঠিটার প্রতি অসম্ভব আগ্রহ।একে একে সব সৃতিগুলো তাকে বিদায় জানালেও হলুদ খামটা আর তার গর্ভের ৩০ বছরের ভারে মলিন, নুয়ে পরা কিন্তু অক্ষত চিঠিটা আজো তাকে আকড়ে ধরে আছে অক্টোপাসের মতো! অবাক হয়ে আজো পড়ে সে চিঠিটা, আর মনে মনে আপ্রাণ চেষ্টা করে চিঠির লেখক ফয়সাল কে স্বরন করার। কিন্তু কিছুতেই মনে করতে পারেনা! আবছা একটা মুখ চোখের সামনে এসেও মিলিয়ে যায়! কি সুখেই না আপন মনে হেসে ওঠে তখন সে। এই সুখ টুকুর জন্যই হয়তো আজো তার মস্তিষ্ক অক্সিজেন গ্রহণ করছে!

"আমি আপনাকে Recommend করবো আপনার মা কে আমার অভয়ারণ্যে Admit করুন। After all দিন গুলো অনেক ভালো যাবে তার।"
ইরার ছেলেকে পরামর্শ দিলেন ডক্টর সাব্বির রহমান। দেশের সুনামধন্য হাতে গোনা কয়েকজন বড় সাইক্রেটিস এর তালিকায় ডক্টর সাব্বির রহমান একজন। তার নিজস্ব একটি চিকৎসালয় আছে সুধুমাত্র মানসিক রোগীদের জন্য। একটু ব্যায়বহুল হলেও চমৎকার পরিবেশ। রোগীদের ২৪ ঘন্টা আলাদা আলাদা কেয়ার নেয়া হয়। দুইটা সেক্টর, একদিকে পুরুষ ও অন্যদিকে মহিলা! তার সামনে বেশ বড় একটি জায়গা জুড়ে ফুল বাগান, আম গাছ, নারকেল গাছ, কামরাঙা গাছ সহ পাখিদের কোলাহলে মুখোর সব সময়। দিনের পুরোটা সময় পুরুষ, নারী উভয় রোগীরাই সানন্দেই কাটিয়ে দেয় বাগান টিতে। চমৎকার সুন্দর একটা ময়ুর পরিবেশটাকে দান করেছে সৌন্দর্যের নতুন মাত্রা। শহর থেকে বেশ দুরে ও উচু প্রাচীর দিয়ে ঘেরা থাকায় সম্পূর্ণ নিরিবিলি একটি অভয়ারণ্য বটে!

"কবে Admit করালে ভালো হয় ডক্টর সাহেব? " বলল ইরার বড় ছেলে।
"উনার যে অবস্থা দেখলাম তাতে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব নিয়ে আসুন উনাকে "
"আজ বিকালেই আসছি আমি " বলে ডক্টর কে ধন্যবাদ জানিয়ে বিদায় নিলো ওরা।

ফেরা যাক ২০৩৪ সালে -

সেদিন ইরার হাত থেকে ফোনটা পরে যাওয়ার শব্দে এবং ইরার কোন সাড়া না পেয়ে, মনে খটকা লাগায় ছুটে আসে বাবু ইরার অফিসে। অফিসে এসে জানতে পারে ততক্ষণেই ইরা কে ধানমন্ডি ল্যাবএইডে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।
জ্ঞান ফেরেনি এখোনো! ডক্টর বললেন "এটা মিনি স্ট্রোক! জ্ঞান ফেরা পর্যন্ত আমাদের অপেক্ষা করতে হবে,"
বলতে না বলতেই একজন নার্স ছুটে এসে জানালো জ্ঞান ফিরেছে ইরার। ততক্ষণে বাবুও পৌছে গেছে হসপিটালে। ইরার বেড এর পাশে দুইটা চেয়ারে বসে আছে বাবু এবং ইরার Husband.
"বাবু ভাই, ফয়সাল সত্যিই বেচেঁ আছে? কোথায় আছে? কেমন ..." ইরা কে থামিয়ে দিলো বাবু।
"শান্ত হও। ফয়সাল বেচেঁ আছে এবং ভালো আছে। তুমি সুস্থ হওয়া মাত্রই নিয়ে যাবো তোমাকে ওর কাছে। "
"মিথ্যা বলছেন বাবু ভাই!! ও ভালো নেই .... ও ভালো নেই ..." বলেই ঘর ফাটিয়ে কেঁদে উঠল ইরা।

তার ৩ দিন পর ঢাকা থেকে -বাবু, ইরা এবং তার স্বামী (অমুক) রওনা দিলো ঝিনাইদহ কেন্দ্রীয় কবরস্থানকে লক্ষ্য করে। প্রায় ৫ ঘন্টার এই যাত্রাপথে একটা কথাও বলেনি ইরা! বিকাল পৌনে ৪টার দিকে পৌছালো তারা। ক্রমেই যেন অবশ হয়ে যেতে থাকলো ইরার সমস্ত শরীর! গাড়ি থেকে নামার ক্ষমতাটাও যেন আর নেই তার! (অমুক) সাহেব শক্ত করে ইরা কে ধরে গাড়ি থেকে নামালেন।
প্রায় ৬ বিঘা জমি নিয়ে গঠিত গোরস্তানটা শত শত গাছ, বাশ ঝাড় আর জঙ্গলে পরিপূর্ণ। গোরোস্থানের সব স্থানে পৌছানোর জন্য রয়েছে দুই হাত চওড়া লম্বা রাস্তা। প্রায় ৩০-৪০ কদম হাঁটার পর বাবু আঙ্গুল উচিয়ে ভাঙা চাটাই দিয়ে ঘেরা পুরোনো একটা কবর কে ইঙ্গিত করলো। ওদের দুজনকে পিছনে ফেলে যন্ত্রের মত সেদিকে হাটা শুরু করলো ইরা!

একটা ঘুমন্ত কুকুরের পেটের উপর গুটিশুটি মেরে ঘুমিয়ে আছে ফয়সাল! খালি গায়ে, ছেড়া একটা লুঙ্গি পরা সে। যৌবন ভরা টগবগে সেই সুঠাম শরীরের একি হাল!! মুখটার দিকে তাকানোর মত অবস্থা নেই! চুল, দারিতে ভরা অপ্রকৃতস্থ মুখটা নিষ্পাপ আলোয় জ্বলজ্বল করছে।
শরীরটাকে আর ধরে রাখতে পারলো না ইরা। হাটু গেড়ে ধপাস করে বসে পরল ফয়সালের পাশে। মাথাটা একটু কাত করে করুন দৃষ্টিতে অপলক তাকিয়ে আছে মুখটার দিকে। বিড়বিড় করে কি যেনো বলতে লাগল। ফয়সালের ধুলোয় ভরা মাথায় পরম যত্নে হাত বুলিয়ে দিলো! হঠাৎ কি যেন হলো তার! আচমকা খিলখিলিয়ে হেসে উঠলো!!! অট্টহাসিতে ফেঁটে উঠলো পুরো গোরোস্থান! বাবু আর ইরার স্বামী হকচকিয়ে গেলো! দ্রুতগতিতে ইরা কে সেখান থেকে টেনেহিঁচড়ে তুলতে চেষ্টা করল ওরা দুজন। প্রচন্ড শক্তিতে বল প্রয়োগ করতে থাকলো ইরাও। টানতে টানতে তাকে গোরস্তানের দরজার কাছে নেয়ার চেষ্টা করছে তারা! হিংস্র হয়ে উঠলো ইরা! রাগের চটে হিসহিস করছে সে ! রক্ত চক্ষু নিয়ে প্রচন্ড ক্ষোভ প্রকাশ করল সে! গলা ফাটিয়ে ফয়সালের দিকে আঙ্গুল তুলে বলল - "আসলেই তুই একটা Slum dog !!! ভিরু, কাপুরুষ!! কেনো একবার সুযোগ দিলিনা তুই আমাকে??? বল? কেনো দিলিনা?? কি অপরাধ করেছিলাম তোর কাছে?? তুই ভেবেছিস তুই মুক্তি পেয়েগেছিস??,,তোর মুক্তি নেই!! আমার হাত থেকে তোর মুক্তি নেই!! মরে গিয়ে হলেও আমাকে জবাবদিহি করতে হবে তোকে!! "

এসবের কিছুই যেনো ঢুকলো না ফয়সালের কানে! বরং আগের মতোই একই ভঙ্গিতে পরে পরে ঘুমুচ্ছে! কিছু মাছি কুকুরটার নাকের কাছে ভনভন করায় নড়ে নড়ে উঠেছে কুকুরটা! সাথে সাথে নড়ছে ফয়সালের শরীরটাও !

********************************************

পরিশিষ্টঃ ফয়সাল আর ইরা এখন এক সাথেই থাকে! ফয়সাল ৭০ আর ইরা ৬২। নিয়তির নিষ্ঠুর সিদ্ধান্তে ইরা আর ফয়সাল তাদের জীবনের সবটুকু হারিয়ে ডক্টর সাব্বির রহমানের চিকিৎসা কেন্দ্রে চিকিৎসাধীন। সেদিন বাবু ফয়সাল কেও এখানেই ভর্তি করিয়ে দেয়।
ডক্টরের চেম্বার থেকে বেরিয়ে দুপুর নাগাদ ইরা কেও সেখানে Admit করে তার ছেলে। প্রথম দিকে ইরা একদিকে আর ফয়সাল অন্যদিকে বসে থাকতো বাগানটার। ধিরে ধিরে একে অপরের সান্নিধ্যে আসে। আবারো নতুন করে পরিচিত হয় একে অপরের সাথে। কিন্তু এতটুকু অতীতের স্মতি আর অবশিষ্ট নেই তাদের নিউরনে! ইরার মুখে কিছু কিছু দাঁত থাকলেও ফয়সালের মুখে একটিও নেই।
প্রকৃতি বোধহয় সর্ব কালেই পবিএতাকে এক করেছে। কখনো শুরুতে বা কখনো শেষে। প্রকৃতি, সত্য আর পবিএতার সাথে অন্যায় করেনি। প্রকৃতি পবিএতার প্রতিষ্ঠা করেছে।

আজ ইরা আর ফয়সাল পুতুল বিয়ে দিবে। বর পুতুলের নাম টুনা, আর কনে পুতুলের নাম টুনি!
ইরার শাড়ির আঁচলে বাধা আছে সেই খাম আর চিঠিটা! দুজনার কেউ জানেনা কার চিঠি কিসের চিঠি!!!
বাবু দূর থেকে ওদের কর্মকাণ্ড দেখে মনে মনে ভাবলো "সত্যিই তো! কি পবিত্র আর নিস্কলঙ্ক সংসার ওদের "!!! চোখ মুছতে মুছতে চলে গেলো বাবু! ৬৮ বছর বয়স বাবুর এখন। এখন তার অবসর সময়। ফয়সাল আর ইরার প্রেম কাহীনির একমাত্র রাজ সাক্ষী সে। তার মরে যাওয়ার পর এই দুনিয়া কোনদিনও জানতে পারবে না এই কালজয়ী ঘটনার কথা!

"আসেপাশের কোন এক stationary তে যাও "
ড্রাইভার কে বলল বাবু। সেখান থেকে একটা দামী ডায়েরী কিনলো সে। বাসায় পৌঁছে নিরিবিলি হয়ে আরাম করে বসল ডায়েরীটা নিয়ে। লেখা শুরু করল প্রথম পাতায়। গল্পের নাম দিল "Slum Dog"!!!

(সমাপ্ত)
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে অক্টোবর, ২০১৭ সকাল ১০:৫৬
২টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

বাংলাদেশের লোকসংস্কৃতিঃ ব্যাঙের বিয়েতে নামবে বৃষ্টি ...

লিখেছেন অপু তানভীর, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:০০



অনেক দিন আগে একটা গল্প পড়েছিলাম। গল্পটা ছিল অনেক এই রকম যে চারিদিকে প্রচন্ড গরম। বৃষ্টির নাম নিশানা নেই। ফসলের মাঠ পানি নেই খাল বিল শুকিয়ে যাচ্ছে। এমন... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাংলাদেশি ভাবনা ও একটা সত্য ঘটনা

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১০:১৭


আমার জীবনের একাংশ জুড়ে আছে; আমি চলচ্চিত্রাভিনেতা। বাংলাদেশেই প্রায় ৩০০-র মত ছবিতে অভিনয় করেছি। আমি খুব বেছে বেছে ভাল গল্পের ভাল ছবিতে কাজ করার চেষ্টা করতাম। বাংলাদেশের প্রায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাকি চাহিয়া লজ্জা দিবেন না ********************

লিখেছেন মোহাম্মদ সাজ্জাদ হোসেন, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১০:৩৫

যখন প্রথম পড়তে শিখেছি তখন যেখানেই কোন লেখা পেতাম পড়ার চেষ্টা করতাম। সেই সময় দোকানে কোন কিছু কিনতে গেলে সেই দোকানের লেখাগুলো মনোযোগ দিয়ে পড়তাম। সচরাচর দোকানে যে তিনটি বাক্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

=এই গরমে সবুজে রাখুন চোখ=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:২১

০১।



চোখ তোমার জ্বলে যায় রোদের আগুনে?
তুমি চোখ রাখো সবুজে এবেলা
আমায় নিয়ে ঘুরে আসো সবুজ অরণ্যে, সবুজ মাঠে;
না বলো না আজ, ফিরিয়ো না মুখ উল্টো।
====================================
এই গরমে একটু সবুজ ছবি দেয়ার চেষ্টা... ...বাকিটুকু পড়ুন

কুড়ি শব্দের গল্প

লিখেছেন করুণাধারা, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:১৭



জলে ভাসা পদ্ম আমি
কোরা বাংলায় ঘোষণা দিলাম, "বিদায় সামু" !
কিন্তু সামু সিগারেটের নেশার মতো, ছাড়া যায় না! আমি কি সত্যি যাবো? নো... নেভার!

সানমুন
চিলেকোঠার জানালায় পূর্ণিমার চাঁদ। ঘুমন্ত... ...বাকিটুকু পড়ুন

×