রাস্তা দিয়ে হাটতে হাটতে একটা মসজিদের বারান্দায় ঝোলানো ঘড়িতে দেখলাম 9:44 am. গ্রামের মসজিদ, তাই সংস্কারের অভাবে মসজিদের নাম এবং এলাকার নাম ঝাপসা হয়ে যাওয়ায় নিজের বর্তমান অবস্থান ঠিক করতে পারলাম না। তবে অনুমান করছি একটানা হাঁটতে হাঁটতে ছায়াদের বাড়ি থেকে ১০ কিমিঃ মত দূরে অবস্থান করছি। কোথায় যাব তাও এখনো ঠিক করিনি। তবে ক্ষুধার জ্বালায় পেটের ছুঁচো গুলো আমাকে শান্তিতে থাকতে দেবেনা বলে ঠিক করেছে। মসজিদের পাশেই একটা কাজী অফিস দেখতে পেলাম, নাম - “হাজী কাজী অফিস”। কাজী অফিসের পাশেই একটা ছোট হোটেল নাম - “আল্লার দান ভাতের হোটেল”। হোটেলের সামনেই ক্যাশ টেবিলে বসে বসে চোখমুখ বুজে কানের মধ্যে ম্যাসের কাটি ঢুকিয়ে জীভ বের করে বিচ্ছিরি ভঙ্গিতে ঘুরাচ্ছেন আর অমৃত সুখ নিচ্ছেন হোটেলের মালিক।
কোথায় পেলেন তিনি আল্লাহ্কে আর এত থুয়ে “ভাতের হোটেল”ইবা কেন দান হিসেবে পেলেন তা জানার জন্য এগিয়ে গেলাম হোটেল মালিকের দিকে। আমাকে আসতে দেখে মালিক সাহেব তার কর্মচারীকে লম্বা একটা হাক পেরে বললেন -
“কই রে ঝন্টু, সাহেব কি খাইবো দ্যাখ”
যদিও আমার পোশাক আশাক মোটেও সাহেবদের মত নয় এবং আমি খাওয়ার জন্যই যে হোটেলে ঢুকেছি সেটাই বা কেন মনে করল জানিনা। আমি একটা টেবিলে গিয়ে বসতেই ঝন্টু নামের ছেলেটা এক প্লেট খিচুড়ি ভাত আর এক বাটি মুরগির মাংস এনে রাখলো আমার সামনে। লোভ সামলাতে পারলাম না। ভাতের প্লেটটা হাতে নিয়ে মাংসের বাটিটা ফিরিয়ে দিয়ে বললাম -
“আমি মরা মুরগির মাংস খাইনা”!!
বলে কাচামরিচ দিয়ে গপগপ করে শুধু খিচুড়ি ভাত খাওয়া শুরু করলাম। আড়চোখে খেয়াল করলাম ঝন্টু নামের ছেলেটা তার মালিকের দিকে তাকিয়ে আছে। মালিক সাহেব কান চুলকানো বাদ দিয়ে ঝন্টু কে ঈশারা করে মাংসের বাটি সরিয়ে ফেলতে বললেন। তারপর হাত চুলকাতে চুলকাতে আমার পাশের ফাকা জায়গায় এসে বসেই আচমকা বলা শুরু করলেন -
“স্যার, ভুল হইয়া গেছে …এই বারের মত মাফ কইরা দ্যান... আর কুনুদিন এইরাম কাম হইবো না স্যার .. আল্লাহর কসম কইরা কইতাছি স্যার … গরীব মানুষ! একটু বেশি লাভের আশায় ভুল কইরা ফালাইছি স্যার … আমারে মাফ কইরা দ্যান স্যার”
বলেই আমার পা ধরে নকল কান্না শুরু করে দিলেন। বুঝলাম তিনি আমাকে ছদ্মবেশী গোয়েন্দা বা পুলিশ প্রশাসনের কেউ ভেবে ভয় পেয়েছেন। আমি কোন প্রতিক্রিয়া না দেখিয়ে ভাতের সাথে কাচামরিচ চিবিয়ে যাচ্ছি। খুব ক্ষিধে পেয়েছিল। ছায়ার হাতের সেই আড়াই প্লেট ভাত অনেক আগেই হজম হয়ে গিয়েছে। পুরো এক প্লেট ভাত শেষ করে আঙ্গুল চাটতে চাটতে ঝন্টু কে ডাক দিয়ে বললাম -
“কই রে ঝন্টু, আরেক প্লেট ভাত দে”
ঝন্টু পিছনে লুকিয়ে লুকিয়ে তার মালিকের নাকে কান্না দেখছিল। আমি ভাত চাইতেই মালিক সাহেব ঝন্টুর দিকে খেঁকিয়ে উঠলেন -
“ওই হারামজাদা!! কি করস?? দ্যাখতাছোছ না স্যারে ভাত চাইছে?? জলদি একটা ডিম ভাইজ্জা লইয়া আয়।”
বলেই আবার আমার পা ধরে কাঁন্নায় মোনযোগ দিলেন। অনেকটা পড়া মুখস্ত করার জন্য ছাত্র-ছাত্রীরা যেভাবে ঝুকে ঝুকে বা দোল খেতে খেতে পড়ে অনেকটা সেরকম -
“স্যার গো .. আমার ছোট ছোট দুইটা মাছুম বাচ্চা আছে গো স্যার, আমার কিছু হইলে ওরা না খাইয়া মইরা যাইবো গো স্যার”
ঝন্টু চটজলদি আরেক প্লেট ভাত দিয়ে গেল। আমি আবারো খাওয়া শুরু করলাম। এবং খেতে খেতেই বললাম -
“আপনার দুই মেয়ে আর এক ছেলে। দুই মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন দুই জামাইকে মোটা অংকের যৌতুকসহ!! আর ছেলে এবার কলেজে উঠেছে এবং দামি মটরসাইকেলে চরে কলেজে যাওয়া আসা করে! সুতারং আপনি মরলেও মা, আর ছেলের খুব বেশি সমস্যা হবে বলে আমার মনেহয় না !! বরং দুনিয়া থেকে একটা খুনি কমবে। যে কিনা অস্বাস্থ্যকর খাবার দিয়ে প্রতিনিয়ত খুন করে চলেছে সাধারণ মানুষ কে”
হোটেল মালিক এবার আমার কথায় আকাশ থেকে পরলেন এবং হাসফাঁস করতে করতে আমার দুই পা জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাদতেঁ কাদতেঁ বললেন -
“ও স্যার গো স্যার… আপনি দেহি সব খোঁজ নিয়াই ঢুকেছেন গো স্যার … কত টাকা নিবেন গো স্যার??”
বলেই কান্না থামিয়ে চোখ বড়বড় করে জীভে কামড় মারলেন!! বুঝলেন টাকার কথাটা জোরে বলা উচিৎ হয়নি। ঝটফট করে উঠে দাঁড়ালেন তিনি, তারপর এক দৌড়ে ক্যাশ ড্রয়ার থেকে ঘুরে এসে আমার বাম হাতের মধ্যে কিছু টাকা গুঁজে দিয়ে ফিসফিস করে বললেন -
“এখানে পাঁচ হাজার আছে স্যার। লাগলে পরে আবার দিমুনে”
আমি খাবার শেষ করে হাত ধুতেই ঝন্টু গামছার মত মোটা টিস্যু হাতে নিয়ে দাড়িয়ে রইলো আমার সামনে। টিস্যু দিয়ে হাত মুখ মুছতে মুছতে খেয়াল করলাম ২৯-৩০ বছরের একটি যুবক ছেলে ইয়া বড়বড় চুল আর দাড়ি সহকারে সারা শরীরে ধুলো মেখে বিধ্বস্ত অবস্থায় হোটেলে প্রবেশ করল এবং চিৎকার করে বলল -
“ওই ঝন্টু আমার ভাত দে।”
খেয়াল করলাম ছেলেটি অপ্রকৃতস্থের মত ঘোঁতঘোঁত আওয়াজ করছে আর এদিক ওদিকে তাকাচ্ছে ছটফট ভঙ্গিতে।
“সিরাজ তুই আবার আইছস??”
বলে হোটেলের মালিক একটা বড় লাঠি নিয়ে ছেলেটিকে তাড়া করলেন এবং হোটেল থেকে বের করে দিলেন। বিরাট কোন মহান কাজ উদ্ধার করে এসেছেন এমন ভঙ্গিতে খানিক বাদে তিনি ফিরে এসে বললেন -
“পোলাডা পাগল, স্যার। অল্প বয়সে ছ্যাঁক খাইয়া রোজ ওই কাজি অফিসের সামনে আইসা বইয়া থাকে আর আমারে জ্বালাইতে আসে। তই মেলা বড়লোকের পোলা। ওর বাপের লগে এমপি মন্ত্রীগো ওঠাবসা আছে। কিন্তু পোলারে কন্ট্রোল করবার পারেনা। রোজ আইসা ওই একই জায়গায় বইয়া থাকবো।”
আমি বললাম -
“হুম”
তারপর ওই পাঁচ হাজার টাকা ওনার হাতে ফিরিয়ে দিতে দিতে বললাম -
“মরা মুরগি মানুষকে খাইয়ে কত টাকা লাভ করেছেন জীবনে? এক কোটি? দুই কোটি?? কেন মরার আগেই অন্তর টাকে মেরে ফেলছেন? আপনার অন্তর তো জানে কতবড় পাপ আপনি করেছেন জীবনে!! সেই অন্তরের আর্তনাদ কি শুনতে পাননা গভীর রাতে?? অনুশোচনার আগুন কি পোড়ায় না স্বপ্নের ভেতর?? যে অর্থের জন্য এত পাপ, সেই অর্থ কি পারবে আপনাকে মুক্তি দিতে?”
বলে বের হয়ে পরলাম হোটেল থেকে। হোটেল মালিক টাকা হাতে দাড়িয়ে রইলেন। মানুষ ঠকানো ওই পাপের টাকা আর কিছুক্ষণ আমার হাতে থাকলে হাতটা বোধহয় পুরেই যেত!! সৎপথের উপার্জিত টাকার শান্তি যে কতটা সুখের তা কে বোঝাবে এই অর্থলোভী মূর্খ মানুষ গুলোকে। তবে বিনা পয়সায় একটা হোটেল থেকে ভাত খাওয়াটাও তো খুব পুন্যের কাজ নয়!! তবুও এইটুকু পাপ করলাম!! জেনে বুঝেই করলাম!! আমি তো আর মহা মানব নই যে, পাপ করবোনা!! তাছাড়া পাপ না থাকলে পুন্যের কোন মূল্য ছিলনা। ঠিক যেমনি কালো ছাড়া আলো মূল্যহীন।
হোটেল থেকে বের হতেই দেখলাম বেচারি সিরাজ নামের ছেলেটা কাজী অফিসের পাশে একটা নারকেল গাছের গোড়ায় গুটিসুটি মেরে বসে আছে। আমি ওর কাছে গিয়ে পাশে বসলাম। কিছুক্ষণ বসে থাকার পর বললাম-
“কেমন আছো সিরাজ?”
সিরাজ আমার দিকে না তাকিয়েই দুলতে দুলতে বলল-
“ভালো না। আমার রূপাকে দেখেছেন?”
“রূপা কে?”
প্রশ্নটা করে যেন আমি বিশাল বড় অন্যায় করে ফেলেছি এমন ভঙ্গিতে আমার দিকে তাকিয়ে বলল-
“রূপাকে চিনেন না?? রূপা আমার বউ… আমার বউ…”
“ওহ… তুমি বিয়েও করে ফেলেছো?”
সে আবার আগের মত অন্যদিকে তাকিয়ে দুলতে দুলতে বলল-
“না। এখনো করি নাই। তবে আজ করবো। আজ ওর আসার কথা। সেজন্যই এখানে বসে আছি।”
আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে অপ্রকৃতস্ত সিরাজেকে আপাদমস্তক পর্যবেক্ষণ করলাম। আমার তৃতীয় দৃষ্টি দিয়ে দেখলাম ওর বুক পকেটে তিন হাজার পাঁচশত টাকা ভাজ করে রাখা অতি যত্নে। এতগুলো বছর এই টাকাটা ওভাবেই তার পকেটে সংরক্ষিত আছে। যেটা ছিল তার বিয়ের খরচ।
আজ থেকে প্রাই বছর দশেক আগের কথা। সিরাজ তখন কুড়ি বছরের এক অদম্য যৌবন ও আকর্ষণীয় চেহারার অধিকারী। তাদের প্রেমের গল্পটাও একটু অদ্ভত ও মজার। হটাৎ করেই রূপা নামের একটি মেয়ের সাথে তার ফোনে পরিচয় হয় রং নাম্বারের মাধ্যমে। বয়স কম রক্ত গরম। তার উপর আবার রূপার মিষ্টি কণ্ঠে পাগল হয়ে সিরাজ তার বাপের পকেট কেটে সয়লাব করে দেয় মোবাইল ফোনের পিছনে। যদিও বর্তমান জামানায় সস্তা প্রেমের এই “প্রক্রিয়াটি” নিজেকে আপগ্রেড করে “ফেইসবুক” নামক চাহারায় আবির্ভূত হয়েছে। যেখানে রোজ লাখ লাখ প্রেম হয় আর কোটি কোটি প্রেম ভাঙ্গে!!
প্রাই ১ বছর রূপা নামের মেয়েটার “কণ্ঠ প্রেমে” পাগল হয়ে একদিন সেই সুরেলা কণ্ঠের মালিকিনি কে নিজের চোখে দেখতে চাওয়ার প্রস্তাব করে বসে সিরাজ। তাতে রূপা বিচলিত না হয়ে সিরাজকে একটা শর্ত দিয়ে বসে। শর্ত হল- রূপা যেদিন তার সাথে দেখা করতে আসবে সেদিনই তাকে বিয়ে করতে হবে!!
এ ধরনের শর্তে সিরাজ পিছিয়ে যেতে পারে এমন ধারণাকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে এক কথায় রাজি হয়ে যায় সিরাজ !! ব্যস… !!! তারপর দিনক্ষণ ঠিক করা হল কবে এবং কোন কাজি অফিসে তাদের বিয়ে হবে। সেই মোতাবেক বিয়ের খরচ বাবদ সাড়ে তিন হাজার টাকা নিয়ে ওই কাজি অফিসের সামনে অপেক্ষা করতে থাকে সিরাজ… অপেক্ষা করতে থাকে… আজো অপেক্ষা করছে… রোজ অপেক্ষা করে … রোজ তার রূপা আসবে... তাকে বিয়ে করতে আসবে…
চলবে…
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে ডিসেম্বর, ২০১৭ সন্ধ্যা ৬:২৭