somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

দানবাক্স

৩১ শে মে, ২০১৮ সন্ধ্যা ৭:৩৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


সাধারনত প্রচন্ড হাড় কাপানো শীতের কুয়াশা খুব বেশি ঘন হয়না। কুয়াশা যত বেশি ঘন হবে শীতের মাত্রাও ততই কম হবে। এটা হল সাধারণ জ্ঞান। কিন্তু কিছু কিছু সময় সাধারণ জ্ঞান কে ভুল প্রমাণিত করার জন্য আমাদের জীবনে অসাধারণ কিছু ঘটনা ঘটে থাকে। আর সেই ঘটনা গুলোকে কেন্দ্র করে তৈরী হতে থাকে গ্রাম্য আষাঢ়ে গল্প, রম্য রচনা, কৌতুক ইত্যাদি ইত্যাদি।

একদম মেঠো অজপাড়া গাঁয়ের একটি ছোট টিনের ছাবরা দিয়ে ঘেরা মসজিদের ঈমাম জনাব লিয়াকত হোসেন। আবার ঈমাম বলে যে বুড়ো মানুষ হবে তা কিন্তু নয়! বরং খুব বেশি হলেও ২৮ থেকে ৩০ বছরের মধ্যেই হবে তার বয়স। সবেমাত্র মাদ্রাসা থেকে পাশ করে ঈমামতি শুরু করেছেন তিনি। মুখে সুন্নতি দাড়ি, খাড়া নাক আর জোড়া ভুরুর জন্য চেহারার ভিতরে একটা মায়াবী ভাব ফুটে উঠতো। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আর সৎ সুন্দর ব্যবহারের জন্য কেমন যেন একটা নূরাণী ভাব ছিলো তার চোখেমুখে। তিন বেলা পেটে ভাতে আর মাস গেলে তার হাতে নামমাত্র কিছু সম্মানী দিয়ে মসজিদের পাশেই কোনার দিকে একটা ছোট্ট ঘর করে তার থাকার ব্যবস্থা করে দেয় মসজিদ কমিটি। এবং ক্রমানুসারে গ্রামের বিভিন্ন বাড়ি থেকে ঈমাম সাহেবের জন্য তিন বেলা খাবার চলে আসতো ঠিক সময় মত।

তিনকুলে আপন বলতে কেউ না থাকায় খুব ছোট বেলায় লিয়াকত হোসেনকে কোন এক এতিমখানায় রেখে আসে তার দূর সম্পর্কের এক চাচা। আর সেখান থেকেই টেনেটুনে পড়াশোনা শেষ করে এখন তিনি এই গ্রামের ঈমান।

ঘটনার দিন ছিল শুক্রবার। যেমন হাড় কাপানো শীত তেমন ঘন কুয়াশা। লিয়াকত হোসেন কাপতে কাপতে ভোর ৪:৩০ মিনিটে রোজকার মত উঠে পরলেন আযান দেয়ার জন্য। ছোট গ্রাম, দরিদ্র গ্রামের মানুষ, তাই ঈমামতিসহ মোয়াজ্জেমের দ্বায়িত্বও পালন করতে হয় লিয়াকত হোসেন কে।

আযান দিতে এখনো পনেরো মিনিট বাকি, তাই উঠে মেসওয়াক করতে করতে কিন্চিত দূরত্বে মসজিদের সামনের কাঠাল গাছটার দিকে একটু হাটাহাটি করার জন্য পা বাড়ালেন তিনি। তারপর হঠাৎই একটা ঘটাম শব্দে সচকিত হয়ে উঠলেন এবং বিষয়টা কি তা জানার জন্য দ্রুত পায়ে এগোলেন কাঠাল গাছটার দিকে। কিন্তু তিনি পৌছনোর আগেই কেউ একজন আরো দ্রুত সটকে পরলো সেখান থেকে, এবং একটা মাইক্রো বাসের ইন্জিন চালু হওয়ার শব্দ পাওয়া গেলে গাড়িটাকে ধরতে রাস্তায় দৌড় দিলেন তিনি ...! কিন্তু লাভ হলনা!! তার আগেই গাড়িটা সেখান থেকে অনেক দূরে চলে গেছে। ঘন কুয়াশার দরুন সাদা ঝাপসা আলো ছাড়া আর কিছুই দেখা গেলনা। মূহুর্থেই যেন ঘটে গেল পুরো ব্যপারটা। তবে গাড়িটার পিছনের নাম্বার প্লেটটা দেখে ওটা যে অনেক দূর থেকে আগত কোন গাড়ি তা আর বুঝতে বাকি রইলো না।

কিন্তু কে? কেন? আর এত ভোরে এই মসজিদের সামনে করছিলটাই বা কি? এসব ভাবতে ভাবতে তিনি যখন কাঠাল গাছটার পাশে এসে দাঁড়ালেন তখনই খেয়াল হল আসল ব্যপারটা! কাঠাল গাছটার গলায় ঝোলানো দান বাক্সটার দিকে তাকিয়ে দেখলেন ওটা তখনো আস্তে আস্তে দুলছে!! আশ্চর্য্য!! বাক্সটার তালা ভাঙা!! তবে? তবে কি আগুন্তক চোর?? ... হতেই পারেনা!! কেননা আগুন্তক মাইক্রোবাসে করে এসেছিল। নেহায়েত ছিচকে এবং মানসিক বিকারগ্রস্ত চোর ছাড়া এ কাজ কোন সাধারণ মানুষের দ্বারা আদৌ সম্ভব নয়। এরকম কোন ছিচকে চোরের নিজস্ব গাড়ি থাকতে পারে এও তো হবার নয়!! তার উপর আবার এই দানবাক্সে প্রতি মাসে টেনেটুনে দুইশো বা তিনশো টাকার বেশি কখনো হয়না। কাজেই আগন্তুক যদি চোর হয়েও থাকে তবে তার কপাল মন্দ ভাবতে ভাবতে দানবাক্সের মুখ খুললেন লিয়াকত হোসেন এবং "থ" মেরে গেলেন তিনি!!

রাজ হাসের ডিমের মত ইয়া বড়বড় চোখ নিয়ে তাকালেন ভিতরে এবং একটা বড় তাল পাতার খামের ভিতরে গুনে গুনে দেখলেন দশটা এক হাজার টাকা নোটের নতুন চকচকে বান্ডিল!!! অর্থাৎ দশ লক্ষ টাকা!!! তার ভিতরে আরো একটা ছোট খাম!! লিয়াকত সাহেব থরথর করে কাঁপতে শুরু করেছেন। এত গুলো টাকা তিনি তার জীবনে কোনদিন দেখেননি। কে, কেন, কি জন্য এতগুলো টাকা এভাবে ফেলে গেল তা কিছুতেই ভেবে পাচ্ছেননা। কি করবেন, বা কি করা উচিৎ কিছুই ঢুকছে না তার মাথায়। হা করে তাকিয়ে আছেন টাকা গুলোর দিকে। যেন কাচাঁ টাকার সোঁদা গন্ধে মো মো করছে চারিপাশ … ঠিক এমন সময় -

“কইগো ঈমাম সাহেব আযান দেওনের টাইম হইয়া গেল তো”
লিয়াকত সাহেবকে কাছে পিঠে কোথাও না পেয়ে হাক পারলেন গ্রামের করিম চাচা। তিনিই সবার আগে নামাজ পড়তে চলে আসেন মসজিদে। ঈমাম সাহেব চমকিয়ে উঠলেন! এখোনো তার ঘোর কাটেনি! কোন রকমে করিম চাচা কে উত্তর দিলেন -
“আসি গো চাচা”
বলে কাঁপতে কাঁপতে টাকা গুলো গামছায় পেচিয়ে দ্রুত পায়ে করিম চাচার চোখ এড়িয়ে নিজের ঘরের দিকে ছুটে গেলেন। ঘরের মধ্যে ঢুকে এদিক সেদিক তাকিয়ে পুরোনো লেপ কম্বলের ভিতরে চাপা দিয়ে রাখলেন টাকা গুলো। উদ্ভ্রান্তের মত শুধু একটা কথায় তার মাথায় বাজতে থাকল -

“কিছুতেই এ টাকার খোজ কাউকে দেয়া যাবেনা … কিছুতেই না…”

টাকা গুলো লুকিয়ে রেখে কিছুটা সস্থি নিয়ে ওযু করতে চলে গেলেন লিয়াকত সাহেব। অবাক হয়ে দেখলেন ওযু করতে গিয়েও থরথর করে কাঁপছে তার হাত দুটো। কি হল তার হাত দুটোর!! কিছুতেই নিয়ন্ত্রণ করতে পারছেননা যেন। শুধু হাত নয়, ওযু শেষ করে আযান দিতে গিয়েও কাঁপছিল তার গলা!! সেই সুমধুর কন্ঠস্বর কোথায় যেন হারিয়ে গেছে। কোনরকমে আযান শেষ করে এসে নামাজের স্থানে বসতেই করিম চাচা পেছন থেকে লিয়াকত হোসেনের ঘাড়ে হাত রেখে কোমল সুরে বলল -
“বাজানের, শইলডা কি খারাপ?”
ছ্যাৎ করে উঠল লিয়াকত হোসেনের বুকের মধ্যে। তোতলাতে তোতলাতে বললেন -
“কক কই! নাতো চাচা। কিছু হয়নাই”
“তাইলে এই শীতের মইদ্যেও অত ঘামতাছো ক্যান বাজান?”
সত্যিই তো!! তার সারা শরীর দরদর করে ঘামছে!! সাথে সাথে পানজাবি দিয়ে ঘাম মুছতে মুছতে মুখে কৃত্রিম হাসি টেনে বললেন-
“না মানে, সকালে একটু দৌড়াদৌড়ি করছিলাম তো তাই…”
“তা ঠিকি আছে .. কিন্তু আযানের মইদ্যে ভুল করলা তো তাই জিগাইলাম আর কি”
সে কি!! আযানেও ভুল হয়েছে নাকি!! আবারো তোতলাতে তোতলাতে বললেন লিয়াকত হোসেন -
“কি ভুল হইল চাচা?”
“তোমার হয়তো খেয়াল নাই, এইডা ফজরের আযান, ‘আসসালাতু খয়রুম মিনান্নাউ’ কইতে ভুইলা গেছ”
একদম চুপ হয়ে গেলেন ঈমাম সাহেব। আর একটা কথাও বললেন না তিনি। ঢের বুঝতে পারছেন যে, তিনি তার নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা হারিয়েছেন। যত কথা বলবেন ততই বিপদ বাড়বে।

ঈমাম সাহেব ফজরের নামাজ শেষ করে সকালের নাস্তা না খেয়েই রওনা দিলেন মসজিদ কমিটির সভাপতির বাড়ি বরাবর, এবং ভিষণ ভাবে চাচার কথা মনে পরায় তাকে দেখতে যাবার নামে বিশেষ ছুটির আবেদন করে বসলেন। কাল বিলম্ব না করে সভাপতি সাহেব ছুটি মঞ্জুর করলেন সাথে সাথেই, এবং পথ খরচ বাবদ কিছু টাকাও দিয়ে দিলেন তার হাতে।

এরপর ওই দশ লক্ষ টাকা একটা ব্যাগের মধ্যে ভরে রাজধানী ঢাকার বুকে পাড়ি জমালেন লিয়াকত হোসেন। রাজধানীতে নাকি রাজাদের বসবাস! এবং যেহেতু তিনি এই মূহুর্থে নিজেকে রাজা ব্যতীত অন্যকিছু ভাবছেন না, তাই ঢাকাই হল তার জন্য একমাত্র উপযুক্ত স্থান। আর এভাবেই নিজেকে রাজা ভাবার সাথে সাথে ভুলেও গেলেন নিজের অতীত, পরিচয়, অস্তিত্ব। এমনকি আর কোনদিন ফেরেননি ছোট্ট সেই গ্রামটিতে।

যাক, অবশেষে কারো মনে কোন সন্দেহের অবকাশ না ঘটিয়ে ভালোই ভালোই যে টাকা গুলো নিয়ে ঢাকায় আসতে পেরেছেন সেজন্য গুনে গুনে ৩৩ বার ‘আলহামদুলিল্লাহ’ বলতে ভুল করেননি ঈমাম সাহেব। যদিও তিনি আর এখন কোন মসজিদের ঈমাম নন, আর তা হবারও ইচ্ছে নেই আর। তিনি এখন লাখপতি, আর লাখপতিরা ঈমাম হয়না! ঈমাম হয় ফকির, মিসকিন!!

ছিঃ!! আশ্চর্য!! এসব কথা ভাবতে একটুও বুক কাঁপছে না তার!! তার সারা জীবনের শিক্ষা, নীতি-আদর্শ সব কিছু কেমন ঝিমিয়ে পরেছে!! টাকার কাছে কি সব কিছুই এভাবে ঝিমিয়ে যায়?

ঢাকায় এসে প্রথমে তিনি উঠলেন একটা অভিজাত হোটেলে, এবং সবথেকে ভাল রুমটা ভাড়া নিলেন। হোটেলের ম্যানেজার তার হাতে রুমের চাবি বুঝিয়ে দিয়ে চলে যেতেই ভিতর থেকে ভাল করে দরজাটা লাগালেন তিনি। এই মূহুর্থটার জন্যই যেন এতক্ষণ অপেক্ষায় ছিলেন। টাকার ব্যাগটা খুলে সেগুলো একটু নেড়েচেড়ে দেখা, প্রাণ ভরে কাচাঁ গন্ধ নেয়া, আর হ্যাঁ … ওর ভিতরে আরেকটি ছোট খাম দেখেছিলেন , সেটাও খুলে দেখার সুযোগ হয়নি আর। এবার একটু অবকাশ মেলায় খামটা খুলে দেখবেন ভাবছেন, যদিও এতখানি পথ জার্নি করেও এতটুকুও ক্লান্তিবোধ নেই তার শরীরে !! সত্যিই .. টাকার কি ক্ষমতা … দুনিয়াতে টাকাই বোধহয় সবকিছু।

ধীরে ধীরে লিয়াকত সাহেব টাকার ব্যাগটি খুললেন এবং সবগুলো বান্ডিলে একবার করে নাক ঘষলেন। অতপর বান্ডিল গুলো দিয়ে ছোটখাটো একটা বালিশ বানিয়ে তার উপর মাথা রেখে কৌতুহলের সহিত ছোট খামটি হাতে নিলেন তিনি। খুব ভাল করে নাড়িয়ে চারিয়ে দেখলেন এবং খামটা খুলে তার ভিতরে একটা চিঠি আবিষ্কার করলেন। বোঝা যাচ্ছে খুব দামী কোন ডায়েরীর পাতা ছিড়ে লেখা হয়েছে চিঠিটা।

...

“প্রিয় নামাজী, পত্রের শুরুতেই সালাম জানবেন। প্রথমেই জানিয়ে রাখি, আমি আমার পরিচয় গোপনের স্বার্থেই এই চিঠি খানা লিখতে বসেছি। তাই চিঠির লেখককে অযথাই খোঁজাখুঁজি না করে চিঠির কথা গুলো মনযোগ দিয়ে পড়ার জন্য অনুরোধ করছি।

ভাবছেন এতগুলো টাকা কেন দিলাম, আর এভাবেই বা দিলাম কেন? জ্বী বিষয়টি আমি পরিষ্কার করে বলছি। প্রথমেই আমি একটু আমার সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত বর্ননা দেই।

আমার নাম হাসান (ছদ্মনাম)। আমার জন্ম হয় বাংলাদেশের কোন এক রেলস্টেশনের কোন এক প্লাটফর্মের ছাউনির নিচে গভীর রাতে। মা’কে মা বলে ডাকার আগেই পালিয়ে যান তিনি আমাকে সেখানে ওই অবস্থায় একা ফেলে। তবে যাওয়ার আগে আমার গলায় পারা মেরে যাননি, এটাই ছিল তার প্রথম ও শেষ ভালবাসা আমার প্রতি। এরপর যেকোন উপায়ে আর দশটা জারজের মত বেঁচে গেলাম আমি, আর আমার কপালে পরল ‘টোকাই’ নামক সিল মোহর। কিন্তু নাহ … আর দশটা টোকাইয়ের মত চলতে দিইনি আমার জীবন। চলে গেলাম একটা এতিম খানায় ‘টোকাই’ নামটা ‘শিক্ষা’ নামক রাবার দিয়ে ঘষে মুছে ফেলার জন্য। মূলত সেখান থেকে যে শিক্ষাটা পেয়েছিলাম তারই প্রয়োগ ঘটানোর চেষ্টা করেছি মাত্র! যা এই চিঠিতে বর্নিত।

যাইহোক, ভিষণ চালাক চতুর হওয়ায় স্বল্প সময়ের ভিতরেই এতিমখানার পরিচালকের দৃষ্টি ও ভালবাসা লাভ করি, এবং অবাধে যেকোন সময় যেকোন কক্ষ গমনের ক্ষমতাও পাই একই সাথে। এরই ধারাবাহিকতায় একদিন পরিচালক সাহেবের কক্ষে ঢোকার সুযোগ পাই এবং আড়ি পেতে অনেক কিছু দেখতে ও জানতে পাই।

জানলাম, দেশের যত বড় বড় কোটিপতি আছেন, মূলত তাদের একটা বিশাল অংশের আর্থিক সহায়তায় চলে এই ধরনের এতিমখানা গুলো। মূলত তারাই এসব মসজিদ, মন্দির, গির্জা, মাদ্রাসায়, এতিমখানায় মোটা অংকের টাকা অনুদান করেন যারা সারাজীবন পাপের টাকা ইনকাম করেছেন। পাপের টাকা ইনকাম করতে করতে যখন আর সেই টাকা রাখার জায়গা থাকেনা এবং জীবন ফুরিয়ে আসে, মৃত্যু ঘনিয়ে আসে ঠিক তখনই তারা এ সমস্ত খাতে টাকা ব্যায় করে পাপ কমানোর চেষ্টা করেন। এতে পাপ কমে কিনা বা বেহেশতের অগ্রীম টিকিট পাওয়া যায় কিনা আমার জানা নেই তবে এটা দেখেছি যারা সৎ পথের উপার্জিত টাকা মসজিদ, মন্দিরে দান করেন তাদের টাকার পরিমাণ নেহায়েত অল্পই হয়। আবার আমি এটাও বলছিনা যে সমস্ত মোটা টাকা দানকারীই অসৎ।

যাইহোক, এরপর আমার ভিতরে ধনী হবার প্রবল আকাঙ্ক্ষা জন্ম নিল। হোক সেটা সৎ উপায়ে বা অসৎ উপায়ে!! বুড়ো কালে বেহেশতের টিকিট পাবার উপায় যেহেতু জানা আছে সেহেতু একটু অসৎ হলে ক্ষতি কি!! আর তাই অসৎ নামক কুড়াল দিয়ে প্রথম কোপটা মারলাম পরিচালকের ঘাড়েই। তার সমস্ত টাকা যে বাক্সটাতে তালা বন্ধ থাকত সেই বাক্সেই একদিন হানা দিলাম, এবং হরিলুট করলাম সমস্ত টাকা। সে সময় থরথরিয়ে আমার হাত কেঁপেছিলো … কারণ আমি জানতাম ওগুলো পাপের টাকা, আর আমার হাত জানত, সে পাপ কাজ করছে।

এবার আসি মূল কথায়। যদিও আপনি বা আপনারা হয়তো এতক্ষণে আমার এই অদ্ভুত কর্মের কারণ অনুমান করতে পেরেছেন বলে ভাবছেন তবুও বলছি আরেকটু বাকি আছে। পরিচালকের বাক্স ভেঙে যে টাকা পেয়েছিলাম তা দিয়ে আজ আমি কোটিপতি। জীবনের এমন কোন সখ, আহ্লাদ বা ইচ্ছা নেই যা আমি অপূর্ণ রেখেছি। হেন কোন পাপ নেই যা আমি করিনি। তবুও দিন দিন টাকার পরিমাণ বাড়তে বাড়তে আজ পাহাড় সমান হয়েছে। প্রয়োজনের অতিরিক্ত অর্থ যে মানুষের জন্য কতখানি ক্ষতিকর তা টের পাই হাড়ে হাড়ে। আজ উপলব্ধি করি এসব গাড়ি, বাড়ি, অর্থকরী সবই মোহ … মিথ্যা মোহ … আর আমার এই উপলব্ধি তার কাছে বানোয়াট মনে হবে যার কাছে অর্থ নেই।

যে হাত দিয়ে সেদিন টাকা গুলো চুরি করেছিলাম সেই হাত দুটো আজ কোন এক দূরারোগ্য রোগে পঁচতে শুরু করেছে। পঁচা এই হাত দিয়েই লিখে চলেছি এই চিঠি। তাই পুরো শরীরটা পঁচে যাবার আগেই বিলিয়ে দিতে চাই সমস্ত পাপের সম্পদ। কিনতে চাই বেহেশতের টিকিট। দেশের বিভিন্ন মসজিদের উন্নয়নে দান করে গেলাম আমার এই টাকা। দোয়া করবেন আমার জন্য, আমি যেন ক্ষমা পাই। ধন্যবাদ।”

পুরো চিঠিটা শেষ করে বড় একটা শ্বাস ছাড়লেন লিয়াকত হোসেন। তারপর কি যেন ভাবলেন কিছুক্ষণ। জানালার কাছে গিয়ে দাড়িয়ে বাইরে বড় বড় দালান কোঠার দিকে তাকিয়ে মনে মনেই বললেন - “এই শহরে কেউই শতভাগ সৎ নয়। দুনিয়ার সব অসৎ মানুষ যদি পঁচতে শুরু করতো তবে এই গ্রহের নাম হত ‘পঁচন গ্রহ!!’”
বলেই হোহোহো করে বিচ্ছিরি একটা হাসি হেসে চিঠিটা কুটিকুটি করে ছিঁড়ে জানালা দিয়ে বাইরে ফেলে দিলেন তিনি। এ সময় হঠাৎ তার চোখ পরল ড্রেসিং টেবিলের আয়নার দিকে, আর অবাক হয়ে দেখলেন নিজের কুৎসিত হাসিটা!! কিন্তু… কে সে? কার হাসি এটা? এ হাসি কি তার? নাকি তার হাসি বিকৃত করছে অন্যকেও !!

- ৪০ বছর পর -

একটা লম্বা আরাম কেদারায় টান টান হয়ে শুয়ে আছেন জনাব লিয়াকত হোসেন। বুকের উপরে পরে আছে এক খানা মোটা ফ্রেমের চশমা। আর পাশেই একটা হাতছড়ি। কিভাবে কিভাবে যে এতটা সময় গড়িয়ে গেল ঠিক ঠাওর করতে পারলেন না। সময় যেন তরল পদার্থ, তাকে ধরে রাখা বা বেধেঁ রাখা যায়না। অনেক বড় বড় অট্টালিকার সাথে পাল্লা দিয়ে আজ তিনি ১৮টি অট্টালিকার মালিক!! কিন্তু সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে পেরে ওঠেননি। প্রকৃতির দানে আজ তার সব কিছুই হয়েছে। দানবাক্সের সেই দশ লক্ষ টাকা বেড়ে আজ কত লক্ষ বা কোটিতে পৌছেছে সে হিসেব রাখার জন্য রীতিমতো ৫ জন ম্যানেজার পোষেন তিনি। ৩ জন রাখেন ব্যাংক ব্যালেন্সের হিসেব, আর ২ জন রাখেন কাচাঁ টাকার হিসেব। তবে কাচাঁ টাকার গন্ধ এখন আর ভাল লাগেনা তার। দিন শেষে যখন রাত আসে তখন গভীর ভাবে শুধু একটা কথা মনে মনে ভাবেন তিনি- “What the funny!!!” জীবন এত ছোট কেন!!! জীবনে এত লোভ কেন? চাহিদা কেন? হিংসা কেন?... ওহে জীবন তুমি এত ছলনাময়ী কেন? কেন…?

লিয়াকত সাহেব আস্তে আস্তে উঠে বসে তার পি.এস হারুন কে ফোন করলেন -
“আসসালামু আলাইকুম স্যার”
“ওয়ালাইকুম আসসালাম। হারুন সাহেব, ঢাকার বাইরে প্রত্যন্ত গ্রাম অঞ্চল ঘুরে অনুন্নত মসজিদ মাদ্রাসার একটা তালিকা তৈরি করুন।”
“কেন স্যার?”
“যা বললাম তাই করুন, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব। আর হ্যাঁ, খেয়াল রাখবেন সেগুলোর বাইরে ‘দানবাক্স’ ঝোলানো আছে কিনা”
“ইয়েস স্যার”

ফোনটা রেখে ধীরে ধীরে লাঠিতে ভর দিয়ে তার লাইব্রেরী রুমে গিয়ে বসলেন। লেদারের কভার ওয়ালা একটা দামী ডায়েরী নিয়ে কিছু একটা লিখতে শুরু করলেন কলমের আলতো স্পর্শে। ঠিক এমন সময় একটা পঁচা গন্ধে নাক টা যেন ঝাঝিয়ে উঠল তার!! হাতটা মেলে তালুর দিকে তাকিয়ে দেখলেন ছোট ছোট কিছু পোকা কুটকুট করে খাচ্ছে তার হাতের পঁচা মাংস!! কিন্তু কোন প্রকার ভাবান্তর লক্ষ্য করা গেলনা তার চোখে মুখে। বরং খুবই স্বাভাবিক ভঙ্গিতে অন্য হাতে একটা কাঠি নিয়ে পোকা গুলোকে টিপে টিপে মারায় মনযোগ দিলেন জনাব লিয়াকত হোসেন।
৩টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

বাংলাদেশের লোকসংস্কৃতিঃ ব্যাঙের বিয়েতে নামবে বৃষ্টি ...

লিখেছেন অপু তানভীর, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:০০



অনেক দিন আগে একটা গল্প পড়েছিলাম। গল্পটা ছিল অনেক এই রকম যে চারিদিকে প্রচন্ড গরম। বৃষ্টির নাম নিশানা নেই। ফসলের মাঠ পানি নেই খাল বিল শুকিয়ে যাচ্ছে। এমন... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাংলাদেশি ভাবনা ও একটা সত্য ঘটনা

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১০:১৭


আমার জীবনের একাংশ জুড়ে আছে; আমি চলচ্চিত্রাভিনেতা। বাংলাদেশেই প্রায় ৩০০-র মত ছবিতে অভিনয় করেছি। আমি খুব বেছে বেছে ভাল গল্পের ভাল ছবিতে কাজ করার চেষ্টা করতাম। বাংলাদেশের প্রায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাকি চাহিয়া লজ্জা দিবেন না ********************

লিখেছেন মোহাম্মদ সাজ্জাদ হোসেন, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১০:৩৫

যখন প্রথম পড়তে শিখেছি তখন যেখানেই কোন লেখা পেতাম পড়ার চেষ্টা করতাম। সেই সময় দোকানে কোন কিছু কিনতে গেলে সেই দোকানের লেখাগুলো মনোযোগ দিয়ে পড়তাম। সচরাচর দোকানে যে তিনটি বাক্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

=এই গরমে সবুজে রাখুন চোখ=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:২১

০১।



চোখ তোমার জ্বলে যায় রোদের আগুনে?
তুমি চোখ রাখো সবুজে এবেলা
আমায় নিয়ে ঘুরে আসো সবুজ অরণ্যে, সবুজ মাঠে;
না বলো না আজ, ফিরিয়ো না মুখ উল্টো।
====================================
এই গরমে একটু সবুজ ছবি দেয়ার চেষ্টা... ...বাকিটুকু পড়ুন

কুড়ি শব্দের গল্প

লিখেছেন করুণাধারা, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:১৭



জলে ভাসা পদ্ম আমি
কোরা বাংলায় ঘোষণা দিলাম, "বিদায় সামু" !
কিন্তু সামু সিগারেটের নেশার মতো, ছাড়া যায় না! আমি কি সত্যি যাবো? নো... নেভার!

সানমুন
চিলেকোঠার জানালায় পূর্ণিমার চাঁদ। ঘুমন্ত... ...বাকিটুকু পড়ুন

×