somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

মাকে নিয়ে হজযাত্রা- এক চীনা লেখিকার বই

০২ রা ফেব্রুয়ারি, ২০১৩ সন্ধ্যা ৭:০৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



সম্প্রতি চীনে 'মাকে নিয়ে হজযাত্রা' শীর্ষক একটি বই খুব জনপ্রিয় হয়েছে। লেখিকা মা লির মায়ের বয়স ৮০ বছর এবং তিনি হুইলচেয়ারে বসে চলাফেরা করেন। মা লি তার মাকে নিয়ে গাড়িতে করে লান চৌ পৌঁছান এবং তারপর বিমানে মক্কা যান। যাত্রাপথের অভিজ্ঞতা নিয়ে মা লি এই বইটি রচনা করেছেন।
মা লি ৪০ বছর বয়সী একজন ইন্টারনেট প্রকৌশলী। কান সু প্রদেশ থেকে মক্কা যেতে ও ফিরে আসতে ১৩ হাজার কিলোমিটার পথ চলতে হয়। দুর্বল মাকে একা একা মক্কা নিয়ে নিয়ে যাওয়া মা লির জন্য একটি কঠিন কাজ ছিল। মা লি বলেন, অনেক দিন ধরে তার মায়ের ইচ্ছা ছিল হজ পালন করার। তিনি বলেন:

"মেয়ে হিসেবে প্রথমে আমি বুঝতে পারি মায়ের মক্কা যাওয়ার আকাঙ্ক্ষা কতটুকু ছিল। হজ পালন না করে যদি একদিন আমার মা মৃত্যুবরণ করেন, তাহলে আমার বোন ও আত্মীয়স্বজন নিশ্চয়ই কেঁদে কেঁদে বলবে যে, মায়ের মক্কা যাওয়ার স্বপ্ন পূরণ হয়নি। কল্পনার এমন দৃশ্যও আমি সহ্য করতে পারি না। যখন আমার মা আছেন এবং আমি তরুণ, তখন মায়ের স্বপ্ন পূরণ করা সম্ভব।"

গত আশির দশকে চীনের সংস্কার ও উন্মুক্তকরণের প্রেক্ষাপটে মক্কা যাওয়া খুব জটিল নয়। তবে মা লির বাবা ও তৃতীয় বোন মারা গেছেন। হজ পালন পরিকল্পনা বার বার পরিবর্তন করেন মা লির মা। প্রতি বছর আত্মীয়স্বজন যখন হজের উদ্দেশে যান, তখন মা লির মা তাদেরকে বিদায় জানাতে যান এবং তার মায়ের বিষণ্ণ চেহারা দেখে মা লির খুব দুঃখ বোধ হয়। ২০০৮ সালে মা লি মায়ের স্বপ্ন পূরণের জন্য তার মাকে নিয়ে মক্কা যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। তবে মা লির পরিবার তাকে সমর্থন করে না। কারণে মা লির মায়ের বয়স প্রায় ৮০ বছর এবং ২০০৮ সালে তার শারীরিক অবস্থা খুব খারাপ হয়ে যায়। তবু তিনি প্রতিজ্ঞা করেন যে, মাকে নিয়ে মক্কা যাবেনই। মা তার এ প্রতিজ্ঞার কথা শুনে খুব খুশি হন। মা লি বলেন:

"মা চক্ষুর ছানি রোগে আক্রান্ত হলেও আগে তিনি অপারেশনে রাজি হন না। তবু মক্কা গিয়ে বায়তুল্লাহ দেখা ও সে সংক্রান্ত জ্ঞান অর্জনের জন্য তিনি অপারেশনে রাজি হন অবশেষে। এ ছাড়া, আমার মা একজন ছোট মেয়ের মতো হজ পালন সম্পর্কিত জিনিসপত্র সংগ্রহ করেন। এমনকি যাওয়ার ৮ মাস আগে থেকে তিনি হজযাত্রা কালের খাবারদাবারের ব্যাপারেও চিন্তা করেন।"

মায়ের ইতিবাচক মনোভাব মা লিকে উত্সাহ দেয়। তিনি মক্কা যাওয়ার প্রস্তুতি নিতে শুরু করেন। ২০০৮ সালের ঈদুল ফিতরের সময় থেকে তিনি প্রতিদিন আরবি ভাষা শিখতে থাকেন এবং নামাজ আদায় করেন। তিনিও হজ পালনের তথ্য ও জ্ঞান সংগ্রহ করেন। তার মা প্রতিদিন আতশকাচ ব্যবহার করে হজ নির্দেশিকা পড়তে থাকেন। এক বছরের প্রস্তুতের পর, ২০০৯ সালের ৩১ অক্টোবর কান সু প্রদেশের লিন সিয়া শহরের ৩ শতাধিক হজযাত্রী মক্কা অভিমুখে রওনা হন। এ যাত্রায় যদিও সবার খুব আনন্দ বোধ হয়, তবে সব সময় তার মায়ের শারীরিক অবস্থা নিয়ে মা লি উদ্বিগ্ন থাকেন। সৌভাগ্যক্রমে সারা যাত্রায় তার মা সুস্থ থাকেন। তিনি বলেন:

"প্রথম দিন বায়তুল্লাহ যাওয়া সবচেয়ে আবেগময় একটি অভিজ্ঞতা। পথে আমি অনুভব করতে পারি যে, আমার মা নিজেকে উত্সাহ দিচ্ছেন। শেষ দিন আমার মা বার বার আমাকে বলেন 'বাচ্চা, দেখো আমি যেন বায়তুল্লাহর ছাদে লেখা কোরানের বাণী দেখতে পাই'। যাওয়ার আগে আমি ভাবি পিঠে বহন করে হলেও আমার মাকে আমি বায়তুল্লাহ দেখাব। আমি বিশ্বাস করি, আল্লাহ আমাদের সব ভাল কামনা ও প্রত্যাশা পূরণ করেন। এ হজযাত্রার মাধ্যমে আমার মায়ের অনেক পরিবর্তন হয়। এটা খুব ভাল একটি বিষয়।"

হজ পালনের ৪০ দিন মা লি ও তার মা পরস্পরকে যত্ন করেন। অনেক মানুষ মা লি ও তার মায়ের গল্প শোনে আগ্রহের সাথে এবং তাদেরকে প্রশংসা করে। চীনের হজ দলের প্রধান মা ইয়াও লিং সাংবাদাতাকে বলেন, তিনি এই প্রথম বারের মতো দেখলেন যে, একটি মেয়ে এত বয়স্ক মাকে নিয়ে মক্কা গেলেন। তিনি যখন প্রথম বিষয়টি জানতে পারেন, তখন মা লি ও তার মাকে দেখার খুব আকাঙ্খা হয় তার। তাদের যাত্রা সুন্দরভাবে শেষ হয়েছে দেখে মা ইয়াও লিং খুব আনন্দিত হন। তিনি বলেন:

"মাকে নিয়ে হজ পালন করতে গিয়ে মা লি অনেক মানসিক ও বৈষয়িক চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হন। তার মায়ের শারীরিক অবস্থা ভাল নয় এবং চোখে প্রায় কিছুই দেখতে পান না। আমি তাদের জন্য অনেক চিন্তা করেছি। তবু মা লির দৃঢ় মানসিকতা, মায়ের প্রতি তার ভালবাসা এবং তার বুদ্ধি দিয়ে এ হজ যাত্রা সফল করেন।"

এবারের যাত্রায় মা লির শরীর ও মন অনেক পরীক্ষার মুখে পড়ে। কয়েক বার তিনি যাত্রা পরিত্যাগ করতে চান। তবে পাশে মাকে দেখলে তিনি বার বার উত্সাহ পান। তার দেশও তার জন্য অনেক শক্তি যোগায়। তিনি বলেন:

"নিজের দেশের সমর্থন ছাড়া আমি হজ পালন করতে পারতাম না। হজ পালনের সময় 'আমি মুসলমান' ও 'আমি চীনা মানুষ' এ দুটি বাক্য আমার জন্য ছিল খুব গুরুত্বপূর্ণ। আমার দেশের উদ্যোগে আমরা নির্ঝঞ্ঝাটে হজ পালন করতে পারি। আমরা অন্যান্য দেশের মুসলমানদের সাহায্যও পাই। আমার বুকে রাখা চীনা পতাকা দেখে তারা সব সময় বলে 'চায়না, ওকে।"

মা লি ও তার মায়ের মতো মুসলমানের সংখ্যা চীনে ২ কোটি। অন্যান্য দেশের মুসলমানদের মতো চীনা মুসলমানদের জন্যও হজযাত্রা গুরুত্বপূর্ণ ও ব্যাপক আয়োজনের একটি বিষয়। চীনা মুসলমানদের সেবা দেওয়ার জন্য চীনা ধর্ম বিষয়ক ব্যুরো এবং চীনা ইসলাম ধর্ম সমিতি দেশের বিভিন্ন বিভাগের সঙ্গে নানা ব্যবস্থা গ্রহণের মধ্য দিয়ে তাদের নিরাপত্তা ও সুস্থতা নিশ্চিত করে। এসব আয়োজনের মধ্যে রয়েছে বিমানের ব্যবস্থা করা এবং চিকিত্সা দল পাঠানো।

চল্লিশ দিনে মা লি ও তার মা মক্কায় তাদের হজযাত্রা সম্পন্ন করেন। যখন তারা নির্ঝঞ্ঝাটে বাড়ি ফিরে পরিবারের সঙ্গে আলিংগন করেন, তখন তাদের চোখ থেকে আনন্দাশ্রু ঝরে পড়ে। আবেগের সঙ্গে মা লি জানান, মায়ের সঙ্গে হজযাত্রা সম্পন্ন করতে পারি তার খুব গর্ব বোধ হয়। তিনি বলেন:

"এ বারের যাত্রায় আমার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অনুভবটি হচ্ছে গর্ব। আশি বছর বয়সী মাকে নিয়ে হজযাত্রায় যেতে এবং নির্ঝঞ্ঝাটে বাড়ি ফিরে আসতে পেরেছি বলে আমি খুব সন্তুষ্ট। আমার মাও খুব খুশি ও গর্বিত। এ যাত্রা তার জন্য খুব তাত্পর্যসম্পন্ন। ফিরে আসার পর তিনি যখন আমাকে দেখেন, তখন জিজ্ঞাস করেন 'মক্কায় আমরা কীভাবে হজযাত্রা করেছি? আমি ভুলে গেছি, তুমি আমাকে আবার জানাও।' আসলে তিনি কিছুই ভুলে যাননি, তিনি কেবল আমার সঙ্গে আবার এ অভিজ্ঞতা নিয়ে কথা বলতে চান।"

যদিও মাকে নিয়ে হজে যাওয়া দু' বছর আগের ঘটনা, তবু যাত্রায় তাদের অভিজ্ঞতা সব সময় মা লির মনে ভিড় জমায়। তাই তিনি গত দু বছরে 'মাকে নিয়ে হজযাত্রা' শীর্ষক বইটি রচনা করেন এবং ২০১৩ জানুয়ারি মাসে সেটি প্রকাশিত হয়। মা লি বলেন, যাত্রার শুরু থেকে তিনি কিছু লিখতে চাইতেন। তবে তিনি কখনও ভাবেননি যে, তিনি একটি বই প্রকাশ করতে পারবেন। তিনি বলেন:

"আমি মনে করি আমার হজযাত্রা দুই বার হয়েছে। এক বার বাস্তব যাত্রা এবং আরেকবার মানসিক ও সাহিত্যিক যাত্রা। বই রচনার মধ্য দিয়ে আমি নিজের জীবনের ঘটনা সংকলন করতে পেরেছি।"


সূত্র- সিআরআই
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা ফেব্রুয়ারি, ২০১৩ সন্ধ্যা ৭:১৯
১০টি মন্তব্য ৮টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

পরিণতি - ৩য় পর্ব (একটি মনস্তাত্ত্বিক রহস্য উপন্যাস)

লিখেছেন সাখাওয়াত হোসেন বাবন, ২৭ শে মার্চ, ২০২৪ দুপুর ১২:২৮



( পরিণতি ৬১ পর্বে'র একটি মনস্তাত্ত্বিক রহস্য উপন্যাস ।)

তিন


আচানক ঘুম ভেঙ্গে গেলো ।

চোখ খুলে প্রথমে বুঝতে পারলাম না কোথায় আছি । আবছা আলোয় মশারির বাহিরে চারপাশটা অপরিচিত... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইফতার পার্টি মানে খাবারের বিপুল অপচয়

লিখেছেন রাজীব নুর, ২৭ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৩:৫৩



গতকাল সরকারি ছুটির দিন ছিলো।
সারাদিন রাস্তাঘাট মোটামুটি ফাকাই ছিলো। ভাবলাম, আজ আরাম করে মেট্রোরেলে যাতায়াত করা যাবে। হায় কপাল! মেট্রো স্টেশনে গিয়ে দেখি গজব ভীড়! এত ভিড়... ...বাকিটুকু পড়ুন

গণতন্ত্র আর বাক-স্বাধীনতার আলাপসালাপ

লিখেছেন অনিকেত বৈরাগী তূর্য্য , ২৭ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৪:২৩


একাত্তর সালে আওয়ামী লীগের লোকজন আর হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা ছিল পাকবাহিনীর প্রধান টার্গেট। যদিও সর্বস্তরের মানুষের ওপর নিপীড়ন অব্যাহত ছিল। গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছিল। মুক্তিযোদ্ধা আর তাদের পরিবারের... ...বাকিটুকু পড়ুন

স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে মুক্তিযোদ্ধাদের মুমিনী চেহারা ও পোশাক দেখে শান্তি পেলাম

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৭ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ৯:৫৮



স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে স্টেজে উঠেছেন বত্রিশ মুক্তিযোদ্ধা তাঁদের চব্বিশ জনের দাঁড়ি, টুপি ও পাজামা-পাঞ্জাবী ছিলো। এমন দৃশ্য দেখে আত্মায় খুব শান্তি পেলাম। মনে হলো আমাদের মুক্তিযোদ্ধা আমাদের মুমিনদের... ...বাকিটুকু পড়ুন

দু'টো মানচিত্র এঁকে, দু'টো দেশের মাঝে বিঁধে আছে অনুভূতিগুলোর ব্যবচ্ছেদ

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ১২:৩৪


মিস ইউনিভার্স একটি আন্তর্জাতিক সুন্দরী প্রতিযোগিতার নাম। এই প্রতিযোগিতায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সুন্দরীরা অংশগ্রহণ করলেও কখনোই সৌদি কোন নারী অংশ গ্রহন করেন নি। তবে এবার রেকর্ড ভঙ্গ করলেন সৌদি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×