বর্তমান মহাজোট সরকারের আমলে ১১ মাসে বিচারবহির্ভূত হত্যকাণ্ডের (ক্রসফায়ার) শিকার হয়েছেন ১১৮ জন। এ সময় র্যাব ও পুলিশের গুলিতে আহত হয়েছে আরও দুই শতাধিক। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীসহ সরকারের নীতিনির্ধারকরা ঘোষণা দেন, চারদলীয় জোট সরকারের মতো এ সরকারের আমলে একটি লোকও ক্রসফায়ারে মরবে না। বর্তমান সরকারের প্রায় এক বছর শাসনামলে দেখা গেছে, ক্রসফায়ার বন্ধ তো হয়ইনি, বরং কোন কোন ক্ষেত্রে ক্রসফায়ারকে উৎসাহিত করা হয়েছে। দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে যখন অকাতরে ক্রসফায়ার চলছিল ঠিক ওই মুহূর্তে খোদ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যাডভোকেট সাহারা খাতুন বলেছিলেন, সন্ত্রাসীরা গুলি করবে আর র্যাব-পুলিশ দাঁড়িয়ে গুলি খাবে, তা হতে পারে না। মন্ত্রীর এহেন মন্তব্যকে মানবাধিকার সংগঠনগুলো ক্রসফায়ারকে উৎসাহিত করা হয়েছে বলে সমালোচনা করে।
প্রতিমন্ত্রী শামসুল হক টুকুও র্যাব কার্যালয়ে এক অনুষ্ঠান শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে পাল্টা প্রশ্ন ছুড়ে বলেছিলেন, আপনার হাতে লাঠি থাকতে সাপ আক্রমণ করলে আপনি তখন কি করবেন? সংশ্লিরা বলছেন, বর্তমান সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর পেশাদার সন্ত্রাসী, চরমপন্থী ও জঙ্গিসহ নানা শ্রেণীর সন্ত্রাসী মাঠে নেমে পড়ে। আইন-শৃংখলা পরিস্থিতির চরম অবনতি ঘটে। পরিস্থিতি সামাল দিতে সেই পুরনো বিতর্কিত ক্রসফায়ার পদ্ধতিকেই অবলম্বন করা হয়। সঙ্গে সঙ্গে সরকারের সংশ্লিষ্টদের ভোল পাল্টে যায় রাতারাতি। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন দাবি করেন, তার সরকারের আমলে দেশে একটি ক্রসফায়ারের ঘটনাও ঘটেনি। এদিকে, ক্রসফায়ারের বিষয়টি উদ্বেগ ছাড়ালে মানবাধিকার সংগঠন ছাড়াও বিষয়টি উচ্চ আদালত পর্যন্ত গড়ায়।
১৭ নভেম্বর ক্রসফায়ারের একটি ঘটনা নিয়ে সুয়োমটো রুল জারি করেন বিচারপতি আবদুর রহমান ও বিচারপতি ইমদাদুল হক সম্বন্বয় গঠিত সুপ্রিমকোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের একটি ডিভিশন বেঞ্চ। আদালত স্বপ্রণোদিত হয়ে মাদারীপুরে লুৎফর খালাসি ও খায়রুল খালাসি নামে দু’ভাইকে গুলি করে হত্যার ঘটনাটি কেন বিচারবহির্ভূত ঘোষণা করা হবে না, সরকার ও র্যাবের কাছে জানতে চেয়ে ৪৮ ঘণ্টার সময়সীমা বেঁধে দেন। দুই সহোদরকে র্যাব আটক করার পর তাদের হেফাজতে হত্যা করা হতে পারে বলে পরিবারের পক্ষ থেকে আশংকা প্রকাশের ৩৬ ঘণ্টা পর তাদের মৃত্যুর খবর প্রকাশিত হয়। আইন-শৃংখলা বাহিনী ও মানবাধিকার সংগঠন সূত্রে জানা গেছে, এ বছর ১১৮টি ক্রসফায়ার সংঘটিত হয়। ক্রসফায়ারে এর মধ্যে র্যাবের হাতে ৫৮, পুলিশের হাতে ৫০, র্যাব ও পুলিশে যৌথভাবে ২১ জন, আনসারের হাতে ২ জন, কারারক্ষীর হাতে ১ জন, বনরক্ষীর হাতে ১ জন, কোস্টগার্ডের হাতে ১ জন ও বাকিরা অন্যান্য বাহিনীর হাতে নিহত হয়েছেন।
খিলগাঁওয়ে ছাত্রলীগ কর্মী সুমন, খিলগাঁও রামপুরায় রাজিব, মোহাম্মদপুরে কলেজছাত্র সুমন, পুরনো ঢাকায় ব্যবসায়ী দুধ মিয়া ও পলিটেকনিকের দুই ছাত্র মহসীন ও জিন্নাহর মৃত্যু সমালোচনার জন্ম দেয়। মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর সোহেল তাজকে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব দেয়া হলে তিনি ঘোষণা দেন, আইন-শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর হেফাজতে অথাৎ কাউকে গ্রেফতার বা আটকের পর কোন ক্রসফায়ার বা এনকাউন্টারের ঘটনা ঘটবে না। তার এই ঘোষণার পরপরই পলেটেকনিকের দুই ছাত্রের মৃত্যু ঘটনায় তোলপাড় সৃষ্টি হয়। গ্রেফতারের পরই বেশিরভাগ ক্রসফায়ারের ঘটনা ঘটেছে বলে অভিযোগ রয়েছে। এমনও হয়েছে, চরমপন্থী দলের ক্যাডারদের রাজধানী থেকে গ্রেফতার করে বাইরে নিয়ে ক্রসফায়ার দেয়া হয়েছে। একদিন আগে তাদের গ্রেফতারের খবর পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। যশোরের সন্ত্রাসী পাগলা সেলিম ও তার ভাইকে ঢাকার শ্যামলী থেকে গ্রেফতারের একদিন পর যশোরে নিয়ে ক্রসফায়ার দেয়া হয়। প্রকাশ্য ক্রসফায়ারের ঘটনা ছাড়াও র্যাব-পুলিশ পরিচয় দিয়ে আটকের পর নিখোঁজ হয়ে যাওয়ার কিছু ঘটনা ঘটেছে। এমনকি রাজধানীর কাফরুলে আমিরুল ইসলাম ও শাহেদ ওরফে পাইক শাহেদকে র্যাব-পুলিশ পরিচয়ে বাসা থেকে ধরে নেয়ার পর গুলিবিদ্ধ লাশ উদ্ধার করা হয়। এর আগেও কয়েকটি ঘটনায় র্যাবের পরিচয় দিয়ে বাসা থেকে ধরে নেয়ার পরে তাদের আর হদিস পাওয়া যায়নি। বিশেষ করে বহিষ্কৃত যুবলীগ নেতা লিয়াকত হোসেনের নিখোঁজ হওয়ার বিষয়টি নিয়ে ব্যাপক চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়। জোট সরকারের পুরস্কারঘোষিত ২৩ শীর্ষ সন্ত্রাসীর অন্যতম লিয়াকতকে গত বছরের ২৪ নভেম্বর তার বোনের লালমাটিয়ার বাসা থেকে র্যাব পরিচয়ে সাদাপোশাকধারী এক দল লোক তুলে নিয়ে যায়। এরপর থেকে তিনি নিখোঁজ। ২০০৪ সালে ৬৮ জন, ২০০৫ সালে ১১১ জন, ২০০৬ সালে ১৯৫ জন, ২০০৭ সালে ৯৪ জন, ২০০৮ সালে ১৮৬ জন র্যাব ও পুলিশের ক্রসফায়ারে নিহত হয়েছেন। এই নিয়ে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার হাতে ৬০৩ জনের মৃত্যু ঘটে। Click This Link
এদিকে বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে গত জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত সারাদেশে ১৫ হাজার ১২৬টি রাজনৈতিক সহিংস ঘটনা ঘটেছে। এসব সহিংসতায় মোট ২৩৯ জন নিহত হয়েছে। এর মধ্যে রাজনৈতিক দলগুলোর অভ্যন্তরীণ কোন্দলে নিহত হয়েছে ৩৯ জন। এদের মধ্যে ৩৭ জন আওয়ামী লীগের এবং ২ জন বিএনপির। একই সময় দেশে সাংবাদিকদের ওপর হামলার ঘটনা ঘটেছে ২২৯টি। এসব হামলায় নিহত হয়েছেন ৩ জন এবং গুরুতর আহত হয়েছেন ৭১ জন।
‘গণমাধ্যমের ওপর চাপ এবং রাজনৈতিক সহিংসতা : রাষ্ট্রের দায়িত্ব এবং গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি’ শীর্ষক আলোচনায় এসব তথ্য তুলে ধরা হয়। Click This Link