লোকমুখে কিংবা সংবাদ মাধ্যমে ও সাহিত্য আঙিনায় মেঘনা কন্যা চাঁদপুরকে নিয়ে অনেক কথা হয়েছে । বিভিন্নজনের কাছে বিভিন্নরূপে ধরা দিয়েছে চাদঁপুর জনপদ। কেউ বলেন, ‘রূপসী চাঁদপুর’, কেউ বলেন ‘ইলিশের দেশ চাঁদপুর’। আবার কেউ চাঁদ সওদাগরের সপ্তডিঙ্গা মধুকরের পালতোলা জাহাজের নোঙর খুঁজে বেড়ান চাঁদপুর জনপদে। এভাবেই নানাজনের নানা ভাবনায় সুদীর্ঘ সময়ের পথ পরিক্রমায় ঐতিহ্য আর আদর্শের নীরব সাক্ষী চাঁদপুর। মেঘনা-ডাকাতিয়া আর ধনাগোদা নদীর জলধারায় বিধৌত দেশের অন্যতম বাণিজ্য বসতির জনপদ এই শ্যামলী চাঁদপুর। এই জেলার সদর দপ্তরও চাঁদপুর নামক শহরে অবস্থিত।
□ ঢাকা সদরঘাট থেকে চাদঁপুর বড় স্টেশনের দিকে যাত্রীবাহী বড় লঞ্চ আসতেছে □
□ পদ্মা, মেঘনা ও ডাকাতিয়া এই তিন নদী এসে এই জায়গায় মিলিত হয়েছে যার কারনে একে বলা হয় তিন নদীর মোহনা □
বাংলাদেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ নৌবন্দর এই শহরটিকে ঘিরে গড়ে ওঠেছে। চাঁদপুর নামে জনপদ হাজার বছরের পথচলায় প্রত্যক্ষ করেছে প্রকৃতির নানা লীলাখেলা। ভূমিকম্প, বন্যা আর নদীর ভাঙ্গনে বারে বারে বিপর্যস্ত হয়েছে কিন্তু কোনো শক্তির দাপটের কাছে হার মানেনি চাঁদপুর, সে মানুষই হোক কিংবা প্রকৃতি। ঐতিহ্যবাহী এক সময়ের মহকুমা শহর, ‘‘Gate way of Eastern India” আজকের জেলা চাঁদপুর।
শত নয়, হাজার বছরের প্রাচীন জনপদ এই চাঁদপুর। বাংলার স্বাধীন সুলতানদের সময় থেকে প্রাচীন বাংলার এক সমৃদ্ধ নগরী চাঁদপুর। বিশিষ্ট চাঁদ ফকির, জমিদার চাঁদ রায় ও ধনাঢ্য বণিক চাঁদ সওদাগরের নামে এ ত্রয়ীযুগলবন্দীতে নামাঙ্কিত চাঁদপুর। এ যুগলবন্দীর নামের দিকে গভীর দৃষ্টিতে তাকালে প্রথমেই দৃষ্টিগোচর হয় পুরন্দপুর গ্রাম ও চাঁদ ফকিরের স্মৃতি। কোড়ালিয়া ও পুরন্দপুর গ্রামে চাঁদ ফকির এলমে তাসাউফের বায়াত দিতেন। একদা কোড়ালিয়া গ্রামে তাঁর বাস ছিলো। চাঁদপুরের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে রয়েছে হাজার হাজার প্রত্নসম্পদ।
মধ্য ভারতের গাঙ্গেয় উপত্যকা ও বাংলার গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র-মেঘনা বিধৌত বিস্তৃত সমতলভূমি গড়ে উঠার বহু পূর্বেই সিলেট, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, ফেনী, ময়মনসিংহের পাহাড়ী এলাকা, ভাওয়াল ও মধুপুরের পাহাড়ী এলাকা সমূহের সৃষ্টি হয়েছিলো। চট্টগ্রাম, সিলেট, কুমিল্লা, ফেনী ও ময়মনসিংহের উত্তরাঞ্চলের পাহাড়ী এলাকাসমূহই বাংলাদেশের সবচেয়ে পুরোনো স্থলভূমি। এই পাহাড় এলাকাগুলোর সৃষ্টি হয়েছিল হিমালয় পর্বতমালা সৃষ্টি হওয়ার সাথে সাথেই।
এরপর কোটি কোটি বছর থেকে হিমালয়ের বিশাল পার্বত্য এলাকায় বৃষ্টি হচ্ছে আর দক্ষিণে সমুদ্রের দিকে নেমে আসছে অসংখ্য নদ-নদী। ফলে হিমালয় থেকে কোটি কোটি টন বালি মাটি নেমে আসছে প্রতি বছর নিম্ন এলাকায়। এমনিভাবে সৃষ্টি হয়েছে ভারত ও বাংলাদেশের বিশাল পলিমাটি এলাকা-এই পলল সমভূমি। এক কথায় সমতল ভূমির সৃষ্টি। সর্বশেষ গড়ে উঠেছে বাংলাদেশের পলিমাটি অঞ্চল। তাই এ অঞ্চলের বয়স সবচেয়ে কম। এই পলিমাটি অঞ্চল এখনো বেড়েই চলেছে। আজকের চাঁদপুর জেলার বেশিরভাগ অংশ সৃষ্টি হয়েছে হাজার দেড় হাজার বছর আগে।
ঐতিহ্যের স্মারক চাঁদপুরের রূপালী ইলিশ
ঐতিহ্য কথাটির আভিধানিক অর্থ হচ্ছে পুরুষানুক্রমিক ধারা বা পরম্পরাগত কথা বা প্রথা কিংবা কিংবদন্তি। ইংরেজিতে ঐতিহ্যকে ‘Tradition’ বলা হয়েছে। স্মারক শব্দের আভিধানিক অর্থ হচ্ছে স্মৃতির উদ্বোধক, যা মনে করিয়ে দেয়। ইংরেজিতে Memorial. আমাদের গর্ব ঐতিহ্যের স্মারক চাঁদপুরের রূপালী ইলিশ। ইলিশের কথা উঠলেই চাঁদপুরের কথা ওঠে। চাঁদপুরের কথা ওঠলেই ইলিশের কথা ওঠে। ইলিশ আর চাঁদপুর হরিহর আত্মা। চকচকে রূপালী ইলিশ আর চাঁদপুরের সখ্যতা হাজার বছরের প্রাচীন। বাংলা অঞ্চলের লোক সাহিত্য-সংস্কৃতিতে রূপালী ইলিশ অচ্ছেদ্য বন্ধনে সম্পৃক্ত। রূপালী ইলিশকে বাদ দিয়ে চাঁদপুরকে কল্পনা করা যায় না।
□ চাঁদপুরের ঐতিহ্য সবার সামনে তুলে ধরার প্রয়াসে নির্মিত রূপালী ইলিশ চত্ত্বর □
আমরা খুবই গর্ব অনুভব করি যখন দেখি ইলিশ বাংলাদেশের জাতীয় মাছ। দেশের অর্থনীতি এবং কর্মসংস্থানসহ আমিষ জাতীয় খাদ্য সরবরাহে ইলিশ অনন্য ভূমিকা পালন করে আসছে। বর্তমানে বার্ষিক প্রায় ২.৯ লাখ মে. টন ইলিশ উৎপাদিত হচ্ছে, যার বাজার মূল্য প্রায় ছয় হাজার কোটি টাকা। দেশে মোট মৎস্য উৎপাদনে একক প্রজাতি হিসেবে ইলিশের অবদান প্রায় শতকরা ১২ ভাগ। রূপালি ইলিশ খেতে যেমন সুস্বাদু, খাদ্যগুণেও তেমনি সমৃদ্ধ।
পদ্মা-মেঘনা মোহনায় ইলিশ দেখতে পাতলা কোমরের রূপালী মেয়ের মতোই সুন্দর। অপূর্ব দেহ সৌষ্ঠব আর মোহময়ী মিষ্টিগন্ধের জন্যে জগৎ বিখ্যাত। এ কথা হয়তো অনেকেই জানেন না, মেঘনা নদীর পানি গুণগত ক্ষেত্রে পৃথিবীর দ্বিতীয় সেরা। প্রবল সূর্যকিরণ আর নদীর গভীরতার জন্যে পদ্মা-মেঘনার মিলিত স্রোতধারায় এক ধরনের প্লাংটন জন্মে, যা হচ্ছে ইলিশের প্রিয় খাবার। এই প্লাংটনগুলো দু’প্রকার। উদ্ভিজ্জ প্লাংটন ও প্রাণীজ প্লাংটন। এ খাদ্য ও প্রজননের প্রয়োজনে ইলিশ সাগর থেকে ছুটে আসে পদ্মা-মেঘনায়।
□ ডাকাতির ভয় এখন নেই, অনেক হাঁটার পর তাই নিশ্চিন্তে ডাকাতিয়া নদীর তীরে এসে একটু জিরিয়ে নিলাম □
সম্ভবত এই নদী দিয়ে মগ-ফিরিঙ্গি জলদস্যুরা নোয়াখালী ও কুমিল্লা জেলায় প্রবেশ করতো। এই নদীতে তাদের মাধ্যমেই ডাকাতি হতো। ডাকাতির উপদ্রবের কারণে নদীটির নাম ডাকাতিয়া হয়েছে বলে ধারণা করা হয়।
ডাকাতিয়া নদীর নামকরণ নিয়ে লোকমুখে আরেকটি মতামত শোনা যায়, একসময় ডাকাতিয়া নদী তীব্র খরস্রোতা ছিল। মেঘনার এই শাখা নদী ডাকাতিয়ায় মেঘনার উত্তাল রূপ ফুটে উঠত। ফলে ডাকাতিয়ার করালগ্রাসে নদীর দুই পাড়ের মানুষ সর্বস্ব হারাত। ডাকাতিয়া পাড়ি দিতে গিয়ে বহু মানুষের সলিল সমাধিও ঘটেছে। ডাকাতের মতো সর্বগ্রাসী বলেই এর নাম হয়েছে ডাকাতিয়া।
□ শপথ ভাস্কর্য □
চাঁদপুর পৌরসভার আর্থিক সহায়তা ও ব্যবস্থাপনায় বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের পটভূমির শৈল্পিক ও আঙ্গিক ব্যঞ্জনায় মূর্ত স্বাধীনতা ভাস্কর্য ‘শপথ’ ২০০০ সালে চাঁদপুর শহরের প্রাণকেন্দ্রে নির্মিত হয়। এই ভাস্কর্যে মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের চেতনা ও চাঁদপুরের ঐতিহ্য রূপালী ইলিশের বিমূর্ত প্রতীক স্থান পেয়েছে।
□ অঙ্গীকার ভাস্কর্য □
চাঁদপুরের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত লেকের ওপর স্থাপিত একটি স্বাধীনতা ভাস্কর্য। চাঁদপুরের ২য় জেলা প্রশাসক জনাব এসএম শামসুল আলমের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে ‘অঙ্গীকার’ ভাস্কর্যটি নির্মিত হয়। প্রত্যহ বিকেল হতে সন্ধ্যা পর্যন্ত শহরের বিভিন্ন স্থান হতে এখানে প্রচুর লোকের সমাগম হয়। এ ভাস্কর্যের নয়নাভিরাম শিল্প-শৈলী শিল্প সমঝদারদের মুগ্ধ করে।
মোলহেড/ ‘রক্তধারা’
ডাকাতিয়া-মেঘনার সঙ্গমস্থলে অবস্থিত চাঁদপুর বড় স্টেশনের পশ্চিম পার্শ্বের ত্রিকোণাকার অংশটি মোল হেড নামে পরিচিত। এখানে দাঁড়ালে খুব স্পষ্টভাবে পশ্চিম দিগন্তে সূর্যাস্ত দর্শন করা যায়। ১৯২১ সনের এপ্রিল মাসে সিলেটের চা বাগানে কুলি বিদ্রোহ ও কর্মস্থল ত্যাগী শত শত চা শ্রমিকের ওপর তৎকালীন ব্রিটিশ সরকারের পুলিশ বাহিনীর গুলিতে এখানে শতাধিক চা শ্রমিক শহীদ হয়।
□‘রক্তধারা’ স্মৃতিসৌধ এর সামনে ক্লান্ত আমি ঠিকদুপুর বেলায়, রাতের বেলায় এই স্মৃতিসৌধ -এর সৌন্দর্য অনেকগুন বেড়ে যায়। □
১৯৭১ সনে এখানে পাক সেনাবাহিনী শত শত মুক্তিকামী মানুষকে হত্যা করে লাশ মেঘনার পানিতে ভাসিয়ে দেয়। মোলহেডে বর্তমান সময়ে ‘রক্তধারা’ নামে একটি স্মৃতিসৌধ নির্মিত হয়েছে। মোলহেড হতে পারে দেশের অন্যতম সুন্দর ঐতিহ্যবাহী পর্যটন তীর্থ।
□ তিন মোহনার অপার সৌন্দর্যে বিমুহিত হয়ে সবা্ই দেখি তীব্র রোদ উপেক্ষা করেও ছবি তুলছে,তবে আমিও বাদ যাব কেন, বসে পড়লাম দুপুরের তপ্ত রোদের মধ্যে □
□ চাঁদপুর সদরে ওয়ান মিনিটের বিখ্যাত তাৎক্ষনাত তৈরি আইসক্রিম □
সারাদিনের ঘুরাঘুরি শেষ করে সমস্ত ক্লান্তি দুর করতে আপনি যেতে পারেন চাঁদপুর নতুন বাজারে অবস্থিত ঐতিহ্যবাহী মিষ্টি ও দধির দোখানে। বিদুৎ থাকা সাপেক্ষে আপনার সামনে জটপট এক মিনিটে তৈরি করে দিবে মজাদার স্বাধের কাপ ভর্তি আইসক্রিম । যার প্রতিটি শীতল স্পর্শে আপনার হৃদয় জয় করবে। প্রতি কাপ আইসক্রিম এর দাম পড়বে বিশ টাকা। পুরা চাঁদপুর সদরে ওয়ান মিনিটের আইসক্রিম খুব জনপ্রিয়। অনেক দুর-দুরান্ত থেকে মানুষ এই আইসক্রিম খেতে আসেন। আমার ভালো লেগেছে আশা রাখি আপনার ও ভালো লাগবে।
□ আইসক্রিম তৈরি করার মেশিন □
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে জুন, ২০২০ বিকাল ৩:৩৬