এশিয়া মহাদেশে এই রকম জাদুঘর আছে দু’টি। একটি সুদূর জাপান দেশে অবস্থিত অন্যটি আমাদের সবুঝ শ্যামল বাংলাদেশে। চট্টগ্রাম নগরীর আগ্রাবাদে উচুঁ উচুঁ সব বড় বড় অট্টালিকার ভিড়ে দেশের একমাত্র জাতিতাত্ত্বিক জাদুঘরটির অবস্থান। চারপাশের মনোরম সবুজের অনাবিল সৌন্দর্য। পিছনে ফেলে আসা হাজার বছরের ইতিহাস আর ঐতিহ্য বহন করে আছে আগ্রাবাদে অবস্থিত জাতিতাত্ত্বিক জাদুঘরটি। এই জাতিতাত্ত্বিক জাদুঘরে রয়েছে বাংলাদেশের ২৯টি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর নিদর্শন। সাথে ভারত, পাকিস্তান ও অস্ট্রেলিয়ার নৃতাত্ত্বিক নানা নিদর্শন। যা আপনার জ্ঞানের পরিধি বিস্তার করবে অনেকখানি। অনেক অজানা বিষয় জানা যাবে সবগুলো গ্যালারি পরিদর্শন শেষ করে। আমাদের বাংলাদেশের নৃগোষ্ঠীগুলোর জীবনচিত্র এখানে দারুণভাবে সংগৃহীত হয়েছে। তাদের ব্যবহার্য পোশাক, গয়না, খাবার, কাজ সব মিলিয়ে প্রত্যেকটি নৃগোষ্ঠীর আলাদা আলাদা ঐতিহ্য আর সংস্কৃতি রয়েছে। যা আমাদের পরবর্তী প্রজন্মকে এই নৃগোষ্ঠীগুলোর জীবনাচরণ সর্ম্পকে জানতে সাহায্য করবে।
■ জাতিতাত্ত্বিক জাদুঘরের একটি কক্ষে রাঙামাটির ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী চাকমা সম্প্রদায়ের ঘরোয়া জীবন তুলে ধরা হয়েছে ■
বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর জীবনযাপন, সাংস্কৃতিক আচার, ঐতিহ্যের নমুনা সংরক্ষণের উদ্দেশ্যেই এই জাদুঘরের প্রতিষ্ঠা হয়েছে। ১৯৬৫ সালে নির্মিত জাদুঘরটি ১৯৭৪ সালে সাধারণ দর্শনার্থীদের জন্য উন্মুক্ত হয়। বর্তমানে জাদুঘরটিতে বাংলাদেশের ২৩টি জাতিগোষ্ঠীর পাশাপাশি পাকিস্তানের কয়েকটি জাতিগোষ্ঠীর নিদর্শন রয়েছে। বাঙালি জাতিসহ বিভিন্ন ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক জাতিগোষ্ঠীর জীবনযাপন, সাংস্কৃতিক আচার, পোশাক, অলংকারের নিদর্শন রয়েছে এতে। আলোকচিত্র, মডেল, নমুনার মাধ্যমে জাতিগোষ্ঠীগুলোর নিজস্বতা তুলে ধরা হয়েছে।
১ দশমিক ৩৭ একর জমির ওপর প্রতিষ্ঠিত জাদুঘরটিতে মোট ১১টি কক্ষ রয়েছে। এক নম্বর গ্যালারির প্রথম কক্ষে রয়েছে বাঙালি জাতিগোষ্ঠীর সংস্কৃতি, জীবনযাপনের বিভিন্ন চিত্র ও নমুনা। দ্বিতীয় কক্ষে উপস্থাপন করা আছে পাকিস্তানের পাঠান, পাঞ্জাবসহ চারটি জাতির পোশাক, হস্তশিল্প, অস্ত্র, বাদ্যযন্ত্রের নমুনা। জাদুঘরের কেন্দ্রীয় গ্যালারিতে রয়েছে বিভিন্ন জাতির ব্যবহৃত অলংকারের নিদর্শন। বাকি কক্ষগুলোতে বাংলাদেশের বিভিন্ন ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক জাতিগোষ্ঠীকে তুলে ধরা হয়েছে। বর্তমানে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর ৩ হাজার ২০০–এর মতো নিদর্শন আছে জাদুঘরটিতে।
জাদুঘরটি পাঁচ দশক পেরোলেও এর পূর্ণাঙ্গতা নিয়ে হতাশা রয়েছে বিশেষজ্ঞ ও দর্শনার্থীদের। জাতিতাত্ত্বিক জাদুঘর একটি বিশেষায়িত জাদুঘর। কিন্তু বাংলাদেশে এ ধরনের একটি জাদুঘর চালানোর মতো প্রয়োজনীয় লোকবল আছে কি না এটি একটি বড় প্রশ্ন। জাতিতত্ত্ব নৃবিজ্ঞান–সংশ্লিষ্ট বিষয়। অথচ এটি প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের অধীনে আছে। জাদুঘরটিতে যেসব নিদর্শন রয়েছে বছরের পর বছর ধরে একইভাবে প্রদর্শন করা হচ্ছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে প্রদর্শন–ব্যবস্থায় নতুনত্ব আনা উচিত।
জাদুঘরটিতে বাঙালি, চাকমা, মারমা, মুরং, সাঁওতাল, খাসিয়া, গারো, চাক, পালিয়া, কোচ, হদি, চাম্পুরা, খুমি, খ্যাংসহ বিভিন্ন জাতির সংস্কৃতি-ঐতিহ্যের বিভিন্ন নিদর্শন রয়েছে। আবার ওঁরাও, মান্দাই, রাজবংশী বা হাজং জাতির নিদর্শন বলতে শুধু কয়েকটি আলোকচিত্র দেয়ালে সাঁটানো অবস্থায় আছে।
একটি দেশের সংস্কৃতির বৈচিত্র্য যথাযথভাবে উপস্থাপন এবং সংরক্ষণের জন্য জাতিতাত্ত্বিক জাদুঘরের একটি বড় ধরনের ভূমিকা রয়েছে। সে বিবেচনায় চট্টগ্রামের জাতিতাত্ত্বিক জাদুঘরের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু যথাযথ উপস্থাপনা ও সংরক্ষণের বিষয়টি বিবেচনায় নিলে বলতে হয়, জাদুঘরটি কোনো কোনো ক্ষেত্রে খণ্ডিত ও অপর্যাপ্তভাবে তার দায়িত্ব পালন করছে। সংখ্যায় হয়তো অনেক জাতিগোষ্ঠী উপস্থাপন করা হয়েছে। কিন্তু একটি জাতির সামগ্রিকতার জায়গা থেকে এটি একেবারেই অপর্যাপ্ত।
গত ডিসেম্বরে জাদুঘরটির সামনের বাগান দর্শনার্থীদের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়েছে। এতে জাদুঘরে দর্শনার্থী আসার সংখ্যাও বেড়েছে। জাদুঘরের মূল ফটকের সঙ্গে লাগোয়া একটি টিকিট কাউন্টারও চালু হয়েছে।
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে জুন, ২০২১ বিকাল ৩:৩৯