somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

⌂ শীতের পাখি পরিচিতি » হাঁস ■ রঙ বেরঙের শীতের পরিযায়ী পাখি » পর্ব- ৩

১৯ শে ডিসেম্বর, ২০১৭ সকাল ১০:২৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


হাজার হাজার মাইল পাড়ি দিতে তাদের কোন ক্লান্তি নেই। একটু নিরাপদে বেচেঁ থাকার জন্য সেই সুদূর সাইবেরিয়া কিংবা আরো দূরের দেশ থেকে শীতের সময়ে আমাদের এই সবুঝ দেশে তাদের আগমন হয় ঝাঁকে ঝাঁকে। তাদের সৌন্দেয্যে পাখি প্রেমী মানুষ গুলো হয় আনন্দিত। পৃথিবীটা যেন তাদের হাতের মুঠোয়। পাখিদের আকাশে কোন সীমানারেখা নেই। নেই কোন বাধা-বিপত্তি। আর কথা না বাড়িয়ে চলুন আপনাদের পরিচয় করিয়ে দিই এমন কিছু পরিযায়ী পাখিদের সাথে …
● পাতারি হাঁস বা পাতি তিলিহাঁস


● মেটে রাজহাঁস বা ধূসর রাজহাঁস


● বড় ধলাকপাল রাজহাঁস


● গিরিয়া হাঁস বা জিরিয়া হাঁস


● পাতি মার্গেঞ্জার বা সরুঠোঁট ডুবুরি হাঁস


● কালো হাঁস


● নীলমাথা হাঁস

শীতের আকাশ জুড়ে থাকে পরিযায়ী পাখির আগমনী ডানা ঝাপটানোর শব্দ। সে শব্দ খোলা আকাশের নিচে নিস্তব্ধ রাতে অনুভব করা যায়। আকাশ পরিষ্কার থাকলে বা পূর্ণিমার রাত হলে দেখাও যায় দৃষ্টিনন্দন লম্বা হাঁসের ঝাঁক শিকলের মতো জড়ো হয়ে উড়ছে রাতের আকাশে। বেশিরভাগ পরিয়ায়ী পাখি পরিভ্রমণের জন্য রাতকেই বেছে নেয়। চলুন আজ আপনাদের সাথে পরিচয় করিযে দিবো এমন আরো কিছু পরিযায়ী পাখির সাথে –


● বড় ধলাকপাল রাজহাঁস

বড় ধলাকপাল রাজহাঁস (Anser albifrons) (ইংরেজি Greater White-fronted Goose ) অ্যান্টিডি পরিবারের অন্তর্গত এক ধরনের হাস। এরা দেখতে অনেকটা ছোট ধলাকপাল রাজহাঁসের মতো। এরা বাংলাদেশের পরিযায়ী পাখিদের অন্তর্ভুক্ত। বড় ধলাকপাল রাজহাঁসের ৫টি উপ প্রজাতি আছে। এর মধ্যে বাংলাদেশে আসে albifrons


বড় ধলাকপাল রাজহাঁস লম্বায় ২৫ থেকে ৩২ ইঞ্চি হয়ে থাকে। পরিযায়ী স্বভাব এর জন্য এদের লম্বা পাখা আছে যার দৈর্ঘ্য ৫১ থেকে ৬৫ ইঞ্চি। এদের ওজন সাধারনত ১.৯৩ থেকে ৩.৩১ কে জি হতে পারে। এদের চোখের সামনে সাদা পালকের দাগ থাকে। এদের উজ্জ্বল কমলা রঙের পা আছে। উপরের পাখনার রঙ ধূসর বর্ণের। এরা দৈর্ঘ্যে মেটে হাস থেকে ছোট কিন্তু ছোট ধলাকপাল রাজহাঁস থেকে বড়। পুরুষ ও স্ত্রী উভয়েই গোলাপি সদৃশ চোখ আছে।


বার্ষিক প্রজননের সাফল্যের জন্য এরা আবহাওয়ার উপর নির্ভরশীল। আর্কটিক অঞ্চলে বাসা বানানো , ডিমে তা দেয়া এবং বাচ্চাদের বড় করার জন্য খুবই কম সময় থাকে। সাধারনত তিন মাস যা শুরু হয় মে এর শেষে বা জুনের শুরুতে এবং শেষ হয় সেপ্টেম্ভরের প্রথমে।


● গিরিয়া হাঁস বা জিরিয়া হাঁস

গিরিয়া হাঁস (বৈজ্ঞানিক নাম: Anas querquedula) বা জিরিয়া হাঁস Anatidae (অ্যানাটিডি) গোত্র বা পরিবারের অন্তর্গত Anas (অ্যানাস) গণের অন্তর্ভুক্ত এক প্রজাতির পরিযায়ী হাঁস। পাখিটি বাংলাদেশ, ভারত ছাড়াও ইউরোপ, আফ্রিকা, উত্তর আমেরিকা, ওশেনিয়া ও এশিয়ার বিভিন্ন দেশে দেখা যায়। ইউরোপ ও পশ্চিম এশিয়া এদের প্রধান প্রজননস্থল। শীতকালে এসব অঞ্চল থেকে ভারতীয় উপমহাদেশ, অস্ট্রেলেশিয়া ও আফ্রিকায় এরা পরিযান করে।

গিরিয়া হাঁসের বৈজ্ঞানিক নামের অর্থই হাঁস (লাতিন: anas = হাঁস; querquedula = এক প্রকারের হাঁস)। সারা পৃথিবীতে এক বিশাল এলাকা জুড়ে এরা বিস্তৃত, প্রায় ১ কোটি ৬৯ লক্ষ বর্গ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে এদের আবাস। বিগত কয়েক দশক ধরে এদের সংখ্যা ক্রমেই কমছে, তবে এখনও আশঙ্কাজনক পর্যায়ে যেয়ে পৌঁছেনি। সেকারণে আই. ইউ. সি. এন. এই প্রজাতিটিকে ন্যূনতম বিপদগ্রস্ত বলে ঘোষণা করেছে। বাংলাদেশের বন্যপ্রাণী আইনে এই প্রজাতিটি সংরক্ষিত। শ্রেণীবিন্যাসবিদ্যার জনক ক্যারোলাস লিনিয়াস ১৭৫৮ সালে সর্বপ্রথম এই প্রজাতিটি বর্ণনা করেন।


গিরিয়া হাঁস দেখতে ছোট আকারের । পুরুষ হাঁসটির মাথা ও বুক বাদামী বর্ণের । চোখের উপর সাদা সীমানাযুক্ত অর্ধাকৃতির দাগ দেখতে পাওয়া যায় । এদের পালক খয়েরী রঙের হয় । ঠোঁট ও পা দেখতে খয়েরী । ডানার নিচের অংশ সাদা সীমানাযুক্ত হালকা নীল । মাথার উপরের অংশ গাঢ় বর্ণের হয় । মুখ লালচে বাদামী । স্ত্রী হাঁসটি দেখতে অনেকটা পাতি তিলিহাঁসের মতো । স্ত্রী হাঁসটির মুখের আকার ও পানিতে ডুব দিয়ে বারবার মাথা ঝাঁকানো দেখে এদের আলাদা করা যায় । এরা দেখতে বাদামী বর্ণের । পা খয়েরী রঙের । ঠোঁট সাধারনত লম্বা হয় । চোখের ভ্রু ফেকাশে ।


গিরিয়া হাঁস ভূচর স্বভাবের । দলবদ্ধভাবে বসবাস করে এবং অপ্রজননকালীন মৌসুমে বিশাল বিশাল দলে বিচরণ করে। বড় বড় সংরক্ষিত জলাশয়ে এদের সহজে দেখা যায়। এরা লোনাপানি ও মিঠাপানি উভয়তেই বাস করতে পারে । প্রজনন মৌসুমে এরা প্রচুর ভাসমান জলজ উদ্ভিদ পাওয়া যায় এমন ছোট পুকুর বা লেকে থাকতে পছন্দ করে । অন্যান্য সময় স্বাদু পানির জলাভূমি যেখানে প্রচুর ভাসমান জলজ উদ্ভিদ থাকে সেখানে এদের দেখতে পাওয়া যায় । এদের দুটি প্রজনন সময়কাল আছে – বসন্ত ও গ্রীষ্ম । এসময় এরা সর্বভুক স্বভাবের হয় । এদের খাদ্য তালিকায় আছে শামুক, জলজ পোকামাকড় এবং তাদের লার্ভা , কেঁচো, ছোট ব্যাঙ , ছোট মাছ , উদ্ভিদের বিভিন্ন অংশ যেমন বীজ, মূল, কাণ্ড, পাতা ইত্যাদি । অন্যান্য সময় এরা শাকাহারী ।

গিরিয়া হাঁসের প্রজনন মৌসুমের একটি শুরু হয় বসন্তে ও অন্যটি শুরু হয় গ্রীষ্মে । এরা এমন ভাবে বাসা বানায় যাতে তা চিহ্নিত না করা যায় । এরা জমিতে বাসা বানায় । স্ত্রী হাঁস ৪ থেকে ৯ টি ডিম পাড়ে । ডিম ফুটে বাচ্চা বের হতে সময় লাগে ২১ থেকে ২৩ দিন । জন্মের ৩৫ থেকে ৪০ দিনের মধ্যে বাচ্চাদের পাখা গজায় ।


● কালো হাঁস বা ঝুঁটি হাঁস:

কালো হাঁস বা ঝুঁটি হাঁস Anatidae (অ্যানাটিডি) গোত্রের অন্তর্গত Aythya গণের মাঝারি আকৃতির এক প্রজাতির ডুবুরি হাঁস। সারা পৃথিবীতে এক বিশাল এলাকা জুড়ে এদের আবাস, প্রায় ২ কোটি ৪ লাখ বর্গ কিলোমিটার। গত কয়েক দশক ধরে এদের সংখ্যা কমে গেলেও আশঙ্কাজনক পর্যায়ে যেয়ে পৌঁছায় নি। সেকারণে আই. ইউ. সি. এন. কালো হাঁসকে Least Concern বা আশঙ্কাহীন প্রজাতি হিসেবে তালিকাভুক্ত করেছে। বিশ্বে ২৬ লাখ থেকে ২৯ লাখ পূর্ণবয়স্ক কাল হাঁস আছে।

বিস্তৃতি
প্রায় সমগ্র ইউরেশিয়া ও আফ্রিকার কিছু কিছু অঞ্চল পর্যন্ত এদের বিস্তৃতি। স্বভাবে এরা প্রধানত পরিযায়ী। তবে মধ্য ও উত্তর-পশ্চিম ইউরোপে কালো হাঁস সাধারণত স্থায়ী। বাংলাদেশ আর ভারতে যে কালো হাঁস দেখা যায় তারা পরিযায়ী হয়ে আসে। শীতের সময়ে ভূমধ্যসাগর, কৃষ্ণ সাগর, উত্তর-পশ্চিম ইউরোপ আর এশিয়ার পশ্চিমাংশে এদের সবচেয়ে বড় দলগুলোর দেখা মেলে।


বিবরণ
পূর্ণবয়স্ক পুরুষ কালো হাঁস একমাত্র মাঝারি হাঁস যাকে দেখতে সাদাকালো মনে হয়। পুরুষ হাঁসের সারা দেহ কালো, কেবল পেটের দিক ও ডানার নিচের দিক বাদ দিয়ে যা ধবধবে সাদা। এছাড়া কপোলের ক্ষুদে ক্ষুদে পালকগুলো কাল, তবে রোদ বা আলো পড়লে চিক চিক করে। পুরুষ হাঁসের ঘাড়ের উপর নুইয়ে পড়া ঝুঁটি থাকে। স্ত্রী হাঁসের আকৃতি পুরুষ হাঁসের মতই, তবে পালক বাদামী বা তামাটে মেশানো বাদামী। উভয় হাঁসেরই চঞ্চু নীলচে-ধূসর, চঞ্চুর সম্মুখভাগে ত্রিকোণাকৃতির কালো দাগ থাকে। স্ত্রী হাঁসের চঞ্চুর নিচের কিছু পালক সাদা। এরা দৈর্ঘ্যে কমবেশি ৪৩ সেন্টিমিটার পর্যন্ত হয়। ওজন ৭০০ গ্রাম থেকে ১.১ কিলোগ্রাম পর্যন্ত হয়।

তৃণসম্বৃদ্ধ নিম্নভূমি ও জলাশয় কালো হাঁসের প্রিয় আবাস। বিশেষত যেসব জলাশয়ের গভীরতা ৩-৫ মিটার সেসব জলাশয়ে এরা বসবাস করে, ১৫ মিটারের বেশি গভীর জলাশয় এড়িয়ে চলে। মিঠাপানির হ্রদ, বড় বিল ও দিঘী, কম স্রোতসম্পন্ন প্রশস্ত নদী, জনহীন চর, উপযুক্ত আবাসযুক্ত উপকূলীয় এলাকা, সামুদ্রিক দ্বীপ এবং মোহনাগুলোতে এদের প্রায়ই দেখা যায়। স্বাভাবিক বাসস্থানের পানি যদি জমে বরফ হয়ে যায় বা এরকম বড়সড় বিপদের সম্মুখীন হলেই কেবল কালো হাঁস শক্তিশালী স্রোতযুক্ত জলাশয় বা গভীর সমুদ্রে নামে।

আচরণ ও প্রজনন
কেবল মধ্য ও উত্তর-পশ্চিম ইউরোপে কালো হাঁস সাধারণত স্থায়ী, পরিযায়ী নয়। অন্যান্য অঞ্চলের হাঁস অধিকাংশই পরিযায়ী স্বভাবের। পরিযায়ী হাঁসেরা এপ্রিলের শেষে প্রজনন অঞ্চলে ফিরে আসে। এসময় এরা পৃথক জোড়ায় অথবা ছাড়াছাড়া ভাবে একই দলে ঘুরে বেড়ায়। এসময় এরা বাসা বানায় ও ডিম পাড়ে। স্ত্রী হাঁস বাসায় ৬ থেকে ১৪টি সবজে-ধূসর ডিম পাড়ে। শুধুমাত্র স্ত্রী হাঁস ডিমে তা দেয়। ডিম পাড়ার ২৩-২৫ দিন পর ডিম ফুটে ছানা বের হয়।


কালো হাঁসের ছানা
অনেকসময় একই জলাশয়ে শ’খানেক বাসা দেখা যায়, যদিও বাসাগুলো কলোনি করে থাকে না। ডিম ফুটে গেলে পুরুষ হাঁসেরা দল বেঁধে উষ্ণতর অঞ্চলে চলে যায়। এটা জুনের শেষ থেকে সেপ্টেম্বরের শুরু পর্যন্ত ঘটে। স্ত্রী হাঁসের পরিযায়ন প্রায় এক মাস পরে ঘটে। শীতের সময়ে অত্যধীক দলবদ্ধভাবে থাকে, একেকটি দলে হাজারের মত সদস্য একসাথে ঘুরে বেড়ায়।

বাসা
কালো হাঁসেরা তৃণ দিয়ে বাসা বানায়। পানিতে ভাসমান অবস্থায়, উঁচু ঘাসসমৃদ্ধ ভূমিতে অথবা দ্বীপে এরা বাসা করে। অনেকসময় গঙ্গাকবুতর ও গাংচিলের সাথে উন্মুক্ত ভূমিতেও বাসা বানায়, বিশেষ করে শিকারীর হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য। বাসা ডাঙায় হলে তা সাধারণত পানির খুব কাছে হয়।

খাদ্যাভ্যাস
কালো হাঁস পানিতে ডুব দিয়ে শামুক, ঝিনুক, গুগলি ও অন্যান্য মলাস্ক খায়, এগুলো এদের প্রধান খাদ্য। এছাড়া এরা জলজ উদ্ভিদের বীজ ও মূলও খায়। পানিতে ভাসমান পোকামাকড়, উদ্ভিদ ও জলজ আগাছা এদের খাদ্য। কালো হাঁস পানির গভীরের জলজ পোকামাকড়, উভচর ও ছোট মাছ খায়।


● পাতি মার্গেঞ্জার বা সরুঠোঁট ডুবুরি হাঁস :

পাতি মার্গেঞ্জার বা সরুঠোঁট ডুবুরি হাঁস (Mergus merganser) ( ইংরেজি Common Merganser) অ্যানাটিডি পরিবারের মারগাস গণের এক প্রজাতির ডুবুরি হাঁস । এরা বাংলাদেশের পরিযায়ী পাখি । বর্তমানে এরা বাংলাদেশে অনিয়মিত । শীতকালে এদের বাংলাদেশের ঢাকা অঞ্চলে দেখতে পাওয়া যায় । একসময় এদের সিলেট অঞ্চলেও দেখতে পাওয়া যেত ।


পাতি মার্গেঞ্জার আকারে বড় হয় ।এরা নীলমাথা হাঁস থেকে আকারে কিছুটা বড় । এদের দৈর্ঘ্য ২১.৩ থেকে ২৮ ইঞ্চি হয়ে থাকে । পাখার বিস্তৃতি ৩১ থেকে ৩৮ ইঞ্চি । এদের ওজন সাধারনত ৯০০ থেকে ২১৬০ গ্রাম হয়ে থাকে । এদের ঠোঁট সোজা ও চিকন হয়ে থাকে । পুরুষ পাখিটির দেহের রঙ পরিস্কার সাদা । মাথা সবুজ রঙের । ঠোঁট দেখতে লাল । দেহের পিছনের অংশ কালো । এদের পাখার উপরের অংশ কালো এবং নিচের অংশ সাদা । স্ত্রী পাখিটি আকারে পুরুষ পাখি থেকে ছোট হয় । এদের দেহের রঙ ধূসর । বুকের রঙ সাদা । মাথা দেখতে লালাভ বাদামী । পা ও পায়ের পাতা কমলা । ঠোঁট লাল রঙের । অপ্রাপ্তবয়স্ক পাখি দেখতে স্ত্রী পাখির মতো ।


পাতি মার্গেঞ্জারকে সাধারনত স্বাদুপানির নদী ও লেকে দেখতে পাওয়া যায় । লোনাপানি থেকে স্বাদুপানিতে এরা বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে । তবে শীতে ও প্রজনন মৌসুমে এদের মাঝে মধ্যে উপকূলীয় অঞ্চল ও লোনাপানির মোহনায় দেখা যায় । এরা সাধারনত বড় গাছের গর্তে বাসা বানায় । তাই এদের গভীর জঙ্গলেও দেখতে পাওয়া যায় ।


পাতি মার্গেঞ্জার এক প্রজাতির ডুবুরি পাখি । এরা গভীর পানিতে ডুব দিয়ে মাছ শিকার করে । এরা একবার ডুব দিয়ে প্রায় ২ মিনিট থাকতে পারে । এরা মাছ ছাড়াও অন্যান্য জলজ প্রাণী শিকার করে । এদের খাবারে তালিকায় আছে বিভিন্ন ধরনের অমেরুদণ্ডী প্রাণী যেমন শামুক , চিংড়ি, কেঁচো, পোকার লার্ভা ,বিভিন্ন ধরনের উভচর প্রাণী যেমন ব্যাঙ ইত্যাদি । এছাড়াও এরা ছোট স্তন্যপায়ী প্রাণী , ছোটপাখি ও উদ্ভিদ খেয়ে থাকে ।


এই প্রজাতির পাখিরা বড় গাছের গর্তে বাসা বানায় যার উচ্চতা সাধারনত ১০০ ফিট হয়ে থাকে । মাঝে মধ্যে এদের জমিতেও বাসা বানাতে দেখা যায় । স্ত্রী পাখি একসাথে ৬ থেকে ১৭টি ডিম পাড়ে । ডিমগুলো দেখতে সাদা রঙের । ডিমগুলোতে স্ত্রী পাখি একাই তা দেয় । ডিম ফুটে বাচ্চা বের হতে সময় লাগে ২৮ থেকে ৩৫ দিন ।


● মেটে রাজহাঁস বা ধূসর রাজহাঁস :
এ দেশের বিরল পরিযায়ী পাখি ধূসর রাজহাঁস (Greylag Goose)। মেটে রাজহাঁস নামেও পরিচিত। Anatidae গোত্রের পাখিটির বৈজ্ঞানিক নাম anser anser ।


পৃথিবীতে এই প্রজাতির ৩ টি উপপ্রজাতি আছে। এ গুলো হল -
• anser
• rubrirostris
• domesticus


ঠোঁটের আগা থেকে লেজের ডগা পর্যন্ত ধূসর রাজহাঁস ৭৫-৯১ সেন্টিমিটার লম্বা। দৈহিক ওজন ৩.০-৩.৩ কিলোগ্রাম। দেহের রং ধূসরাভ-বাদামি। ভালো করে লক্ষ করলে পিঠে ক্ষুদ্র ডোরা দেখা যায়। মাথা ও গলার রং হালকা ছাই। বুক ও পেট হালকা বাদামি ও তাতে ছোট ছোট কালো ফোঁটা। লেজের তলা ও ওপরটা সাদা। চ্যাপ্টা ও বড় লালচে-গোলাপি ঠোঁট। চোখ বাদামি। পায়ের পাতা ও নখ গোলাপি এবং তাতে কাঁচা মাংসের মতো আভা। স্ত্রী-পুরুষ দেখতে একই রকম, তবে আকারে পুরুষ কিছুটা বড়। অপ্রাপ্তবয়স্কগুলোর বুক-পেটে কালো ফোঁটা নেই এবং পায়ের রং ধূসর।


ধূসর রাজহাঁস মূলত শীতপ্রধান আইসল্যান্ড, স্কটল্যান্ড, ফিনল্যান্ড, জার্মানি, স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশসমূহ, পোল্যান্ড, রাশিয়া (সাইবেরিয়া), মধ্য এশিয়া প্রভৃতি দেশের বাসিন্দা। শীতকালে চট্টগ্রাম ও বরিশাল বিভাগের বিভিন্ন চরাঞ্চল ও উপকূলীয় এলাকায় এবং সিলেট বিভাগের হাওর-বিলে দেখা মেলে। কদাচ ঢাকা বিভাগের কোনো কোনো জলাশয়েও দেখা যায়। এরা সাধারণত জলাবদ্ধ নিচু ভূমি, চরের সদ্য গজানো তৃণভূমি, সদ্য কাটা শস্যখেতে দলবদ্ধভাবে বিচরণ করে। পানির নিচে ঠোঁট ডুবিয়ে খাবার খোঁজে। ঘাস, জলজ আগাছা, শস্যের কচি ডগা, শামুক-গুগলি প্রভৃতি খায়। মূলত দিনে সক্রিয় থাকে, তবে পূর্ণিমা রাতেও সক্রিয় থাকতে দেখা যায়।


এপ্রিল-মে মাস প্রজননকাল। আমাদের দেশে যে প্রজাতির ধূসর রাজহাঁস আসে, এরা মধ্য এশিয়া ও সাইবেরিয়ায় প্রজনন করে। স্ত্রী-পুরুষ সারা জীবনের জন্য জোড় বাঁধে। নলবন, ঝোপঝাড় বা পানিতে ভাসমান জলজ উদ্ভিদের মধ্যে বাসা বানায়। ডিম পাড়ে ৪-৬টি। ডিমের রং ক্রিম-সাদা। স্ত্রী একাই ডিমে তা দেয় ও ২৭-২৮ দিনে ডিম ফোটে। বাবা-মা দুজনে মিলেই বাচ্চাদের যত্ন নেয়। বাচ্চাদের দেহের পালক পুরোপুরি গজাতে ৮-৯ সপ্তাহ সময় লাগে। তবে আকাশে উড়তে আরও কিছুদিন অপেক্ষা করতে হয়। শীতের পরিযায়নে এরা বাবা-মায়ের সঙ্গে একই দলে অংশ নেয়।


● নীলমাথা হাঁস

নীলমাথা হাঁস বা নীলশির (Anas platyrhynchos) (ইংরেজি Mallard ) অ্যানাটিডি পরিবারের অ্যানাস গণের এক ধরনের বিরল হাঁস । এরা বাংলাদেশের পরিযায়ী পাখি । শীতকালে এদের বাংলাদেশের ঢাকা বরিশাল ও সিলেট অঞ্চলে দেখা যায় ।

নীলমাথা হাঁস মধ্যম আকারের জলজ হাঁস । এরা লম্বায় ২০ থেকে ২৬ ইঞ্চি হতে পারে । পাখার দৈর্ঘ্য ১০.১ থেকে ১২ ইঞ্চি হয়ে থাকে । পাখার বিস্তৃতি ৩২ থেকে ৩৯ ইঞ্চি হয় । এরা ওজনে ০.৭২ থেকে ১.৫৮ কে জি হতে পারে । এদের ঠোঁটের দৈর্ঘ্য ১.৭ থেকে ২.৪ ইঞ্চি এবং গোড়ালির দৈর্ঘ্য ১.৬ থেকে ১.৯ ইঞ্চি হয়ে থাকে । পুরুষ হাঁসটির মাথা চকচকে সবুজ রঙের । বুক দেখতে বেগুনি আভাযুক্ত বাদামী বর্ণের । এদের ডানা খয়েরী বাদামী রঙের হয়ে থাকে । পেট ধূসর খয়েরী । এদের পিছনের অংশ কালো এবং এর সাথে সাদা সীমানাযুক্ত গাঢ় লেজ থাকে । এদের লেজ কোঁকড়ানো থাকে । ঠোঁট হলুদাভ কমলা সাথে কালো ফোঁটা আছে । স্ত্রী হাঁসটির সারা গায়ে বাদামী ছোপ ছোপ থাকে। এদের ঠোঁট কালো ও কমলা । বুক বাদামী বর্ণের । স্ত্রী হাঁসটির লেজ সোজা থাকে । স্ত্রী পুরুষ উভয়েরই ডানার নিচের অংশ দেখতে বেগুনি নীল যা সাধারনত বিস্রামের বা উড়ার সময় দেখতে পাওয়া যায় ।


নীলমাথা হাঁস সর্বভুক স্বভাবের । এদের খাদ্য তালিকার প্রধান অংশ জুড়ে আছে শামুক জাতীয় প্রাণী , অমেরুদণ্ডী প্রাণী যেমন গোবরে পোকা , মাছি, ফড়িং, প্রজাপতি, এবং বিভিন্ন উদ্ভিদ অংশ যেমন বীজ মূল কাণ্ড ইত্যাদি । কিছু সমীক্ষায় দেখা গেছে যে এরা ব্যাঙ ও খায় । এরা জলাভূমিতে থাকতে পছন্দ করে । পানিতে ডুব দিয়ে এবং মাঠে চরে খাদ্য সংগ্রহ করে । এরা নদীর তীরে বাসা বানায় । এরা এক সাথে মিলে চলাফেরা করতে পছন্দ করে ।


প্রজনন মৌসুমে এরা জোড়ায় জোড়ায় থাকে । এদের প্রজনন মৌসুম হল অক্টোবর এবং নভেম্বর । স্ত্রী হাঁস তার নিজ ওজনের অর্ধেক ওজনের সমান ডিম পাড়ে । এজন্য তাকে প্রচুর বিশ্রাম নিতে হয় । এরা সুরক্ষিত স্থানে বাসা বানায় যা শিকারির নজর থেকে দূরে থাকে । স্ত্রী হাঁস এক সাথে ৮ থেকে ১৩ টি ডিম পাড়ে । ডিমে তা এরা একাই দিয়ে থাকে । ডিম ফুটে বাচ্চা বের হতে সময় নায় ২৭ থেকে ২৮ দিন । জন্মের পর থেকে বাচ্চারা মায়ের সাথেই থাকে ।


● পাতারি হাঁস বা পাতি তিলিহাঁস :

পাতি তিলিহাঁস (বৈজ্ঞানিক নাম: Anas crecca) ইংরেজি নাম: Eurasian Teal বা পাতারি হাঁস Anatidae (অ্যানাটিডি) গোত্র বা পরিবারের অন্তর্গত Anas (অ্যানাস) গণের অন্তর্ভুক্ত এক প্রজাতির পরিযায়ী হাঁস। পাখিটি বাংলাদেশ, ভারত ছাড়াও ইউরোপ, আফ্রিকা, উত্তর আমেরিকা ও এশিয়ার বিভিন্ন দেশে দেখা যায়।


পাতি তিলিহাঁসের বৈজ্ঞানিক নামের অর্থ সবুজডানা হাঁস (লাতিন: anas = হাঁস; সুইডিশ: crecca = সবুজ ডানা)। সারা পৃথিবীতে এক বিশাল এলাকা জুড়ে এরা বিস্তৃত, প্রায় ২ কোটি ৬৪ লক্ষ বর্গ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে এদের আবাস। বিগত কয়েক দশক ধরে এ দের সংখ্যা অপরিবর্তিত রয়েছে, আশঙ্কাজনক পর্যায়ে যেয়ে পৌঁছেনি। বাংলাদেশের বন্যপ্রাণী আইনে এই প্রজাতিটি সংরক্ষিত।



পাতি তিলিহাঁস দলবদ্ধভাবে বসবাস করে এবং অপ্রজননকালীন মৌসুমে বিশাল বিশাল দলে বিচরণ করে। বড় সংরক্ষিত জলাশয়ে এদের সহজে দেখা যায়। উদ্ভিদ বীজ ও ছোট ছোট জলজ জীব এদের প্রধান খাদ্য। উত্তর আমেরিকার সবজেপাখ তিলিহাঁসকে (A. carolinensis) কখনও কখনও এই প্রজাতিটির উপপ্রজাতি বলে মনে করা হয়।

শীতের পরিযায়ী পাখির বিগত পর্ব সমূহঃ

■ রঙ বেরঙের শীতের পরিযায়ী পাখি » পর্ব- ২
■ রঙ বেরঙের শীতের পরিযায়ী পাখি » পর্ব- ১
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে জুন, ২০২০ সকাল ১১:৪৯
১৪টি মন্তব্য ১৪টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

দু'টো মানচিত্র এঁকে, দু'টো দেশের মাঝে বিঁধে আছে অনুভূতিগুলোর ব্যবচ্ছেদ

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ১২:৩৪


মিস ইউনিভার্স একটি আন্তর্জাতিক সুন্দরী প্রতিযোগিতার নাম। এই প্রতিযোগিতায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সুন্দরীরা অংশগ্রহণ করলেও কখনোই সৌদি কোন নারী অংশ গ্রহন করেন নি। তবে এবার রেকর্ড ভঙ্গ করলেন সৌদি... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমার প্রফেশনাল জীবনের ত্যাক্ত কথন :(

লিখেছেন সোহানী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সকাল ৯:৫৪



আমার প্রফেশনাল জীবন বরাবরেই ভয়াবহ চ্যালেন্জর ছিল। প্রায় প্রতিটা চাকরীতে আমি রীতিমত যুদ্ধ করে গেছি। আমার সেই প্রফেশনাল জীবন নিয়ে বেশ কিছু লিখাও লিখেছিলাম। অনেকদিন পর আবারো এমন কিছু নিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমি হাসান মাহবুবের তাতিন নই।

লিখেছেন ৎৎৎঘূৎৎ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩



ছোটবেলা পদার্থবিজ্ঞান বইয়ের ভেতরে করে রাত জেগে তিন গোয়েন্দা পড়তাম। মামনি ভাবতেন ছেলেটা আড়াইটা পর্যন্ত পড়ছে ইদানীং। এতো দিনে পড়ায় মনযোগ এসেছে তাহলে। যেদিন আমি তার থেকে টাকা নিয়ে একটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুক্তিযোদ্ধাদের বিবিধ গ্রুপে বিভক্ত করার বেকুবী প্রয়াস ( মুমিন, কমিন, জমিন )

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৫:৩০



যাঁরা মুক্তিযদ্ধ করেননি, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে লেখা তাঁদের পক্ষে মোটামুটি অসম্ভব কাজ। ১৯৭১ সালের মার্চে, কৃষকের যেই ছেলেটি কলেজ, ইউনিভার্সিতে পড়ছিলো, কিংবা চাষ নিয়ে ব্যস্ত ছিলো, সেই ছেলেটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। সাংঘাতিক উস্কানি মুলক আচরন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৪



কি সাঙ্ঘাতিক উস্কানিমুলক আচরন আমাদের রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রীর । নাহ আমি তার এই আচরনে ক্ষুব্ধ । ...বাকিটুকু পড়ুন

×