মহাবিশ্বের সমস্ত মৌলিক কণাগুলোকে তাদের বৈশিষ্ট্যের উপর ভিত্তি করে প্রধানত দুইভাগে ভাগ করা যায়। ফার্মিয়ন ও বোসন।
যে সমস্ত মৌলিক কণা দিয়ে বস্তুজগৎ গঠিত (যেমন- ইলেকট্রন, প্রোটন ও নিউট্রন) সেগুলোকে বলা হয় ফার্মিয়ন কণা। এদের বৈশিষ্ট্য হল- এদের স্পিন সংখ্যা হচ্ছে অর্ধপূর্ণ সংখ্যা (যেমন- ½, 3/2, 5/2… )। এই কণাগুলোর নামকরণ করা হয়েছে ইটালিয়ান পদার্থবিজ্ঞানী এনরিকো ফার্মির নামানুসারে। এবার প্রশ্ন হল বোসন কণা কী?
মৌলিক কণার মত মৌলিক চারটি বল দ্বারা এই পুরো মহাবিশ্ব গঠিত বলে ধরা হয়। এই মৌলিক বলগুলোর জন্য দায়ী কণাগুলোকে বলা হয় বোসন কণা। এদের স্পিন সংখ্যা হচ্ছে পূর্ণ সংখ্যা (যেমন- 0,1,2,3…)। এই কণাগুলোর নাম রাখা হয়েছে আমাদের বাঙালী পদার্থবিজ্ঞানী সত্যেন বসুর নামানুসারে। এখন এই বলবাহী কণা (force barrier particle) আসলে কী তা অনেকের কাছে পরিষ্কার নাও হতে পারে। একটু খোলাসা করে বলা যাক।
মহাবিশ্বে বিদ্যমান মৌলিক চারটি বল হল- বিদ্যুৎচুম্বকীয় বল, সবল নিউক্লীয় বল, দুর্বল নিউক্লীয় বল ও মহাকর্ষ বল। বেতার তরঙ্গ, দৃশ্যমান আলো, অতিবেগুনী রশ্মি কিংবা ইনফ্রারেড রশ্মি- এসবই হল বিদ্যুৎচুম্বকীয় বলের উদাহরণ। এই বিদ্যুৎচুম্বকীয় বল উৎপন্ন হয় কিংবা এই বল চলাচল করে ফোটন নামক এক ধরণের কণার মাধ্যমে। সবল নিউক্লীয় বল হচ্ছে পরমাণুর নিউক্লিয়াসের ভেতরে থাকা প্রোটন ও নিউট্রনকে ধরে একত্রে রাখার জন্য দায়ী বল। এদের মধ্যে প্রতিনিয়ত মেসন নামক একধরনের কণার বিনিময়ের ফলে এই বল উৎপন্ন হয়। আবার এই মেসন কণা এবং প্রোটন, নিউট্রনের ভেতরে থাকা কোয়ার্ক নামক কণা সৃষ্টির জন্য দায়ী গ্লুয়ন নামক একপ্রকার কণা। এই গ্লুয়ন কণাই হচ্ছে সবল নিউক্লিয়াসের বাহক কণা।
এরপরে আসা যাক দুর্বল নিউক্লীয় বলের কথায়। যে সমস্ত নিউক্লিয়াসের ভর অত্যন্ত বেশি কিংবা অস্থিতিশীল, সেই সমস্ত নিউক্লিয়াস ভেঙে যেকোনো সময় তেজষ্ক্রিয় রশ্মির বিকিরণ হতে পারে। যেমন- কার্বন আইসোটোপ। এই তেজষ্ক্রিয় বিকিরণের জন্য দায়ী হচ্ছে দুর্বল নিউক্লীর বল। এই দুর্বল নিউক্লীয় বলের বাহক কণা হচ্ছে W ও Z বোসন নামক কণা।
এতক্ষণ যতগুলো বলবাহী কণার কথা উল্লেখ করলাম, এগুলো সবই হল বোসন কণা। এদের একত্রে বলা হয় গজ-বোসন।
মহাকর্ষ বলের কথা তো এখনও বলা হয়নি। অবশ্য এই মহাকর্ষ বল নিয়ে রয়েছে এক মস্ত সমস্যা। আমরা জানি যে মহাকর্ষ বল হচ্ছে মহাবিশ্বের বস্তুসমূহ পরস্পরকে যে বলে আকর্ষণ করে। যেমন- সূর্য পৃথিবীকে আকর্ষণ করছে। তেমনি পৃথিবী তার নিজ অভিকর্ষ দিয়ে আমাদেরকে আকর্ষণ করে তার বুকে আটকে রাখছে। এখন প্রশ্ন হল- এই মহাকর্ষ বলের জন্য দায়ী কোন কণা? ফার্মিয়ন, নাকি বোসন? এ নিয়ে দীর্ঘকাল ধরে বিজ্ঞানীরা দ্বিধা-দ্বন্দ্বে ভুগছেন। অবশেষে গ্র্যাভিটন নামক একটি তাত্ত্বিক বলবাহী কণার অস্তিত্ব তারা ধরে নিয়ে মোটামুটি এর ব্যাখ্যা দাঁড় করালেন। এ-পর্যন্ত উল্লেখ করা সকল কণা নিয়েই গঠিত হল মৌলিক কণাগুলোর গাণিতিক মডেল (Standard Model of Particle)।
মহাকর্ষ বল সমস্ত মহাবিশ্ব জুড়েই বিস্তৃত রয়েছে। আবার চারটি মৌলিক বলের মধ্যে এই বলটিই সবচেয়ে বেশি দুর্বল। কিন্তু এই বলের জন্য দায়ী কে তা নিয়ে খটকা থেকেই যাচ্ছিল। একটি বস্তুর ভর যত বৃদ্ধি পায়, তার মহাকর্ষ বল (কিংবা আকর্ষণ বল) তত বৃদ্ধি পায়। এখন প্রশ্ন হচ্ছে- ভর কেন বৃদ্ধি পায়? অনেক অনেক কণা মিলেই তো বস্তুর ভর সৃষ্টি হয়, তাই না? আবার কণা সৃষ্টি হয় শক্তির রূপান্তরের মাধ্যমে। আইনস্টাইনের ভর-শক্তি সমীকরণের মাধ্যমে সকলেই জানেন যে, ভর শক্তিতে কিংবা শক্তি ভরে রূপান্তরিত হয়। এখন প্রশ্ন হল, মহাবিশ্ব সৃষ্টির পরে যদি শক্তি রূপান্তরিত হয়ে ভরযুক্ত কণায় পরিণত হয়, এবং ভরযুক্ত কণা মিলে যদি বস্তুজগত গঠন করে, তাহলে শক্তি কিভাবে ভর লাভ করে অস্তিত্বশীল হল? অর্থাৎ ভর সৃষ্টির জন্য দায়ী কোন কণা?
১৯৬৪ সালে ব্রিটিশ পদার্থবিদ পিটার হিগসসহ আরও ক’জন বিজ্ঞানী মিলে অবশেষে ভর উৎপন্নকারী একধরণের কণার কথা ভবিষ্যদ্বাণী করেন। নতুন এই কণার নাম দেওয়া হল, হিগস-বোসন। কী এই হিগস-বোসন কণা? কিভাবে এটি ভর সৃষ্টি করে? আর ঈশ্বর কণাই বা কেন একে বলা হয়?
ধরে নিন, পুরো মহাবিশ্ব জুড়ে এমন একটি অদৃশ্য ক্ষেত্র আছে, যার ভেতরে আমরা অস্তিত্বশীল রয়েছি। ইথার মাধ্যমের মত কাল্পনিক এই ক্ষেত্রকে বলা হবে হিগস-বোসন ক্ষেত্র (যদিও ইথার মাধ্যম বলতে আসলে কিছু নেই, এটি বাতিল হওয়া একটি তত্ত্ব)। আর এই ক্ষেত্র সৃষ্টিকারী কণাকেই বলা হবে হিগস-বোসন কণা। এই তত্ত্বানুসারে, মহাবিশ্বের সমস্ত কণা এই ক্ষেত্রের মধ্য দিয়ে চলাচল করে। প্রোটন, নিউট্রন কিংবা ফোটন- সবই এর ভেতর দিয়ে যাতায়াত করে। হিগস-বোসন ক্ষেত্রের কাজ হচ্ছে সকল মৌলিক বলকে বাধা প্রদান করা। যে কণার ভর যত বেশি, ধরে নিতে হবে হিগস-বোসন ক্ষেত্র সেই কণাকে তত বেশি বাধা প্রদান করে। আর যে কণা যত বেশি হালকা, সেই কণা তত কম বাধা পায়। অর্থাৎ কণাগুলোর ভর আসলে কিছুই নয়, হিগস-বোসন ক্ষেত্রের মধ্য দিয়ে চলাচল করার সময় যে যত বেশী বাধা পাবে ধরে নিতে হবে তার ভর তত বেশী। এক্ষেত্রে বিপরীত উক্তিও সত্য।
কিন্তু এবার আপনি প্রশ্ন করতে পারেন, আলো বহনকারী ফোটনের ক্ষেত্রে কী বলা যায়? আলো তো ভরশূন্য! হ্যাঁ। আলো ভরশূন্য। তারমানে আলো বহনকারী কণা (কিংবা তরঙ্গ) ফোটন আসলে হিগস-বোসন ক্ষেত্রের মধ্য দিয়ে চলাচলের সময় কোনও বাধাই পায় না। তাই এর ভর শূন্য। হিগস-ক্ষেত্র বুঝার জন্য উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ধরুন আপনি কোনও রাস্তা দিয়ে জোরে দৌড়াচ্ছেন। আবার আপনার পাশাপাশি আরেকজন হাটুপানির কোনও নদীর উপর দিয়ে দৌড়াচ্ছেন। দু’জনের বেগ কি সমান হবে? নাহ। কারণ, পানির উপর দিয়ে যিনি দৌড়াবেন, তিনি আপনার মত সাবলীলভাবে দৌড়াতে পারবেন না। পানির বাধার কারণে তার অবস্থা কাহিল হয়ে যাবে, গতি শ্লথ হয়ে যাবে। কণাগুলোর ক্ষেত্রেও অনেকটা এরকমই ধরে নিন। কোনও কণা বেশী বাধা পাচ্ছে, আর কোনটা কম পাচ্ছে, আবার কোনোটা হয়ত কোনও বাধাই পাচ্ছেনা। এজন্যই হিগস-বোসন ক্ষেত্র সৃষ্টিকারী হিগস-বোসন কণাকে ভর উৎপন্নকারী কণা বলা হয়।
কিন্তু এর নাম ঈশ্বর কণা হল কিভাবে?
আসলে ঈশ্বর শব্দের সাথে এর সামান্যতম কোনও সম্পর্ক নেই, ছিলও না। পুরোটাই একটা অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা। হিগস-বোসন কণার অস্তিত্ব প্রমাণ করার জন্য যখন বিশ্বের বড় বড় বিজ্ঞানীরা হুমড়ি খেয়ে পড়লেন বড় বড় ল্যাবরেটরীতে, তখন একসময় তারা বুঝতে পারলেন, একে ধরা মোটেও কোনও সহজ কাজ নয়। এর কারণ, এটি এতোটাই ক্ষণস্থায়ী যে জন্মের সাথে সাথেই সেকেন্ডের হাজার ভাগের একভাগ সময়েরও কম সময়ে এটি বিলীন হয়ে যায়। তো আপনারাই বলুন, এমন আয়ুধারী কোনও কণাকে জাল ফেলে ধরা কি চাট্রিখানি কথা? জালের ফোকরের চেয়েও যদি মাছের সাইজ শতগুণে ছোট হয়, তো কোন জাল দিয়ে আপনি তাকে ধরবেন? বিজ্ঞানীরা বিরক্ত হয়ে একসময় একে ‘গডড্যাম পার্টিক্যাল!’ বলে ডাকা শুরু করলেন। এই গডড্যাম কণা নিয়ে নোবেলজয়ী বিজ্ঞানী লিওন ল্যাডারম্যান একসময় একটি বই লিখলেন। বইটির নাম তিনি দিয়েছিলেন- ‘দ্য গডড্যাম পার্টিক্যাল: ইফ ইউনিভার্স ইজ দ্য আনসার, হোয়াট ইজ দ্য কোয়েশ্চন?’ কিন্তু প্রকাশক বইটি প্রকাশ করার আগে এখানে একটা কারসাজি করে বসলেন। তিনি পাঠকমহলে নাড়া দিয়ে বইটির বিক্রি বাড়ানোর জন্য গডড্যাম শব্দটি থেকে ড্যাম বাদ দিয়ে দিলেন। ব্যস, হয়ে গেল গড পার্টিক্যাল! তাই আজও মানুষ কণাটির নাম শুনেই কৌতূহল নিয়ে জিজ্ঞেস করে, কী এই ঈশ্বর কণা? ঈশ্বরের সাথে কি এর কোনও সম্পর্ক আছে?
যাই হোক। এই কণা সম্পর্কে কয়টা তথ্য জেনে নেওয়া যাক, যেগুলো অনেক হিসাব-নিকাশ করে বের করা হয়েছে। এর আনুমানিক ভর 114 GeV থেকে 185 GeV (গিগা ইলেকট্রন ভোল্ট)। এটি খুবই ক্ষণস্থায়ী, যা আগেই উল্লেখ করা হয়েছে। এর স্পিন অর্থাৎ নিজ অক্ষের উপর ঘূর্ণনের মান শূন্য। ফলে, এর বিপরীত কণা বা এন্টি-হিগসবোসন কণা নেই।
সুইজারল্যান্ডের জেনেভা শহরে অবস্থিত বিশ্বের সবচেয়ে বড় ল্যাবরেটরী সার্ন-এর (CERN) লার্জ হ্যাড্রন কলাইডার যন্ত্রে প্রোটনের সাথে প্রোটনের সংঘর্ষ ঘটিয়ে মৌলিক কণা উৎপন্ন করার একটা উপায় জানা আছে বিজ্ঞানীদের। এভাবে অসংখ্য সংঘর্ষ ঘটিয়ে তারা একটি মৌলিক কণা অবশ্য বের করতে পেরেছেন, যার ভর 125 GeV এবং অন্যান্য বৈশিষ্ট্যসমূহ ঈশ্বর কণার বৈশিষ্ট্যের কাছাকাছি। তাই বিজ্ঞানীরা ঈশ্বর কণা নিয়ে এখন বেশ আশাবাদী। ২০১২ সালের জুলাই মাসের ৪ তারিখে সার্নের বিজ্ঞানীরা ঘোষণা দিয়েছিলেন এই কণার কথা এবং বলেছিলেন ঈশ্বর কণার সাথে এর মিল প্রায় শতভাগ। ২০১৪ সালে আবারও বিজ্ঞানীরা ঘোষণা দিলেন, নতুন এই কণাটিই বোধহয় ঈশ্বর কণা। কারণ, এর স্পিন শূন্য, যা ঈশ্বর কণার সাথে মিলে যায়। দেখা যাক, ভবিষ্যতে কী হয়।
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই জুলাই, ২০১৮ রাত ৮:৪৮