somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ঘুঘু পাখির বসত গড়ি!

২০ শে নভেম্বর, ২০১৮ সকাল ৮:১৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


ছবিঃ ১ - আমার বারান্দায় ঘুঘু পাখি

আজকাল প্রায় সকাল বেলাই আমার ঘুম ভাঙ্গে বিভিন্ন পাখিদের সুমধুর ডাকে। কি যে ভালো লাগে! সকালে উঠেই মনটা একদম অন্য রকম হয়ে যায়। বাসার চারপাশে অনেক, অনেক গাছপালা। সকাল হলেই চড়ুই আর শালিক পাখিদের কিচির মিচিরের সাথে শুনা যায় ঘুঘু পাখির মিষ্টি কন্ঠের সুমধুর ঘু ঘু ডাক। ঘুঘুর ডাক একটু দূর থেকেই শুনা যায়, কারন ঘুঘুরা খুব শান্ত প্রকৃতির পাখি হলেও, মানুষজন থেকে কেন যেন একটু দুরেই থাকে। সেদিন সকাল বেলা ঘুম ভাঙ্গার পর ঘুঘু পাখির ডাক যেন খুব কাছ থেকে মনে হলো, বেশ জোড়ে শুনা যাচ্ছে, ঘটনা কি? কি সুন্দর করে যে ডাকে, নিজের কানে না শুনলে বুঝানো যাবে না। বারান্দার দরজা খুলে বাইরে বের হয়ে তো আমি অবাক! এসির আউট ডোর ইউনিটটা প্রায় বারান্দার দেয়াল ঘেসে লাগিয়েছিলাম। ইনডোর আউট ডোর ইউনিটের মাঝখানে যে কপার টিউব গুলি প্যাঁচানো থাকে, তার উপর একটা ঘুঘু পাখি বসে ডাকছে। আরেকটা বারান্দার গ্রীলের উপর। হঠাৎ আমাকে দেখে দুই জনই ডাক থামিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। ভালো করে তাকিয়ে দেখলাম এসির পাশে বসা ঘুঘুটা বাসা বানাচ্ছে। সাত সকাল বেলা একি কান্ড! ঘাস, পাতা, ছন আর কি সব দিয়ে যেন প্রায় বাসা বানিয়েই ফেলেছে! ভালোই অবাক হলাম! এরা সাধারনত মানুষের বাসায় ঘর বানায় না। মনে হয় আশে পাশে ঘর বানানোর কোন ভালো জায়গা পায়নি। দেখে খুবই মায়া লাগলো। বারান্দার দরজাটা লাগিয়ে দিয়ে ঘরে চলে আসলাম। অফিসে যাবার আগে বউকে ঘুঘু পাখির বাসা বানানোর কথাটা বলে, বারান্দায় পারতপক্ষে নিতান্তই দরকার না হলে কাউকে যেতে দিতে মানা করে দিলাম। বিকাল বেলা বাসায় ফিরে শুনি সারাদিনই ঘুঘু পাখি দুইটা বারান্দায় ছিল, এখনো আছে, নিজেদের বানানো বাসায় বসে ঘুটুর ঘুটুর করছে। নির্ঘাত আদর ভালোবাসা শুরু করে দিয়েছে, মেটিং এর সময় মনে হয় শুরু হয়েছে! দিনের বাকি সময়টাও আমরা বারান্দার দরজা প্রায় লাগিয়েই রাখলাম। পরের দিন সকালেও একই অবস্থা, তবে ঘুম ভাঙ্গার পর মনে হলো ডাকাডাকি অনেক বেড়ে গেছে। ঘুঘু পাখিগুলি যেন ভয় না পায় সেজন্য বারান্দার দরজা প্রায় সেদিনও বন্ধ রাখলাম।

তৃতীয় দিন দুপুর বেলা বাসায় এসে শুনি বিরাট দুর্ঘটনা ঘটে গেছে, বারান্দায় এসে দৃশ্যটা দেখে মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল। বারান্দায় একটা ঘুঘু পাখির ডিম পড়ে ভেঙ্গে আছে আর পাখি দুটা চুপ করে বারান্দার গ্রীলের উপর বসে আছে। কাছে যেয়ে বাসাটা দেখলাম, নীচ থেকে বাসাটা অসমান মনে হলো, একটা চেয়ার এনে দাঁড়িয়ে ভালো করে দেখতেই ডিমটা পড়ে যাওয়ার কারনটা বুঝা গেল। এসির কপার টিউবগুলির প্যাঁচ উঁচু নীচু থাকার জন্য বাসার মেঝেটা সমান করে বানাতে পারেনি, তাই ডিমটা এমনিতে পড়ে যেয়ে ভেঙ্গে গেছে। পাখি দুইটার এভাবে চুপ করে বসে থাকা দেখে এতই খারাপ লাগলো যে, সাথে সাথে চেয়ার থেকে নেমে ঘরে ঢুকলাম। এক সপ্তাহ আগে এপেক্স থেকে জুতা কিনেছিলাম কিন্তু এখনো পড়া হয়নি, জুতা বের করে রেখে বাক্সটা হাতে নিয়ে দেখলাম সাইজ একদম ঠিকমত আছে। বারান্দায় ফিরে এসে চেয়ারে দাঁড়িয়ে বাক্সটা দেয়াল আর এসির আউট ডোর ইউনিটের মাঝখানে শক্ত করে বসিয়ে দিলাম, নীচে কয়েকটা কাঠি দিয়ে বাক্সটা বেধে দিলাম, নড়াচড়া করে দেখলাম যথেষ্ঠ শক্ত হয়েছে। এবার পাখিদের পুরানো বাসাটা সুন্দর করে বাক্সের ভিতর বসিয়ে দিলাম। গতকালকে মুরগির ডিম কেনার সময় সাথে কিছু খড় দিয়েছিল, সেটাও বাসায় দিলাম। মনে হলো বাসাটা বেশ ভালো হয়েছে। চেয়ার থেকে নেমে আসতেই একটা ঘুঘু উড়ে এসে বাক্সটার পাশে বসে দেখলো, কি এটা? আমি ঘরের ভিতর দাড়িয়ে দেখছি পাখিটা কি করে? একবার বাক্সটার ভিতরে বসে, আবার সাথে সাথে উঠে যায়। ভয় পাচ্ছে মনে হয়, পাখি ধরার খাঁচাও মনে করতে পারে। হাতে সময় ছিল না, অফিসে ফিরতে হবে, দরজাটা লাগিয়ে দিয়ে চলে আসলাম। বিকালে ফিরে বারান্দায় দেখি বাক্সের মধ্যে একটা ঘুঘু খুব সুন্দর করে বসে আছে, আরেকটা এসির উপর বসে ঘুটুর ঘুটুর করছে। এখনও আমি কোনটা পুরুষ আর কোনটা মেয়ে চিনিনা। শুনেছি ঘুঘুদের ডিম দেয়ার আগে প্রচুর মিলিত হতে দেখা যায়। এদের অন্তরঙ্গ মূহুর্তে আর ডিস্টার্ব করলাম না, বারান্দার দরজা লাগিয়ে দিলাম। ছবি তুলতেও সাহস পেলাম না যদি ভয় পেয়ে চলে যায়!

ঠিক চার বা পাঁচ দিন পরে বিকাল বেলা অফিস থেকে ফিরে দেখি বাক্সের মধ্য একটা ঘুঘুও নেই। আশে পাশে তাকিয়ে দেখলাম কোথাও নেই। চেয়ার একটা নিয়ে এসে উঠে দাড়িয়ে বাক্সের মধ্য তাকিয়ে আমি হতম্ভব!


ছবিঃ ২ - ২টা ডিম সহ ঘুঘু পাখির বাসা……

ইন্টারনেট ঘাটাঘাটি করা শুরু করলাম এদের সম্পর্কে জানার জন্য। মোটামুটি কিছু তথ্য পেলাম। ১০ থেকে ১৫ দিন ডিমে তা দিবে এরা দুইজন পালা করে, বাচ্চা বড় হয়ে উড়া না শিখা পর্যন্ত আর কোথাও যাবে না। বেশ খুশি গেলাম, একদম ফ্রি ফ্রি এক জোড়া ঘুঘু পাখি পেয়ে গেলাম, যা তা কথা নাকি! পাখি দুইটার আমাদের প্রতি ভয় প্রায় কেটে গেছে, বারান্দার দরজা এখন খোলাই থাকে। আমার দুই ছেলে তো মহা খুশি। ছোটটা কেবল কথা শিখছে, বারান্দায় যেয়েই বাক্সটা দেখিয়ে বলে পাখি পাখি। আর ঘুঘু যেটা বাক্সে বসে থাকে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে কে বারান্দায় যাওয়া আসা করে……..


ছবিঃ ৩ – মা ঘুঘু ডিমে তা দিচ্ছে…

বাসার সবার খাবারের দায়িত্ব আমার বউয়ের। ঘুঘু পাখি দুইটা এখন এই বাসায় থাকে, এরা আর বাদ যাবে কেন? বিভিন্ন অনুষ্ঠানে দইয়ের ছোট মাটির যেরকম বাটি থাকে, সেরকম একটাতে বিভিন্ন টাইপের খাবার দিল আমার বউ। কিন্তু একটাও খাওয়া তো দূরের কথা স্পর্শও করলো না। নিজেরাই বাইরে থেকে পালা করে খাওয়া খেয়ে আসে। দুই ঘুঘু পালা করে ডিমে তা দিতে শুরু করলো। এদের ডাকাডাকি দেখে আন্দাজ করতাম কোনটা এখন বাসায় তা দিচ্ছে…...


ছবিঃ ৪ – বাবা ঘুঘু রাতের বেলা ডিমে তা দিচ্ছে…

আস্তে আস্তে ডিম ফুটে কবে যেন দুইটা বাচ্চা হয়ে গেল। টেরও পাইনি আমরা। একদিন বাবা মা কেউ নাই দেখে সাহস করে চেয়ারে দাঁড়িয়ে আবার অবাক হলাম। বাচ্চা দুইটা বড় হয়ে গেছে। কি যে সুন্দর লাগছে, আস্তে হাত দিয়ে গায়ে আদর করে দিলাম, বেশ ভয় পেল দেখলাম। বেশি বিরক্ত না করে ছবি তুলে রাখলাম।


ছবিঃ ৫ – বাচ্চারা বড় হয়ে গেছে, উড়াল দেবার সময় হয়ে এসেছে…..

কয়েকদিনের মধ্যেই বাচ্চারা হাল্কা করে উড়তে শুরু করলো। বাক্স থেকে উঠে এসির উপর কিংবা গ্রীলের উপর যেয়ে বসত বাবা বা মায়ের সাথে, আবার বাক্সে ফিরে আসত। এভাবেই কয়েক দিন চলল বারান্দায় বাবা মায়ের কড়া নজরে উড়াউড়ি শেখা…...



ছবিঃ ৬ – মা ঘুঘু বড় দুইটা বাচ্চার সাথে …


দেখতে দেখতে বাচ্চারা বেশ বড় হয়ে গেল। প্রায় উড়াল দেবার বয়স হয়ে এসেছে। মনটাও খারাপ হতে শুরু করলো। বাচ্চাদের নিয়ে বাবা মা ঘুঘু পাখিরা কয়েকদিনের মধ্যেই হয়ত চলে যাবে। একদিন অফিস থেকে ফিরে আসার পর বউ জানালো যে, এরা দল বেধে কখন যেন বাসা ছেড়ে চলে গেছে। চেয়ারে দাঁড়িয়ে দেখলাম বাক্সটা খালি পরে আছে। কেমন যেন বাসাটা খালি খালি লাগছে কিন্তু কিছুই করার নেই। প্রথম দিন থেকেই পণ করেছিলাম যে, এদের কে জোর করে আটকে রাখবো না, নিশ্চয়ই যে পরিমান আদর অ্যাপায়ন করেছি সহজে এদের ভূলে যাবার কথা না………

ঘুঘু নিয়ে আমাদের বাংলাভাষায় বেশ কিছু প্রবচন, ছেলে ভোলানো ছড়া, শ্লোক চালু আছে। নির্বংশ হওয়া বোঝাতে বলে ‘ভিটায় ঘুঘু চরা’। আরও আছে—‘বারবার ঘুঘু তুমি খেয়ে যাও ধান/ এই বার ঘুঘু তোমার বধিব পরাণ’, ‘ঘুঘু দেখেছ ফাঁদ দেখনি’ ইত্যাদি। চোরের রাজা বা ডাকাতের সর্দারদের বলে ‘বড়ঘুঘু’। আবার ছোট শিশুদের পায়ের ওপরে রেখে দুলুনি দিতে দিতে ‘ঘুঘু সই/ ফুপু কই’ এমন ছড়া কাটার চল আছে। যেভাবে দিন দিন এরা নির্বংশ হয়ে যাচ্ছে এখন খোদ ঘুঘুর বংশেই ঘুঘু চরার পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। নিরাপদ বাসা বানানোর জন্য এদের জায়গার সত্যই খুবই অভাব। কেন জানি মন বলছে এরা আবার ফিরে আসবে………….

ঠিক ঠিক তাই হলো যা ভেবেছিলাম। কিছুদিন পরেই কপোত কপোতীরা আবার এসে হাজির। একদিন অফিস থেকে ফিরে আসতেই ছোট ছেলেটা আমার হাত ধরে বারান্দায় নিয়ে যেয়ে আংগুল উঁচু করে বাক্সটা দেখিয়ে বলল, পাখি পাখি। বাচ্চারা সাধারনত এইরকম ভূল করে না। বাক্সটার কাছে যেতেই বাক্সে বসা ঘুঘু টা আমাকে দেখে মোটা গলায় ডাকা শুরু করল। ডাক শুনেই বুঝলাম, আবার ডিম দিবে, তাই বাসায় ফিরে এসেছে। আওয়াজ করে মেয়েটা বুঝিয়ে দিল, আমরা আবার ফিরে এসেছি। কি যে ভালো লাগলো! প্রেমিক ঘুঘু কই? চারপাশে দেখলাম না। অসুবিধা নেই। সন্ধ্যা হয়ে এসেছে আর প্রিয়তমাও এখানেই আছে, ও আর যাবে কই? ফিরে তো আসতেই হবে। রাতের বেলা বারান্দা থেকে প্রেমিক প্রেমিকার ঘন ঘন প্রেমালাপ শুনা গেল। আরেকবার বাচ্চা না হওয়া পর্যন্ত এরা আর কোথাও যাবে না…….



ছবিঃ ৭ – বড় দুইটা বাচ্চা ঘুঘু পাখি …


এই পর্যন্ত আমার এই বাসা থেকে তিনটা প্রজন্ম জন্ম গ্রহন করেছে। প্রতিবার দুইটা করে ছয়টা বাচ্চা হয়েছে। শুনেছি প্রতিবার একটা ছেলে আর একটা মেয়ে ঘুঘু জন্ম নেয়। তার মানে চার জোড়া কপোত কপোতী। তৃতীয় প্রজন্মের চলে যাবার সময় আমি বাসায় ছিলাম। সেদিন মনে হয় অফিস ছুটি ছিল। সকাল এগারোটার দিকে বাবা মা দুই বাচ্চাকে নিয়ে বারান্দার গ্রীলে যেয়ে বসল। মাথা সবার বাইরের দিকে। ভাব সাব দেখে মনে হলো, চলে যাবার সময় হয়ে এসেছে। আমি বারান্দায় এসে দাড়ালাম। প্রথম বাবা মা নীচে ঝাপ দিল, তারপর দুই বাচ্চা। বাচ্চা দুইটার ঝাপ দেয়া দেখে ভয় পেয়ে গেলাম। তাড়াতাড়ি কাছে যেয়ে নীচে তাকিয়ে দেখি বেশ জোড়ে জোড়ে পাখা নাড়ছে বাচ্চারা, তারপরও পড়ে যাচ্ছে, হায় হায়, সর্বনাশ, আমি মোটামুটি প্রিপারেশন নিয়ে ফেলেছি নীচে দৌড় দেবার জন্য। পাঁচ তলা থেকে লাফ দিয়েছে, ঠিক দুই তলায় এসে বাচ্চা দুইটা হঠাৎ করেই উড়া শিখে ফেলল। উড়তে উড়তে বাবা মায়ের পাশে যেয়ে দাড়াল, তারপর আস্তে আস্তে উড়ে চলে গেল আমার চোখের সামনে থেকে। সামনে তাকিয়ে রইলাম যতক্ষন পর্যন্ত পাখিগুলি কে দেখা যায়। এক সময় নীল আকাশের মাঝে ক্ষুদ্র হতে হতে বিলীন হয়ে গেল……….

ঘুঘু পাখিদের সম্পর্কে যা সবার জানা দরকার, তা হলোঃ
১. পুরুষ ঘুঘুদের প্রায়ই মাদি ঘুঘুদের চারপাশে ঘুরে ঘুরে ডাকতে শোনা যায়।
২. যে ঘুঘুটি বেশির ভাগ সময় বাইরে থাকে, বেশি কাজ করে বেড়ায়, অর্থাৎ কামলা, সেটিই ছেলে ঘুঘু।
৩. যে ঘুঘু পাখিটি জোড়ে জোড়ে ডাকে সেটিই ছেলে ঘুঘু।
৪. পুরুষ ঘুঘু পাখি ডাকবেই। বয়স হলে ছেলে ঘুঘু খাঁচায় থাকলেও ডাকবে, কিন্তু মেয়ে ঘুঘু হলে ডাকাডাকি করবে না।
৫. বর্তমানে পাখি আইনে ঘুঘু ধরা বা হত্যা করা দণ্ডনীয় অপরাধ। খারাপ লোক যাতে শিকার করে ঘুঘুর প্রজাতি বিলুপ্ত করতে না পারে সেদিকে আমাদের সবার খেয়াল রাখতে হবে।
৬. সবারই ইচ্ছা থাকে পোষা পাখি তাদের চিনবে, ডাক দিলেই উড়ে এসে হাতে বসবে। কিন্তু পৃথিবীতে এমন কিছু পাখি আছে যাদের পোষ মানানো যায় না। ঘুঘু তার মধ্যে অন্যতম। খুব ছোট বেলা থেকে পালন করলেও ঘুঘু পাখিকে পুরোপুরি পোষ মানানো কখনোই সম্ভব নয়।

ঘুঘু পাখিদের নিয়ে জীবনানন্দ দাশ রূপসী বাংলা কবিতায় অসাধারণ কিছু কবিতার অংশ লিখেছেন। জীবনানন্দের ‘এখানে ঘুঘুর ডাকে’ নামের কবিতার সেই ঘুঘু আর নেই বনে। শুনা যায় না তার মিষ্টি ডাক। কোথায় যেন ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে ঘুঘু পাখিটি! গ্রাম বাংলার মিষ্টি পাখি ঘুঘুর বংশে ঘুঘু চরার দশা এখন। পাঠকদের জন্য এই কবিতাংশ দুইটা নীচে তুলে দিলাম, এর চেয়ে ভালো কোন লেখা ঘুঘু পাখিদের নিয়ে আমি পাইনি-
১.
পৃথিবীর সব ঘুঘু ডাকিতেছে হিজলের বনে;
পৃথিবীর সব রূপ লেগে আছে ঘাসে;
পৃথিবীর সব প্রেম আমাদের দু’জনার মনে;
ছড়ায়ে আছে শান্তি হয়ে আকাশে বাতাসে।
২.
এখানে ঘুঘুর ডাকে অপরাহ্নে শান্তি আসে মানুষের মনে;
এখানে সবুজ শাখা আঁকাবাঁকা হলুদ পাখিরে রাখে ঢেকে;
জামের আড়ালে সেই বউকথাকও টিরে যদি ফেল দেখে
একবার — একবার দু’পহর অপরাহ্নে যদি এই ঘুঘুর গুঞ্জনে
ধরা দাও — তাহলে অনন্তকাল থাকিতে যে হবে এই বনে;

এখন নভেম্বর মাস। প্রায় চার মাস হয়ে গেল ঘুঘু পাখির তৃতীয় প্রজন্ম আমার বাসা থেকে উড়তে শেখার পর চলে গেছে। মজার বিষয় হলো এখনো এই পাখি গুলি আমার বাসার আশে পাশেই ঘুরাঘুরি করে। প্রায় প্রতিদিনই এদের ডাকাডাকি শুনতে পাই। সব গুলি বাচ্চাই বড় হয়ে গেছে। দূর থেকে দেখলে এখন আর আমি বুঝতে পারি না কোনটা বাচ্চা আর কোনটা বাবা মা। বারান্দায় দাড়ালেই ছেলে ঘুঘু পাখির বিষন্ন কামনা মদির কন্ঠের সুমুধুর ঘুঘু ডাক শুনা যায়। মাঝে মাঝেই ছেলে ঘুঘু পাখি গুলি বারান্দায় এসে গ্রীলে বসে থাকে, উচ্চস্বরে ডাকতে থাকে, বারান্দায় আমরা যাওয়া আসা করি সেটা পাত্তাও দেয় না, শুনলেই এদের নিয়ে পুরানো স্মৃতি গুলি মনে পড়ে যায়, মনে হয় আমাদের সেই

স্মৃতি গুলি মনে করিয়ে দেবার জন্যই এখানে এসে ডাকে। হয়তো ঘুঘুর বাচ্চাদের ছোট বেলার কথা মনে পড়ে যায় যখন, তখন এসে ঘুরে যায় আর পুরুষ ঘুঘু হয়তো আমাদের মনে করিয়ে দেয় আমি আবার প্রিয়তমাকে নিয়ে ফিরে আসব। হঠাৎ করেই কোন কোন দিন মেয়ে ঘুঘু পাখির নিম্ন স্বরের ডাক শুনতে পাই, যেয়ে দেখি বাক্সের কাছে বা মধ্যে বসে আছে। আমাদেরকে দেখে ওর গম্ভীর গলায় নিম্ন স্বরে ডাকতে শুনে মনে হয়, বাসায় এসে ওর ভালোবাসার সেই দিন গুলির কথা আমাদের স্মরন করিয়ে দিচ্ছে, বলে দিচ্ছে আমাকে ভূলে যেও না, আবার যখন মেটিং এর সময় হবে আমি এই বাসায়ই ফিরে আসব, এটাই আমার বাসা, বারবার আমি এখানেই ফিরে আসব……………

ঘুঘু পাখির বাসার বাক্সটা কিছুটা ভেঙ্গে ছিড়ে গিয়েছিল। নতুন একটা বাক্স দিয়ে বাসাটা আবার সুন্দর করে বেধে দিয়েছি। চিটাগাং এ বৃষ্টির সময় অনেক দিন টানা বৃষ্টি হয়, একটুও থামাথামি নেই। এই সময় পাখিদের ডানা ভিজে গেলে আর উড়তে পারে না। আর সামনে শীতকাল, হয়তও এবার প্রচন্ড ঠান্ডাও পড়তে পারে। ঘুঘু গুলিতো ওদের বাসা চেনেই, দরকার পরলে এখানে এসে নিরাপদে আশ্র‍য় নিতে পারবে। আর আমরাও অধীর আগ্রহে এই ঘুঘু পাখিদের জন্য অপেক্ষা করে আছি, কবে এরা আবার এই ভালোবাসায় গড়া বসতে ফিরে আসবে…………

সবাইকে ধন্যবাদ ও শুভ কামনা রইল।
সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত @ নীল আকাশ, নভেম্বর, ২০১৮


নীচের অংশটুকু আমার লেখা নয়, আগ্রহী পাঠকদের জন্য ইন্টারনেট থেকে পাওয়া কিছু তথ্য তুলে দিলামঃ
১. বাংলাদেশের অতি পরিচিত পাখি ঘুঘু। ঘুঘু পাখি উড়তে পারে বেশ দ্রুত। লোকালয়ের কাছে বসবাস করলেও এরা আড়ালে থাকে। নিজেদের বাসা নিজেরাই তৈরি করতে পারে। ঘুঘু পাখি খুব সুন্দর সুরেলা কণ্ঠে ডাকতে পারে। ঘুঘু পাখি দেখতে প্রায় কবুতরের মতো। এরা প্রায় ৩০ থেকে ৪২ সেঃমিঃ লম্বা হয়। ঘুঘু পাখির লেজ বেশ লম্বা। কোনো কোনোটির ডানায় ও লেজে কালো রং ও স্পষ্ট ২টি হলুদ ডোড়া দাগ রয়েছে। আবার কোনো কোনোটির লেজের নিচের রং হয় দারুচিনির মতো। ঘুঘুর দেহ ফ্যাকাসে ধূসর, বাদামি ও তামাটে রংয়ের হয়। ঘাড়ে বেগুনি প্রলেপ রয়েছে। ঠোঁট বাদামি ও কালো। এদের প্রধান খাদ্য শষ্যদানা। এছাড়াও খাদ্য তালিকায় রয়েছে বিভিন্ন রকম ফল, বীজ ও গাছের কচি কুঁড়ি। পিঁপড়া ও কীটপতঙ্গও খেয়ে থাকে। বাসা বানানোর সময় এরা ঘাস পাতা মাটিতে টানাটানি করে তবে এই টানাটানি এরা মানুষের সামনে করে না। এরা এতই চতুর যে যদি টের পায় তাদের বাসা কেউ দেখে ফেলেছে তখন তারা বাসা অন্য কোথাও সরিয়ে নেয়। কেউ যদি কোন ঘুঘুর বাসার সন্ধান পায় তাহলে সেই বাসার দিকে সরাসরি না তাকানো উত্তম। ঘুঘু মানুষের দৃষ্টি খুব সহজেই বুঝতে পারে। ডিম পাড়ার পর ঘুঘু জুটি একজনের পর অন্যজন পালা করে তা দেয়। কিন্তু তা পরিবর্তনের সময় কেউ দেখতে পাওয়াটা খুবই কঠিন ব্যাপার, সম্ভব না বললেই চলে।

ঘুঘুর আরেক নাম বনকপোত। পায়রা, ঘুঘু, হরিয়াল—এসব একই পরিবারের পাখি। ঘুঘুর বৈজ্ঞানিক নাম– Streptopelia chinensis । ঘুঘু ও কবুতর কলম্বিডি পরিবারের অন্তরভুক্ত। বিশ্বে কলম্বিডি নামের এই পরিবারে পাখি আছে ৩১০ প্রজাতির। আমাদের দেশে প্রজাতির সংখ্যা ১৬। তবে কেবল ঘুঘুই আছে অন্তত ৭ প্রজাতির। সচরাচর সারা দেশে যেটি দেখা যায় সেটি তিলাঘুঘু। বুকের নিচে ধূসর। পিঠ বাদামি। গলায় কালোর মধ্যে সাদা ফোঁটা। আকার ২৮ থেকে ৩০ সেন্টিমিটার। একটু নিচু ঝোপঝাড়ে ঘুঘু বাসা করে। পাখিবিশেষজ্ঞ শরিফ খান ভাষ্যমতে গত ৩০ বছরে ঘুঘুর সংখ্যা ব্যাপকভাবে কমেছে। কোথাও কোথাও কমে চার ভাগের এক ভাগে নেমে এসেছে। তিলাঘুঘু ছাড়া আমাদের দেশের অন্য ঘুঘুর মধ্যে আছে মটরঘুঘু, বাজঘুঘু, ছোটঘুঘু, লাইছেঘুঘু, বাঁশঘুঘু ও ধূমকলঘুঘু। আকারে ধূমকলঘুঘুই সব থেকে বড়। নিরীহ এই পাখি মানুষের লোভের শিকার হয়ে হয়তো একদিন হারিয়েই যাবে দেশ থেকে। শুধু জীবনানন্দের কবিতার পঙক্তিতেই থাকবে তার কথা, ‘পৃথিবীর সব ঘুঘু ডাকিতেছে হিজলের বনে;/পৃথিবীর সব রূপ লেগে আছে ঘাসে;।'

২. একটি পূর্ণ বয়স্ক ঘুঘু যখন ডিম উৎপাদনে উপযোগী হয় তখন চোখের বৃত্ত ছোট হয়। ধূসর বর্ণের পুরুষ ঘুঘুর চোখের বৃত্তের রং হয় কমলা অথবা লাল। পরিধি ২-৩ মিলিমিটার পর্যন্ত। স্ত্রী ঘুঘুর রং বাদামি ধূসর রংয়ের, চোখের বৃত্ত ১ মিলিমিটার পর্যন্ত পুরু হয়। এই ঘুঘু সাধারণত ১০ থেকে ১৪ বছর পর্যন্ত বাঁচে। অনেক ক্ষেত্রে ২১ বছর পর্যন্তও টিকে থাকে। ৬ মাস বয়স হলেই ডিম পাড়া শুরু করে। কখনও কখনও এর ব্যতিক্রম হয়ে ৮ মাস লেগে যায়। এই পাখি একসাথে ২টি করে ডিম পাড়ে। ডিমের রং সাদা ও কিছুটা ফ্যাকাসে। ডিম লম্বায় ২.৬ সেঃ মিঃ ও প্রস্থে ১.৫ সেঃ মিঃ। পুরুষ ও স্ত্রী দুজন মিলেই ডিমে তা দিয়ে থাকে। এপ্রিল থেকে জুলাই পর্যন্ত এদের প্রজননের সময়। ডিম থেকে বাচ্চা ফুটতে সময় লাগে ১৩ থেকে ১৪ দিন। ঘুঘুর ডিম ফুটে বাচ্চা বের হলে এই সময় এরা দুজনেই প্রচুর খাবার সন্ধানে থাকে। কোন ঘুঘুর খাওয়া দাওয়ার তড়িঘড়ি দেখেই বুঝা যায় এর বাচ্চা থাকতে পারে। এছাড়াও বাচ্চা দেয়া ঘুঘুদের বাচ্চাদের নিয়মিত খাবার খাওয়ানোর কারনে ঠোঁটের গোঁড়ার দিকে দুই পাশে চোখের কাছ পর্যন্ত ভেজা ভেজা দেখা যায়। এই চিহ্ন দেখে সহজেই বুঝা যায় এদের বাসায় বাচ্চা আছে। প্রতিবার এক জোড়া করে বছরে তিনবার ডিম দেয়। বাচ্চা ফুটলে প্রথম দুই-তিন দিন মা ঘুঘুর মুখ থেকে একরকম লালা নিঃসরণ হয়। এটাই ছানার খাদ্য। কবুতরের ক্ষেত্রেও তাই, একে বলে ‘পিজিয়ন মিল্ক’।

৩. বাংলাদেশে ঘুঘুদের বসবাসের জায়গা এখন অনেক সংকুচিত হয়েছে। যত্রতত্র ইটভাটায় গিলে খেয়েছে বড় বড় গাছ। আর পাখি শিকারিদেরও লোভাতুর শ্যেন দৃষ্টি থেকে সত্যি সত্যি রক্ষা করা যায়নি পাখিদের। ঘুঘু পাখিকে শিকারির কবল থেকে সতি সত্যি রক্ষা করা যায়নি। আজ ঘুঘু দেশে এখন প্রায় বিপন্ন পাখি। মাংস সুস্বাদু, সেটাই হয়েছে ঘুঘুর কালশত্রু। বাড়ির আশপাশের ঝোপ-জঙ্গলের এই পাখিটিই শিকারিদের তীর ও গুলি ছোড়ার প্রথম লক্ষ্য।

সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে সেপ্টেম্বর, ২০২০ সকাল ১১:৫২
২৮টি মন্তব্য ২৮টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

একটি ছবি ব্লগ ও ছবির মতো সুন্দর চট্টগ্রাম।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ৮:৩৮


এটি উন্নত বিশ্বের কোন দেশ বা কোন বিদেশী মেয়ের ছবি নয় - ছবিতে চট্টগ্রামের কাপ্তাই সংলগ্ন রাঙামাটির পাহাড়ি প্রকৃতির একটি ছবি।

ব্লগার চাঁদগাজী আমাকে মাঝে মাঝে বলেন চট্টগ্রাম ও... ...বাকিটুকু পড়ুন

মেহেদী নামের এই ছেলেটিকে কি আমরা সহযোগীতা করতে পারি?

লিখেছেন ইফতেখার ভূইয়া, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ১০:০৪


আজ সন্ধ্যায় ইফতার শেষ করে অফিসের কাজ নিয়ে বসেছি। হঠাৎ করেই গিন্নি আমার রুমে এসে একটি ভিডিও দেখালো। খুলনার একটি পরিবার, ভ্যান চালক বাবা তার সন্তানের চিকিৎসা করাতে গিয়ে হিমশিম... ...বাকিটুকু পড়ুন

দ্য অরিজিনস অফ পলিটিক্যাল জোকস

লিখেছেন শেরজা তপন, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ১১:১৯


রাজনৈতিক আলোচনা - এমন কিছু যা অনেকেই আন্তরিকভাবে ঘৃণা করেন বা এবং কিছু মানুষ এই ব্যাপারে একেবারেই উদাসীন। ধর্ম, যৌন, পড়াশুনা, যুদ্ধ, রোগ বালাই, বাজার দর থেকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। ভালোবাসা নয় খাবার চাই ------

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৯ শে মার্চ, ২০২৪ দুপুর ১:০৬


ভালোবাসা নয় স্নেহ নয় আদর নয় একটু খাবার চাই । এত ক্ষুধা পেটে যে কাঁদতেও কষ্ট হচ্ছে , ইফতারিতে যে খাবার ফেলে দেবে তাই ই দাও , ওতেই হবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

জাতীয় ইউনিভার্সিটি শেষ করার পর, ৮০ ভাগই চাকুরী পায় না।

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৯ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৪:৫৭



জাতীয় ইউনিভার্সিটি থেকে পড়ালেখা শেষ করে, ২/৩ বছর গড়াগড়ি দিয়ে শতকরা ২০/৩০ ভাগ চাকুরী পেয়ে থাকেন; এরা পরিচিত লোকদের মাধ্যমে কিংবা ঘুষ দিয়ে চাকুরী পেয়ে থাকেন। এই... ...বাকিটুকু পড়ুন

×