somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

নতুন বছরে যা চাই আমি

০১ লা জানুয়ারি, ২০১৭ রাত ৮:১৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

*
ফরিদপুর শহরের অদূরে গোয়ালচামট গ্রামের শ্রীঅঙ্গন মন্দিরের জলার সিঁড়ির ওপর বছর দশেক ধরে আশ্রয় নিয়েছেন এক মহিলা। তাঁর এক হাত নেই। ডান হাত দিয়েই খান এবং বাকি কাজ সারেন। এই বৃদ্ধা গত ১০টি বছর ধরে রোদ-বৃষ্টি-শীতের মাঝে ঐ একটু জায়গাতেই শুয়ে বসে কাটিয়ে দিচ্ছেন দিনরাত। মাঝে শুধু টয়লেট করতে হলে খুব কষ্টে নিচে নেমে ঝোপের আড়ালে যান। এই মহিলাকে অনিয়মিতভাবে দিনে তিনবেলা কোনোরকম ধরণের এক খাবার দেওয়া হয় মন্দির থেকে। গায়ে পড়ার ম্যাক্সি, অল্প ওমের কম্বলটা এবং মাঝে মাঝে মশা তাড়ানোর কয়েল দেয় এলাকাবাসীদের কেউ কেউ। অবাক করা বিষয়ই বটে। আরও অবাক করা বিষয় হলো, বৃদ্ধা যেখানে বসে থাকেন বা ঘুমান, সেই অল্প জায়গাটুকুতে পাশ ফিরতে গেলেই দোতলা সমান উচ্চতা থেকে নিচে মাটিতে পড়ে যাবার সম্ভাবনা। কিন্তু বৃদ্ধা কখনও পড়ে যান না। কেউ কেউ বলে তিনি পাগল। আবার অনেকেই বলেন, স্বামী মারা যাওয়ার পর এই মহিলা ও তাঁর ছেলেকে স্বামীর সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করে তাঁর শরিকরা। সেই থেকেই তাদের ওপর অভিমান এবং ক্ষোভ থেকে এখানে এই মন্দিরে আশ্রয় নেন তিনি, হন স্রষ্টার অবতারের স্মরণাপন্ন। কিন্তু সাধুরা ভেতরে বেশিদিন থাকতে না দিলে বাইরেই সিঁড়ির পাশে আশ্রয় নেন। এই মহিলা আজও সুবিচার পাননি। বৃষ্টিতে ভিজে তাঁকে আমি জ্বরে কাঁপতে দেখেছি, শীতেও তিনি কাঁপেন ঠান্ডায়। কিন্তু কেউ নিতে এলে যান না। অন্য কারো বাসাতেও তিনি অতিথি হয়ে যান না। ওখানে বসেই এক ধ্যানে ঈশ্বরের কাছে বিচার চেয়ে চলেছেন আজও!

*
খুব অল্প বয়সেই পরিবার ছাড়া হতে হয়েছিলো লতাকে। বাবা-মা এবং সাত ভাইবোনের অভাব-অনটনের সংসারে ঠাই হয়নি ওর। জন্ম নিয়েই দেখেছে বাবা-মায়ের মলিন মুখ। কন্যাসন্তান জন্ম নিলে অধিকাংশ বাঙ্গালি বাবা-মায়ের মুখ যেমনটি হয় আর কি। তারপর একটু বড় হলে, একদিন ঘুরতে নিয়ে যাওয়ার নাম করে নিজেদের পরিচিত বস্তি ছেড়ে শাহবাগ ভার্সিটি এলাকায় ওকে রেখে যায় ওর বাবা। তারপর অনেক কেঁদেছে ও, বাবা-মাকে খুঁজেছে রাস্তায় রাস্তায়। শেষে তাদের কাউকেই না পেয়ে, লতা পাকাপাকিভাবে আশ্রয় নিয়েছে এই ক্যাম্পাস এলাকাতেই। এখানেই ফুটপাথে বসে এক খালার কাছে ফুল দিয়ে মালা বানানো শিখে নিয়েছে। শাহবাগের ফুলের দোকান থেকে সস্তায় দুই একদিনের বাসি ফুল কিনে নিয়ে মালা গেঁথে বিক্রি করেই পেট চলে এখানকার ফুটপাথের মেয়ে-মহিলাদের। লতারও তাই, মালা বিক্রির টাকাতেই পেট চলে। রাতে খালার পাশেই অন্য সবার সাথে এক হয়ে শুয়ে পড়ে ও। ক্যাম্পাসের ছেলেমেয়েদেরকে ব্যাগ কাঁধে ক্লাসে যেতে দেখে ওরও ইচ্ছা হয় স্কুলে যাবে। কিন্তু খালা কড়া ভাষায় বলে দিয়েছে, পড়ালেখার নাম নেয়াও নাকি ওর জন্য পাপ।

অন্য দিনের মতো, আজকের দিনেও রজনীগন্ধ্যার মালা হাতে লতা দাঁড়িয়ে আছে শাহবাগ মোড়ের বিশাল স্ক্রিনগুলোর নিচে। সিগন্যাল পড়তেই, চকচকে প্রাইভেট কারগুলোকে টার্গেট করে এগিয়ে গেলো ও। তিনটা গাড়ির গ্লাসই খুললো না। গ্লাস খুললো লাল টয়োটা গাড়িটা থেকে এক মহিলা।
-আপা, নিবেন? মাত্র ১০ ট্যাকা।
-কিরে, তোর ফুল এতো নরম ক্যান? বাসি ফুল নিয়ে আসছিস বিক্রি করতে?
-কই আফা, এক্কেবারে তাজা। কেবল মালা গাইত্থা আনলাম...
-এহ, আসছে! দুইটা ১০ টাকায় দিবি?
-এইডা কী কন আফা! আফনেরা এমুন করলে বাচুম ক্যামনে?

গ্লাসটা আবার উঠে গেলো। ভেতর থেকে স্পষ্ট শোনা গেলো দুটি শব্দ-- 'ফকিন্নির বাচ্চা!'

*
এইচএসসি পাশের পর হঠাৎ করেই বাবাকে হারিয়ে বসে অনুপ। বাবাকে ছাড়া ও এবং ওর মা কখনই কিছু বুঝতো না। দুজনই সহজ-সরল, তাই বাবার মৃত্যুর পর গোটা দুনিয়াটাই যেন পাল্টে গেলো। শ্রাদ্ধ-শান্তির পর আত্মীয়রাও যার যার বাড়ি চলে গেলো। মায়ের কপালে সিঁদুর নেই, গায়ে সাদা কাপড় দেখে শুধুই কান্না পায় অনুপের। আর মনে পড়ে বাবার স্মৃতি। কাঁদতে কাঁদতেই পড়ে মাসখানেক পর ঢাকার ভালো একটা ভার্সিটিতে চান্স পেয়ে যায় সে। কিন্তু মন সায় দেয় না। মাকে একা এই ময়মনসিংহে রেখে ও কী করে ঢাকা যায়? তার চেয়ে আনন্দমোহনই ভালো। মায়ের পাশে থাকা যাবে। কিন্তু বাধ সাধে বড় হবার প্রচন্ড ইচ্ছা। ছোট থেকেই ভালো ছাত্র অনুপ, এভাবেই থেমে যাবে? মাকে রাজি করিয়ে সে পাড়ি জমায় ঢাকার উদ্দেশ্যে।

ঢাকায় গিয়ে খুব কষ্টে রাজনীতি করার শর্তে ভার্সিটির হলে সিট পায় সে। আর পেট চলে টিউশন করে। সাথে পত্রিকায় লেখালেখি ও সম্পাদনায় সহযোগিতা করেও কিছু পায়। কিন্তু এভাবে সৎভাবে চলতে কষ্ট হলেও সে পথভ্রষ্ট হতে পারে না। এভাবেই খুব কঠিন এক বিষয়ে অনার্স করেই ফেললো সে কষ্টেমষ্টে। রেজাল্টও মোটামুটি ভালোই হলো। কিন্তু যেখানে ওর কাজ করার ইচ্ছা, সেখানে ওর যোগ্যতার মূল্যায়ন হলো না। ওর মনেও জেদ, অন্য কোথাও সে যাবে না। ডাক এলেও দেয় ফিরিয়ে। লোকে তাকে পাগল বলে, ও নাকি বাস্তবজ্ঞান রাখে না, কল্পনায় চলে। এভাবেই কেটে যায় বছরের পর বছর। হতাশার মেঘ ঘন থেকে ঘনতর হয়। সময় বয়ে চলে। প্রেয়সী হাত চলে যায় অন্যের হাতে। কিন্তু অনুপের ভাগ্য খোলে না।

ওদিকে অনুপের মায়ের দিন কাটে ছেলের পথ চেয়ে। ছেলে কবে চাকরি পাবে, আর কবে তাঁকে নিয়ে একসাথে থাকবে, কবে ছেলের একটা বৌমা আনবে! চার দেয়ালের মাঝে এভাবে রাতের পর রাত একা থাকতে, একা বাজার করে এনে এই বয়সেও একা খেতে আর তাঁর একদমই ভালো লাগে না। তবুও তাঁকে থাকতে হয়। নতুন বছরের প্রথম বছরে ছেলের ফোন এলে, তিনি চোখের জল মুছে হাসি হাসি কণ্ঠে ছেলেকে নতুন বছরের জন্য প্রাণখুলে দোয়া করেন।

*
উপরে যে মানুষগুলোর গল্প শুনলেন, তাঁরা এই সমাজেই বাস করেন। ঘটনা কোনোটাই বাস্তব ঘটনা নয়, আবার সবগুলোই বাস্তব। এই মানুষগুলোর কাছে থার্টি ফার্স্ট নাইটের আকাশভরা দামি দামি আতশবাজি কিংবা ফানুশের কোনো অর্থ নেই। এদের কাছে নতুন বছরের নতুন সকালের মানে নতুন কিছু নয়, আর দশটা সাধারণ মানুষের মতই আরও একটা দিনের শুরু, যে দিনটি বাঁচার জন্য তাঁকে অনেক সংগ্রাম করতে হয়। এই মানুষগুলোর কাছে নতুন বছরটি কিছুটা হলেও আনন্দের বার্তা নিয়ে আসুক। চোখের জল মুছে যাক ঠোঁটের প্রাণবন্ত হাসিতে।

-দেব দুলাল গুহ
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা জানুয়ারি, ২০১৭ রাত ৯:০৭
১টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ছিঁচকাঁদুনে ছেলে আর চোখ মোছানো মেয়ে...

লিখেছেন খায়রুল আহসান, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:০৯

ছিঁচকাঁদুনে ছেলে আর চোখ মোছানো মেয়ে,
পড়তো তারা প্লে গ্রুপে এক প্রিপারেটরি স্কুলে।
রোজ সকালে মা তাদের বিছানা থেকে তুলে,
টেনে টুনে রেডি করাতেন মহা হুলস্থূলে।

মেয়ের মুখে থাকতো হাসি, ছেলের চোখে... ...বাকিটুকু পড়ুন

হার জিত চ্যাপ্টার ৩০

লিখেছেন স্প্যানকড, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩



তোমার হুটহাট
চলে আসার অপেক্ষায় থাকি
কি যে এক ছটফটানি
তোমার ফিরে আসা
যেন প্রিয় কারো সনে
কোথাও ঘুরতে যাবার মতো আনন্দ
বারবার ঘড়ি দেখা
বারবার অস্থির হতে হতে
ঘুম ছুটে... ...বাকিটুকু পড়ুন

জীবনাস্ত

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৪৪



ভোরবেলা তুমি নিশ্চুপ হয়ে গেলে একদম,
তোমার বাম হাত আমার গলায় পেঁচিয়ে নেই,
ভাবলাম,তুমি অতিনিদ্রায় আচ্ছন্ন ,
কিন্তু এমন তো কখনো হয়নি
তুমি বরফ জমা নিথর হয়ে আছ ,
আমি... ...বাকিটুকু পড়ুন

যে দেশে সকাল শুরু হয় দুর্ঘটনার খবর দেখে

লিখেছেন এম ডি মুসা, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:১১

প্রতি মিনিটে দুর্ঘটনার খবর দেখে অভ্যস্ত। প্রতিনিয়ত বন্যা জলোচ্ছ্বাস আসে না, প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনার খবর আসে। আগে খুব ভোরে হকার এসে বাসায় পত্রিকা দিয়ে যেত। বর্তমানেও প্রচলিত আছে তবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

জেনে নিন আপনি স্বাভাবিক মানুষ নাকি সাইকো?

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:১৮


আপনার কি কারো ভালো সহ্য হয়না? আপনার পোস্ট কেউ পড়েনা কিন্তু আরিফ আর হুসাইন এর পোস্ট সবাই পড়ে তাই বলে আরিফ ভাইকে হিংসা হয়?কেউ একজন মানুষকে হাসাতে পারে, মানুষ তাকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×