মাত্র ৫০০টাকা বেতনে চাকরি করে কেউ এই জামানায়? হ্যাঁ করে, আমার মা করে। মা ধর্ম মন্ত্রণালয়ের অধীনে বাড়ির পাশের মন্দিরে প্রাক-প্রাথমিক পর্যায়ে পড়ায়, পাশাপাশি ডিএইচএমএস(ঢাকা) ডাক্তার। আমি যখন ঢাকায়, তখন এই দুটি দায়িত্ব পালন করেই একা ঘরে কেটেছে তার গত ৯টি বছর। ফরিদপুর শ্রীধাম শ্রীঅঙ্গনের দাতব্য চিকিৎসালয়ে গত ১৭ বছর ধরে আমার মা হোমিও চিকিৎসা করে। প্রথমে মাসিক ৩০০টাকা ও রোগীপ্রতি ২ টাকা ভিজিটে রোগী দেখতো মা। আর আঙ্গিনার সাধু-মোহন্তরা পরিবারসহ সবসময়ই বিনামূল্যে ঔষধ পান। শহরের ঐতিহ্যবাহী ব্যবসায়ী মারোয়ারিরা যাবতীয় ঔষধ সরবরাহ করে ফ্রিতে। বাবা মাকে বলেছিলো, তোমার সংসারে টাকা দিতে হবে না, তুমি শুধু মানুষের সেবা করো। বাসাতেও বাবার মায়ের নামে ‘পুষ্প হোমিও হল’ খোলা হয় এবং সেখানে ফরিদপুর ও ফরিদপুরের বাইরে থেকেও অনেক রোগী আসে, অনেক দুস্থ বিনামূল্যে চিকিৎসাসেবা পায়। অনেক রোগ আছে, যার চিকিৎসা হোমিওতে ভালো হয়। আমার দাদুও ছিলেন শহরের নামকরা হোমিও চিকিৎসক। ৭৫-এ অনেকটা বিনা চিকিৎসায় মাকে হারিয়ে বাবার ইচ্ছা ছিলো আমাকে বানাবে ডাক্তার, আর পরবর্তীতে দাদির (ঠাকুমা) নামে খুলবে একটি হাসপাতাল, সেখানে গরিবেরা বিনা খরচে চিকিৎসাসেবা পাবে। কিন্তু অসময়ে বাবাকে হারিয়ে তার মাসখানেক পর আমার আর সরকারি মেডিক্যালে চান্স হলো না। আমি যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছি, তারপর মায়ের বেতন ২০০টাকা বাড়িয়ে করা হলো ৫০০ টাকা। সেই বেতনেই আজও চলছে মায়ের সেবাদান, শুক্রবার বাদে প্রতিদিন বিকেলে ২ ঘন্টা, ইচ্ছা হলে আরও বেশি সময়। গত বছর রোগীপ্রতি ফি ২ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৫টাকা করা হয়েছে। যদিও যুগের সাথে তাল মিলিয়ে এবং বাবার অবর্তমানে আমাদের পরিবারের কথা বিবেচনা করে কিছু বিবেকবান মানুষ বিবেক করেই ভিজিট হয়তো কিছুটা বেশি দেয়। কিন্তু আজ অবধি শ্রীঅঙ্গন কর্তৃপক্ষের বা মহানাম সম্প্রদায়ের বিবেকে বেতন বাড়িয়ে যুগোপযোগী করার কথা আসেনি। এমনকি আমার সহজ-সরল মাকে আমার অবর্তমানে সেখান থেকে সরিয়ে দেয়ারও অনেক চেষ্টা হয়েছে, আমার ছাত্রাবস্থায় করা হয়েছে দুর্ব্যবহার। আর আজ যা হলো, মানুষের উপকার করলে হয়তো তাই হয়।
কেউ কেউ বলে, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান নাকি এখন দিনদিন হয়ে যাচ্ছে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। ‘পিকে’ কিংবা ‘ওহ মাই গড’ তো আমরা দেখেছি। আর এখানে দাতব্য চিকিৎসালয়ে ব্যবসা নেই, টাকার কারবার নেই। তাই এখানেই যেন রাজ্যের অবহেলা। এসব কারণে মারোয়ারিরাও এখন আর দাতব্য চিকিৎসা চালিয়ে নিতে আগ্রহী নয়। ১ বছর ধরে তারা ঔষধ দেয় না শুনে তাদের দোকান গোপাল বস্ত্রালয়ে গিয়ে এমন অনেক গল্পই শুনলাম। কিন্তু ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান নিয়ে কিছু বললে সবাই আমাকেই নাস্তিক বানিয়ে দেবে, ভুলে যাবে আমার বাবার মায়ের অবদান, স্রষ্টার প্রতি আমার ভক্তি। তাই আর না বলি। এরপর আমার অনুরোধে তাঁরা আবার ঔষধ পাঠিয়েছেন, কিন্তু সেটা এখনও মায়ের চেম্বারে এসে পৌঁছায়নি। এর মাঝে আজ থেকে শুরু হলো বৈশাখী উৎসব। অন্য বছর এই সময় ফরিদপুরে থাকা হয় না, এবার চাকরির কারণে আছি। বাসায় দুপুরে একজন সাধু পবিত্র বন্ধু আর এলাকার দর্জি গোপাল এলো। তারা এসে যা বললো, তা হলো, শ্রীঅঙ্গনের মহানাম সম্প্রদায়ের সভাপতি বলেছেন, মায়ের চেম্বারটি যেন তাদেরকে ছেড়ে দেয়া হয়, সেখানে তারা দোকান দেবেন। আমাদের আপত্তিতে তারা চেম্বারের সামনের জায়গায় চেম্বারের ঝাপ নামিয়ে দোকান করতে চায়। কিন্তু তাতে তো চেম্বার বন্ধ ভেবে রোগী ফিরে যাবে, তাই আপত্তি করলে তারা ফিরে গিয়ে সরাসরি সভাপতিকে দিয়েই ফোন দেওয়ালো। প্রণামপর্বের পর সভাপতি বিকেলে আমাকে ও মাকে দেখা করতে বললেন, আর শেষে ওদের চাপে বললেন, উৎসব চলাকালীন সময়ে হোমিও চিকিৎসার দরকার নেই, সিভিল সার্জন মেডিক্যাল টিম পাঠাবে।
তো, আমরা দেখা করতে গেলাম বিকেলে, সাথে সভাপতির অনেক নাম শুনে তাকে প্রণাম জানাতে সঙ্গে এলেন কবি ও সাংবাদিক বড়ভাই সিদ্ধার্থ শঙ্কর ধর, দৈবক্রমে তিনি ফরিদপুরেই ছিলেন। গেলেই সভাপতি মহারাজ জানালেন, তাঁর এখন কথা বলার সময় নেই, ভক্তদের বসতে দেয়া খেতে দেয়া শুতে দেয়া সব কাজ তাকেই এখন করতে হবে। আমরা বিনীতভাবে বললাম, আমরাও তো বেকার নই, কাজের মাঝে ছুটি নিয়েই তো এসেছি, সময় নেই তো ডাকলেন কেন? তিনি কোনো উত্তর না দিয়ে বসতেও না দিয়ে চলে গেলেন। আমরা নিজেরাই চেয়ার টেনে বসলাম। কিছুক্ষণ পর পবিত্র এসে জানালো, সভাপতি তাকে পাঠিয়েছেন কথা বলতে। আমরা বললাম, আমরা তাঁর সঙ্গেই কথা বলতে চাই, কারণ তিনি ডেকে এনেছেন। এই কথা বলায় সে বললো, ‘ঝামেলা করার দরকার নেই, আপোষে মিটিয়ে ফেলি’। খেয়াল করলাম সে আমাকে ও আমার পঞ্চাশোর্ধ মাকে 'তুমি' বলে সম্বোধন করছিল, বয়সে ছোট হয়েও! বছর তিনেক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হল পলিটিক্স আর ৭ বছরের সাংবাদিকতা জীবনের অভিজ্ঞতা বলে, এর নাম ফাঁপর নেয়া। সেই কথা বলে আবারও নিজেদের পরিচয় দিলে, সে বলে বসলো, ‘ডিসিকেও গোনার টাইম নাই’। আমরা বুঝলাম, এখানে আর কথা বলা বৃথা।
সে নিচে গিয়ে সভাপতিকে ডেকে আনলো। সাথে এলো একজন ভিন্ন ধরণের লোক, নাম অটল। সভাপতি বললেন, কী চাও বলো। আমি বললাম, এই এলাকা থেকে আমিই প্রথম বিসিএস ক্যাডার হলাম, আপনার আশীর্বাদ চাই। আর চাই মায়ের চেম্বার বন্ধ নাহোক, ওখানে দুস্থের সেবা হোক। তিনি বললেন, সেবার দরকার আছে কি নেই সেটা নাকি তিনি বুঝবেন। বেশ, তিনি সভাপতি, বুঝতেই পারেন, কিন্তু তাহলে এই ১৭ বছর কেন দরকার পড়লো, আর আজ কেন দরকার নেই? এই কটা দিনই কিছু রোগী হয়, এই রোজগারটাও কেন বন্ধ করবেন? আমি এটাও জানালাম, আমি এবারই ৮ বছর পর উৎসবে ফরিদপুর আছি, সহকর্মীদের অনেককে আমন্ত্রণ জানিয়েছি, তারা আসলে কোথায় বসতে দেবো? তিনি বলে দিলেন, কর্তৃপক্ষ হিসেবে তিনিই সিদ্ধান্ত নেবেন কাকে ডাকা হবে আর কাকে হবে না। এর অর্থ হলো, ১৭ বছর চিকিৎসাসেবা দিয়েও মা আঙ্গিনার কেউ না, আমি এই এলাকায় ছোট থেকে বড় হয়েছি তবুও আমি এখানকার কেউ নই, বাবু ফরিদীর কোনো অবদান আঙ্গিনাতে নেই। মুক্তিযুদ্ধের সময়ে শ্রীঅঙ্গনের আটজন সাধু হত্যার ঘটনার চাক্ষুষ বর্ণনা আছে বাবার বই কমলের একাত্তরে, বাবার দেয়া তথ্যেই প্রাক্তন সম্পাদক অমর বন্ধু আঙ্গিনার বড় বড় কড়াইগুলো তুলাগ্রাম থেকে উদ্ধার করেছিলো, আটজন সাধু হত্যার দিনটিকে ‘বন্ধু দিবস’ ঘোষনার জন্য পত্র পত্রিকায় লিখেছিলো, প্রায় ২৫ বছর আগে এই ফাঁকা এলাকায় এসে এলাকার উন্নয়নে শালিশ মেটানোয় কমিটিতে থেকে আঙ্গিনার ভালো-মন্দ দেখায় তাঁর সকল অবদানকে তিনি ‘না’ করে দিলেন! উচ্চস্বরে এই কথাগুলো বলেই তিনি আবার চেয়ার ছেড়ে উঠে গেলেন। অথচ, ভাবতেই অবাক লাগে, এই মানুষটার প্রতি ভক্তি থেকেই তার থেকে মা মালা নিয়েছিলো বাবা মারা যাওয়ার পর এবং তার আদেশেই মা গত ৮ বছর মাংস খায়নি, আমাকেও বঞ্চিত করেছে! প্রিয় কিছু বাদ দিলে নাকি মৃত স্বামীর আত্মার শান্তি মিলে!
তখন নিজেদের খুব অপরাধী মনে হলো, যেন ডেকে এনে অপমান করা হলো। সবাই মিলে চেম্বার খুলে বসলাম। রোগী এলো। তখন কেউ এলো না, কিন্তু চেম্বারের সামনে দোকানের কাজ শুরু হয়ে গেলো। চেম্বার বন্ধ করে আসার সময় পবিত্র খুব অভদ্রভাবে চেম্বারের চাবি চাইলে আমি আর কিছু না বলে পারলাম না। বললাম, ‘মা তোমার আর সেবা করতে হবে না। তুমি সভাপতির কাছে চেম্বারের চাবি কালই দিয়ে দেবে, আর যাবে না’। চলে আসার পর উত্তম মামার ফোন। তিনি বললেন, আমরা আসার পর নাকি পবিত্র বন্ধু ব্রহ্মচারী গালিগালাজও করেছে এবং মামা হিসেবে তিনি তার প্রতিবাদ করেছেন। তারপর নাকি অন্য সাধুরা এসে তাঁকে নিবৃত্ত করে সরিয়ে নিয়েছে। আবার গিয়ে জানা গেলো, অনেকেই সাধুদের ব্যবহারে অসন্তুষ্ট। একজন বললেন, ‘আঙ্গিনা আর আগের আঙ্গিনা নাই’। সিদ্ধার্থদা বলে ফেললেন, ‘প্রণাম করতে এসে সাধুদের ব্যবহার দেখে আর প্রণাম করতে ইচ্ছা করলো না। ভদ্র ব্যবহারের জবাবে সাধুরা কেন এভাবে উত্তেজিত হবে?’ প্রিয়বন্ধু নামে আরেক সাধু জানালো, গতবার নাকি মায়ের চেম্বারে তিনি মালপত্র রেখেছিলেন বলে পবিত্রকে টাকা দিতে হয়েছিলো! আরেকজন বললো, গরিব কেউ প্রসাদ পেতে বসলে নাকি উঠিয়ে দেয়া হয়! আর যারা খায়, তারাও কাজের বিনিময়ে। হায়রে ধান্দা! ধান্দার কালো থাবার সেবা মানবতা শেষ!
প্রসঙ্গত বলে রাখি, এর আগে বাবা মারা যাওয়ার পর আমি যখন ঢাকায় তখন আমার বাসার বরাদ্দপত্রে সঠিক পরিমাপ উল্লেখ থাকার পরেও কমিটির জানামতেই আমার জায়গা অনেকটা বেদখল হয়েছে। তখন প্রতিবাদ করলে পরোক্ষভাবে মায়ের জীবনের হুমকি দেয়াসহ আমাদের উঠিয়ে দেয়া হবে এমন ইশারাও দেয়া হয় কমিটির থেকে। আসলে বাবাই ভুল করেছিলো। নিজের পৈতৃক ভিটা ছেড়ে এখানে এসে সুন্দর একটা এলাকা গড়ে তোলার ইচ্ছা করা এবং উন্নয়নে অবদান রাখাটাই তাঁর মস্ত বড় ভুল ছিলো। সৎ জীবনযাপনের কারণেই এত উঁচু স্তরের মানুষ হয়েও তিনি শহরের অভিজাত এলাকায় বাড়ি বানাননি। সেটাই এখন আমাদের প্রতি মুহূর্তের কষ্ট, স্মৃতিময় জায়গাটা ছাড়তেও পারিনা আবার শান্তিতেও নেই। এত কষ্ট করে এখান থেকে মানুষ হলাম, দেশসেরা কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়লাম, লেখালেখি সাংবাদিকতা করলাম, এখন সরকারের প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তা হলাম, অথচ আজ নিজভূমে পরবাসী বলে মনে হচ্ছে। এখন তো আমাদের নিরাপত্তাই হুমকির মুখে বলে মনে হচ্ছে! এতোদিন যারা শত চেষ্টাতেও আমাকে দমিয়ে রাখতে পারেনি, তারা হয়তো এবার শেষ চেষ্টায় নামবে। তার আগেই এলাকা ছাড়বো কি? আসলে অনেক না বলতে চেয়েও আজ এতোদিন পর কথাগুলো না বলে পারলাম না।
কাল থেকে আঙ্গিনায় উৎসব। মূল গেট দিয়ে ঢুকলে হাতের ডানে চেম্বারের সামনের পাল্লাগুলো বন্ধ থাকবে, সেখানে হবে দোকান। সেই দোকানের টাকা আঙ্গিনার উন্নয়নকার্যে ব্যায় হবে কিনা সেটা দেখা আমাদের মতো পাপীদের দায়িত্ব না। জগদ্বন্ধু সুন্দর যাদেরকে অধিকার দিয়েছেন কমিটিতে বসার, তাঁরাই এসব দেখবেন। আসলে আমরাই পাপী মানুষ, তাই ঈশ্বরের রক্ষাকর্তাদের বিরাগভজন হয়েছি! আপনার ঘরে কে বা কারা থাকে, তার ওপর নির্ভর করে বলে দেয়া যায় আপনি কেমন। হরিপুরুষ প্রভু জগদ্বন্ধু সুন্দর, তুমি এখন ওখানে কেমন আছো?
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা মে, ২০১৭ রাত ৩:০৪