শ্রেণী শত্রু খতম করো শ্রমিক রাজ কায়েম করো,
বন্দুকের নলই সকল ক্ষমতার উৎস
কিংবা আফগান স্টাইলে বিপ্লব করা হবে
এসব শ্লোগান বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে বহুল পরিচিত। সশস্ত্র গোপন সংঘাত, চরমপন্থী রাজনীতি কিংবা গলাকাটা নৃশংসতার অভিজ্ঞতা এখনও অর্জন করে চলেছে দেশের বৃহৎ একটি অঞ্চলের মানুষ।
মুক্তিযুদ্ধ হলো দুই কুকুরের লড়াই,
সংসদ হলো শুয়োরের খোঁয়াড়,
ভোটের বাক্সে লাথি মারো অস্ত্র হাতে তুলে ধরো,
হারামজাদা জনগণ থাকলো তোদের নির্বাচন আমরা চললাম সুন্দরবন
এ জাতীয় উচ্চারণও মানুষের স্মৃতি থেকে মুছে যায়নি। এসব শ্লোগান, কর্মকান্ড ও তৎপরতা এই বাংলাদেশের বুকে অত্যন্ত দাপটের সঙ্গে চলতে দেখেছে দেশবাসী। আর এর মহান কৃতিত্ব' দাবী করতে পারে কেবল দেশের বামপন্থী রাজনৈতিক দলগুলো এবং তাদের নেতা-কর্মীরাই।
আজ বাংলাদেশে বামপন্থী নেতাদের মুখে গণতন্ত্রের খৈ ফুটার বহর এবং অন্য ধর্মভিত্তিক গণতান্ত্রিক দলের মুন্ডুপাত করার অবিরাম প্রচেষ্টা দেখে দেশবাসীর মনে জেগেছে নানা প্রশ্ন।
এরমধ্যে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হলো, বাংলাদেশকে বামপন্থীরা কী দিয়েছে?'
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা এই প্রশ্নের সারমর্ম খুঁজতে গিয়ে আঁতকে উঠেছেন।
দেখা গেছে, দেশের কোন রাষ্ট্রপ্রধানকে হত্যার মতো ঘটনার সূচনা তারা করেছে।
বাংলাদেশের বুকে বিদেশী দূতাবাসে হামলার জঘন্য দৃষ্টান্ত স্খাপন করেছে তারাই।
শ্রেণী শত্রু খতমের নামে আজ পর্যন্ত আইনের বাইরে বিচার বহির্ভূত নৃশংস হত্যাকান্ড সংঘটিত করে চলেছে এই বামপন্থীরাই। তারা গত ৩৫ বছরে অর্ধ লক্ষাধিক মানুষকে নিজেরা হত্যা করেছে অথবা হত্যার মুখে ঠেলে দিয়েছে।
থানা-পুলিশ ফাঁড়িতে হামলা এবং আইন প্রয়োগকারী সদস্যদের হত্যা ও অস্ত্র-গোলাবারুদ লুন্ঠন কারা করে চলেছে তাও মানুষের জানা আছে।
দেশে গণতন্ত্রের অভিযাত্রাকে বারবার ব্যাহত করতে ষড়যন্ত্রের ঘোট পাকাতেও এদের জুড়ি নেই বলে মনে করেন রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা।
এসব বামপন্থী দল ও গ্রুপের বিভিন্নমুখী কেবলা' রয়েছে মূল দুই কেবলা' মস্কো ও পিকিং থেকে বিচ্যুতির পর এসব বামপন্থীরা বিভিন্ন ব্যক্তিত্ব, দল ও দেশের লেজুড়ে পরিণত হয়। কার্ল মার্কস, লেনিন, মাওসেতুং, স্ট্যালিন, ট্রটস্কি প্রমুখের জীবনাবসানের পর কেউ চারু মজুমদারের নক্সালবাড়ির লাইন নেয়, কেউ পশ্চিমবেঙ্গর বর্তমান বামপন্থী ক্ষমতাসীনদের লেজুড়বৃত্তি গ্রহণ করে, কেউ কিউবার ফিদেল ক্যাস্ট্রো কিংবা চে-গুয়েভারা, কেউবা আলবেনিয়ার আনোয়ার হোজ্জাকে তাত্বিক নেতা মেনে টিকে থাকার সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে।
বামপন্থীরা বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের সবচেয়ে বড় লড়াকু হিসেবে নিজেদের জাহির করার প্রয়াস চালালেও ইতিহাস বলে অন্য কথা। সে সময় এদের একটি বড় অংশই মুক্তিযুদ্ধকে দুই কুকুরের লড়াই' হিসেবে আখ্যা দিয়ে একই সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধা ও পাকবাহিনীর ওপর আক্রমণ চালিয়েছে।
একটি অংশ আবার ভারতকে সম্প্রসারণবাদী আখ্যা দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাও করেছে। স্বাধীনতার পরও কোন কোন বামপন্থী গ্রুপ নামের আগে পূর্ব পাকিস্তান' ব্যবহার অব্যাহত রাখে। এর অন্যতম ছিল পূর্ব পাকিস্তানের বিপ্লবী কমিউনিস্ট পার্টি (মাকর্স-লেনিন)
স্বাধীনতার পরপরই ২/৩টি ছাড়া বাকি বামপন্থী দলগুলো আন্ডারগ্রাউন্ডে থেকেই সন্ত্রাসী কর্মকান্ড শুরু করে।
এক রিপোর্টে দেখা যায়, ১৯৭৩ সালের জুলাই-আগস্ট এই দুই মাসে বাম উগ্রপন্থীরা ১৩টি পুলিশ ফাঁড়ি ও ১৮টি বাজার আক্রমণ করে, ১৪০টি আগ্নেয়াস্ত্র ও ৬হাজার ৬শ'৮০টি গোলাবারুদ লুট করে। হত্যা করে ২৬জন রাজনৈতিক নেতা-কর্মীকে।
আরেক রিপোর্টে জানা যায়, ১৯৮৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে তারা সিরাজগেঞ্জর নিমগাছি পুলিশ ফাঁড়ি '৮৭ সালের জানুয়ারীতে শেরপুরের চন্দ্রকোণা পুলিশ ক্যাম্প একই বছরের মার্চে নাটোরের গুরুদাসপুর থানা,'৮৮-র এপ্রিলে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইল পুলিশ ফাঁড়ি এবং একই বছরের মে মাসে মাগুড়ার শ্রীপুর থানা লুট করে। কোন কোন থানা দুইবার পর্যন্ত লুট করা হয়।
এই গোপন বাম রাজনীতির শ্রেণী শত্রু খতমের নৃশংসতার মৃগয়াক্ষেত্র হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের বৃহত্তর যশোর, কুস্টিয়া, খুলনা, সাতক্ষীরা,রাজবাড়ি এবং বৃহত্তর রাজশাহীর বিস্তীর্ণ অঞ্চল।
সর্বহারার বধ্যভূমি হিসেবে আজো খ্যাত হয়ে আছে রাজশাহীর তানোর ও বাগমারা, নওগাঁর আত্রাই ও রানীনগর, নাটোরের সিংড়া ও গুরুদাসপুরের নাম। পাবনা ও সিরাজগেঞ্জর কোন কোন প্রত্যন্ত এলাকায় থানা লুট ও পুলিশ খুনের ঘটনা সাম্প্রতিককালেই ঘটেছে। আত্রাই ও রানীনগরের ইতিহাসের জন্য সর্বহারা-বামপন্থীরা গর্ববোধ করে। বাম চরমপন্থীদের তৎপরতার শুধুমাত্র ঝিনাইদহ জেলার যে চিত্র পাওয়া রীতিমত ভয়ানক।
স্বাধীনতার পর থেকে ১৯৯২ পর্যন্ত দুই দশকে এই একটি জেলাতেই চরমপন্থী দলের হাতে ও নিজস্ব সংঘাতে ৩ হাজার মানুষ খুন হয়। শুধু '৯২-৯৩-এর মাঝামাঝি সময়ে যশোর-কুস্টিয়া অঞ্চলে অন্তত: ৭৫জন নিহত হয়। বন্দুকযুদ্ধে একদিনে নিহত হয় ১২জন[।] '৯৩-এর ৩রা মার্চ একসঙ্গে জবাই করে হত্যা হয় ৭জনকে। ২০০৪সালের এক রিপোর্টে দেখা যায়, সে বছর একই জেলায় ১০১টি হত্যাকান্ড ঘটানো হয়েছে। এর মধ্যে ৫০টি ঘটায় চরমপন্থীরা। এর আগে ২০০৩-এ ৭৫জন, ২০০২-এ ৭৩জন এবং ২০০১ সালে ৫৯জন নিহত হয় বিভিন্ন ঘটনায়।
গোপন বামপন্থী আন্দোলনকারীদের এই তৎপরতার জন্য ছিল সমৃদ্ধ অস্ত্র-ভান্ডার। ব্যবহৃত হয়েছে নানা দেশী-বিদেশী অস্ত্র। সাপ্তাহিক বিচিত্রার এক রিপোর্ট থেকে জানা যায়, এসব অস্ত্র প্রধানত: ভারত থেকে আসলেও চট্টগ্রামের শান্তিবাহিনীর কাছ থেকেও অস্ত্রের চালান আসতো।
১৯৯৩ সালে পুলিশ স্বপন বাহিনীর স্বপনের কাছ থেকে হােঙ্গরীর বুদাপেস্টে তৈরী সম্পূর্ণ অটোমেটিক এম.৯৫-এম রাইফেল উদ্ধার করে। এই অস্ত্রটি ওয়ারশ জোটের সদস্যরা ব্যবহার করতো। পরে তা ভারতীয় সীমান্ত রক্ষীরা ব্যবহার করেছে। ১৯৯১সালে শৈলকুপার গণবাহিনীর সদস্য ইদ্রিস আলী একটি মর্টারসহ আত্মসমর্পণ করে। যশোরে সর্বহারাদের স্খল মাইন ব্যবহারের রিপোর্টও পুলিশের খাতায় আছে।
গোপন বামপন্থীরা নিজেদের ইচ্ছেমত মানুষকে মৃত্যুদন্ড' দেয়ার রীতি ঘোষণা করে।
১৯৭৩-৭৪সালে নোয়াখালী অঞ্চলে তারা প্রথম তথাকথিত ‘গণআদালত' গঠন করে এধরনের মৃত্যুদন্ড কার্যকর করার পদ্ধতি চালু করে। ১৯৯৪ সালের অেক্টাবরে নড়াইল সদর থানার সিংরাশোলপুর বাজারে জনৈক কৃষক নেতাসহ কয়েকজন এক জনসভায় সন্ত্রাসবিরোধী' বক্তব্য রাখলে ১৯ অেক্টাবর এদের ৫জনের মৃত্যুদন্ড ঘোষণা করা হয় রীতিমত মাইক বাজিয়ে ও দেয়ালে পোস্টার সেঁটে। এরমধ্যে মূল আসামী' মহব্বত হোসেনকে ১৩ই নবেম্বর শহর থেকে বাড়ি ফেরার পথে পিটিয়ে হত্যা করে মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হয়
গোপন রাজনীতির নামে সন্ত্রাসী তৎপরতা চালানোর মাধ্যমে মূলত: বিপুল অংকের অর্থ আদায় হয়ে থাকে। পার্টি চালানো,বাহিনী তৈরী, অস্ত্র সংগ্রহের নামে এই অর্থ সংগ্রহ করা হলেও এর একটা বড় অংশই শহর-নগরীতে বসবাসরত প্রকাশ্য রাজনীতির গডফাদারদের কাছে পোঁছে দিতে হয়। গোপন রাজনীতির অনেকের সুতো ঐ গডফাদারদের হাতের নাটাইয়ের সঙ্গে বাঁধা বলেও প্রচার আছে। ১৯৯৩ সালের এক রিপোর্টে জানা যায়, প্রকাশ্যে রাজনীতিতে আসার খরচ' হিসেবে সর্বহারা পার্টি যশোর, কুষ্টিয়া, নড়াইলের গ্রাম্য জনপদগুলো থেকে ৩ কোটি টাকার তহবিল' সংগ্রহের উদ্যোগ নেয়া হয়। নড়াইলের একটি মাত্র ইউনিয়ন নন্দীতেই চাঁদা ধরা হয় ২০ লাখ টাকা। এসব ব্যক্তিদের কেউই মহাজন কিংবা জমিদার নয়।
বাজারের ছোট দোকানী, মাঝারী কৃষক, এমনকি স্কুল মাস্টারকেও চাঁদা দেয়ার নির্দেশ দেয় পার্টির কর্মীরা। কিন্তু এখন পর্যন্ত সর্বহারা নামে কোন প্রকাশ্য রাজনৈতিক দল মাঠে দেখা যায়নি। তাহলে ঐ বিপুল অংক কাদের পকেটে গেল তা প্রশ্ন হয়ে রয়েছে।