somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বৈশাখের লাবণ্যপ্রভা.......

১৪ ই এপ্রিল, ২০১১ ভোর ৫:১৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

বড় ঘরটার ঠিক মাঝখানে একটা বড় আয়না। আয়না নিয়ে বেশ ভাললাগা জুড়ে আছে মনটায়, সেই আয়নার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতেই নিজেকে বড় হতে দেখা লাবণ্যর। কপালের টিপটাকে আস্তে আস্তে মাঝ বরাবর বসিয়ে দিয়ে দেখছে কেমন লাগে। নাহ! সবসময়ের মত আজকে আর ছোট টিপ দিবেনা। নিউমার্কেট থেকে বড় টিপের একটা পাতা কিনে এনেছে। আজকের দিনটার জন্য বেশ পরিকল্পনা করছিল বেশ কয়েকদিন ধরেই। এই দিনটা একটু অন্যরকম ভাবেই গুরুত্বপূর্ণ লাবণ্যের জীবনে। সেই ছোটবেলা থেকে সারা বছর এই দিনটার জন্য অপেক্ষা!
ছোটবেলায় এই দিনটায় বাবা-মার সাথে ঘুম ভেঙে রমনার বটমূলে ছায়ানটের প্রোগ্রাম দেখতে যেত। যেবার রমনায় বোমা হামলা হয়েছিল, সেবারও গিয়েছিল। রমনা, শিল্পকলা, টিএসসি...এসবে ঘুরাঘুরি। বাবা-মার হাত ধরে ছোট একটা মেয়ে মাঝখানে ঢুকে ঘুরে বেড়াত। হাওয়াই মিঠাই, নাগরদোলা, আর গলা মিলিয়ে গেয়ে ওঠা, এসো হে বৈশাখ, এসো এসো!! পান্তা-ইলিশ আর মিষ্টি-মন্ডা খেয়ে খুশিতে আত্মহারা হয়ে বাসায় ফিরে টিভিতে নববর্ষের অনুষ্ঠান দেখা। আস্তে আস্তে রূপ পাল্টালো উদযাপনের। স্কুলে কলেজে অনুষ্ঠান হত। সাদা শাড়ি লাল পাড়ে আর ছোট করে একটা টিপ দিয়ে চলে যেত বৈশাখের রং এ মেতে ওঠার দিনগুলো।
নববর্ষের ধরন যে আরও অন্যরকম, সেটা টের পেল বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে এসে। ডিপার্টমেন্ট থেকে মাসকট বানানো হয়, সাজানো হয় বর্ণিল সাজে। বাসার থেকে অনুমতি নিয়ে আগের দিন রাতে থাকে সবাই মিলে মহড়ার কাজে। একদিকে ছোট রিহার্সাল রুমে চলে গানের মহড়া, আর অন্যদিকে বাইরে চলে রং দিয়ে আল্পনা আঁকার কাজ। কিছু ছাত্রছাত্রী মিলে কাগজ কেটে বানায় নতুন নতুন নকশা। আর বেশ কিছু বন্ধুরা মিলে নিরলস ভাবে করে যায় ফানুস আর মাসকট বানানোর কাজ। সারারাতের খাটাখাটুনির পর ভোরে যখন সব সুন্দর মত হয়ে যায়, তখন নিজেদের কাজে নিজেরাই মুগ্ধ হয়ে যায়। ভোর থেকে চলে রবীন্দ্র সংগীত আর বৈশাখের নানা গানের উচ্ছ্বাস! আর প্রিয় বন্ধু বান্ধব আর বিশেষ প্রিয়জনকে নিয়ে ঘুরে বেড়ানোর আনন্দে খুঁজে পায় নতুন করে বৈশাখের মানে। আয়নায় দেখতে দেখতে এসব ভাবছিল লাবণ্য। বড় টিপ অমিতের খুব প্রিয়। তাই কাল খুঁজে খুঁজে অমিতের পছন্দের বড় টিপ কিনে এনেছে লাবণ্য।
বেশ কয়দিন ধরেই খুব বেশি মাত্রায় উচ্ছ্বাস আর উত্তেজনা কাজ করছিল এই বৈশাখকে নিয়ে। শাড়ি, চুড়ি, টিপ, গলার ছোট একটা মালা, আর কানের দুল, নূপুর- সব চাই এবার। হাত ভর্তি করে চুড়ি পরতে হবে। চুড়ির রিনিঝিনি সবসময়ই পছন্দ লাবণ্যর। মোট ৪ডজন চুড়ি কিনেছে সে। মা-কে নিয়ে ঘুরে ঘুরে পছন্দ মত শাড়ি কিনেছে। লাল এর উপর সোনালি কারুকার্য, আর হালকাভাবে সাদার কাজ করা সুন্দর এক জামদানি। এত উৎসাহ কেন হচ্ছে এবার বুঝতে পারছেনা সে। এত উত্তেজনা। এত উচ্ছ্বাস! নিজের আনন্দে নিজেরই ভয় লেগে যাচ্ছে। এত এত প্রস্তুতি, সব ঠিকমত হবে তো? কিছু ঝামেলা হবেনা তো?
কাল রাতে বারবার এই ভাবনাগুলো মাথায় ঘুরেফিরে আসছিল তার। চোখে কাজল দিতে দিতে আরেকবার ফোনটার দিকে তাকাল লাবণ্য। অমিতটাকে সেই যে কখন ফোন করেছে, ধরছেই না ছেলেটা। মেসেজ দিয়ে রেখেছে। এই দিনগুলোতে নেটওয়ার্কের এত সমস্যা হয়! কি জানি কোথায় আছে ছেলেটা। কাল কথা প্রসঙ্গে অমিতের সাথে দুষ্টামি করতে করতে খেপিয়ে দিয়েছিল লাবণ্য। অমিতটা বড্ড খেপেছিল, সারারাত ফোন অফ। ডিপার্টমেন্টের রিহার্সালেও আসেনি। সব কাজের মধ্যমণি যেই ছেলেটা, অবলীলায় সব কিছু বাদ দিল! এত অভিমান!! এত রাগ? কি করে যে পারে ছেলেটা এত রাগ করতে? লাবণ্যর রাগতো বেশিক্ষণ টিকেনা। কেন জানি অমিতের সাথে কোনভাবেই পারেনা রাগ করে থাকতে! ছেলেটা যে কেন পারে! কীভাবে পারে!
মন খারাপ হতে থাকে লাবণ্যর। ও...যে কেমন! জানে ছেলেটা অভিমানী, কি দরকার ওকে খেপিয়ে দেবার! নিজেকে খুব করে বকে দিতে ইচ্ছা হচ্ছে! আর অমিতটাই বা কি!! এত রাগ করতে হয়?? ও তো জানেই লাবণ্য দুষ্টামি করে, ওকে রাগাতে যে লাবণ্যের অনেক মজা লাগে, তাও তো জানে সে! তবে কিসের এত রাগ?? লাবণ্যকে কি পড়তে পারেনা অমিত?? সেই দিন থেকে, যখন থেকে শুধুই ক্লাসের বন্ধুদের "শেষের কবিতার লাবণ্য-অমিত" নিয়ে পুরো ক্লাসসুদ্ধ ওদের পিছনে লেগে থাকা অতিক্রম করে, আস্তে আস্তে নিজেদের ভালবাসার তীর্থ খুঁজে নিয়েছিল নিজেদের মধ্যে! যখন ভালবাসার পবিত্রতায় বেড়ে গিয়েছিল একে অন্যের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ। কেন তবে এত রাগ? কিসের এত অভিমান? চোখের কোণে পানি জমতে শুরু করেছে! কি বিচ্ছিরি একটা অভ্যাস! কিছু হলেই কান্না পেয়ে বসে। ফোনটা হাতে নিয়ে একটা মেসেজ লিখল লাবণ্য। ফোনের কিপ্যাডগুলোতে জোরে জোরে চাপ দিয়ে যেন নিজের অভিমান আর কষ্টকে উগড়ে দিচ্ছে সে।

আমি তোমায় আবার ভালবাসবো দেখো। তুমি শুধু উপেক্ষা করো আরেকবার...
আগের মত সোনা ডাঙার চিল হয়ে যাও,আগের মত শালুকপাতার বিল হয়ে যাও।
হাত বাড়ালেই তোমায় যখন পাবোনা আর
তখন থেকে আবার তুমি আমার!


মেসেজ পাঠিয়ে দিয়ে রওনা হল ক্যাম্পাসে। সবাই কী সুন্দর করে সেজেছে! সবাই কত খুশি! সবাই ওর প্রশংসা করছে। কিন্তু কিছুই যেন মনকে শান্ত করছে না আজ! যার জন্য এত সাজসজ্জা, যাকে ঘিরে এত কিছু, যার জন্য আজ লাবণ্য নিজের লাবণ্যকে মেলে দিতে এসেছে, সেই মানুষটার যে কোন দেখা নাই। কেউ দেখেনি। খুব একা লাগতে থাকে লাবণ্যর। গলায় কি যেন আটকে আছে। ফুঁপে বের হয়ে আসতে চাচ্ছে যেন কোন জলোচ্ছ্বাস! মুখ ঘুরিয়ে নিজেকে সামলাতে চেষ্টা করে। পিছনে গান বাজছে, খুবই প্রিয় গান লাবণ্যের.....

বৈশেখেতে রং মাখিবি কে কে আয় ও....বধূয়া....
তোর চুলেতে কেন ফুল নেইরে হায়........
জোনাক জ্বলে চিকমিক চিকমিক করে
বুকের মধ্যে বোশেখের ঝড় ওঠে...................

বুকের ভেতরটা কেমন যেন খালি খালি লাগতে থাকে। আর পারছেনা। বারবার দমকে উঠছে। নাহ! কোন ফোন নাই, কোন রিপ্লাই ও নাই। আরেকটা মেসেজ লিখতে বসে লাবণ্য, এই শেষ!! না হয় চলে যাবে আজ! হবেনা একটা বৈশাখ করা! এই তো চাও তুমি অমিত!! প্রচন্ড রাগ হতে থাকে। খুব দ্রুত লিখতে থাকে সে। কি আজব। চোখের পানিতে ফোনের কিপ্যাড ভিজে যাচ্ছে! নাহ, এভাবে কাঁদা যাবেনা! ছেলেটা যদি রাগতে পারে, রাগ তারও আছে, কষ্ট তারও হয়।

তোমাকে ক্ষমা করেছি অরন্য
এভাবে দখলে দখলে জর্জরিত করার অপরাধ,
শ্বাসপ্রশ্বাসে ঢুকে যাওয়ার অপরাধ।
.........................................
তবু ক্ষমা করেছি অরন্য।
ভালবেসে আর যাই হোক
ভালবাসায় দিতে শিখেছি আমি!



সবার অলক্ষ্যে চলে যেতে চাচ্ছিল লাবণ্য। গেটের দিকে যেতে কয়েক কদম পা বাড়িয়েছে। "নাহ! আর দেখবনা পিছন ফিরে!" নিজেকে বার বার বলে যাচ্ছে। হঠাৎ শুনতে পেল আনিকার কন্ঠস্বর......"আরে অমিত! কই ছিলে? তোমার লাবণ্য তো তোমাকে খুঁজেই সারা! এই তো এই মাত্র এখানে ছিল! কোথায় যে গেল!" নাহ! পিছন ফিরবে না সে! যাবেনা অমিতের কাছে। মনকে বারবার বুঝিয়ে যাচ্ছে। প্রবোধ দিচ্ছে আপন মনে। কিন্তু অস্হিরতা কাটছেনা, কি হয় দেখলে একটি বার। অমিতকে কিনে দেয়া সেই পান্জাবিটা কি পরেছে অমিত? আর ওর জন্য নিয়ে আসার কথা যেই ফুলগুলো? যেগুলো খোঁপায় গুঁজে দিবে বলেছিল? "একবার শুধু দেখি! প্লিস" নিজের কাছে অনুনয় করছিল যেন। হঠাৎ একটা হাত এসে চেপে ধরল লাবণ্যের হাত। চুড়িতে হালকা চাপ লাগল। মুখ শক্ত করে আছে লাবণ্য। ভাঙতে দেয়া যাবেনা নিজেকে। নিঃশব্দে হেঁটে যাচ্ছে পাশাপাশি। হাতে একটা চিরকুট দিয়েছে অমিত। পিছন ফিরে মুখ তুলে অশ্রুসজল চোখে চিরকুট খুলে পড়তে লাগল লাবণ্য। প্রিয় কটা লাইন--

“হে ঐশ্বর্যবান,
তোমারে যা দিয়েছিনু, সে তোমারই দান
গ্রহন করেছ যত, ঋনী তত করেছো আমায়"



সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই এপ্রিল, ২০১১ ভোর ৫:৩১
৫৬টি মন্তব্য ৫৬টি উত্তর পূর্বের ৫০টি মন্তব্য দেখুন

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ছায়ানটের ‘বটমূল’ নামকরণ নিয়ে মৌলবাদীদের ব্যঙ্গোক্তি

লিখেছেন মিশু মিলন, ১৭ ই এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩



পহেলা বৈশাখ পালনের বিরোধীতাকারী কূপমণ্ডুক মৌলবাদীগোষ্ঠী তাদের ফেইসবুক পেইজগুলোতে এই ফটোকার্ডটি পোস্ট করে ব্যঙ্গোক্তি, হাসাহাসি করছে। কেন করছে? এতদিনে তারা উদঘাটন করতে পেরেছে রমনার যে বৃক্ষতলায় ছায়ানটের বর্ষবরণ... ...বাকিটুকু পড়ুন

বয়কটের সাথে ধর্মের সম্পর্কে নাই, আছে সম্পর্ক ব্যবসার।

লিখেছেন ...নিপুণ কথন..., ১৭ ই এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:৫০


ভারতীয় প্রোডাক্ট বয়কটটা আসলে মুখ্য না, তারা চায় সব প্রোডাক্ট বয়কট করে শুধু তাদের নতুন প্রোডাক্ট দিয়ে বাজার দখলে নিতে। তাই তারা দেশীয় প্রতিষ্ঠিত ড্রিংককেও বয়কট করছে। কোকাকোলা, সেভেন আপ,... ...বাকিটুকু পড়ুন

মানুষের জন্য নিয়ম নয়, নিয়মের জন্য মানুষ?

লিখেছেন রূপক বিধৌত সাধু, ১৭ ই এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৫:৪৭



কুমিল্লা থেকে বাসযোগে (রূপান্তর পরিবহণ) ঢাকায় আসছিলাম। সাইনবোর্ড এলাকায় আসার পর ট্রাফিক পুলিশ গাড়ি আটকালেন। ঘটনা কী জানতে চাইলে বললেন, আপনাদের অন্য গাড়িতে তুলে দেওয়া হবে। আপনারা নামুন।

এটা তো... ...বাকিটুকু পড়ুন

একজন খাঁটি ব্যবসায়ী ও তার গ্রাহক ভিক্ষুকের গল্প!

লিখেছেন শেরজা তপন, ১৭ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:০৪


ভারতের রাজস্থানী ও মাড়ওয়ার সম্প্রদায়ের লোকজনকে মূলত মাড়ওয়ারি বলে আমরা জানি। এরা মূলত ভারতবর্ষের সবচাইতে সফল ব্যবসায়িক সম্প্রদায়- মাড়ওয়ারি ব্যবসায়ীরা ঐতিহাসিকভাবে অভ্যাসগতভাবে পরিযায়ী। বাংলাদেশ-ভারত নেপাল পাকিস্তান থেকে শুরু করে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছিঁচকাঁদুনে ছেলে আর চোখ মোছানো মেয়ে...

লিখেছেন খায়রুল আহসান, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:০৯

ছিঁচকাঁদুনে ছেলে আর চোখ মোছানো মেয়ে,
পড়তো তারা প্লে গ্রুপে এক প্রিপারেটরি স্কুলে।
রোজ সকালে মা তাদের বিছানা থেকে তুলে,
টেনে টুনে রেডি করাতেন মহা হুলস্থূলে।

মেয়ের মুখে থাকতো হাসি, ছেলের চোখে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×