somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

নাইটমেয়ার

০৩ রা জুলাই, ২০১০ রাত ১০:১০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


প্রথম তাকে দেখা গেল অফিসিয়াল শাদা শার্ট, ব্ল্যাক প্যান্টে অল্প চুলে ঢাকা মাথাটা বেশ রাজকীয় ভঙ্গিতে সামনের দিকে ঝোঁকানো। পূর্বাপরহীন কথার সূত্রপাত। উদ্দেশ্য সামাজিক, বিধেয় অজানা। আপনার শেলফ জুড়ে তো অনেক বই। হ্যাঁ। তো আপনার প্রিয় লেখক কে? অনেকেই, তবে কাফকা ইজ্ দ্য বেস্ট। কাফকা? হ্যাঁ। ফ্রানৎস কাফকা। নাম শুনিনি তো কখনো। ওহ! এই ছিল কথার সূত্রপাত। তারপর ঘটনা ঘটে চলল নিয়মতান্ত্রিকভাবে। মুকুন্দরামের চরিত্র সব। কেউ কালকেতু, কেউ ফুল্লরা, কেউ যুবরাজ, কেউ কুইন অফ সেবা, কেউ ঘুটে কুড়ানি। উৎসবের বাতি সব জ্বলতে শুরু করল। ছাদ জুড়ে আলোর ফুল, নকল হিরার ফুল। অনেকেই তাদের বাগানে নকল হিরার ফুল সাজিয়ে রাখতে পছন্দ করে। নকলও যখন আসলের মতো উদ্ভাসিত হয়, একই রকম উষ্ণতা, আর্দ্রতা, শৈত্যভাব এনে দেয় তখন নকল আর আসলের প্রভেদ থাকে না। মনের অবস্থা তখন চরম হয়ে দেখা দেয়। ছোট-কাটরা, বড় কাটরা, আহসানমঞ্জিল সব যখন দেখা শেষ তখন মাথায় চাপল মঞ্চ-নাটক। কোপার্নিকাসের কাপ্তেন, সময়ের প্রয়োজনে, নিমজ্জন। দেখতে দেখতে দর্শকরা সব ঝিমিয়ে এলে চোখে পড়ল রোমশ হাত। শার্টের ভেতরে ঢাকা পড়া হাতটি ক্ষণিকের জন্য দৃশ্যমান হল মঞ্চের আলোতে। তারপর সব চুপচাপ। বাতি চলে গেল। সারা শহরে কোনো বাতি নাই। হাঁটতে হাঁটতে ক্রিসেন্ট লেকের স্বচ্ছ জল। সে জলে মুখ দেখা যায়। চাঁদের মৃদু আলোতে সব কিছু দেখা যাচ্ছে। সেখানে দেখা হল দ্বিতীয়বার। মাথার মাঝখান থেকে সোজা একটা শিং উঠে গেছে আর বুকের খাঁচা জুড়ে অসংখ্য হাড়-গোড় : মানুষের, শূকরের, আর সেখানে আস্ত একটা রাজহাঁস, অর্ধ-দগ্ধ।
রাতের কাপ্তাই লেকে ভেসে উঠেছে অসংখ্য চাকমা নারী, যুবক, বৃদ্ধ, বৃদ্ধার লাশ। রক্তের একটা ক্ষীণধারা এসে মিশেছে চাকমা রাজবাড়ির হেঁশেল থেকে। অসংখ্য সারস, সারসের ছিন্ন-ভিন্ন দেহাংশ ভেসে বেড়াচ্ছে লেকের গভীর জলে। এখানে ডুবে আছে কত প্রেম-অপ্রেম, ঘৃণা, অবদমন, বেদনা, নৃশংসতার কাহিনি। তারই উপরে ভেসে চলছে ইঞ্জিনের নৌকা। অস্পস্ট আলোয় দেখা যাচ্ছে দোহারা নারী-পুরুষ; তাদের চান্দ্র ভ্রমণ। এ ভ্রমণ মধুর নয়, এ শুধু স্রোতের টানে ভেসে চলা। যেমন ভেসে চলে কচুরি, শ্যাওলা, শাপলার ঝাড়, মুণ্ডুহীন নারী। ডিনারের টেবিলে পমফ্রেট ফ্রাই, সিজলিং বিফ, ফ্রায়েড রাইস, জলের বদলে সোডা ওয়াটার। পরিপাটি হোটেলের ডাইনিং রুম- ন্যাপকিন, ফর্ক, টেবল স্পুন, সাইড ডিশ। সাদা শার্ট পরা ওয়েটার কিন্তু সকল টেবিল শূন্য। কোনায় ইউরোপিয়ান এক নারী, সাথে ফিলিপিনো যুবক আর একজন আরব; হয়তো ব্যবসায়ী দল নয়তো পর্যটক। স্মার্টলি ছুরি দিয়ে কাটছে রাঁজহাসের বারবিকিউ। বিপরীত কোণে নৌকার নারী-পুরুষ। নিঃশব্দে খেয়ে চলেছে সিজলিং প্রণ। গুডনাইট স্যার, গুডনাইট ম্যাডাম। ওহ্ থ্যাঙ্কস। নানারকম সৌজন্য-শব্দে ভরে উঠল হোটেলের ডাইনিং ঘর। হোটেলের এ-মাথা হতে ও-মাথা টানা বারান্দা । অসংখ্য অর্কিড, ক্যাকটাস, পাতাবাহার দিয়ে ছেয়ে আছে ব্যালকনি। অন্ধকারে লতিয়ে ওঠা মানিপ্ল্যান্ট অজগরের মতো দাঁড়িয়ে আছে। নারী প্রবেশ করল স্নানঘরে, সঙ্গী ধূমপানরত, হোটেলের বদ্ধ ঘরে। ধোঁয়ায় ভরে গেছে ঘরের বাতাস। মোবাইল সংযোগ বিচ্ছিন্ন,ল্যান্ডফোন বিকল। পিনপতন নিস্তব্ধতা। বাথরুমের দরজায় প্রচণ্ড শব্দ। আমি তোমাকে খুন করব। মানে? মানে কী জানিস না শয়তান....
অর্ধ ভেজা শরীরে বাথরুম থেকে বেরিয়ে এলো নারী। তুমি ন্যাংটা হয়ে গোসল করছিলে না? সব দেখা যাচ্ছে লন থেকে।
মানে? কী বলছো এসব? তুমি ভীষণ উল্টা-পাল্টা কথা বলছো।
কী!!! আমি মিথ্যা বলছি তোকে? হারামজাদী। মুহূর্তে বদলে গেল ভাষা। চোখ জ্বলছে। ক্রমশ শ্বেত বর্ণের শরীরে জেগে উঠলো কেনিয়ান বাঘের ছোপ, রোমশ থাবা। হোটেলের নির্জন কক্ষে শিকার-শিকারী। নয় কোনো প্রেমিক-প্রেমিকা পতি-পত্নী, বন্ধু-বান্ধবী। এ অন্য পৃথিবী। মঞ্চের এক পাশে গ্রীন রুম। সবাই নাটকের জন্য সাজছে। কারো হাতে ছুরি, কারো বা রামদা, লাঠি, ফুলের মালা। কার জন্য কী অপেক্ষা করছে কেউ বলতে পারে না। চরিত্ররা নীরব, অপেক্ষমান। এটা তো ঘটছে দরজার ভেতরে। দরজা ভেতর থেকেই লক করা। শীততাপ নিয়ন্ত্রিত হোটেলের ঘর হতে কোনো অস্ফুট চিৎকার, শীৎকার, বলাৎকারের কোনো শব্দই বাইরে যায় না। কোথাও পৌঁছায় না কোনো শব্দ। কেউ বুঝতে পারে না ভেতরে বেড়ে ওঠা প্যারানয়েড সিনড্রোমকে। হ্যালুসিনেশনের ভেতর কাটিয়ে দেয়া এক-একটা জীবন। আর যদি কেউ পাল্টে দেয় ঘটনার ধারাকে তো শুরু হতে পারে নিঃশব্দ কবরের ঘরে নির্জন অধিবাস। যুগ-যুগান্ত ধরে সে জীবন। কেউ ছুঁড়ছে পাথর, কেউ লোহার টুকরো। রক্তাক্ত যোয়ান অফ আর্ক, রক্তাক্ত আনা কারেনিনা, রক্তাক্ত মাদাম বোভারী, রক্তাক্ত নভেরা আহমেদ। ক্রাইস্টের বিপরীতে মুক্ত করে দেয়া বারাব্বাস। সেই লাল চুলের স্থূলাঙ্গী নারী যে ভেবে নেয় বারাব্বাস তাকে ভালোবাসছে বা এইসব মিঃ জেকিল এন্ড মিঃ হাইড। তারাও তো জানে কে তারা- কেন? এক নিঃশ্বাসে নিঃশেষ হেমলকপূর্ণ পাত্রটি। জ্ঞানবিদ্বেষপূর্ণ পানীয়টি পান করে যন্ত্রণার আনন্দে কাঁপছে সক্রেটিস।

পুরুষ সঙ্গীটির চোখের নীচে বড় একটা কাঁটা দাগ। হোটেলকক্ষে কাঁপছে থরথর করে। চোখ বিস্ফারিত। ভয়ার্ত নারী দরজা খুলে বাইরে যেতে চাইলে মত্ত হাতির মতো উন্মাদনায় জাপটে ধরল তাকে। জিভ দিয়ে চাটতে থাকল সারা শরীর। রাতের মত্ত হাতিই লেকের শীতল ভোরে অন্য মানুষ। একটা বেগুনি লজ্জাবতী। ছুঁয়ে দিলে বুজে আসছে। ব্রেডে বাটার লাগাতে লাগাতে অন্যমনস্ক নারী। কী খাচ্ছো-না? হ্যাঁ। কোথায়? অরেঞ্জ জুসটা খাও, ভাল লাগবে। এটা এই হোটেলের সবচেয়ে ভাল ব্রেকফাস্ট। তোমার জন্য অর্ডার দিলাম। তুমি তো ভিন্ন কিছু পছন্দ করো। নিঃশব্দে জুসে মুখ দিয়ে নারী ভাবছে অন্য কথা। সারসের উড়ে চলা দূর আকাশে সাইবেরিয়ার সারসেরা প্রতিবছর খাবারের সন্ধানে উড়ে আসে কত হাজার মাইল, ক্লান্তিহীন বা ডানায় তাদের থাকে ভরা ক্লান্তি। তবু বাতাস কেটে কেটে কত পথ চলা। কত ঝড়-ঝঞ্ঝা, তুহিনঝরা রাত। তোমার শরীর খারাপ লাগছে? নারী শক্ত মুখে বসে থাকে। তার চোখে-মুখে নির্লিপ্তি। কে এই সঙ্গী? কাগজে সাক্ষর দিয়ে তৈরি করা মানুষ। নিয়ম দিয়ে বাধা সম্পর্ক। কাপ্তাইয়ের লেকে, বান্দরবানের পাহাড়ে, ইনানি বিচে, হোটেলে-মোটেলে যেখানে খুশি যাও, থাকো, রাত্রি-যাপন করো কেউ কিছু বলবে না।
কৃষ্ণাভ নারী হলুদ রঙের জামদানি শাড়ি পরে পাহাড়ের ঢাল বেয়ে নামছে, নামছে। বেশ ঢালু পথটা। গাছ ধরে-ধরে নেমে আসা। সঙ্গীও চলছে কিছুটা পেছনে, বুনো লতা-গুল্ম, স্বর্ণলতার থোকা সব প্যাঁচানো-জড়ানো। কিছু দূর পরপর মেহগনি, শিরিষ, শাল নানা জাতের গাছ। ঢাল বেয়ে নামতেই ছোট একটা জলাশয়মতো, কিন্তু জলটা স্বচ্ছ। একজন বৃদ্ধা বসে আছে নীল ডুরে শাড়ী পড়া, বিড়ি ফুঁকছে। এখানে কেউ থাকতে পারে অবিশ্বাস্য। কথা বলে জানা গেল হোটেলে মশলা পেষার কাজ করতো এখন তার মেয়ে সে কাজ করে। একটু অন্ধকার হয়ে এলে বৃদ্ধা পাহাড় বেয়ে তরতর করে উঠে গেল। ভোজবাজির মতো মিলিয়ে গেল। রাত হয়ে এলে আবার ঢাল বেয়ে উপরে উঠে আসা। ওঠার পথে জামদানি শাড়ি খানিকটা ছিঁড়ে গেল। ওঠাটা কঠিন কিন্তু চেনা বলে সময় লাগল কম। উপরে উঠতেই নির্জন পথ সোজা চলে গেছে হোটেলে আর বিপরীত দিকে শহরের পথ। রাতের ডিনারে সেই বিদেশিনী । আজ বেশ একটা লেস দেয়া ড্রেস পড়ে এসেছে। চোখে-মুখে স্মার্টনেস। পশ্চিমা নারীÑপুরুষের এই স্মার্টনেস কি তাদের সহজাত? না মনে হয়। এ হচ্ছে সর্বোচ্চ সুবিধার মধ্যে বেড়ে ওঠার ফল। সারা পৃথিবীর অসংখ্য মানুষের রক্ত পান করে তাজা হয়ে ওঠা মানুষ এরা। কিন্তু এ জন্য শুধু এ মেয়েটি দায়ী নয়। মেয়েটির পূর্ব-পুরুষেরা হাঁটুÑভাঙার বাঁকে যে কবর তৈরি করেছে সেখানে অসংখ্য মানুষের আর্তনাদ শোনা যায়। তার উপরেই তৈরি হয়েছে স্কাইস্ক্র্যাপার, টুইন টাওয়ার....কত কী! বেদানার জুসকে মনে হচ্ছে চুমুকে চুমুকে রক্ত পান করছে আরবটি। নারী চোখ ফিরিয়ে নিল। পেট উগড়ে বমি এলে দৌড়ে গেল বেসিনে। পেছনে সঙ্গী। কী হল তোমার? ঢক ঢক করে বমি করে ভাসিয়ে দিল বেসিন। ওয়েটার দু’জন দৌড়ে এলো। শেষে ক্লান্ত শরীরে সিঁড়ি বেয়ে ২০৮ নম্বর রুমেÑ সেখানে মৃদু আলোতে পূর্ব রাতের স্মৃতি ভর করল নারীর মনে। খুব জোর করে চোখ বন্ধ করে ঘুমানোর চেষ্টা। সঙ্গী কাঠের সোফাতে বসে একটার পর একটা সিগারেট খাচ্ছে ।
আমার সাথে আসাটা তোমার ঠিক হয়নি বোধহয়, আমাকে স্বাভাবিকভাবে নিতে পারছো না, ভয় পাচ্ছো । না আমি তোমার কোনো ক্ষতি করব না, কিন্তু আই নো হু ইউ আর। ট্রাপড ইনোসেন্ট গাইস, দেন টরচারড দেম। আমি তা এলাউ করব না- নো নেভার। এটা তোমাদের পেশা । নারী কম্বল গায়ে দিয়ে চুপ করে আছে। মনে হচ্ছে জোরে নিঃশ্বাস ফেললেই দৌড়ে এসে ঝাঁপিয়ে পড়বে। ইউ আর এ প্রফেশনাল উম্যান। আই উইল ডিভোর্স ইউ সুন। এখন যত পারো ঘুমিয়ে নাও, আমরা কিন্তু কাল সকালে কক্সবাজার যাচ্ছি না, ঢাকায় ফেরত যাচ্ছি। ঢাকায় ফিরেই তুমি সোজা তোমাদের বাসায় চলে যাবে, আমি আমাদের বাসায়। পরে যা করার করব। সব ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে যাবে-এসব বলতে বলতে পুরুষ সঙ্গীটি বিছানায় উঠে এলো। জড়িয়ে ধরল সঙ্গিনীকে- সাদা ম্যাক্সি টেনে খুলে ফেলল। তারপর উন্মত্ত আদর। মেয়েটি অসাড় হয়ে পড়ে থাকল। নিঃশ্বাসের ওঠানামা বাড়ছে। মেয়েটির মনে হচ্ছে গলা টিপে মেরে ফেলা হবে তাকে। কেউ জানতে পারবে না। কাপ্তাই লেকের অতল জলে তলিয়ে যাবে চাকমাদের মতো। অসংখ্য ভেসে ওঠা লাশের সারি, সেখানে নিজের লাশও দেখতে পাচ্ছে মেয়েটি। হঠাৎ ফোনের ক্রিং ক্রিং শব্দে চমকে উঠল দুজনেই। দৌড়ে ফোন ধরতেই ঐপাশে টু টু শব্দ শোনা গেল। সারারাত মটকা মেরে পড়ে থাকতে থাকতে ভোর হয়ে এলে মেয়েটি উঠে বাথরুমে যায়। কলের শব্দ শুনে সঙ্গীটি জেগে ওঠে । দরজায় নক। দ্রুত ভয়ার্ত মুখে বেরিয়ে আসে মেয়েটি। কী, রাতে ভয়ে ঘুমাতে পারোনি? ভেবেছ মেরে তোমাকে লেকে ফেলে দেব? চমকে উঠলেও মুখে স্বাভাবিক অভিব্যক্তি আনার চেষ্টা। ব্রেকফাস্টের পর চেক আউট করে হোটেল থেকে বেরিয়ে পড়ল দুজন। ঢাল বেয়ে বেশ খানিকটা নামার পর বেবি ট্যাক্সি পাওয়া গেল। বিকট শব্দে এক- হাত, দু- হাত লাফিয়ে লাফিয়ে ট্যাক্সি এসে থামল রাঙামাটি বাসÑস্ট্যান্ডে। সঙ্গীর চোখে-মুখে ঝিলিক, বলল - এবারের মতো মাফ করে দিলাম। বাট নট ফর এভার। কাউন্টার থেকে ঢাকার না কক্সবাজারের টিকেট কেনা হল দুটো। বাস চলতে শুরু করলে জানালা দিয়ে দেখা যাচ্ছে চারপাশের লালচে পাহাড় আর তার মধ্যে ছড়িয়ে থাকা সবুজ বৃক্ষরাজি, লাল পোষাকে নারীরা পাহাড়ের ঢাল বেয়ে উঠছে- খুব সুন্দর হালকা হলুদ মিষ্টি আলো, পাহাড়ি কলাগাছের সারি, আনারসের ঝোপ। কিন্তু কোনো দৃশ্যই মেয়েটির মনে ভালোলাগার অনুভূতি জাগাতে পারছে না। মনের ভেতর চরম অনিশ্চয়তা, অসহ্য অনুভূতি। এ কার সাথে চলেছে সে? ক্ষণে ক্ষণে পাল্টে যায়। অসুস্থ মনের বিকার। সঙ্গীটি মেয়েটিকে টুপি পরিয়ে দিল, জানালার পর্দা টেনে দিল। বলল, ঘুমাও, সারারাত ঘুমাওনি।
রাঙামাটির খাড়াই-উৎড়াই পাহাড় ছেড়ে ধীরে ধীরে বাসটি এগিয়ে চলল। বিউটি এন্ড দ্য বিস্ট, বিউটি এন্ড দ্য বিস্ট। এ কথাটা সারাক্ষণ ঘুরছে মাথায়। সকলের মধ্যেই তো এই হিংস্রতা, এই সৌন্দর্য রয়েছে। কারো মাঝে বিস্টটা বেশি, বিউটিটা কম, কারো উল্টো। বিয়ের সিদ্ধান্তটা হুট করেই নেয়া, এত অসহনীয় এক অবস্থার মধ্যে দিয়ে দিন চলছিল তখন যে যা-কিছু করে ফেলার মতো অবস্থা। স্বাভাবিকতার কোনো বালাই ছিল না তখন। একাকীত্ব আর সমাজÑবিচ্ছিন্নতা। না কোনো স্বপ্ন নয়, দুঃস্বপ্ন নয় - সময়ের প্রয়োজনে মুহূর্তের সিদ্ধান্ত...যেন সময় চলে গেলে আর তা করা হত না। ঠিক সুইসাইড করার মতো..... যখন সেই চরম মুহূর্তটা আসে তারপর এক সেকেন্ড চলে গেলে অন্য মানুষ, অন্য চিন্তা। আয়নায় যে চোখ তখন দেখা যায় তা সম্পূর্ণ অচেনা। জুয়া খেলার মতো কার্ড টেনে নেয়া। মেয়েটি স্পেডট্রামে বরাবরই ভাল কিন্তু যখনই সে কোনো হৃদয়ঘটিত সম্পর্কে মারাত্মকভাবে জড়িয়ে গেছে বা আদৌ তা ঘটত কি না তাতো এখন সন্দেহ হয়। তার রিফ্লেকশন খুব মর্মান্তিক হয়েছে। সে যতই ভালোবেসেছে, উন্মাদ হয়ে উঠেছে, চরম রিস্কের মধ্যে গেছে ততই সঙ্গী হয়ে উঠেছে অচেনা..ক্রুয়েল। না, মানুষের মনের পরিবর্তনটা মেনে নেয়া যায় কিন্তু সম্পর্কের মধ্যে বিভ্রান্তি তৈরি করা, গোপনতা, ডিস্রেসপেক্ট্ এক পর্যায়ে নিজের কাছেই নিজেকে কদাকার করে তোলে। আরশিতে যে চোখ সে দেখত তা বেদনায় নীল নয়, রিজেক্শন্ আর না বোঝার ফলে যতদূর সম্ভব নিরুত্তাপ হতে পারে সে চোখের দৃষ্টি তাই হয়ে উঠেছিল। এমন নয় যে তা শুধু ভালোবাসা না পাওয়ার জন্য। বরং তার সম্পূর্ণ অস্তিত্বকে গ্রহণ করতে না পারা। খুব কাছে এসে আর সহ্য করতে না পারা। এসবই সেসময়ে তাকে প্রায় অস্তি¡ত্বহীন করে তুলেছিল। এমন-কী নিজের কাছেও নিজের কোনো প্রয়োজন আর ছিল না। তলস্তয়ের কাতেরিনা হয়ে গেল মাস্লভা,-চোর কাঁটা এক। নিজেকে নিয়ে খেলাচ্ছলে সব করে গেল মেয়েটি.....তার চিবুকে, চোয়ালে একটা নিরন্তর বিষন্নতা - সেই স্পেনীয় শেষ যুবরাজ
আব্দুল্লাহ‘র মতো যার ভূতÑভবিষ্যৎ আগেই জানা ছিল.....সবাই জানতো স্পেনের প্রতিটা আত্মা জানতো । সবার চোখের মধ্যে ছিল হাহাকারের চিহ্ন। রাজ্যপাট হারিয়ে ধূসর মরুভূমিতে মরীচিকার পেছনে ছুটতে ছুটতে....আব্দুল্লাহ হায়! কোথায় সে আব্দুল্লাহ - এ তো কক্সবাজার শহরে ঢোকার মোড়। দুপাশে সবুজ ঘাসে ঢাকা লালচে পাহাড়, বাঁশের বেড়া দিয়ে ঘেরা ছোট ছোট ঘর। পাহাড়ের ঢালে একটা দুটো ঘর বেশ দূরে দূরে। মাথায় লাকড়ি নিযে পাহাড়ের ঢাল বেয়ে উঠছে চাকমা মেয়েরা, পিঠে ছোট ছোট পুটলিতে তাদের শিশুরা। বাস এত দ্রুত চলছে, সিনেমার এডিটিং টেবিলে বসে কাঁচি চালিয়ে যাবার মতো দেখতে হচ্ছে বাইরেটা। পথটা এক জায়গায় এসে ঢালে নামতে শুরু করলো । আবার উঠছে। বাসটা ঢাল বেয়ে উঠছে। দূরের ছাইরঙা সমুদ্রটা হঠাৎই যেন নিচ থেকে উপরের দিকে ভেসে উঠছে। দৃষ্টি সীমায় এসে পড়ল জেগে ওঠা সমুদ্রটা........অপূর্ব এক দৃশ্য। শরীরে অচেনা শিহরণ। বিশাল জলরাশি ভেতরটাকে একেবারে বদলে দিল। হঠাৎই বাসটা ডানে মোড় নিল। ওয়াইন খাওয়ার পর যেমন একটু মৃদু আবেশ আসে তেমনভাবে চোখ বুজে আসছে। পাশের সঙ্গী বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। চেহারায় একটা শিশুসুলভতা। পাঁচ-ছয় বছরের বালকদের মতো লাগছে। বাস ছুটছে কলাতলি বাস স্টপেজের দিকে। আরেকটা শহর। কক্স সাহেবের সমুদ্রশহর। নামগুলো সব ইতিহাস, তেমন কেউ জানেও না। অ্যানাদার এক্সপেরিয়েন্স, অ্যানাদার নাইটমেয়ার। বুনো স্ট্রবেরি। এল সি ডি স্ত্রিনে ভেসে ওঠা স্ট্রবেরি। মুখে দিতেই গাল বেয়ে চুইয়ে পড়ছে রস। রক্তবর্ণ রস। স্বাদ লবনাক্ত। রক্তের স্বাদ কি এমন? কে জানে। কাঁচা মাংস খাওয়ার দিন তো কবেই শেষ হয়ে গেছে। তবু মুখে যেন সেই স্বাদ লেগে আছে, পুরানো স্বাদ, বাইসনের স্বাদ।

সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা জুলাই, ২০১০ রাত ১১:১১
২টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ডালাসবাসীর নিউ ইয়র্ক ভ্রমণ

লিখেছেন মঞ্জুর চৌধুরী, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ২:৪৪

গত পাঁচ ছয় বছর ধরেই নানান কারণে প্রতিবছর আমার নিউইয়র্ক যাওয়া হয়। বিশ্ব অর্থনীতির রাজধানী, ব্রডওয়ে থিয়েটারের রাজধানী ইত্যাদি নানান পরিচয় থাকলেও আমার কাছে নিউইয়র্ককে আমার মত করেই ভাল ও... ...বাকিটুকু পড়ুন

ধর্ম ও বিজ্ঞান

লিখেছেন এমএলজি, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৪:২৪

করোনার (COVID) শুরুর দিকে আমি দেশবাসীর কাছে উদাত্ত আহবান জানিয়ে একটা পোস্ট দিয়েছিলাম, যা শেয়ার হয়েছিল প্রায় ৩ হাজারবার। জীবন বাঁচাতে মরিয়া পাঠকবৃন্দ আশা করেছিলেন এ পোস্ট শেয়ারে কেউ একজন... ...বাকিটুকু পড়ুন

তালগোল

লিখেছেন বাকপ্রবাস, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৩৫


তু‌মি যাও চ‌লে
আ‌মি যাই গ‌লে
চ‌লে যায় ঋতু, শীত গ্রীষ্ম বর্ষা
রাত ফু‌রা‌লেই দি‌নের আ‌লোয় ফর্সা
ঘু‌রেঘু‌রে ফি‌রে‌তো আ‌সে, আ‌সে‌তো ফি‌রে
তু‌মি চ‌লে যাও, তু‌মি চ‌লে যাও, আমা‌কে ঘি‌রে
জড়ায়ে মোহ বাতা‌সে ম‌দির ঘ্রাণ,... ...বাকিটুকু পড়ুন

মা

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৩


মায়াবী রাতের চাঁদনী আলো
কিছুই যে আর লাগে না ভালো,
হারিয়ে গেছে মনের আলো
আধার ঘেরা এই মনটা কালো,
মা যেদিন তুই চলে গেলি , আমায় রেখে ওই অন্য পারে।

অন্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

কপি করা পোস্ট নিজের নামে চালিয়েও অস্বীকার করলো ব্লগার গেছে দাদা।

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:১৮



একটা পোস্ট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ আগে থেকেই ঘুরে বেড়াচ্ছে। পোস্টটিতে মদ্য পান নিয়ে কবি মির্জা গালিব, কবি আল্লামা ইকবাল, কবি আহমদ ফারাজ, কবি ওয়াসি এবং কবি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×