somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

জলাতঙ্ক

০৮ ই সেপ্টেম্বর, ২০১০ রাত ১০:১১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


রাত থেকেই পেটে ভীষণ ব্যথা হচ্ছে। এক একবার ব্যথাটা শুরু হচ্ছে একটা কামড়ের মধ্যে দিয়ে। ছোটবেলায় মাহবুব চীনা জোকের কথা অনেক শুনেছে। একেই হয়তো বলে মরণ-কামড়। একবার কামড়ের পর মেরে রেখে যাবে। কিন্তু এই চীনা জোক একবার মারার পর আবার আসে এবং আবার কষে কামড় বসায়। বাসার সবারই এমন হচ্ছে কিনা মাহবুব জানে না। তবে সকাল থেকেই পানিতে দুর্গন্ধটা আসতে শুরু করল। একেবারে কাঁচা গু’র গন্ধ। কুলি করার জন্য মুখে দিতেই গা গুলিয়ে এলো, মনে হচ্ছে পানির মধ্যে গু গুলিয়ে দেয়া হয়েছে। মাহবুব দৌড়ে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ায়। রাস্তা দিয়ে ফেরিওয়ালারা গাড়ি সাজিয়ে মৌশুমি ফল নিয়ে যাচ্ছে। সকালবেলা অফিস যাওয়ার পুরো মুডটাই নষ্ট হয়ে গেল। নাখালপাড়ার পানিতে কখনো এত দুর্গন্ধ আসে নি এর আগে। পুরান ঢাকা, মিরপুর, শান্তিবাগ এরিয়ায় পানির সমস্যার কথা অনেক শুনেছে মাহবুব। পেপার পত্রিকায় দেদারছে লেখালেখি হচ্ছে কিন্তু তা শুধু ইনফরমেশন হিসাবে স্মৃতিতে জমা হয়েছে কোনো অনুভূতি তৈরি করে নি এতদিন। আজ একেবারে ব্রক্ষ্মতালু জ্বালিয়ে দিয়েছে, নাহ্ এ পানি মুখে তোলা যাবে না।
মাহবুব কী অবস্থা দেখছ? এখন শান্ত, সৌম্যকে কোন পানি দেব? যাও দোকান থেকে মাম এনে দাও। বড় রাস্তার ওষুধের দোকান থেকে নিয়া আসো। পাড়ার দোকানে সব নকল।
কেন ঘরে ফুটানো পানি নাই আগের?
না নাই সকালে উঠে নাস্তা বানাইতে গিয়া সব খরচ হয়ে গেছে।
আশ্চর্য বাচ্চাদের পানি রাখবা না? মাম দিলেও তার ভরসা কী? মামও তো ফুটায়া দিতে হবে।
দিতে হলে দেব। কথা বলো না, মেজাজ এমনিতেই খারাপ হয়ে আছে।
শাকিলা সমস্যা মনে হয় তোমার একার হয়েছে আর কারো হয় নাই?
কার কার হইছে তা দিয়া আমি কী করব? কারো কারো তো সমস্যা হয়ও নাই। তাতে ফায়দা কী? এসব কুযুক্তি আমাকে দেখাতে আসবানা। কাজের মেয়ে দুইটার ডায়রিয়া শুরু হয়ে গেছে, ওদের দুটো করে এমডোকল খাওয়ালাম সকালে, তাও কু কু করতেছে।
আচ্ছা আমাদের বাসার পানিতেই কী এই সমস্যা দেখা দিল না পাশের বাসায়ও হয়েছে?
কী জানি! জানি না।
তুমি হনুফা না হলে অজিফাকে পাঠাও জেনে আসুক।
কোন বাসায় পাঠাব? ঐ হুজুরদের বাসায় পাঠাতে পারবনা, ওরা যা বেয়াদপ।
আরে আমি কি বলছি ঐ বাসায় পাঠাতে, নির্মলাদের বাসায় যাক।
ওহ্।
মাহবুবের পেটের কামড়টা আবার শুরু হয়েছে, দৌড়ে বাথরুমে গিয়ে ঢোকে। শান্ত, সৌম্যকে মামের বোতল কিনে স্কুলে পাঠান হয়। বাসার জন্য সারা দিন ধরে বড় রাস্তা’র আম্বিয়া ফুপু’র বাসা থেকে ক্যান ভর্তি করে পানি আনে হনুফা, অজিফা। বারবার আসা-যাওয়াতে বাসা কাদায় প্যাকপ্যাক হয়ে যায়। শাকিলা খিটখিটা মেজাজে সারাদিন ঘর পরিষ্কার করতে থাকে। পানির দুর্গন্ধটা একেবারে মগজের মধ্যে ঢুকে গেছে, কিছুতেই তাড়ানো যাচ্ছে না। শাকিলা কলেজে ফোন করে জানিয়ে দেয়; আজ যেতে পারবে না, বাসায় সমস্যা। কলেজের ভাইস প্রিন্সিপাল এমন তিরিক্ষি মেজাজের অথচ সব সময় তাকেই ফোন করে না আসার কারণ ব্যাখ্যা করতে হয়। শাকিলা বার বার ফোনের শব্দে দৌড়ে যায় কিন্তু কলটা আসে না। পিয়াল অনেকদিন ফোন করে না। ওর সাথে সকাল থেকে কথা বলতে ইচ্ছে করছে কিন্তু ইচ্ছাটা দমন করছে শাকিলা। পুরানো প্রেমিকের সাথে কথা ঘুরে- ফিরে ঐ একই বিন্দুতে এসে শেষ হয়, দু’জনের প্রতি দু’জনের ভালবাসার সাথে চাপা দেয়া হিংস্রতাটাও এসে থাবা মারে। নাহ্ এর কোনো মানে হয় না, আর কোনোদিন পিয়ালে’র সাথে কথা বলবে না বলে ঠিক করে শাকিলা। যদিও এরকম বহুবার ভেবেছে শাকিলা কিন্তু এক সময়ে কোনো কিছুই তার কাছে আর অর্থ বহন করে না। পিয়ালে’র সাথে কথা বলা না বলা’র মধ্যে কোনো ফারাক সে পায় না। মানুষে’র ব্যক্তিত্ব একটা মুখোশ ছাড়া আর কী! তাকে আরোপ করে বা জোর করে চাপিয়ে দিয়ে একটা অবয়ব হয়তো দেয়া যায় কিন্তু শাকিলার কাছে তা হাস্যকার ঠেকে। যা কিছু স্বতস্ফূর্তভাবে শুরু হয় তাকে কুঠারাঘাত করে নতুন আকার দেয়া বা পুড়ে শেষ হয়ে যাওয়া সিগারেটে’র আগুন উস্তে দিতে মন চায় না।
পরের দিন ওয়াসা’র পানি’র গাড়ি কিনে আনে মাহবুব। চারতলা বাড়ি’র প্রতি ফ্লোরে দুটি করে মোট আটটি ফ্লাটের জন্য দুই গাড়ি পানি আনা হয়। রিজার্ভ ট্যাঙ্কি ব্লিচিং পাউডার দিয়ে ধুয়ে পরিষ্কার করা হয়। নতুন কেনা পানিতে কোনো দুর্গন্ধ নেই কিন্তু তবু কেমন যেন একটু গা গুলিয়ে ওঠে মাহবুবে’র। দৌড়ে বেসিনে গিয়ে ওয়াক্ ওয়াক্ করতে থাকে। পাশের বাসার নির্মলা ছোট বোনকে নিয়ে পরের দিন রাতে আসে কথা বলার জন্য। ওদেরও একই সমস্যা, পানির মধ্যে পচা দুর্গন্ধ। নির্মলা খুব শুকিয়ে গেছে, চোখ-মুখ গর্তে, বয়সের ছাপটা যেন একটু বেশিই পড়েছে নির্মলার চেহারায়। পোশাকে একটা মলিন ভাব। মাহবুব প্রথমে নির্মলাকে দেখে চমকে উঠলেও স্বাভাবিকভাবে কথা বলে।
নির্মলা যে!
হ্যাঁ, ভাল আছেন?
এইতো।
ভাবী নাই মাহবুব ভাই?
আছে। বস তোমরা।
জ্বী ঠিক আছে বলে একটু আরষ্ঠভাবে দাঁড়িয়ে থাকে নির্মলা।
মাহবুব শাকিলাকে ডাকতে ভেতরের ঘরে চলে যায়।

নির্মলা অনেকদিন পরে এলো মাহবুবদের বাসায়। তা প্রায় বারো বছর হবে। তখন মাহবুব বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ত, নির্মলা কলেজে। মাহবুবদের বাসায় একটা ছোট বাগান ছিল। রক্ত করবী, গন্ধরাজ, বেলি নানাজাতের ফুলের গাছ। বাসায় ঢুকলেই এক ঝাপটা ফুলে’র গন্ধ এসে নাকে লাগত। নির্মলা ভাবতে ভাবতে একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়ে।
শাকিলা বেশ গম্ভীর হয়ে ড্রইং রুমে আসে।
ওহ্ তোমরা?
জ্বী ভাবী, কেমন আছেন?
আছি ভাই একরকম। তোমরা ভাল?
এই- ভাল। বাচ্চাদের দেখছিনা?
ওরা পড়ছে।
ভাবী একটা বিষয়ে আলাপ করার জন্য আসলাম।
হ্যাঁ বলো।
ভাবী আমাদের বাসায় পানি’র খুব সমস্যা দেখা দিয়েছে, পানিতে দুর্গন্ধ, মুখে দেয়া যাচ্ছে না।
হ্যাঁ আমাদেরও ময়লা পানি আসছে দু’দিন ধরে।
আমাদের এক সপ্তাহ হয়ে গেল প্রায়।
তাই নাকি? শাকিলা আৎকে ওঠে।
নির্মলা ফ্যাসফ্যাসে গলায় বলতে থাকে, কী করব বুঝতে পারছি না, মেয়েটা’র খুব সমস্যা হচ্ছে। পেটে’র অসুখ ছাড়ছে না।
মাহবুব এসে শাকিলার পাশে বসে। নির্মলা তুমি কি স্কুলে চাকরি করছ?
হ্যাঁ। আগেরটাই।
অনেক দিন হয়ে গেল, না?
হ্যাঁ, বারো বছর।
নির্মলা হঠাৎ বলতে শুরু করে; মাহবুব ভাই পানির সমস্যার কথা কী আর বলব! জানেন তো সব। শুনলাম আপনি ওয়াসা’র নতুন লাইন আনতেছেন....আমরাও ভাবতেছি আনব ।
নতুন লাইন আনাতো খুব ঝামেলা নির্মলা; সিটি কর্পোরেশন, ওয়াসা সব কিছুর পার্মিশন এনে তারপর কাজ শুরু করতে হবে।
হুম, অনেক ঝামেলা জানি। সেজন্যইতো আপনার কাছে আসলাম। আমার হাজ্ব্যান্ড্ এর পোস্টিং গাইবান্ধায়, আমার স্কুল সব সামলে করে উঠতে পারতাম না। মেয়ের শরীর খুব খারাপ হয়ে গেছে। একসাথে যদি পানি’র লাইন আনা যায়, এই ফেবারটুকু যদি করেন।
শাকিলা ওদের কথার মধ্যে থেকে নিঃশব্দে উঠে যায়। নির্মলা’র আদিখ্যাতা দেখে রাগ লাগতে থাকে শাকিলা’র। রান্নাঘরে গিয়ে অজিফাকে বকাবকি করতে থাকে। কি-রে এখনই ঘুমে ঢুলতেছিস? চা’টাও বানাতে পারিস না? শাকিলা রান্নাঘরে পাতিলে’র ঠাসঠুস শব্দ করতে থাকে। যতসব, আসছে। নিজেদের ঝামেলায় বাঁচি না, এরা আসছে ভাই পাতাইতে! কেন নিজেরা যেতে পারিস না ? অফিসে অফিসে ঘুরে স্যান্ডেলের তলা খসা! কে তোদের আটকাইছে?
শাকিলা ড্রইংরুমে কলা, বিস্কিট, চানাচুর দিয়ে পাঠায় অজিফাকে।
নির্মলা খাও।
না না এসব ঝামেলা করতে গেলেন কেন ভাবী? আমরা মাত্র নাস্তা করে এসেছি।
নাহ্, ঝামেলা কী!
নির্মলা মাহবুবের দিকে তাকিয়ে বলে তাহলে মাহবুব ভাই কাল কি আমি পানি’র বিল আর টাকা নিয়ে আসব?
আমি খবর দেব নির্মলা। ওরা কখন আসবে বলে নাই, জানালে তোমাদেরকে জানিয়ে দেব।
কই কিছুইতো খাচ্ছো না তোমরা!
এই খাচ্ছি ভাবী, আপনিও নিন।
শাকিলা মুখ ভার করে বসে থাকে।
হঠাৎ ইলেকট্রিসিটি চলে যায়। অন্ধকারে ঘরের ভেতর গুমোট আবহাওয়া তৈরি হয়। মাহবুব , শাকিলা, নির্মলা, নীলা চারজন অন্ধকারে চুপ করে বসে থাকে। ওদের নিঃশ্বাসের শব্দে ঘরের বাতাস ভারী হয়ে ওঠে। কয়েক মিনিট পর হনুফা মোম হাতে ড্রইংরুমে এসে ঢোকে। মাহবুব দেখতে পায় নির্মলার চোখের নীচে কালি জমে গেছে, কেমন ক্লান্ত আর শুষ্ক ফুলের মতো লাগে নির্মলাকে। নির্মলা চোখ নামিয়ে নেয়।
শাকিলা হঠাৎ সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়, নির্মলারাও ওঠে।
তাহলে আপনি খবর দিয়েন। ওহ্ আপনার মোবাইল নাম্বারটা দেন মাহবুব ভাই। মাহবুব যন্ত্র চালিতের মতো বলতে থাকে জিরো ওয়ান সেভেন টু......
নির্মলা’র নাম্বারটাও মাহবুব হাতের মোবাইলে সেভ করে নেয়।

ওরা চলে যাবার পর মাহবুব অনেকক্ষণ ধরে বারান্দায় দাঁড়িয়ে সিগারেট খেতে থাকে। লোডশেডিং এর সময়টা ঘরে থাকা সম্ভব হয় না, বারান্দায় একটু বাতাস আসে সেখানে দাঁড়িয়ে একটার পর একটা সিগারেট খেতে থাকে সে। আজ অনেকদিন পর সামনা সামনি নির্মলাকে দেখতে পেয়ে ভিন্ন এক অনুভূতি হয় মাহবুবের। ঠিক কেমন নিজেও বুঝতে পারছে না। এই নির্মলার জন্যই এক সময় পাগল ছিল মাহবুব। দিনরাত জানালা দিয়ে তাকিয়ে থাকত। রাস্তার মোড়ে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকত, যদি একবার দেখা যায়। নির্মলা সব সময়ই নিম্ন স্বরে কথা বলত। মাহবুবকে কখনো তুমিও বলে নি। কিন্তু চোখ তুলে নির্মলা তাকালে মাহবুব বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকতে পারত না, চোখ নামিয়ে ফেলত। একবার ঈদে’র দিন নির্মলা ওর কল্পনা মাসিকে নিয়ে এসেছিল মাহবুবদের বাসায়, তখন বাসায় কেউ ছিলনা. সব নানা বাড়ি। মাহবুব নির্মলাকে ওর ঘরে নিয়ে গিয়েছিল। নির্মলা’র কালো গভীর চোখে’র দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে মাহবুব উন্মাদ হয়ে উঠেছিল। কী যে উন্মাদনা! কী যে মন্থন! আর কারো জন্য কখনো এমনটা হয়নি মাহবুবের। নির্মলা সেদিন একেবারে ভিন্ন রুপে প্রকাশিত হয়েছিল মাহবুবের কাছে। জমিয়ে রাখা কানা উপচানো অস্থিরতা’র সবটুকু ঢেলে দিয়েছিল নির্মলা, বাধা-বন্ধনহীন, উন্মাতাল ঝড়ের মতো। মাহবুব একেবারে অন্য এক মানুষ হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু ওই দিনে’র পর থেকে নির্মলা কেমন যেন অপরিচিত’র মতো ব্যবহার করত, ক্রমশ দূরে সরে যেতে লাগল বাসায় আর আসত না। মাহবুবকে দেখলে দ্রুত হাঁটতে শুরু করত। মাহবুব কলেজে গিয়ে কথা বলতে চাইলে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকত। কোনো কথা বলত না। মাহবুব তখন ভাবত নির্মলা কেন এমন আচরণ করছে? ওই দিনের ঘটনা কি তার মনে এমন কোনো প্রতিক্রিয়া তৈরি করেছে যার জন্য সে মাহবুবে’র কাছ থেকে পালাতে চাইছে, এমন কী নিজের কাছ থেকেও.....মাহবুব বুঝতে পারে নি, না কোনোদিন তা সে বুঝতে পারে নি। নির্মলার নিজেকে সরিয়ে নেয়ার কারণটা তেমন করে আর জানা হয় নি, আর জেনেই বা কী হ’ত? এরকম কিছুই তো হ’ত নাকি অন্যরকম? নির্মলা’র সেই সময়কার কোনো কথা হয়তো ওর জীবনের মোড় পাল্টে দিত! কে জানে! এরপর টানা পাঁচ বছর লিটনে’র আড্ডা। তরল-কঠিনের জার্নি নতুন এক রিয়েলিটিতে নিয়ে দাঁড় করিয়েছিল মাহবুবকে। নিজেকে নিজের থেকে খুলে দেখবার একটা প্রক্রিয়া সে কীভাবে কীভাবে শিখে নিয়েছিল। সেই ভ্রমণে না ছিল নির্মলা, না কোনো প্রেম, অ-প্রেম, আকাঙ্খা। একটা যন্ত্রযানে চলে একমুখি যাত্রা। কোনো কিছুর বালাই ছিলনা আর মাহবুবে’র। না ছিল না। সে হয়ে পড়ল শিল্পী’র মতো। কাঠ খুঁড়ে খুঁড়ে নিজেরই একটা মূর্তি বানাতে লাগল। এসব ভাবতে ভাবতে বহুরাত হয়ে যায়। শাকিলা পিছন থেকে মাহবুবে’র পাশে এসে দাঁড়ায়। বাতাসহীন গ্রীষ্মের রাতে দু’জনেই দরদর করে ঘামতে থাকে।
মাহবুব তোমার ইচ্ছাটা কী?
কিসের ইচ্ছা?
কীসের আবার পানি’র লাইন আনার, ওরাও কি আমাদে’র সাথে লাইন আনবে?
আনলে আনবে তাতে আমাদের সমস্যা কী?
এমনিতেই নিজেদের সমস্যায় বাঁচি না তার উপর এই যন্ত্রণা!
কীসের যন্ত্রণা?
যন্ত্রণা না?
শাকিলা নিজেরটা ছাড়া আর কিছু চিন্তা করতে পার না, না?
নাহ্, পারি না। তাও নিজেরটাও যদি পুরা চিন্তা করতে পারতাম! আমি বুঝিনা কেন তুমি নির্মলাদের সাথে কাজ করতে চাও?
কেন চাই তুমি বল।
কেন চাও তুমি তা ভাল করেই জান মাহবুব। আর ভেবোনা অন্যরা সব ঘাস খায়. তারা কিছুই জানে না।
এখানে জানাজানির কি আছে? শাকিলা এই জিনিসগুলা বাদ দাও। ওরা আসছে একটা সমস্যা নিয়ে, পারলে হেল্প করব, না পারলে নাই। এত কমপ্লিকেটেড করতেছ কেন, বলত?
কমপ্লিকেটেড আমি করতেছি না। তুমিই করতেছ। কর ভাই হেল্প কর। নারী জাতির কল্যানে জীবন পাত কর। কিন্তু এর রেজাল্ট ভাল হবে না। এখন তোমার বয়স কত সেই হুঁশ যেন থাকে। আমি কিন্তু বাড়াবাড়ি বরদাস্ত করব না।
আচ্ছা বরদাস্ত কর না। শুধু শুধু আমাকে উত্তেজিত করছ কেন?
দু’জনে ঝগড়া করতে করতে মাঝরাত হয়ে যায়, ইলেকট্রিসিটি আসে না। প্রায় পুরো রাত লোডশেডিং। শান্ত, সৌম্য না খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। নাখালপাড়া’র সরু গলি’র ভেতর অসংখ্য ফ্লাটবাড়ির মাঝে মাহবুবদের চারতলা বাড়িটা মুখ গুঁজে থাকে, তাকে আলাদা করে চেনা যায় না। লোডশেডিং এর সময় দু’ একটা বাড়ি দ্বীপের মতো আলোতে ভাসতে থাকে।

ভোর হতে না হতেই কলিংবেল। ওয়াসার নতুন লাইন আনার জন্য টাকা নিতে এসেছে জব্বার। জব্বারই কাজ-কর্ম সব করবে, দালালি। মাহবুব জানে জব্বার যা টাকা নিচ্ছে তার ওয়ান থার্ড অফিসে জমা দিতে হবে বাকিটা ওর পকেটে কিন্তু করার কিছু নেই। মাহবুব যখন থেকে অফিস-আদালতে যাতায়াত শুরু করল তখন থেকেই এই দশা দেখছে। তার বুকের ভেতর সবসময় একটা গর্ব ছিল, সততার গর্ব, উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া এই বস্তুটি’র খালি অহমটাই এখন পড়ে আছে তা আর মাহবুবের কোনো কাজে আসে না। ওইটা এখন আর ওয়ার্ক করছে না, অভিধানের যাদুঘরে শোভা পাচ্ছে। জব্বারের পিছন পিছন আধ ঘণ্টা পরে এসে ঢুকল সিটি করপোরেশনের আকমল গুন্ডা, ওয়াসার লতিফুল মিয়া। ওদের ব্যস্ত-সমস্ত ভাব দেখলে ভিমরি খেতে হয়, মাহবুব আগেই ব্যাঙ্ক থেকে টাকা তুলে রেখেছিল কিন্তু নির্মলা কাল রাতে মোবাইলে জানায় তার হাতে টাকা নেই, ঠেকার কাজটা চালিয়ে নিতে রিকোয়েষ্ট করে। হুট করে এতগুলো বাড়তি টাকা রেডি করা কঠিন ব্যাপার, শেষে অফিসের মকবুলকে ফোন করে রাতে অনেক কষ্টে টাকার বন্দোবস্ত করে মাহবুব । শাকিলা এসব কিছুই জানে না, রাতে বারবার মকবুলে’র সাথে কথা বলা, বাইরে যাওয়া, টেনশন এসব দেখে শাকিলার মনে হতে থাকে মাহবুব তার কাছে কিছু লুকাচ্ছে। সকালে লোকজন আসার পরেই যখন শুনতে পেল নির্মলাদের পানির লাইনও একই সাথে আসছে, মাহবুব টাকা দিচ্ছে, নির্মলা আসে নি, শাকিলা আর নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না।
লোকজনের সামনে এসে বলে, মাহবুব নির্মলাদের পানির লাইনও একসাথে আসতেছে?
মাহবুব হু বলে চুপ করে থাকে।
মাহবুব তুমি আমার কথা বুঝতে পারছ না, তোমাকে কী বল্লাম রাতে? ওদের সাথে আমাদের লাইন আনতে পারবা না। আমি সেইটা মেনে নেব না। শাকিলা রাগে গজ গজ করতে করতে থাকে। বাইরের লোকের সামনে শাকিলার অগ্নিমূর্তি দেখে হতচকিত হয়ে যায় মাহবুব। ওয়াসার লতিফুল বলে ভাবী লাইন ওনাদেরটা আনলে আপনাদের কোনো লাভ নাই কিন্তু ওনাদের আছে; মাহবুব ভাইতো নিজে তদ্বির করে একসাথে আননের জন্য টাকা দিতে চাইছেন। মাহবুব মাথা নীচু করে থাকে। নির্মলা বলে কিন্তু আপনারা ওনাদের কাজের সাথে আমাদেরটা মিলাবেন না। আমি বলে গেলাম এইটাই ফাইনাল। মাহবুব লোডশেডিং এর গরমে এম্নিতেই ভিজে জুবুথুবু, শাকিলার রণরঙ্গিণী চেহারা দেখে একবারে শেটিয়ে যায়। লোকজনকে বিকালে আসার কথা বলে অফিসে যাওয়ার জন্য রেডি হতে থাকে। শাকিলা রান্নাঘরে গিয়ে থালা- প্লেট পিটাতে থাকে। হনুফা-অজিফাকে অকারণে ধমকাতে থাকে। যা সব বাসা থেকে বাইর হইয়া যা। তোদের দিয়া কী করব আমি? চেহারা দেখব? অকাম্মা এক একটা ঘাড়ে আইসা চাপছে, গাট্টি গাট্টি খাওয়াও পড়াও! কোন কাজে লাগিস তোরা? আমাকে সারাদিন এই বালের সংসারের জন্য কাজ করতে হয় কেন? হনুফা মুখে মুখে উত্তর দেয়..... আপনি কোন কামটা করেন সব তো আমার উপর চাপাইছেন। অজিফারেও পটের বিবি বানাইছেন, আমি কাইলকাই চইলা যামু। শাকিলা এক থাপ্পর লাগিয়ে দেয় হনুফার গালে। মাহবুব এতটা আশা করে নি, তার মনও খচখচ করছিল। বিশেষ করে রাতে নির্মলার সাথে কয়েকবার কথা বলার পর তার নিজেরই সব কিছু ওলট-পালট লাগছে। এটা ঠিক কেমন অনুভূতি মাহবুব নিজেও বুঝতে পারছেনা। বুকে একটা চিনচিন ব্যথা আবার বলকানো পানির মতো ভেতর থেকে কেউ যেন মাহবুবকে জানান দিচ্ছে তোমার সব আকাঙ্খাই শেষ হয়ে যায় নি, নির্মলা একটা উপলক্ষ্য হয়ে দেখা দিয়েছে। এতদিনকার বুক চাপা আর্তনাদটা গলা ঠেলে বেড়িযে আসতে চাইছে। মাহবুব শাকিলার দিকে তাকিয়ে ভাবে, না শাকিলার প্রতি কোনো দিনই কোনো আগ্রহ বোধ করে নি সে। বিয়েটা হয়ে যায় যান্ত্রিক নিয়মে। সমাজ- যন্ত্রের অণু পরমাণুদের কার্যগুলোর একটা মূখ্য কাজ এই বিবাহ প্রথা। নির্মলা ঝুঁকি নিয়ে পরিবার ছেড়ে আসতে চায় নি বলে যে এমন ঘটেছে তা নয়। পূর্ব থেকেই যন্ত্র সমাজ চলছিল। তার একটা কক্ষে মাহবুব ছিল, কিছুদিন যন্ত্রের নির্দেশ মেনে চলে নি, আউট ল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেই গৎবাঁধা সব ; তার অনুষঙ্গ হয়ে..... অনুষঙ্গ তার হয়ে ক্রিয়া করে গেছে। এতদিন পর হঠাৎ নির্মলাকে দেখে ভেতরের ঘুমিয়ে থাকা আগ্নেয়গিরিটা জেগে উঠেছে। মাহবুব জানে তার হাত পা বাঁধা কোনো কিছুই সে ব্রেক করতে পারবে না, তা যদি করতে যায় তাহলে নিজশুদ্ধ উপরে পড়বে। আর কেনই বা তা সে করবে? এসব চিন্তা মাহবুবকে আচ্ছন্ন করে রাখে, শাকিলার রক্তাভ চোখ সে দেখতে পায় না, শান্ত, সৌম্য’র দিকে তাকানোর অবস্থাও তার নেই, ইচ্ছা করছে একটা একটা করে পানির পাইপ সব কেটে দিতে। পানিতে যখন বিষ্ঠা এসেছে তা ভাল করেই আসুক। রাশি, রাশি দুর্গন্ধযুক্ত পানিতে সয়লাব হয়ে যাক এই শহর. জনপদ। বারবার ঠেকা দিয়ে কাকে রক্ষা করার জন্য এই আয়োজন?
মাহবুব অফিসে যাওয়ার জন্য জোরে জোরে পা ফেলে বাসস্ট্যান্ডের দিকে এগিয়ে যায়। রিকশায় নির্মলাকে দেখতে পায় মেয়ে কোলে নিয়ে বসে আছে; চেহারায় একটা বিষণœতার ছাপ, ক্লান্তি আর হতাশার চিহ্ন। নির্মলার গর্তে ঢুকে পড়া চোখের ভেতর মাহবুব ঢুকে পড়ে। এ যেন তলহীন কুয়া তলিয়ে যাচ্ছে.... তলিয়ে যাচ্ছে। রাশি রাশি জলে’র মাঝে সাঁতরাতে থাকে মাহবুব, তৃষ্ণায় ছটফট করছে কিন্তু জলে সে মুখ দিতে পারছে না, গন্ধে গা গুলিয়ে উঠছে। পেটে কামড় দিয়ে ব্যথাটা আবার শুরু হয়, মাহবুব দ্রুত বাসার দিকে ফিরতে থাকে।

















































































































































































































































৪টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

জীবনের গল্প

লিখেছেন ঢাকার লোক, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:৩৫

মাত্র মাস দুই আগে আমার এক আত্মীয়ের সাথে দেখা আমার এক বোনের বাড়ি। তার স্ত্রী মারা গেছেন তার সপ্তাহ দুই আগে। মক্কায় উমরাহ করতে গিয়ে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

অভিমান

লিখেছেন জিনাত নাজিয়া, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১০:১২

" অভিমান "

তোমার ঠোঁটে বোল শিখেছি
তুমি আমার মা, কেমন করে
ভুলছ আমায় বলতে
পারিনা। এমন করে চলে
গেলে, ফিরে ও এলেনা। হয়তো
তোমার সুখেই কাটছে দিন,
আমায় ভাবছ না।

আমি এখন সাগর... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমার কিছু ভুল!

লিখেছেন মোঃ খালিদ সাইফুল্লাহ্‌, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১:৪৮

১। ফ্লাস্কে চা থাকে। চা খেতে টেবিলে চলে গেলাম। কাপে দুধ-চিনি নিয়ে পাশে থাকা ফ্লাস্ক না নিয়ে জগ নিয়ে পানি ঢেলে দিলাম। ভাবছিলাম এখন কি করতে হবে? হুঁশ ফিরে এল।... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাংলাদেশের লোকসংস্কৃতিঃ ব্যাঙের বিয়েতে নামবে বৃষ্টি ...

লিখেছেন অপু তানভীর, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:০০



অনেক দিন আগে একটা গল্প পড়েছিলাম। গল্পটা ছিল অনেক এই রকম যে চারিদিকে প্রচন্ড গরম। বৃষ্টির নাম নিশানা নেই। ফসলের মাঠ পানি নেই খাল বিল শুকিয়ে যাচ্ছে। এমন... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাংলাদেশি ভাবনা ও একটা সত্য ঘটনা

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১০:১৭


আমার জীবনের একাংশ জুড়ে আছে; আমি চলচ্চিত্রাভিনেতা। বাংলাদেশেই প্রায় ৩০০-র মত ছবিতে অভিনয় করেছি। আমি খুব বেছে বেছে ভাল গল্পের ভাল ছবিতে কাজ করার চেষ্টা করতাম। বাংলাদেশের প্রায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

×