বাংলা চলচ্চিত্রের কিংবদন্তি অভিনেতা নায়করাজ রাজ্জাক আর নেই৷ অদ্য ২১ আগস্ট সোমবার সন্ধ্যা ৬:১৫ মিঃ হার্ট অ্যাটাক করার পর তাকে বেসরকারি ইউনাইটেড হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। তবে সব ধরনের চেষ্টা করেও চিকিৎসকরা ব্যর্থ হন৷ মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৭ বছর।
আব্দুর রাজ্জাক জন্মগ্রহণ করেছিলেন ১৯৪২ সালের ২৩ জানুয়ারি, অবিভক্ত বাংলায়, কলকাতার টালিগঞ্জে৷ স্কুলে পূজার অনুষ্ঠানে মঞ্চনাটক করতে গিয়ে আকৃষ্ট হন অভিনয়ের প্রতি। ১৯৬১ সালে অভিনয়ে ক্যারিয়ার গড়তে রাজ্জাক চলে যান মুম্বাইয়ে৷ কিন্তু সেখানে ব্যর্থ হয়ে ফেরত আসেন টালিগঞ্জে৷ সেখানেও সফল না হয়ে ১৯৬৪ সালে পাড়ি জমান বাংলাদেশে (তৎকালীন পূর্ব-পাকিস্তান)৷
কাজ শুরু করেন আব্দুল জব্বার খানের সহকারি পরিচালক হিসেবে৷ এর মধ্যেই 'তেরো নাম্বার ফেকু ওস্তাগর লেন' চলচ্চিত্রে ছোট ভূমিকায় অভিনয় করেন তিনি৷ ‘ডাকবাবু’, উর্দু ছবি ‘আখেরি স্টেশন’সহ কয়েকটি চলচ্চিত্রেও ছোট ছোট ভূমিকায় অভিনয় করেন তিনি৷
এসব চরিত্রে অভিনয় করে প্রশংসা কুড়ালেও, ক্যারিয়ারে আসছিল না গতি৷ কিন্তু বাংলা চলচ্চিত্রের আরেক কিংবদন্তি জহির রায়হানের বেহুলা চলচ্চিত্রে নায়কের ভূমিকায় সুযোগ পান রাজ্জাক৷ চলচ্চিত্রে তাঁর ভূমিকা ছিল লখিন্দরের৷ বিপরীতে নায়িকা ছিলেন সুচন্দা৷
দর্শকেরা লুফে নেয় নতুন এই জুটি৷ সুপারডুপার হিট এই ছবির পর আর কেউ আটকে রাখতে পারেনি রাজ্জাককে৷অভিনয় করেছেন পাঁচশতাধিক বাংলা ও উর্দু চলচ্চিত্রে।
এরপর বাংলা চলচ্চিত্রের এই সুদর্শন অভিনেতা জুটি গড়েছেন ববিতা, শাবানাসহ সে সময়কার প্রায় সব জনপ্রিয় অভিনেত্রীর সাথে৷ তবে দর্শকদের কাছে সবচেয়ে জনপ্রিয় হয়েছিল রাজ্জাক-কবরী জুটি। ১৯৯০ সাল পর্যন্ত বেশ দাপটের সাথেই ঢালিউডে সেরা নায়ক হয়ে অভিনয় করেন রাজ্জাক। এর মধ্য দিয়েই তিনি অর্জন করেন নায়করাজ রাজ্জাক খেতাব। অর্জন করেন একাধিক সম্মাননা। এছাড়াও, রাজ্জাক জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিলের শুভেচ্ছা দূত হিসেবে কাজ করেছেন।
বাংলার মানুষের কাছে তিনি পরিচিত হয়ে ওঠেন ‘নায়করাজ’ নামে। ষাটের দশকে চলচ্চিত্রে ক্যারিয়ার শুরুর পরই দর্শকদের মনে চিরস্থায়ী স্থান করে নেন এই শক্তিশালী অভিনেতা৷
সাদা-কালো থেকে রঙিন, ছোট পর্দা থেকে বড় পর্দা, পূর্ব পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ, প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে পাঁচ দশকেরও বেশি সময় ধরে দাপটের সাথে রাজত্ব করেছেন এই রাজা।
বৈচিত্র্যময় ক্যারিয়ারে অভিনয় করেছেন পাঁচ শতাধিক বাংলা ও উর্দু চলচ্চিত্রে৷ রাজ্জাকের উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্রের মধ্যে রয়েছে ‘জীবন থেকে নেয়া’, ‘নীল আকাশের নীচে’, ‘আনোয়ারা’, ‘সুয়োরাণী-দুয়োরাণী’, ‘দুই ভাই’, ‘মনের মতো বউ’, ‘ময়নামতি’, ‘ক খ গ ঘ ঙ’, ‘বেঈমান’৷
বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর ‘রংবাজ’ দিয়ে বাংলাদেশে অ্যাকশনধর্মী চলচ্চিত্রের সূচনাও ঘটান রাজ্জাক৷ নিজে পরিচালনা করেছেন ‘বদনাম’, ‘সৎ ভাই’, ‘চাপা ডাঙ্গার বউ’সহ ১৬টি চলচ্চিত্র।
রাজ্জাক স্ত্রী লক্ষ্মী (খায়রুন নেসা), তিন ছেলে বাপ্পারাজ, বাপ্পি ও সম্রাট এবং দুই মেয়ে শম্পা ও ময়নাকে রেখে গেছেন৷ তার ছেলেরাও চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন।
একনজরে নায়ক রাজ রাজ্জাক
জন্মঃ ১৯৪২ সালের ২৩ জানুয়ারি।
মৃত্যুঃ ২০১৭ সালের ২১ আগস্ট।
পুরো নামঃ আবদুর রাজ্জাক।
বাবাঃ আকবর হোসেন।
মাঃ নেসারুন্নেসা।
স্ত্রীঃ খায়রুন্নেসা (ভালোবেসে নায়করাজ লক্ষ্মী বলে ডাকতেন)।
সন্তানঃ তিন ছেলে ও দুই মেয়ে (এক মেয়ে মৃত)।
নাতি-নাতনির সংখ্যাঃ আটজন।
অভিনয়ের শুরুঃ সপ্তম শ্রেণীতে পড়ার সময়।
অভিনয়ের গুরুঃ পীযূষ বোস (কলকাতা)।
অভিনয়ে পারিবারিক সমর্থনঃ শুধু মেজ ভাই আবদুল গফুর।
চলচ্চিত্রের সঙ্গে সম্পৃক্ততাঃ আবদুল জব্বার খানের সঙ্গে ‘উজালা’ চলচ্চিত্রের সহকারী পরিচালক হিসেবে।
নায়ক হিসেবে প্রথম চলচ্চিত্রঃ জহির রায়হানের ‘বেহুলা’।
প্রথম নায়িকাঃ কোহিনূর আক্তার সুচন্দা।
জুটি হিসেবে জনপ্রিয়তাঃ কবরীর সঙ্গে। প্রথম চলচ্চিত্র সুভাষ দত্তের ‘আবির্ভাব’।
নায়ক হিসেবে অভিনয়ঃ ১৯৯০ সাল পর্যন্ত। নায়ক হিসেবে শেষ চলচ্চিত্র ‘মালামতি’। বিপরীতে নূতন।
চরিত্রাভিনেতা হিসেবে অভিনয়ঃ ১৯৯৫ সাল থেকে।
পারিবারিক কষ্টঃ বড় মেয়ে শম্পার থ্যালাসেমিয়ায় ১৯৯২ সালের ২ ফেব্রুয়ারি মৃত্যু।
প্রথম প্রযোজিত চলচ্চিত্রঃ রংবাজ (রাজলক্ষ্মী প্রডাকশন্স), পরিচালক জহিরুল হক। বিপরীতে কবরী।
নায়ক হিসেবে বড় ছেলে বাপ্পারাজের অভিষেকঃ চাঁপা ডাঙ্গার বউ (নির্দেশনা নায়করাজ রাজ্জাক)।
প্রযোজনায় বিরতিঃ ২০০০ সালে ‘মরণ নিয়ে খেলা’ চলচ্চিত্রটি নির্মাণের পর ব্যবসায়িক ক্ষতির কারণে।
প্রথম পরিচালিত চলচ্চিত্রঃ অনন্ত প্রেম (১৯৭৭), বিপরীতে ববিতা।
প্রযোজনায় ফিরে আসাঃ ২০০৮ সালে ‘আমি বাঁচতে চাই’। নায়ক হিসেবে ছোট ছেলে সম্রাটের অভিষেক।
সর্বশেষ পরিচালিত চলচ্চিত্রঃ আয়না কাহিনী (২০১৪)।
সর্বশেষ অভিনীত চলচ্চিত্রঃ বাপ্পারাজ পরিচালিত প্রথম চলচ্চিত্র ‘কার্তুজ’।
নায়ক হিসেবে যাদের বিপরীতে কাজ করেছেনঃ সুচন্দা, কবরী, শবনম, শাবানা, নাসিমা খান, সুজাতা, ববিতা, কবিতা, নূতন, অঞ্জনা, কাজরী।
আমরা নায়ক রাজ রাজ্জাকের বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করছি।
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে আগস্ট, ২০১৭ বিকাল ৩:২৩