somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বাংলা গানের বরেণ্য শিল্পী নিলুফার ইয়াসমিনের ১৪তম মৃত্যুবার্ষিকীতে শ্রদ্ধাঞ্জলি

১০ ই মার্চ, ২০১৮ দুপুর ১:৫৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার প্রাপ্ত বাংলাদেশের বরেণ্য সঙ্গীতশিল্পী নিলুফার ইয়াসমিন। সময়ের গড্ডালিকা প্রবাহে সৃজনশীলবাংলা গান যখন ভেসে যাচ্ছিল, তখন গুটিকয় শিল্পী ভালোবাসা দিয়ে উজ্জীবিত করেছেন আমাদের নিজস্ব গীতি, নিঃসন্দেহে নীলুফার ইয়াসমীন তাঁদের অন্যতম। একনিষ্ঠ শিল্পী বলতে যা বোঝায় নীলুফার ছিলেন তা-ই। তাঁর অপার ভক্তি ছিল সংগীতের প্রতি, শিক্ষকের প্রতি, শ্রোতার প্রতিও। নিলুফার ইয়াসমিনের উচ্চাঙ্গ সংগীত শেখা শুরু হয় ওস্তাদ পি সি গোমেজ এর কাছে ১৯৬৪ সালে ৷ একাধারে ১৯৮৪ সাল পর্যন্ত তিনি উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত শেখেন ৷ তারপর উপমহাদেশের প্রখ্যাত ওস্তাদ বড়ে গোলাম আলী খাঁ-র সুযোগ্যা ছাত্রী মীরা ব্যানার্জীর কাছে তালিম নেন ৷ এরপর প্রখ্যাত সারেঙ্গী বাদক ওস্তাদ সগীরউদ্দীন খাঁ ওমুরশিদাবাদের স্বনামধন্য ওস্তাদ এ দাউদ সাহেব ও প্রশান্ত বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে দীর্ঘকাল তালিম গ্রহণ করেন ৷ তিনি নজরুল-সংগীতের প্রাথমিক শিক্ষা পেয়েছেন স্বরলিপিগ্রন্থ থেকে ৷স্বরলিপি অনুসরণ করেই প্রথম দিকে বেতার-টেলিভিশনে নজরুল-সংগীত গেয়েছেন। তিনি প্রখ্যাত কন্ঠশিল্পী, নজরুল-সংগীতস্বরলিপিকার ও বিশেষজ্ঞ শেখ লুত্ফর রহমান ও সুধীন দাশ-এর কাছে নজরুল-সংগীত শিখেছেন ৷বাংলা গানের বরেণ্য শিল্পী নিলুফার ইয়াসমিনের ১৪তম মৃত্যুবার্ষিকী আজ। ২০০৩ সালের এই দিনে মাত্র ৫৫ বছর বয়সে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। বরেণ্য সঙ্গীত শিল্পী নিলুফার ইয়াসমিনের ত্রয়োদশ মৃত্যুবার্ষিকীতেআমাদের শ্রদ্ধাঞ্জলি।


নিলুফার ইয়াসমিন ১৯৪৮ খ্রিষ্টাব্দের ১৬ই ফেব্রুয়ারি কলকাতার ১৩০/অ পার্ক স্ট্রীটে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম লুৎ‍ফর রহমান এবং মায়ের নাম মৌলুদা খাতুন। তার পৈত্রিক বাড়ি সাতক্ষীরার মুকুন্দপুর গ্রামে। নিলুফার ইয়াসমিনের পিতা লুৎ‍ফর রহমানছিলেন অবিভক্ত বাংলার একজন সিভিল সার্ভিস অফিসার এবং মা মুর্শিদাবাদের স্বনামধন্য ওস্তাদ কাদের বক্সের ছাত্রী ছিলেন। তিনি ভাল গান গাওয়া ছাড়াও ভাল হারমোনিয়াম বাজাতে পারতেন। নিলুফার ছিলেন তাঁর পাঁচ বোনের মাঝে চতুর্থ। তার অন্যান্য বোনরা হলেনঃ বড় বোন ফরিদা ইয়াসমিন, মেজো বোন ফওজিয়া খান, সেজো বোন নাজমা ইয়াসমীন হক ও ছোট বোন প্রখ্যাত কণ্ঠশিল্পী সাবিনা ইয়াসমিন। নিলুফার ইয়াসমিনের শৈশব কেটেছে মুর্শিদাবাদ, রাজশাহী এবং ঢাকায়। মায়ের কাছে নিলুফার ইয়াসমিনের সঙ্গীতে হাতেখড়ি। বাসায় গ্রামোফোন রেকর্ড প্লেয়ার ছিল। পিতা নতুন নতুন রেকর্ড কিনে আনতেন আর বোনেরা সবাই মিলে সেসব রেকর্ডের গান বার বার বাজিয়ে শুনে শিখে ফেলতেন। আঙ্গুরবালা, ইন্দুবালা, কমলাঝরিয়া, হরিমতী, কে মল্লিক, জ্ঞান গোস্বামী, শচীনদেব বর্মণ, মৃণালকান্তি ঘোষ, কমল দাশগুপ্ত, আব্বাসউদ্দীনসহ আরও বিখ্যাত সব শিল্পীর গাওয়া রেকর্ড থেকে তাঁর মা গান তুলে গাইতেন এবং তাঁর গাওয়া থেকেই নিলুফার ইয়াসমিন গান শিখে ফেলতেন। তাঁর মা-ই তাঁকে বলতেন যে এ-সব গানগুলোর রচয়িতা কাজী নজরুল ইসলাম। তখন থেকেই নজরুল সঙ্গীতের প্রতি তাঁর আকর্ষণ জন্মে। সংগীত শিক্ষার পাশাপাশি প্রতিষ্ঠানিক শিক্ষায়ও তাঁর ছিলো সমান মনোযোগ। নীলুফার ইয়াসমীনের শিক্ষাজীবন কেটেছে ঢাকাতেই। মতিঝিল সেন্ট্রাল সরকারি বালিকা বিদ্যালয় থেকে তিনি ১৯৬৩ সালে ম্যাট্রিক পাস করেন। উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেন সরকারি বদরুননেসা কলেজ থেকে এবং ১৯৬৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সমাজবিজ্ঞানে বি.এ. (অনার্স) এবং ১৯৭০ সালে ২য় শ্রেণীতে প্রথম হয়ে এম.এ. পাস করেন। এর আগে ১৯৬৯ খ্রিষ্টাব্দে প্রখ্যাত গীতিকার, সুরকার, শিল্পী ও অভিনেতা খান আতাউর রহমানের সঙ্গে তাঁর বিবাহ হয়। তাদের একমাত্র পুত্র আগুন বর্তমান প্রজন্মের একজন প্রতিষ্ঠিত কণ্ঠশিল্পী ৷


কর্মজীবনে নিলুফার ইয়াসমিন বাংলাদেশ বেতারের ছোটদের অনুষ্ঠান খেলাঘরের মাধ্যমে শিল্পী জীবন শুরু করেন। পরবর্তীতে বাংলাদেশ টেলিভিশনের শুরু থেকে আর্মত্যু একজন নিয়মিত শিল্পী হিসেবে গান গেয়েছেন। নিলুফার ইয়াসমিন উচ্চাঙ্গ, নজরুল, অতুলপ্রসাদ, দ্বিজেন্দ্রলাল, রজনীকান্ত, টপ্পা, ঠুমরি, কীর্তন, রাগপ্রধান, আধুনিক গানসহ গানের ভুবনের প্রায় সবগুলো শাখাতেই অবাধ বিচরণ করেছেন। রাগ প্রধান গানে অসাধারণ দখল থাকলেও তিনি নজরুল-সংগীতশিল্পী হিসেবেই বেশি পরিচিত। শুভদা, অরুণ-বরুন-কিরণমালা, জোয়ার ভাটা, আবার তোরা মানুষ হ, সুজন সখী , যে আগুনে পুড়ি, জীবন-তৃষ্ণা , জলছবি ইত্যাদি ছায়া ছবির প্লেব্যাকে কণ্ঠ দিয়েছেন নিলুফার ইয়াসমিন। আগুন জ্বলেরে, জীবন সেতো পদ্ম পাতার শিশির বিন্দু, তোমাকে পাবার আগে, এক বরষার বৃষ্টিতে ভিজে, এতো সুখ সইবো কেমন করে, পথের শেষে অবশেষে বন্ধু তুমি, যদি আপনার লয়ে এ মাধুরী, এতো কান্নাই লিখা ছিলো ভাগ্যে আমার, যে মায়েরে মা বলে কেউ ডাকে না, প্রতিদিন সন্ধ্যায়, মাগো আমার যে ভাই, নীল পাখিওরে, এখনো কেন কাঁদিস ও পাখি, ফুলে মধূ থাকবেই, দিওনা দিওনা ফেলে দিওনা প্রভৃতি তার কণ্ঠে গীত বিখ্যাত গান। নিলুফার ইয়াসমিন 'সুজন সুখী'' চলচ্চিত্রে কন্ঠপ্রদানের জন্য ১৯৭৫ সালে বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সাংবাদিক সংস্থার পুরস্কার, 'শুভদা' চলচ্চিত্রে কন্ঠপ্রদানের জন্য ১৯৮৬ সালে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার ও বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সাংবাদিক সংস্থার পুরস্কার, সংগীত বিষয়ে অনন্য অবদানের জন্য ২০০৪ সালে মরণোত্তর রাষ্ট্রীয় "একুশে পদক'' এবং নজরুল সংগীতে তাঁর অবদানের জন্য ১৪১০ বাংলা সালে "নজরুল পদক'' সহ অসংখ্য পুরস্কার ও সম্মাননা অর্জন করেছেন। ১৯৯৫ সাল থেকে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকলা ও সংগীত বিভাগের নজরুল সংগীত বিষয়ের প্রভাষক হিসেবে মৃত্যুর শেষ দিন পর্যন্ত নিয়োজিত ছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকলা ও সংগীত বিভাগে নজরুল সংগীতে তাঁর অবদানের কথা চিরস্বরণীয় করে রাখতে তাঁর নামে নাট্যকলা ও সংগীত বিভাগে পাঠাগার স্থাপন করা হয়েছে।


শিল্পী হিসেবে নীলুফার ইয়াসমীনের জনপ্রিয়তা শুধু দেশের গন্ডিতেই সীমাবদ্ধ ছিল না, বিদেশেও ছিল ব্যাপক পরিচিতি। ১৯৮৪ সালে কলকাতার 'অগ্নিবীণা'-র আমন্ত্রণে ঢাকাস্থ নজরুল একাডেমীর সাংস্কৃতিক দলের সংগে কলকাতা এবং বঙ্গ সংস্কৃতি সম্মেলনের আমন্ত্রণে দিল্লি ও কলকাতায় সংগীত পরিবেশন করেন। এ-ছাড়াও তিনি পরবর্তীতে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জাপান, ফ্রান্স, পাকিস্তান ভ্রমণ করেন এবং সংগীত পরিবেশন করে প্রচুর প্রশংসা অর্জন করেন৷অসাধারণ সংগীত-প্রতিভার অধিকারী নীলুফার ইয়াসমীনের তুলনা শুধুই নীলুফার ইয়াসমীন। ২০০১ সালের মাঝামাঝি সময়ে নিলুফার ইয়াসমিনের টিউমার ধরা পড়ে। অপারেশনের পর তিনি আবার ফিরে এসেছিলেন সঙ্গীত ভুবনে। কিন্তু নিয়তির অমোঘ নিয়মে ২০০৩ সালের ১০ই মার্চ ঢাকাস্থ বারডেম হাসপাতালে মাত্র ৫৫ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন বাংলা গানের মহান এই শিল্পী। বিনয়ী, নম্র, মিষ্টভাষিনী, নিরহংকার নীলুফারের মতো ব্যতিক্রমধর্মী শিল্পী বাংলা গানে খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। শুধু নজরুল সংগীতই নয়, বৈচিত্র্যে পরিপূর্ণ বাংলা গানের বিভিন্ন ধারায় নীলুফারের সাবলীল বিচরণ ছিল সত্যিই বিস্ময়কর। তাঁর অকাল মৃত্যুতে বাংলা গান হারিয়েছে তাঁর একজন একনিষ্ঠ সাধককে। তবে তার সুরের ইন্দ্রজালে শ্রোতাদের মাঝে তিনি স্মরণে থাকবেন চিরদিন। আজ এই বরণ্যে গুণী শিল্পীর ১৪তম মৃত্যুবার্ষিকী। বাংলা গানের বরেণ্য শিল্পী নিলুফার ইয়াসমিনের মৃত্যুবার্ষিকীতে শ্রদ্ধাঞ্জলি।
সর্বশেষ এডিট : ১০ ই মার্চ, ২০১৮ বিকাল ৩:২৭
৫টি মন্তব্য ৪টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

কুড়ি শব্দের গল্প

লিখেছেন করুণাধারা, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:১৭



জলে ভাসা পদ্ম আমি
কোরা বাংলায় ঘোষণা দিলাম, "বিদায় সামু" !
কিন্তু সামু সিগারেটের নেশার মতো, ছাড়া যায় না! আমি কি সত্যি যাবো? নো... নেভার!

সানমুন
চিলেকোঠার জানালায় পূর্ণিমার চাঁদ। ঘুমন্ত... ...বাকিটুকু পড়ুন

ধর্ম ও বিজ্ঞান

লিখেছেন এমএলজি, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৪:২৪

করোনার (COVID) শুরুর দিকে আমি দেশবাসীর কাছে উদাত্ত আহবান জানিয়ে একটা পোস্ট দিয়েছিলাম, যা শেয়ার হয়েছিল প্রায় ৩ হাজারবার। জীবন বাঁচাতে মরিয়া পাঠকবৃন্দ আশা করেছিলেন এ পোস্ট শেয়ারে কেউ একজন... ...বাকিটুকু পড়ুন

তালগোল

লিখেছেন বাকপ্রবাস, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৩৫


তু‌মি যাও চ‌লে
আ‌মি যাই গ‌লে
চ‌লে যায় ঋতু, শীত গ্রীষ্ম বর্ষা
রাত ফু‌রা‌লেই দি‌নের আ‌লোয় ফর্সা
ঘু‌রেঘু‌রে ফি‌রে‌তো আ‌সে, আ‌সে‌তো ফি‌রে
তু‌মি চ‌লে যাও, তু‌মি চ‌লে যাও, আমা‌কে ঘি‌রে
জড়ায়ে মোহ বাতা‌সে ম‌দির ঘ্রাণ,... ...বাকিটুকু পড়ুন

মা

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৩


মায়াবী রাতের চাঁদনী আলো
কিছুই যে আর লাগে না ভালো,
হারিয়ে গেছে মনের আলো
আধার ঘেরা এই মনটা কালো,
মা যেদিন তুই চলে গেলি , আমায় রেখে ওই অন্য পারে।

অন্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

কপি করা পোস্ট নিজের নামে চালিয়েও অস্বীকার করলো ব্লগার গেছে দাদা।

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:১৮



একটা পোস্ট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ আগে থেকেই ঘুরে বেড়াচ্ছে। পোস্টটিতে মদ্য পান নিয়ে কবি মির্জা গালিব, কবি আল্লামা ইকবাল, কবি আহমদ ফারাজ, কবি ওয়াসি এবং কবি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×