রোমান সাম্রাজ্যের পঞ্চম এবং জুলিও-ক্লডিয়ান রাজতন্ত্রের সর্বশেষ রোমান সম্রাট নিরো। নিরো ছিলেন এক পাগলাটে শাসক। নিরো'র শাসনামলে অমিতব্যয়িতা লক্ষ্য করা যায় এবং ক্ষমতার অপব্যবহারের সাথে জড়িত ছিল। তিনি অনেকগুলো হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িত ছিলেন। এমনকি তিনি নিজ মাতাকেও সৎভাইকে হত্যা করেছেন। এছাড়াও বিষ প্রয়োগে সৎভাই ব্রিটানিকাসকে হত্যার সাথেও জড়িত ছিলেন তিনি। রাজ্য পরিচালনা থেকেও বেশী পছন্দ করতেন প্রজাদের দেখাতে যে তিনি একাধারে কবি, আবৃত্তিকার, নাট্যকার, যন্ত্রশিল্পী ও সারথী। নিষ্ঠুর এই শাসক কবিতা লিখতেন। ভালো অভিনয় করতেন। বাজনার প্রশংসা তো ছিলই। রোম যখন পুড়ছিল এই নিরোই নিশ্চিন্তে বেহালা বাজাচ্ছিলেন। তাঁর শাসনকালে নিরো কূটনীতিবিদ্যায় পারদর্শীতা দেখান। ব্যবসা-বাণিজ্য এবং সাম্রাজ্যের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড সম্প্রসারণ করে ব্যাপকভাবে সকলের মনোযোগ আকর্ষণ করেন। তিনি থিয়েটারের জন্য ভবন নির্মাণের আদেশ দেন এবং অ্যাথলেটিক ক্রীড়ার প্রধান পৃষ্ঠপোষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। এ সময়ে সফলভাবে যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটে এবং শান্তি রক্ষার্থে পার্থিয়া সাম্রাজ্যের সাথে চুক্তিতে আবদ্ধ হন। প্রথম রোমান-ইহুদি যুদ্ধ শুরু হয় এ সময়েই। আজএই নিষ্ঠুর শাসকরে মৃত্যুবার্ষিকী। ৬৮ খ্রীষ্ট পূর্ব অব্দের আজকের দিনে তিনি রোমের বাইরে আত্মহত্যা করেন সম্রাট নিরো।
নিরো যার পুরো নাম নিরো ক্লডিয়াস গাষ্টাস জার্মানিকাস। ৩৭ খ্রীষ্টাব্দের ১৫ ডিসেম্বর ইতালীর অ্যান্টিয়ামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম নেইয়াস দোমিতিয়াস আহেনোবারবাস এবং মাতার নাম এগ্রিপ্পিনা দি ইয়াঙ্গার। জন্মের পর গ্র্যান্ড-আঙ্কেল ক্লডিয়াস নিরোকে উত্তরাধিকারী হিসেবে দায়িত্ব পালনের লক্ষ্যে দত্তক সন্তানরূপে গ্রহণ করেছিলেন। ৫৪ খ্রীষ্টপূর্ব অব্দে ক্লডিয়াস নিহত হন। খুব সম্ভবতঃ ক্লডিয়াস নিরো'র মা এগ্রিপ্পিনা দি ইয়াঙ্গার কর্তৃক নিহত হয়েছিলেন। নিরোকে ক্লডিয়াসের পুত্র ব্রিটানিকাসের কাছ থেকে ক্ষমতা গ্রহণ নিশ্চিতকল্পে ইয়াঙ্গার এ পদক্ষেপ নেন। ক্লডিয়াস নিহত হবার ৫৪ খ্রীষ্ট পূর্ব অব্দের ১৩ অক্টোবর নিরো রোমান সাম্রাজ্যের পঞ্চম সম্রাট হন। ৬৪ খ্রিষ্ট-পূর্বাব্দের ১৮ জুলাই এক ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে রোম নগরীর অধিকাংশ এলাকা আগুনে পুড়ে ছাঁই হয়ে যায়।
কথিত আছে সম্রাট তার প্রাসাদের বিশালত্ব বাড়াতেই জমি চেয়েছিলেন রোমবাসীর কাছে। কিন্তু রোমবাসী জমি দেননি। তারা রাজাকে বোঝানোর চেষ্টা করেছেন, জমিগুলো তাদের বেঁচে থাকার সম্বল। রাজা জনগণের কথা কানে তোলেননি। কারণ রাজার দরকার প্রাসাদের সৌন্দর্য বাড়ানো। এর মধ্যে আগুন লাগে রোম নগরীতে। দাউ দাউ আগুনে পুড়তে থাকে গোটা রোম। মানুষের আর্তনাদে আকাশ-বাতাস ভারি হয়। ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ ভিড় জমান রাজবাড়ির সামনে। রাজকর্মচারীরা তাদের তাড়িয়ে দেন। সম্রাটের কানে যায়নি মানুষের আর্তনাদ। কারণ নিরো ব্যস্ত তখন বাজনা নিয়ে। সম্রাট জানতেন রোম পুড়ছে। আর আগুন লাগিয়েছে তারই লোকজন। আগুন নিভলে সম্রাটের বাজনাও থামল। তিনি ঘটনাস্থলে গেলেন। হাত বাড়িয়ে দেন সাহায্যের। কিন্তু এতে আশ্বস্ত হননি ক্ষুব্ধ মানুষ। শুধু রোম পোড়ানো নয়, সম্রাট নিরোর ব্যক্তিগত জীবনে আরও অনেক নিষ্ঠুর অধ্যায় ছিল। ব্যক্তিগত স্বেচ্ছাচারিতায় বাধা দেওয়ায় তিনি খুন করেছিলেন নিজের মাকে। অথচ এই নিরোই প্রথম জীবনে অনেক জনহিতকর কাজের জন্য প্রজাদের প্রশংসা পেয়েছেন। কিন্তুু দ্বিতীয় পর্যায়ে তার মাতা রাজ্য পরিচালনায় হস্তক্ষেপ করায় নিরোর আসল স্বরূপ উদভাসিত হয়। ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস, ৫৯ খ্রীষ্টাব্দে নিরো তার গর্ভধারিণী মাতাকে এবং ৬২ খ্রীষ্টাব্দে স্ত্রী অক্টাভিয়াকে নির্মমভাবে হত্যা করে প্রেমিকা পপ্পায়া সাবিনাকে বিয়ে করেন। সাবিনাকে বিয়ে করার কিছুদিন পরই নিরো আবার উদাসীন ও প্রজাদের প্রতি নিষ্ঠুর হয়ে ওঠেন। ৬৪ খ্রীষ্টাব্দে রোম যখন পুড়ে ধ্বংস হচ্ছিল তখন নিরো তাচ্ছিল্যের সাথে যন্ত্রসঙ্গীত ও কবিতাবৃত্তিতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। অনেক ঐতিহাসিক মনে করেন নিরোই নিজে ধ্বংস করার জন্য আগুন লাগিয়েছিলেন এবং সত্যকে ধামাচাপা দেয়ার জন্য বহু খ্রীষ্টানকে প্রকাশ্যে নিধন করেন। নিরো সব সময় আশা করতেন জনগণ তার পাশে থাকবে। তিনি যা খুশি করবেন তা তারা মেনে নেবে। রোমান সম্রাটের শেষ পরিণতি ছিল জনগণের কঠিন তিরস্কার ও প্রতিবাদ। এই তিরস্কার সহ্য করতে পারেননি নিরো। তাই বেছে নেন আত্মহননের পথ। এরপরও রোমবাসীর একাংশ শোক প্রকাশ করেছিলেন নিরোর জন্য। টাসিটাসের মতে, এ অগ্নিকাণ্ডের জন্য নিরো খ্রিস্টানদেরকে দায়ী করেছিলেন। কিন্তু অনেক রোমান অধিবাসী মনে করেন যে, নিরো স্বয়ং ডোমাস অরেয়া স্বর্ণ ভবন নির্মাণে আগুন লাগানোর আদেশ দিয়েছিলেন। পরবর্তীকালে এ কথাটি ভুল প্রমাণিত হয় ও গুজব হিসেবে বিবেচিত হয়। কেননা, তখনও বেহালা বাদ্যযন্ত্রের আবিষ্কার ঘটেনি। কিন্তু তিনি প্রাচীন গ্রীসের উদ্ভাবিত লির বাজাতে পারতেন।
সম্রাট নিরোকে জনপ্রিয়বিহীন সম্রাটরূপে আখ্যায়িত করা হয়, যিনি রোম পুড়ে যাওয়া অবস্থায় বেহালা বাজাচ্ছিলেন। তিনি খ্রিস্টানদের প্রথমদিককার উৎপীড়নকারীর হিসেবে পরিচিত ছিলেন। রাতে আলোর উৎস থেকে আগুন নিয়ে তাঁর উদ্যান পুড়াতে গিয়ে খ্রিস্টানদেরকে আটক করেছিলেন। টাসিটাস, সুতোনিয়াস এবং ক্যাসিয়াস দিও এ বিষয়টি তাদের লেখনীতে প্রকাশ করেছেন। কিছু সূত্র থেকে প্রাপ্ত বিষয়াবলীতে নিরো'র আলোকপ্রিয়তা চিত্রাকারে তুলে ধরা হয়েছে। তারপরও তাঁকে চিত্রকর্মে সাধারণ রোমান বিশেষ করে প্রাচ্যের কাছে জনপ্রিয় সম্রাট হিসেবে চিত্রিত করা হয়েছে। কিন্তু আধুনিক ইতিহাসবেত্তাগণ প্রাচীন তথ্যের বিশ্বাসযোগ্যতা ও নিরো'র অমিতব্যয়িতা এবং ক্ষমতার অপব্যবহারকারীর ভূমিকার বিষয়টি প্রশ্নাকারে তুলে ধরেছেন। রোম যখন পুড়ছিল সম্রাট নীরো তখন বাঁশি বাজাচ্ছিলেন- এমন একটা কথা বেশ প্রচলিত। ইতিহাসে এ নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে বেশ তর্ক-বিতর্ক রয়ে গেছে। অনেকে যখন নীরোকে দোষারূপ করেছিল তার নীরব দর্শকের ভূমিকার জন্যে, অন্যদিকে অই অপবাদকে মিথ্যে বলে কেউ কেউ এও দাবি করেছিল যে নীরো ঘটনার পর পর ক্ষতিগ্রস্তদের পাশে গিয়ে দাড়িয়েছিলেন এবং পরবর্তীতে অই ধ্বংসস্তূপের ওপর নতুন ও চোখ ধাঁধানো রোম নগর সৃষ্টি করেছিলেন। নীরোর ভূমিকা নিয়ে বিতর্ক থাকলেও আগুন যে লেগেছিল তাতে কোন সন্দেহ ছিল না। ৬৪ সালের ১৮ জুলাই তারিখে সংঘটিত অই ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে রোম নগরীর ১৪ জেলার মাত্র ৪ জেলা রক্ষা পায় এবং বাকীগুলো পরিণত হয় আক্ষরিক অর্থে ধ্বংস্তূপে। ছয় দিনের অই অগ্নিকাণ্ডের পরের ঘটনা আরো ভয়াবহ। তাতে ছিল নীরোর প্রত্যক্ষ ভূমিকা। আগুন লাগার পর পর গুজব ছড়িয়ে যায় যে সম্রাট নীরো পেলেটাইনের চূড়ায় বসে আগুন লাগানোর নির্দেশ দেন এবং তার আশপাশ যখন আগুন দাউ দাউ করে গোটা নগর গ্রাস করেছিল তখন তিনি বাঁশীতে ‘স্যাক অব ইলিয়াম’-এর সুর তুলছিলেন। এ অভিযোগ বাতিল করে ভিন্ন ইতিহাসবিদ (টাসিটাস) বলেন, নীরো সে সময় ‘এনটিয়ামে’ ছিলেন এবং বাঁশী যে বাজাচ্ছিলেন তা কেবল গুজব। টাসিটাসের মতে, এই ঘটনার পর নীরো কোন নিরাপত্তা প্রহরী ছাড়াই দৌড়ে যান ঘটনাস্থলে এবং ক্ষতিগ্রস্তদের সাহায্যে লেগে পড়েন। তিনি ক্ষতিগ্রস্তদের তার প্রাসাদে আশ্রয়ও দেন। এর পর তিনি নতুন ‘আরবান প্ল্যান’ তৈরি করেন এবং ভগ্নস্তূপের ওপর গড়ে তুলেন নতুন আধুনিক রোম নগর।
খ্রীষ্টপূর্ব অব্দের ৬৮ সালে কর ব্যবস্থার প্রতিবাদ জানিয়ে গলে ভিনডেক্সের সহায়তায় বিদ্রোহ এবং হিস্পানিয়ায় (স্পেন) গালবা কর্তৃক আক্রমণের শিকার হয়ে নিরো পলায়ণপূর্বক সিংহাসনচ্যুত হন। ফাঁসীকাষ্ঠে ঝুলবেন এ আশঙ্কায় ৯ জুন, ৬৮ তারিখে প্রথম রোমান সম্রাট হিসেবে আত্মহত্যা করেন নিরো। তাঁর এ আত্মহননের মধ্য দিয়ে জুলিও-ক্লদিয়ান রাজত্বকালের পরিসমাপ্তি ঘটে। এরপর সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য গৃহযুদ্ধ শুরু হয় যা চার সম্রাটের যুদ্ধ নামে ইতিহাসে পরিচিতি পায়। নিরোর ক্ষমতার সমাপ্তি রোমের ইতিহাসে একটি ভয়ানক অধ্যায়। এই পতন রোমের সাধারণ মানুষের সামনে এটাই প্রমাণ করে যে রোমের শাসন একটি ‘অভিজাত পরিবারের’হাতে বন্দী নয়। এই ক্ষমতা অন্য মানুষের হাতেও চলে যেতে পরে। যে কোনো যোগ্য ব্যক্তি অথবা বিশেষ করে সেনাপ্রধানদের হাতে চলে যেতে পারে। সেনাবাহিনীরা এই শিক্ষা শিরোধার্য হিসেবে গ্রহন করল।
অবিশ্বাস্য হলেও সত্য যে, এই নিরোই আবার রোমকে তিলে তিলে গড়ার কাজে আত্মনিয়োগ করেন। নিরোর ‘গোল্ডেন হাউস’ বিশ্বের সর্বকালের সৌন্দর্য মন্ডিত আড়ম্বরপূর্ণ স্থাপত্য শিল্প হিসাবে পরিচিত লাাভ করে। ৬০ খ্রীষ্টাব্দের প্রথমদিক থেকেই ব্রিটেন, ফ্রান্স ও স্পেনের বিভিন্ন দল-উপদল নিরোর বিরুদ্ধে চলে গিয়ে বিদ্রোহ করে। পরবর্তী পর্যায়ে রোমান সিনেট নিরোকে ভৎসনা করে এবং মৃত্যু পরোয়ানা জারী করে। সর্বশেষে ৬৮ খ্রীষ্টাব্দের জুন মাসে বিশাল রোম সাম্রােজ্যের অধিপতি পঞ্চম সম্রাট আত্মহত্যা করে জীবনাবসান ঘটান। যার প্রতিটি রক্ত কণায় সৃষ্টি নিরো, যার উদ্যম, প্রচেষ্টা এবং উন্মাদনায় নিরো বিশাল সাম্রাজ্যের অধিপতি হলেন, যে মাকে শ্রদ্ধা, ভয় ও অনুসরণ করতেন সে মাকে নিরো হত্যা করেছে নিদ্বির্ধায়। অপরদিকে যে রোমকে পুড়িয়ে মনের মাঝে নির্মম সুখ অনুভব করেছেন আবার সেই রোমকে সৃষ্টি করেছেন অধীর আগ্রহ নিয়ে অনুপম সৌন্দর্যে। আজ তথাকথিত এই নিষ্ঠুর শাসকের মৃত্যুবার্ষিকী। ইতিহাসে কালের স্বাক্ষী হয়ে আছেন তার মৃত্যুদিন।
নূর মোহাম্মদ নূরু
গণমাধ্যমকর্মী
[email protected]
সর্বশেষ এডিট : ১০ ই জুন, ২০১৮ সকাল ১১:০৫